Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে একটি বক্তৃতা

স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে একটি বক্তৃতা -- বেগম রোকেয়া

বেগম রোকেয়া

 

পরাধীন ভারতবর্ষে নারীর শিক্ষা ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অগ্রদূত, লেখিকা, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২)-র জন্ম হয়েছিল রংপুরের (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভূত) পায়রাবন্দ গ্রামে। স্বামীর মৃত্যুর পর কলকাতায় এসে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল তাঁর উদ্যোগেই শুরু হয়। ‘মতিচূর’, ‘অবরোধবাসিনী’ ইত্যাদি গ্রন্থও রচনা করেন। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে প্রদত্ত তাঁর এই ভাষণটি ‘উৎস মানুষ’-এর ‘প্রতিরোধ’ সংকলন থেকে প্রকাশকের সহৃদয় অনুমতিক্রমে এখানে পুনঃমুদ্রিত
হল।

মাননীয় উপস্থিত ভগিনীবৃন্দ,

আপনারা আমার ন্যায় তুচ্ছ নগণ্য ব্যক্তিকে এ সময়ের জন্য সভানেত্রীপদে বরণ করিয়া আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিয়াছেন, তজ্জন্য আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। কিন্তু আমি অবশ্যই বলিব যে, আপনাদের নির্বাচন ঠিক হয় নাই। কারণ আমি আজীবন কঠোর সামাজিক পর্দার অত্যাচারে লোহার সিন্দুকে বন্ধ আছি — ভালরূপে সমাজে মিশিতে পাই নাই। এমনকি সভানেত্রীকে হাসিতে হয়, কাঁদিতে হয়, তাহাও আমি জানি না। সুতরাং আমার ভাষায় কথায় অনেক ভুলভ্রান্তি থাকিবে, আপনারা প্রস্তুত থাকুন।

শ্রদ্ধাস্পদা ভাগিনী মিসেস লিন্ডসে আমাকে মুসলমান বালিকাদের শিক্ষা সম্বন্ধীয় অভাব-অভিযোগের কথা বলিতে অনুরোধ করিয়াছেন। সমবেত সুশিক্ষিতা গ্রাজুয়েট মহিলাদের সম্মুখে এ সম্বন্ধে কিছু বলিতে পারিব, এমন যোগ্যতা আমার নাই। তবে ২০/২১ বৎসর হইতে সাহিত্য ও সমাজসেবা করিয়া, বিশেষত ১৬ বৎসর যাবৎ সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল পরিচালনা করিয়া যতটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়াছি, তাহাই আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত করিতে সাহস করিতেছি।

স্ত্রীশিক্ষার কথা বলিতে গেলেই আমাদের সামাজিক অবস্থার আলোচনা অনিবার্য হইয়া পড়ে, আর সামাজিক অবস্থার কথা বলিতে গেলে, নারীর প্রতি মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের অবহেলা, ঔদাস্য এবং অনুদার ব্যবহারের প্রতি কটাক্ষপাত অনিবার্য হয়। প্রবাদে আছে, বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়। এখন প্রশ্ন এই যে, মুসলমান বালিকাদের সুশিক্ষার উপায় কী? উপায় তো আল্লাহর কৃপায় অনেক-ই আছে, কিন্তু অভাগিনীগণ তাহার ফলভোগ করিতে পায় কই? আপনারা হয়তো শুনিয়া আশ্চর্য হইবেন যে, আমি আজ ২২ বৎসর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব কাহারা, জানেন? সে জীব ভারতনারী। এই জীবগুলির জন্য কখনও কাহারও পরান কাঁদে নাই। মহাত্মা গান্ধী অস্পৃশ্য জাতির দুঃখে বিচলিত হইয়াছেন, স্বয়ং থার্ডক্লাশ গাড়িতে ভ্রমণ করিয়া দরিদ্র রেলপথিকদের কষ্ট হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেন। পশুর জন্য চিন্তা করিবারও লোক আছে, তাই যত্রতত্র পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি দেখিতে পাই। পথে কুকুরটা মোটরচাপা পড়িলে তাহার জন্য অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পত্রিকাগুলিতে ক্রন্দনের রোল দেখিতে পাই। কিন্তু আমাদের ন্যায় অবরোধবন্দিনী নারীজাতির জন্য কাঁদিবার একটি লোকও এ ভূ-ভারতে নাই।

নারী ও পুরুষ বিরাট সমাজদেহের দুইটি বিচ্ছিন্ন অংশ। বহুকাল হইতে পুরুষ নারীকে প্রতারণা করিয়া আসিতেছে, আর নারী কেবল নীরবে সহ্য করিয়া আসিতেছে। পুরুষের পক্ষে নারায়ণী সেনা আছেন বলিয়া তাহারা এ যাবৎ নারীর উপর জয়লাভ করিয়া আসিতেছেন। সুখের বিষয়, এতকাল পরে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আমার হিন্দু ভগিনীদের প্রতি কৃপাকটাক্ষপাত করিয়াছেন। তাই চারিদিকে হিন্দু সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অবরোধবন্দিনী মহিলাদের মধ্যে জাগরণের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। তাঁহারা, বিশেষত মাদ্রাজের মহিলাবৃন্দ সর্ব বিষয়ে উন্নতির পথে অগ্রসর হইয়াছেন। এবার মাদ্রাজের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের ডেপুটি প্রেসিডেন্টের পদে একজন মহিলা নির্বাচিত হইয়াছেন। সম্প্রতি রেঙ্গুনে একজন ব্যারিস্টার হইয়াছেন। লেডি ব্যারিস্টার মিস সোরাবজির নামও সুপরিচিত, কিন্তু মুসলিম নারীর কথা আর কী বলিব? — তাহারা যে তিমিরে সে তিমিরেই আছে।

‘মাতা যদি বিষ দেন আপন সন্তানে
বিক্রয়েন পিতা যদি অর্থপ্রতিদানে’

তাহাকে আর কে রক্ষা করিবে? আলিগড়ের প্রসিদ্ধ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ সাহেব একসময় তাঁহার কোনও এক বক্তৃতায় বলিয়াছেন, এদেশে বালক ও বালিকার শিক্ষায় পার্থক্য রাখার ফলে আমাদের অবস্থা এরূপ শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছে যে আমাদের দুঃখে শেয়াল কুকুর কাঁদে। বালিকাদের শিক্ষা না দেওয়া আমাদের পক্ষে গৌরবের বিষয় নহে, বরং ইহা আমাদের দূরপনেয় কলঙ্ক। ইত্যাদি ইত্যাদি।

অর্থাৎ ২০ বৎসর পূর্বে আমি হেন নগণ্য যাহা ১ম খণ্ড ‘মতিচূর’-এ বলিয়াছি, সেই কথা এখন শেখ সাহেবের ন্যায় জ্ঞানবৃদ্ধ লোকের মুখেও শুনিতেছি। যাঁহারা ইতিহাস পাঠ করিয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, মূর্খতার অন্ধকারযুগে আরবগণ কন্যা বধ করিত। যদিও ইসলাম ধর্ম কন্যাদের শারীরিক হত্যা নিবারণ করিয়াছেন, তবুও মুসলিমগণ অম্লান বদনে কন্যাদের মন, মস্তিষ্ক এবং বুদ্ধিবৃত্তি অদ্যাপি অবাধে বধ করিতেছেন। কন্যাকে মূর্খ রাখা এবং চতুষ্প্রাচীরের অভ্যন্তরে আবদ্ধ রাখিয়া জ্ঞান ও বিবেক হইতে বঞ্চিত রাখা অনেকে কৌলীন্যের লক্ষণ মনে করেন।

কিছুকাল পর্যন্ত মিশর এবং তুরস্ক স্ত্রীশিক্ষার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তাঁহারা ঠকিয়া ঠকিয়া নিজেদের ভ্রম বুঝিতে পারিয়া এখন সুপথে আসিয়াছেন।

সম্প্রতি তুরস্ক এবং মিশর, ইউরোপ ও আমেরিকার ন্যায় পুত্র ও কন্যাকে সমভাবে শিক্ষা দিবার জন্য বাধ্যতামূলক আইন করিয়াছেন। কিন্তু তুরস্ক আমেরিকার পদাঙ্ক অনুসরণে সোজা পথ অবলম্বন করেন নাই, বরং আমাদের ধর্মশাস্ত্রের একটি অলঙ্ঘনীয় আদেশ পালন করিয়াছেন। যেহেতু পৃথিবীতে যিনি সর্বপ্রথমে পুরুষ স্ত্রীলোককে সমভাবে সুশিক্ষা দান করা কর্তব্য বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন তিনি আমাদের রসুল মকবুল (অর্থাৎ পয়গম্বর সাহেব)। তিনি আদেশ করিয়াছেন যে, শিক্ষালাভ করা সমস্ত নরনারীর অবশ্যকর্তব্য। তের শত বৎসর পূর্বেই আমাদের জন্য এই শিক্ষাদানের বাধ্যতামূলক আইন পাশ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমাদের সমাজ তাহা পালন করেন নাই।

পরন্তু ঐ আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছে এবং তদ্রূপ বিরুদ্ধাচারকেই বংশগৌরব মনে করিতেছে। এখনও আমার সম্মুখে আমাদের স্কুলের কয়েকটি ছাত্রীর অভিভাবকের পত্র মজুদ আছে — যাহাতে তাঁহারা লিখিয়াছেন যে, তাঁহাদের মেয়েদের যেন সামান্য উর্দু ও কোরান শরীফ পাঠ ছাড়া আর কিছু, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া না হয়। এই তো আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা।

ভারতবর্ষে যখন স্ত্রীশিক্ষার বাধ্যতামূলক আইন পাশ হইবে, তখন দেখা যাইবে। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, মুসলমান — যাঁহারা স্বীয় পয়গম্বরের নামে (কিম্বা ভগ্ন মসজিদের এক খণ্ড ইষ্টকের অবমাননায়) প্রাণদানে প্রস্তুত হন, তাঁহারা পয়গম্বরের সত্য আদেশ পালনে বিমুখ কেন? গত অন্ধকারযুগে যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে, তাঁহারা যে ভ্রম করিয়াছেন, তাহাও ক্ষমা করা যাইতে পারে, কিন্তু এই বিংশ শতাব্দীতে যখন বারংবার স্ত্রীশিক্ষার দিকে তাঁহাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যাইতেছে যে, কন্যাকে শিক্ষা দেওয়া আমাদের প্রিয় নবী ফরয (অবশ্যপালনীয় কর্তব্য) বলিয়াছেন, তবু কেন তাঁহারা কন্যার শিক্ষায় উদাসী?

এখন শিক্ষার অবস্থা এই যে, আমাদের দেশের গড়পড়তা প্রতি ২০০ (দুইশত) বালিকার একজনও অক্ষর চিনে না, প্রকৃত শিক্ষিত মহিলা বোধ হয় দশ হাজারের মধ্যেও একজন পাওয়া যাবে না। কেবল এই বঙ্গদেশে প্রায় তিন কোটি মুসলমানের বাস।

গত জানুয়ারি মাসে শিক্ষা বিভাগ হইতে আমাকে একখানি পত্রে অনুরোধ করা হইয়াছিল যে, বঙ্গদেশে যতগুলি মুসলিম গ্র‍্যাজুয়েট আছেন, তাঁহাদের নাম ও ঠিকানা লিখিয়া যেন আমি অবিলম্বে পাঠাই। কিন্তু আমি বঙ্গের মাত্র একটি গ্র‍্যাজুয়েট এবং আগা মইদুল ইসলাম সাহেবের কন্যাত্রয় ব্যতীত আর কাহারও নাম দিতে পারি নাই। আগা সাহেব বঙ্গদেশের অধিবাসী নহেন, সুতরাং তিন কোটি মুসলমানের মধ্যে মাত্র একটি মহিলা গ্র‍্যাজুয়েট পাওয়া গেল বলিতে হয়। সম্ভবত অণুবীক্ষণযন্ত্রের দ্বারা অনুসন্ধানের পর প্রেসিডেন্সি ও বর্ধমান বিভাগের স্কুলের ইনস্পেকট্রেস আমাকে মুসলিম মেয়ে গ্র‍্যাজুয়েট খুঁজিয়া বাহির করিতে বলিয়াছিলেন। আবার আমি শেখ আবদুল্লাহ সাহেবের একটি বচন উদ্ধৃত করিতেছি।

স্ত্রীশিক্ষার বিরোধীগণ বলে যে, শিক্ষা পাইলে স্ত্রীলোকেরা অশিষ্ট ও অনম্যা হয়। ধিক! ইহারা নিজেদের মুসলমান বলেন, অথচ ইসলামের মূল সূত্রের এমন বিরুদ্ধাচারণ করেন। যদি শিক্ষা পাইয়া পুরুষগণ বিপথগামী না হয়, তবে স্ত্রীরা কেন বিপথগামিনী হইবে? এমন জাতি, যাহার নিজেদের অর্ধেক লোককে মূর্খতা ও পর্দারূপ কারাগারে আবদ্ধ রাখে, তাহারা অন্যান্য জাতির যাঁহারা সমানে সমানে স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন করিয়াছেন, তাঁহাদের সহিত জীবনসংগ্রামে কীরূপে প্রতিযোগিতা করিবে? ভারতবর্ষে এক কোটি লোক ভিক্ষাজীবী, তন্মধ্যে মুসলমান সংখ্যায় অধিক। সুতরাং তাহারা কোন মুখে অন্য জাতির সহিত সমকক্ষতা করিবে? আমরা আবার কৌলীন্যের বড়াই করি। ভিক্ষাবৃত্তি সর্বাপেক্ষা নীচ কাজ আর মুসলমান সংখ্যাই ইহাতে অগ্রণী। ইহার কারণ এই যে, তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধনে বঞ্চিত রাখিয়া সর্ববিষয়ে পঙ্গু করিয়া রাখিয়াছে। ফলে তাহাদের গর্ভজাত সন্তান অলস ও শ্রমকাতর হয়; সুতরাং বাপদাদার নাম লইয়া ভিক্ষা করা ছাড়া তাহারা আর কী করিবে?

এখন স্ত্রীলোকেরা ভোটদানের অধিকারপ্রাপ্ত হইয়াছে কিন্তু মুসলিম মহিলাগণ এ অধিকারের সদ্বব্যবহারে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত করিয়াছেন। গত ইলেকশনের সময় দেখা গেল কলিকাতায় মাত্র ৪ জন স্ত্রীলোক ভোট দিয়াছে। ইহা কি মুসলমানদের গৌরবের বিষয়? তাহারা কোন সুযোগের আশায় বা অপেক্ষায় বসিয়া আছেন?

যে পর্যন্ত পুরুষগণ শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে স্ত্রীলোকদিগকে তাহাদের প্রাপ্য অধিকার দিতে স্বীকৃত না হয়, সে পর্যন্ত তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে শিক্ষাও দিবে না। যাহারা নিজের সমাজকে উদ্ধার করিতে পারিতেছে না, তাহারা আর দেশোদ্ধার কীরূপে করিবে? অর্ধাঙ্গীকে বন্দিনী রাখিয়া নিজে স্বাধীনতা চাহে, এরূপ আকাঙ্খা পাগলেরই শোভা পায়। সদাশয় ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যেমন ভারতবাসীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা সহ্য করিতে চাহেন না — আমার মনে পড়ে প্রায় ২১ বৎসর পূর্বে মিষ্টার মর্লি বলিয়াছিলেন, ‘যদি তাহারা চাঁদের জন্য আবদার করে (If they cry for the moon) তাহা আমরা দিতে পারি না।’ ইত্যাদি এবং আমাদের অমুসলমান প্রতিবেশিগণ এখন সাধারণত যেরূপ মুসলমানদের দাবিদাওয়া সহ্য করিতে পারেন না, সেইরূপ মুসলমান পুরুষগণও নারীজাতির কোনও প্রকার উন্নতির অভিলাষ স্বীকার করিতে চাহেন না। কিন্তু আল্লাহর কুদরত বা প্রকৃতির নিয়ম অতি চমৎকার। তিনি এ বিশ্বজগৎকে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধিয়া রাখিয়াছেন। আমরা পরস্পরের সাথে এরূপভাবে জড়িত আছি যে, একে অপরকে অতিক্রম করিয়া চলিতে পারি না। মুসলিম ভ্রাতৃগণ যতদিন আমাদের দুঃখ সুখের প্রতি মনোযোগ না করিবেন ততদিন তাহাদের কথাও ভারতের ওপর ২২ কোটি লোক শুনিবে না, আর যতদিন ঐ ২২ কোটি লোক ৮ কোটি মুসলমানকে উপেক্ষা করিবে ততদিন পর্যন্ত তাঁহাদের রোদনও ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কর্ণকুহরে প্রবেশ করিবে না। বহুদিন হইল একটি বটতলার পুঁথিতে পড়িয়াছিলাম:

‘আপনি যেমন মার খাইতে পারিবে,
বুঝিয়া তেরছাই মার আমাকে মারিবে।’

মুসলমানদের যাবতীয় দৈন্য-দুর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রীশিক্ষার ঔদাস্য। ভ্রাতৃগণ মনে করেন, তাঁহারা গোটাকতক আলিগড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর করিয়াই পুলসিরাত (পারলৌকিক সেতু বিশেষ) পার হইবেন — আর পার হইবার সময় স্ত্রী ও কন্যাকে হ্যান্ডব্যাগে পুরিয়া লইয়া যাইবেন।

কিন্তু বিশ্বনিয়ন্তা বিধাতার বিধান যে অন্যরূপ — যে বিধি অনুসারে প্রত্যেককেই স্ব স্ব কর্মফল ভোগ করিতে হইবে। সুতরাং স্ত্রীলোকদের উচিত যে, তাঁহারা বাক্সবন্দী হইয়া মালগাড়িতে বসিয়া সশরীরে স্বর্গলাভের আশায় না থাকিয়া স্বীয় কন্যাদের সুশিক্ষায় মনোযোগী হন। কন্যার বিবাহের সময় যে টাকা অলংকার ও যৌতুক ক্রয়ে ব্যয় করেন, তাহারই কিয়দংশ তাহাদের সুশিক্ষায় ও স্বাস্থ্যরক্ষায় ব্যয় করুন। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য শারীরিক ব্যায়ামচর্চা করা প্রয়োজন আর প্রয়োজন বিশুদ্ধ বাতাস। আল্লাহর দান বিশুদ্ধ বাতাস বিনা পয়সায় গ্রহণ করিতে মহিলাগণ কেন অনিচ্ছুক আমি তাহা বুঝিতে পারি না। শীতকালে তাঁহারা এরূপভাবে জানালা দ্বার বিশেষতঃ সার্সী বন্ধ করিয়া রাখেন যে আমার মনে হয়, গভর্নমেন্ট কেন আইন করিয়া দ্বার জানালার সার্সী ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করেন না। পাঁচ ছয় বৎসর হইল ডাক্তার মিস কোহেন বালিকা বিদ্যালয়সমূহের ছাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ভারপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। আমাদের স্কুলের কতিপয় বালিকার স্বাস্থ্যের রিপোর্ট, যখন তাহাদের মাতার নিকট এই অনুরোধসহ গেল যে, ‘আপনারা অনুগ্রহপূর্বক শীঘ্র ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করুন।’ তাহাতে তাঁহারা চটিয়া এই উত্তর দিলেন যে — স্কুলমে লাড়কী পড়নে কো দিয়া হ্যায়, না বিচার করনে কো, কে আঁখ কমজোর, দাঁত কমজোর, হলক মে ঘাও হ্যায়, ফেফড়া খারাব হ্যায়। ইয়ে সব বোলনে সে হামারী লাড়কী কা শাদী ক্যায়সে হোগা? ইয়ে সব বাৎ রহনে দে, হামারী লাড়কী কা, ডাক্তারনীসে না দেখায়ে।’ ইয়া আল্লাহ। মেয়ের প্রাণ লইয়া টানাটানি, অথচ শাদীর চিন্তায় মায়ের চোখে ঘুম ধরে নাই। ফল কথা, অশিক্ষিতা মাতার নিকট ইহাপেক্ষা আর কী আশা করা যাইতে পারে।

আমাদের স্কুলের ছাত্রীগণ পরীক্ষার সময় প্রায়শঃ ভূগোল ইতিহাস স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় বিষয়ে অকৃতকার্য (ফেল) হয়, ইহার কারণ এই যে তাহারা নিজেদের বাসভবন এবং স্কুলগৃহ ব্যতীত দুনিয়ার আর কিছুই দেখিতে পায় না, এই দুনিয়ায় তাহাদের পিতা ও ভ্রাতা ছাড়াও আর কেহ আছে কিনা, তাহা তাহারা জানে না, রুদ্ধ বায়ুপূর্ণ কক্ষে আবদ্ধ থাকিয়া মা মাসীকে রোগ ভোগ ও স্বাস্থ্য নষ্ট করিতে দেখে। তাহারা কেবল জানে অসুখ হইলে ডাক্তার ডাকিতে হয়। এই সকল কুরোগের একমাত্র ঔষধ সুশিক্ষা।

উপসংহারে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল এবং আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলামের উল্লেখ করা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। কলিকাতা মুসলিম সমাজের উন্নতির নিমিত্ত এই উভয় প্রতিষ্ঠানই প্রাণপণে যত্ন করিতেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইহারা এখনও পূর্ণ মাত্রায় সফলতা লাভ করে নাই। স্কুলটিকে হাই স্কুলে উন্নীত করা এবং ইহার জন্য একটি নিজের বাড়ি হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন এবং আঞ্জুমানটি মুসলিম মহিলাসমাজে সর্বজনপ্রিয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আজ আপনাদের অনেকখানি সময় নষ্ট করিলাম তজ্জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া এখন আমি ইতি করি।

[১৩৩৩ বঙ্গাব্দ]