পশ্চিম বর্ধমান: জনতার ইস্তেহারের খোঁজে

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 



প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

এখন ভোটের সময়, সময় এখন ইস্তেহারের। নির্বাচনের এই ভরা বসন্তে বাণ ডেকেছে প্রতিশ্রুতির। জিতলে কী করা হবে এ রাজ্যের মানুষের জন্য তার সুমুদ্রিত বয়ান। তবে আমরা যারা নির্বাচকমণ্ডলী, জানি ভোটের পর এই বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতির পরিণতি কী হবে। অবশ্য সবটাই আমাদেরই যে বুঝতে হবে এমন মাথার দিব্যি অবশ্য কেউ দেয়নি। এই ইস্তেহার, জনকল্যাণের ব্রত, মাইকে গলার শিরা ফুলিয়ে শপথ আদৌ কতটা বাস্তবোচিত না কি নির্বাচনী জুমলা (শব্দটির কপিরাইট শ্রীযুক্ত অমিত শাহ মহাশয়ের), তা নিয়ে তথ্যনির্ভর আলোচনা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। বরং যে জিনিসটা পাঠকের নজরে আনতে চাইছি, যে এই সমস্ত প্রতিশ্রুতি, দাবি, ইস্তেহার— পুরো বিষয়টা ভীষণভাবে কেন্দ্রীভূত। সমস্তটাই একটা কেন্দ্রীয় ছক মেনে তৈরি, যেন বাগনান থেকে জলপাইগুড়ি সবার সমস্যা, চাওয়াপাওয়াটা এক ছাঁচে গড়া। অবশ্য এর মানে এটা নয় যে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্পের মত কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি ইস্তেহারে থাকবে না। কিন্তু কেন্দ্রকে যদি পরিধির সঙ্গে যুক্ত না করা যায়, যদি আঞ্চলিক বিষয়গুলিকে ইস্তেহারে সমন্বিত না করা যায় তাহলে রাজনীতি তৃণমূল স্তর পর্যন্ত পৌঁছবে কী করে? নব্বইয়ের দশকে সমাজভাবনায় একটা কথা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল— ‘থিঙ্ক গ্লোবালি, অ্যাক্ট লোকালি’। কিন্তু এদেশে রাজনীতির ভীষণ কেন্দ্রীভূত চেহারাটা দেখলে বোঝা যায় কথাটা নেহাতই কথার কথা হয়ে রয়ে গেছে। যদি আমাদের আচরিত রাজনীতির অবয়বটা পাল্টাতে হয় তবে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না, আমাদেরই শুরু করতে হবে। এই কথকতা সেই লক্ষ্যেই একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস।

জনতার ইস্তেহারের খোঁজে যাওয়ার আগে পশ্চিম বর্ধমান জেলা সম্পর্ক একটু আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে। আসানসোল ও দুর্গাপুর এই দুই মহকুমা নিয়ে এই জেলা। আদ্যন্ত শিল্পাঞ্চল এই এলাকা সম্পর্কে একদা স্কুলপাঠ্য ভূগোল বইতে লেখা হত রানিগঞ্জের কয়লা, পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ডের লৌহ আকরিক, বীরমিত্রপুরের চুনাপাথর, দামোদর নদীর জল, উন্নত যাতায়াতব্যবস্থা (জিটিরোড, ডাবল লাইন রেলপথ), সুলভ শ্রমিক ও বিদ্যুতের কারণে আসানসোল-দুর্গাপুর ভারতের অগ্রগণ্য শিল্পাঞ্চল। তখন সারা ভারত থেকেই বিভিন্ন ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষ এখানে আসত কাজের খোঁজে। এ ছিল এক মিনি ভারতবর্ষ। তবে আশির দশক থেকে ছবিটা পাল্টে যেতে থাকে। বন্ধ হতে শুরু করে ছোট-বড়, বেসরকারি-রাষ্ট্রায়ত্ত একের পর এক কারখানা। এ অঞ্চলের বর্তমান প্রজন্ম এখন কাজের সন্ধানে বাইরে যায়। বন্ধ কারখানা, হার মেনে নেওয়া শ্রমিক আন্দোলন, চোরা পথে কয়লা পাচারের ফন্দিফিকির গত বিশ বছর ধরে এই অঞ্চলের ট্রেডমার্ক। প্রসাধনী পরিবর্তন অবশ্য হয়েছে, কিন্তু একটু কান পাতলে শোনা যাবে অনিবার্য পতনের শব্দ। এইরকম একটা মনখারাপ করা সময়ে কী হতে পারে মানুষের ইস্তেহার বা দাবিপত্র তা নিয়েই আমাদের আলোচনা।

দেখা যাক এক এক করে।

প্রথমত, আসানসোল সম্পর্কে যাদের সামান্যতম জানা বোঝা আছে তারা জানেন যে একদা এখানকার সেনরেল সাইকেল কারখানা সারা ভারতে চ্যাম্পিয়ন ব্র্যান্ড হিসাবে পরিচিত ছিল। যেহেতু সাইকেল তৈরির জন্য রকেট প্রযুক্তি লাগে না তাই সেই জমি ও শেডকে কাজে লাগিয়ে আবার সাইকেল কারখানাটি নতুন করে চালু করা যায়। এ রাজ্যে সবুজ সাথী প্রকল্পের অধীনে প্রচুর সাইকেল লাগে যা সরকার পাঞ্জাব থেকে কিনে আনে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব যান হিসাবে করোনা অতিমারি পরবর্তী সময়ে সাইকেলের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় নতুন কারখানা তৈরি হলে কর্মসংস্থান তো হবেই, তার সঙ্গে অর্থনীতিতেও বৃদ্ধি আসবে।

দ্বিতীয়ত, আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের একের পর এক কারখানা কীভাবে ও কেন বন্ধ হল এ নিয়ে বহু তর্ক, আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে সেই আলোচনায় আমরা প্রবেশ করব না। কিন্তু তিনটি কারখানার বিষয়ে আলাদা করে উল্লেখ করা দরকার যেগুলি একটু পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা এবং গণআন্দোলন থাকলে চালু করা সম্ভব। এগুলি হল বার্নপুর ওয়াগন কারখানা, রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্থান কেবলস ও দুর্গাপুর এইচসিএফএল। এগুলোর বাজারের সমস্যা অনেক কম। যেমন ওয়াগনের চাহিদা যথেষ্ট, কেবলসের উৎপাদিত সামগ্রীর মধ্যে কিছু বৈচিত্র্য আনতে পারলে পরিস্থিতির বদল ঘটতে পারে।

তৃতীয়ত, একই সঙ্গে দাবি থাকছে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে বাঁচানোর। কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট লবির প্রতি দায়বদ্ধতায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছে। এবারের আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তু দুর্গাপুরের অ্যালয় স্টিলস প্লান্ট ও চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ কারখানা। এই লাভজনক কারখানাগুলিকে বাঁচানোর দাবি আজ এলাকার সমস্ত মানুষের।

চতুর্থত, আসানসোল-রানিগঞ্জ অপার কয়লা সম্পদে সমৃদ্ধ। শিল্পসভ্যতার চালিকাশক্তি কয়লা একদিকে যেমন এই অঞ্চলের জন্য আর্থিক সুবিধা বয়ে এনেছে তেমনি কারণ হয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়ের। ধস, আগুনে এখানে জমি, জল, জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। আজ থেকে বহু বছর আগে শিল্পাঞ্চলের প্রবাদপ্রতিম শ্রমিক নেতা ও সাংসদ হারাধন রায় জনস্বার্থে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এক মামলা করেন। হারাধনবাবুর বক্তব্য ছিল মাটির নিচের কয়লা সম্পদ উত্তোলন করতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত কোল কোম্পানি যদি মাটির উপরের জনজীবন ও পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে তবে রাষ্ট্রকেই তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেই জনস্বার্থ মামলায় প্রাথমিকভাবে রায় ধস-কবলিত মানুষের পক্ষে গেছে। তৈরি হয়েছে পুনর্বাসনের মাস্টার প্ল্যান ও এ বাবদ কেন্দ্রীয় অনুদানও এসে গেছে। কিন্তু এক যুগ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও ধসকবলিত এলাকার মানুষ পুনর্বাসন পাননি। বরং আরও নতুন নতুন এলাকা ধসের কবলে পড়েছে। জীবন ও সম্পত্তিহানি এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিষয়টির সমাধান চাইছে এলাকার মানুষ।

পঞ্চমত, পশ্চিম বর্ধমান জেলায় আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল পরিবেশের বিপন্নতা। এর জন্য সবচেয়ে বড় কারণ হল খোলামুখ কয়লাখনি। লাভের পরিমাণকে সর্বোচ্চ করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি কোল কোম্পানিগুলি মাইলের পর মাইল এলাকায় গভীর খাত বানিয়ে কয়লা উত্তোলন করছে। ৫-১০ বছর কয়লা তুলবার পর গোটা এলাকাটাকে বাস্তবত শ্মশান বানিয়ে এলাকা ছাড়ছে তারা। ফলত ভূমিক্ষয়, জলস্তর কমে যাওয়া, সামান্য যেটুকু চাষাবাদ ছিল তা ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমাদের পাওনা হচ্ছে। এই এলাকায় তাকালে বোঝা যায় সহনশীল উন্নয়নের ধারণা কতটা শূন্যগর্ভ আস্ফালন। তাই মানুষের জীবন, জীবিকা ও পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতিকে বদলে ফেলতে হবে।

ষষ্ঠত, যে কোনও অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি এক অপরিহার্য শর্ত। জেলার মানচিত্র দেখলেই বোঝা যাবে যে শিল্পশহর বার্নপুর থেকে দামোদর নদী পেরোলেই পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া। যোগাযোগের জন্য রয়েছে রেলব্রিজ। একটু উদ্যোগী হলেই রেলব্রিজের সমান্তরালে গড়ে তোলা যায় রোডব্রিজ। তিনটি জেলার মানুষের এই দীর্ঘদিনের দাবিটি পূরণ হলে এখানকার অর্থনীতিতে সদর্থক প্রভাব পড়বে।

সপ্তমত, পুরনো শিল্পসংস্থাগুলো যখন একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন নতুন দিনের শিল্প আসবে এই আশায় গড়ে তোলা হয় এই জেলায় বেশ কয়েকটি শিল্পতালুক যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অঙ্গদপুর-রাতুড়িয়া (দুর্গাপুর), কন্যাপুর (আসানসোল), মঙ্গলপুর (রানিগঞ্জ)। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই শিল্পতালুকগুলির ৭০ শতাংশ আজ বন্ধ। অথচ শিল্পমালিকদের নামমাত্র মূল্যে জমি দেওয়া হয়েছিল, সঙ্গে ছিল জল, বিদ্যুৎ এবং হাজারো রকম করছাড়। এই শিল্পতালুকগুলিকে পুনরায় সচল করা এবং অঙ্গদপুর-রাতুড়িয়া অঞ্চলে পরিবেশ দূষণকারী স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলিকে অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য উদ্যোগী হওয়া দরকার।

অষ্টমত, একথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে ভারতে পর্যটনশিল্প প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে পারে। আসানসোল-দুর্গাপুরকে কেন্দ্র করে দেউল, নজরুল স্মৃতিধন্য চুরুলিয়া, মাইথন, কল্যাণেশ্বরী মন্দির এবং পার্শ্ববর্তী জেলার বড়ন্তি, পঞ্চকোট, বিহারীনাথ, পাঞ্চেৎ ও জয়চণ্ডী পাহাড় নিয়ে একটা পর্যটন সার্কিট গড়ে তোলা যেতে পারে যা কর্মসংস্থানের অনেক সুযোগ করে দিতে পারে। ইতিমধ্যেই উল্লেখিত অঞ্চলগুলো পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে সারা রাজ্যে পরিচিত, প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি সাহায্য।

নবমত, পশ্চিম বর্ধমান জেলার একটা বড় সমস্যা হল জলাভাব। জেলার দুপাশ দিয়ে অজয় ও দামোদর নদী বয়ে গেছে, এছাড়া রয়েছে কম দৈর্ঘ্যের ছোট দৈর্ঘ্যের নদী। এগুলি আজ অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও মানুষের দ্বারা জবরদখলের কারণে মৃতপ্রায়। সেগুলিকে পুনরুদ্ধার করার কথা আমাদের ভাবতেই হবে। যেমন আসানসোল শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা গাড়ুই ও নুনিয়া নদী বড় নর্দমায় পরিণত। নদী বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে এই ভাবনা আজ আলোচনার বৃত্তে আনতেই হবে।

এই ইস্তেহার বা দাবিপত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বরং একে প্রাথমিক খসড়ামাত্র বলা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর উপর ভরসা নয়, গণসচেতনতা ও মুক্তকণ্ঠ পারে নিজেদের আশা-আকাঙ্খাকে সামনে আনতে। আর শেষ বিচারে এই দাবিগুলি স্থানিক নয়। কারণ এর মধ্যে লুকিয়ে আছে শিল্পায়নের নীতি, সরকারের পলিসি, সহনশীল উন্নয়নের ধারণা ও পরিবেশ সচেতনতার প্রশ্ন। সমস্ত প্রতর্ক নিরর্থক, যদি না সেটার কেন্দ্রে মানুষ থাকে। গণতন্ত্র অন্তত সেই কথাটাই বলে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...