Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

“ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?” : বাংলা মাধ্যম স্কুল ও একটি সাম্প্রতিক(?) বিপর্যয়

বাংলা মাধ্যম স্কুল

অভিষেক ঘোষাল

 

সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, ৭৫টি বাংলা মাধ্যম স্কুল নাকি বন্ধ হতে চলেছে। তা মশাই এতে আশ্চর্যের কী! এ তো হওয়ারই কথা। কী আছে বলুন তো বাংলা মাধ্যম স্কুল-গুলোতে? শিক্ষণের সঠিক পরিকাঠামো, উপযুক্ত পরিবেশ, ক্লাসরুম, টয়লেট, যোগ্য শিক্ষক কোনটা আছে? এই শেষ পয়েন্টটিতে অনেকেরই গোঁসা হবে। কিন্তু তিষ্ঠ ক্ষণকাল। কী তীব্র অব্যবস্থা আর মান্ধাতার আমলের পরিকাঠামো নিয়ে এই টিমটিমে বাংলা মাধ্যম-গুলো টিকে আছে, তা একটু আশেপাশে তাকালেই বোঝা যায়।

বামফ্রন্ট সরকারের ইংরেজি তুলে দেবার অনন্য সিদ্ধান্ত যে এই অবনমনের একটি প্রধান কারণ, এ বিষয়ে আজ আর সন্দেহের অবকাশ নেই। আমরা, যারা তিরিশোর্ধ্ব প্রজন্ম, তাঁদের বাবা-মা’র আমলেও এমন মানুষ পাওয়া দুর্লভ নয়, যাঁরা একইরকম যত্নে ও আগ্রহে দু’টি ভাষাই চর্চা করেছেন। বাংলা ও ইংরেজি। দৈনন্দিন ও কার্যক্ষেত্রের উপযোগী দু’টি ভাষা। এটাকে অস্বীকার করা, বা এ নিয়ে ছুঁৎমার্গ রাখা আসলে উটপাখি সিনড্রোম, যে ইংরেজি জানা, লিখতে ও বলতে, এবং স্বভাবতই পড়তে পারার দক্ষতা গোলকায়িত বাংলার ভৌগোলিক পরিসরেও কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার জন্য আবশ্যক। আমি বাংলা মিডিয়াম, ফলে যেকোনও কথায় ওই শবর সিরিজের সহযোগী গোয়েন্দাটির মতো সেই সীমাবদ্ধতার কথা কপচাতে থাকব, আর বহুজাতিক ব্যবসায়ী সংস্থা তাদের লাভালাভ ভুলে আমায় কমফোর্ট জোন দিতে উদগ্রীব হবে, এ তো ইউটোপিয়ার মেসোমশাই! এমন দাবির যৌক্তিকতা কী! কেন একজন বাংলা মাধ্যমের ছাত্র বা ছাত্রী ন্যূনতম ইংরেজির মুখোমুখি হতে এতটা ভীত হবেন?

উত্তরটা তিক্ত, আর সেজন্যই গোঁসা স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক অতীতে স্কুল শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা (এসএসসি) নিয়ে যে থার্ড ক্লাস প্রহসনটা চলছে, তাতে কী আশা করা যায়? জীবিকানির্বাহের উপযোগী শিক্ষার আশা করাটা অন্যায় কোথায়? আর সেই আশায় জল ঢেলে চলেছে এই অসামান্য সিস্টেম। সোজা হিসেব, তুমি বাংলা মাধ্যমে পড়ে দেশের ভবিষ্যৎ গড়বার নির্মল দায়িত্বে নিজেকে সঁপে দেবে? দেওয়াচ্ছি। দিনের পর দিন প্যানেল ঝুলবে। কোর্ট কেসের ফয়সালা হবে না। শিক্ষকের চাকরির ব্যাপারে তোমার শেষ আগ্রহটুকুর গলা টিপে মারা হবে দায়িত্ব নিয়ে, আর তোমার সামনে অন্য প্রায় কোনও বেসরকারি ভদ্রস্থ মাইনের চাকরির বিকল্পই থাকবে না, কারণ তোমার ইংরেজি নড়বড়ে। যোগ্য শিক্ষকের অভাব হবে না তো কী এমএলের অভাব হবে? একজন ভালো ছাত্র কোন্ ভরসায় শিক্ষকের উপযুক্ত মনোবৃত্তি তৈরি করবেন নিজের নিয়োগ প্রক্রিয়ার এমন জটিল অসহ্য নির্লজ্জ অস্বচ্ছতা দিনের পর দিন দেখে? আর যোগ্যতার মাপকাঠির ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রভাব, উৎকোচের উপযোগিতা ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে তো যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো।

সংকটটা হয়, যাঁরা কলেজে পড়ান, তাঁদের। স্কুলশিক্ষায় যদি একটা বড় সমস্যা হয় যোগ্যতার অভাব, কলেজে শিক্ষকদের একটা বড় অংশের সাধারণ প্রবণতা ফাঁকিবাজি। আর বিবিধ রাজনৈতিক তৈলমর্দনের সমীকরণ কষা থেকে ক্ষণিকের বিরামে আর যাই হোক স্কুলশিক্ষণের খামতি পুষিয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়া যায় না। যে অধ্যাপক বা প্রতিষ্ঠান সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ধক দেখান, অচিরেই তাঁদের জ্ঞানচোখ ফোটে, তাঁরা বুঝে যান আঠারো বছরের জগদ্দল গামবাটপনা এক-দু’বছরের চেষ্টায় সারিয়ে তুলবার আয়োজন ভস্মে ঘি ঢালা ছাড়া কিছুই নয়। এ আয়োজন অবৈজ্ঞানিক, দায়িত্ববান কলেজ শিক্ষকদের কাছে এই চাহিদা অপ্রাসঙ্গিক ও অশালীন। ব্যতিক্রম সবেতেই খুব সামান্য রয়ে যায় বলেই এই ঢপের সিস্টেম খুঁড়িয়ে হলেও চলছে, সে কমিটেড একবগ্গা কলেজ শিক্ষকের ক্ষেত্রেই হোক, বা শ্রী জ্যোতিভূষণ চাকীর মতো প্রণম্য স্কুল শিক্ষকের প্রসঙ্গেই হোক। কিন্তু সাধারণ চিত্রটি এরকমই, আর এ নিয়ে হাইপোথেটিক্যাল কোনও সমাধানসূত্র দাবি করাই বাতুলতা। খোদ সময়ের কাছেই এর উত্তর নেই। ইতিহাসের কাছে থাকতে পারে, কিন্তু তারও তো একটা কনটেক্সট আছে। সেই প্রেক্ষিতবিচ্যুতি ইতিহাসের শিক্ষাকে অসম্পূর্ণ করবেই। ফলে হাতড়ে বেড়ানো আর দু’দিনের হাহুতাশ, দেকেচ, ৭৫টা স্কুল!!!

সেই সঙ্গে আরেক আজব দাবি হয়েছে। সেটি খানিক এরকম, ”যাঁরা বাংলা বাংলা করে হেদিয়ে মরছেন, সেই তাঁদের ছেলে বাংলা মিডিয়ামে পড়ে তো?” না মশাই, পড়ে না। কারণ সে আমি নই, আমার ছেলে। আমার হঠাৎ বেগ আসার মতো আবেগের নকরাবাজিতে আমি তাকে সারাজীবন পঙ্গুত্বের পথে ঠেলে দিতে পারি না। এই লাজবাব বাংলা মাধ্যমের ফাটকাবাজির মধ্যে নড়বড়ে ইংরেজি জানা আমার পরবর্তী প্রজন্মকে স্রেফ আমার এথিক্সের বোঝা বইতে ছেড়ে দেব বৃহত্তর প্রতিযোগিতার পরিসরে, তার না থাকবে ব্যূহ-বৃত্ত-তীর-তীরন্দাজ, এমনকি বর্মখানিও দিতে যাব ভুলে, আর তারপর খানিক আদর্শের বগল চুলকে বলব প্রাগৈতিহাসিক ভুল, এ কি ফাজলামি, নাকি? স্কুলগুলো বন্ধ হওয়ারই ছিল। আরও অনেক এমন হবে। কারণ এটা ভবিতব্য। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার মতো, সিঙ্গল স্ক্রিন ছবিঘর উঠে যাওয়ার মতো, এটা তীব্র এক টুকরো কাঁচা আছোলা বাস্তব, যার মুখোমুখি কোনও আবেগ দিয়ে হওয়া যাবে না।

আমি একবারও বলছি না, বাংলা মাধ্যম স্কুল উঠে যাওয়ায় প্রবল উল্লসিত হওয়ার কথা, বরং ভীষণই অসহায়তা আর নিরাপত্তাহীনতায়, বিরক্তিতে বলতে চাইছি — এটা হওয়ারই ছিল।

উত্তরণ? সম্ভব কি? জানি না। স্কুল কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা, যোগ্য শিক্ষককুলের উদ্ভাবনী শিক্ষণপদ্ধতি, উপযুক্ত নিরাপত্তা ও সম্মান, আর সর্বোপরি বাস্তবকে মেনে নিয়ে এগোনোর মানসিকতা হয়তো বা কিছু দিশা দেখাতে পারে। তবে এসব বড় উদ্বায়ী, আবছা ঠেকছে এ মুহূর্তে। সহজ উপায়, এ লেখা যাঁরা পড়বেন, ওয়েবম্যাগের সেসব পাঠকও জানেন, ভালো ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানকে ভর্তি করে, বাড়িতে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে ভালোবেসে পড়ার, জানার উপযোগী পরিবেশ তৈরির চেষ্টা, অথবা এমন কোনও বাংলা মাধ্যম-এ তাঁকে পড়ানো, যেখানে অপর ভাষাকে সম্মান শেখানোর প্রয়োজনীয় ছাঁদটি রয়েছে। বাকি আবছায়া সমাধানসূত্রগুলি স্পষ্ট হতে পারে তখনই, যখন হাহুতাশের মাত্রা কমিয়ে একটু রূঢ়তায় আমরা বিচার করতে বসব পরিস্থিতিকে, তার সম্মুখীন হতে, লজ্জিত হতে শিখব। সর্বার্থে শিখতে চাইব।