Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ওঁরাই রুখে দিয়েছেন

শিমূল সেন

 

ওঁদের প্রয়োজন পড়েনি গান বা কবিতা লেখা প্ল্যাকার্ড, সেমিনারের বাতলে দেওয়া নকশা, অথবা রোববার দুপুরের বিবেকী মিছিলের মতো সাজানো মধ্যবিত্তির। সাম্প্রতিক দাঙ্গায় আসানসোল জ্বলছে যখন, নির্বাচিত সরকারের প্রশাসন তথৈবচ, রাস্তায় নেমে দাঙ্গা রুখেছেন ওঁরা। সেই প্রতিরোধ পূর্বপরিকল্পনাহীন, মরিয়া, স্বতঃস্ফূর্ত, পরিবর্তনশীল, স্থানিক ও তাৎক্ষণিক। কেবল কোনও ব্যক্তিগত দায় থেকে নয়, এক যৌথ শুভবোধে জড়ো হন ওঁরা। দাঙ্গার সঙ্গেই সব সময় সহাবস্থান করে রাস্তার এই ঝলমলে যৌথ প্রতিরোধ, যে জীবন কলকাতা-আকীর্ণ জীবন থেকে অনেক দূরের। এ রকম হাজারো মুখের ভিড়ে আসানসোলের কিছু চরিত্রের কথা গত কয়েক দিনে জানা গেছে বিভিন্ন মাধ্যমে।

দাঙ্গার সময় অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রে, বিশেষত স্থানীয় মাঝারি আর ছোট পুঁজির লেনদেনে আক্রমণ নামিয়ে আনা একরকমের রেওয়াজই। ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় আক্রান্ত হয়েছিল মধ্য কলকাতার অসংখ্য নামজাদা বিপণি, আবার বছর দেড়েক আগে, দুর্গাপুজো-মহরমের সময়ে হুগলির বড় শহরে যে সংঘর্ষ হয়, সেখানেও ছবিটা এক। আসানসোল এই অতীত জানে। গত ২৬ মার্চ আসানসোলের ব্যবসাকেন্দ্রগুলিতে শুরু হয় সংঘর্ষ, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ। রানিগঞ্জের বড়বাজারে ভাঙচুর চলে শ-খানেক জায়গায়। পবন খেতান, সঞ্জিত খেতানদের বিধ্বস্ত দোকান আগলাতে ছুটে আসে মহম্মদ দানিশ আনসারি, গুড্ডু খানের নেতৃত্বে নিজেদের প্রতিরোধী বাহিনী। তাঁরা ভিটেমাটির প্রতি অগাধ প্রত্যয়ে বলেছেন, ‘দাঙ্গাবাজেরা এখানে ঝামেলা পাকিয়ে দিয়ে চলে গেছে। আমরা এই শহরে যে রকম মিলেমিশে থাকি, সে ভাবেই থাকতে চাই সব সময়।’ আসানসোল বাজারে ১৫ বছর ধরে নিয়মিত পালা করে বসেছেন মহম্মদ উসমান আর ধনপতি রায়। ইনি সকালে ফল বেচেন, উনি সন্ধেয় দোকান দেন তেলেভাজার। এঁরা সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘এই দোকান চলে বন্ধুত্বে ভর করে। এখানে কোনও ধর্মের প্রকাশ নেই।’ চাঁদমারির শিবমন্দির-সংলগ্ন এলাকায় দোকান-হারিয়ে নিঃস্ব বারো জন ব্যবসায়ীকে আর্থিক সহায়তা করেছেন কুরাশি মহল্লার হাজি নাহনানে খান। খানিক টাকাকড়ি পেয়ে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ পান-ব্যবসায়ী উমাশঙ্কর গুপ্ত, মনোজ যাদব, নিরঞ্জন শাহরা। এঁরা সকলেই বোঝেন, দাঙ্গা হলে ব্যবসা চলবে না, টান পড়বে পেটে। এঁরা জানেন, দাঙ্গার সময়ে উন্মত্ত দুষ্কৃতীরা কখনওই লুঠপাট চালাবে না বড় মাল্টি-ন্যাশনালের সুরক্ষিত রিটেল স্টোরে, বরং আক্রমণ নেমে আসবে তাঁদেরই মতো অনেকের অনিশ্চিত জীবিকার ওপর।

শুধু অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে নয়, কসমোপলিটান শহর আসানসোল কথা রেখেছে তার নিজস্ব ঐতিহ্যের কাছেও। যে ঐতিহ্য ধর্মীয় একতার কথা বলে, যে ঐতিহ্য যৌথ যাপনে বেঁধে বেঁধে থেকেছে এত কাল। এই সামাজিক সম্পর্ক না থাকলে, হয়তো, এতখানি সহজ হত না দাঙ্গা-প্রতিরোধ। অশান্তি থামানোর জন্য বিনিদ্র রাত জেগেছেন সামসের আলম আর বিট্টু বর্মারা। রানিগঞ্জের দুর্গামন্দিরের পাশেই খলিলুর রহমানের বাড়িতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ধর্মসভার, বাসিন্দাদের নিজেদের তাগিদে করা হয়েছে শান্তিমিছিল। তাণ্ডবের সময় নিয়ামতপুরের দুর্গামন্দির পাহারা দিয়েছেন নূর সিদ্দিকি, রমজান মোল্লারা, ওদিকে পাড়ার মসজিদকে নিরাপত্তা দিয়েছেন প্রাণগোপাল হাজরা, অনাথবন্ধু মুখোপাধ্যায়। খানিক দূরেই রেলপাড়ার দক্ষিণাকালী মন্দির অছি পরিষদ টাকা দিয়েছে পড়শি মাজারের পুনর্নির্মাণের জন্য। সেখানকার অছি সদস্য মলয় মজুমদার ভরসা জুগিয়েছেন কাশিম খানকে। সম্প্রীতির এই আবহে, গুটিকয়েক দাঙ্গাবাজের উস্কানি স্বভাবতই পরাস্ত হয়ে গেছে এই অগুনতি নামহীন জনসমষ্টির কাছে। আসানসোলের দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মুখোমুখি যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছে ধর্মীয় অহং আর আস্ফালনকে। ভিটেমাটির নামে এত কালের সম্প্রীতির ঐতিহ্য বহাল রেখেছেন ওঁরা।

কারা এই মানুষগুলি, যাঁরা মরিয়া হয়ে হাতেকলমে দাঙ্গা রুখলেন? তাঁরা কি অতিরিক্ত মানবিক, অথবা বিদ্বেষের ভিড়ে নেহাতই ব্যতিক্রমী কেউ-কেউ? না, এঁরা ব্যতিক্রম নন। সমাজে দূরতর দ্বীপের মতো এঁরা জেগে রয়েছেন বলেই দাঙ্গা কখনওই শেষ সত্য নয়, তার প্রতিরোধও অবশ্যম্ভাবী। বাইরে থেকে সাদা চোখে দেখে মনে হয়, বিচ্ছিন্নতার যে মানচিত্র আমাদের মননে বুনে দিয়েছে বিশ্বায়িত সমকাল, তা এখনও এঁদের গ্রাস করতে পারেনি। এঁরা এখনও পারেননি ততখানি একক হয়ে উঠতে, একই মেঘে-রোদ্দুরে এঁরা বেঁচে থাকেন, অন্য অনেকের যাপনের উপাদান সংগ্রহ করে। এখনও এঁদের অগাধ আস্থা রয়েছে কৌমে, যৌথতায়, যে বন্ধনগুলি দৃশ্যত লোপ পাচ্ছে আমাদের চারপাশে। এই পারস্পরিক নির্ভরতার ভরসাই এঁদের প্রেরণা জোগায় রাতদুপুর অবদি তথাকথিত ‘অপরে’র ধর্মস্থান পাহারা দিতে। আত্মীয়তার সূত্রে জড়ো হওয়া এই নামহীন মুখগুলি নিজেদের অজান্তেই গড়ে তুলেছে স্বতন্ত্র এক পারিবারিকতা, যাকে কোনও নিশান বা মতাদর্শ চালনা করে না। এই সামাজিক স্তরে এসে একের ধর্মবোধ সহজেই মিশে যায় অপরের সঙ্গে, ওপরতলার ব্যাকরণ না মেনে গড়ে ওঠে অসংখ্য কমিউনিটি, যাঁরা ধক রাখেন দাঙ্গা দেখা দিলে দ্রুত প্রতিরোধ করার। আমাদের চারপাশের মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপ মোটেই এমন নয়, সেখানে একক ব্যক্তি-পরিচিতির অসংখ্য প্রিজম, কিন্তু প্রতিটিই দৃঢ়, নমনীয় নয় ততটা, সেগুলির মধ্যে স্ববিরোধ কম। খেয়াল করলে হয়তো এ’ও দেখা যাবে, অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভাবে যে লুম্পেনতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত পশ্চিমবঙ্গকে ইদানীং অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হিংসার মুখোমুখি করেছে, সেই একই লুম্পেনরাই হয়তো লাঠিসোঁটা নিয়ে নিজেদের ভাষায় দাঙ্গা রুখে দিতে পারেন অনায়াসে, তাঁদের মধ্যে যেমন থাকে দাঙ্গা বাঁধানোর ক্ষমতা, তেমনই, দাঙ্গা থামানোর প্রতিরোধী শক্তিও। বাইরে থেকে হয়তো একে স্ববিরোধ বলে মনে হয়, কিন্তু এখানেই এর অনন্যতা। যতবার ভোট কুড়োনোর স্বার্থে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে ঝামেলা পাকানো হবে, এঁরাই সে’সব ধান্দাবাজি রুখে দেবেন, যাঁদের কথা ওপরে খানিক এল, আবার এলও না।

এই প্রতিরোধকারীরা নিশ্চিত জানেন মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক দুশো কিলোমিটার লং মার্চের কথা। শুধু মহারাষ্ট্রে নয়, পড়শি মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থানেও ছড়িয়ে পড়েছে অভূতপূর্ব কৃষক অভ্যুত্থান। কৃষিক্ষেত্রে সংকট দীর্ঘতর হয়ে উঠছে, ক্রমশ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে চাষবাস। কৃষক পরিবারের সন্তানরা সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে চলে আসছে শহরে। কিন্তু সেখানেও চাকরির নিশ্চয়তা কোথায়? যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে বসে আছেন প্রশিক্ষিতরা। ওদিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জেরে চাকরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে রোবটদের, কোনও জ্যান্ত মানুষকে নয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সমীক্ষা বলে দিয়েছে, ২০২০-র মধ্যে ভারতেই ধ্বংস হবে ৫০ লক্ষ চাকরি, ২০৫০-এর মধ্যে ৬৯ শতাংশ শ্রমপদ গিলে খাবে সাইবার মেধা, যার প্রত্যক্ষ প্রিলিউড আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আঘাত হানবে ভারতের শিল্পোন্নত মেট্রো শহরগুলিতে। অন্যদিকে পৃথিবীব্যাপী জনসংখ্যা বাড়ছে, যা তিন দশক পর গিয়ে দাঁড়াবে ৯ মিলিয়নে, খাবারের চাহিদা বেড়ে যাবে শতকরা ৬০ ভাগ, যা সামলাতে না পারলে দেখা দেবে নিদারুণ খাদ্যসংকট। আর এই সব কিছুর পরে রয়েছে এই বিপন্ন পৃথিবীর পরিবেশগত সমস্যাও। শেষ ৫০ বছরে বিশ্বের উষ্ণতা বেড়েছে বার্ষিক এক শতাংশ হারে, গত চার দশকে গ্রিন হাউস গ্যাস-নিঃসরণ বেড়েছে ৮০ শতাংশ। এই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে অবশ্যম্ভাবী সংকটের দিকে। জলবায়ুর সংকটই যদি না মেটানো যায়, বাকি সব প্রশ্ন তার সামনে গৌণ হয়ে পড়ে।

এই হচ্ছে চারপাশের অবস্থা, এবং আসানসোলের নূর, মলয়, মনোজ, মহম্মদরা এই বাস্তবতাতেই বেঁচে থাকেন। সকলেই জানেন, বোঝেন, জরিপ করেন, কোন পৃথিবী তাঁরা রেখে যাচ্ছেন সন্ততিদের জন্য। আসানসোলে এঁরা প্রতিরোধ গড়েছেন বিদ্বেষের বিরুদ্ধে। এমন মোটেই নয় যে ধর্মীয় সমস্যাগুলি ততখানি জরুরি নয়। কিন্তু সমাজের যে স্তরে একে অপরকে ছুঁয়ে তাঁরা বেঁচে থাকেন, সেখানকার ধর্ম ওপরমহলের ধর্মবোধের, ফরমানের বা বিভাজনের তোয়াক্কা করে না, কখনও অনুবাদ করে নেয় নিজের বয়ানে, ল্যাং মেরে দেয় রাষ্ট্রীয় অভিসন্ধিকে। এই বিপদসংকুল ব্যবস্থায় তাঁরা একই সঙ্গে পারস্পরিক ভরসায় শ্বাস নিচ্ছেন, শাসকের কাছে জানতে চাইছেন আগামী পৃথিবীর জরুরি খবরগুলি। এই সব জিজ্ঞাসার দিকে সপ্রশ্ন তাকিয়েই তাঁদের ঘাড়ে ন্যস্ত দাঙ্গা রোখার ভার। দাঙ্গা রুখে যেতে হবে তাঁদের। হবেই। এ যে তাঁদের ইতিহাসের দায়।