Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নিহিত কোমলগান্ধার : সিনেমা সঙ্গীত ও ঋত্বিক ঘটক — পাঁচ

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

চতুর্থ পর্বের পর

কোমল গান্ধার (১৯৬১)

ঋত্বিক কুমার ঘটকের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’-এর প্রায় দশ বছর পর নির্মিত হয় ‘কোমল গান্ধার’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কবিতার সূত্র ধরে সিনেমাটির নামকরণ হয়। ঋত্বিকের এবারের সিনেমার প্লটও অন্যান্য গল্পগুলির মতো স্বতন্ত্র। ঋত্বিক নিজে একদা বামপন্থী গণনাট্য আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার নানান জায়গায় গড়ে ওঠা ‘নব্য’ থিয়েটার ভাবনা ও তার মূলস্রোতের শরিকও ছিলেন তিনি। বহুদিন ধরেই ভেবেছিলেন থিয়েটার জীবনের সুখ, দুঃখ, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে কোনও কাজ করবেন তিনি। ‘কোমল গান্ধার’-এর মধ্য দিয়ে তিনি যেন তাঁর সেই স্বপ্নের পথচলাকে সেলুলয়েড-এর হাত ধরে বাস্তবায়িত করলেন। থিয়েটারের আদর্শ, আপোষহীন শ্রেণিসংগ্রাম, নৈতিকতা, ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে তাই তিনি তুলে ধরেছিলেন এই সিনেমার মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে তৎকালীন গণনাট্য সংঘের কার্যকলাপ এবং তাদের ভাবনাচিন্তার ফসল হিসেবে ‘কোমল গান্ধার’ ফুটে ওঠে। IPTA (Indian People’s Theater Association)-এর কর্মীদের অদম্য passion, turbulent versatility এবং creativity তাকে মুগ্ধ করেছিল। ‘কোমল গান্ধার’-এর হাত ধরে সেই প্রয়াসটুকুকে ঋত্বিক যেন সম্মান জানালেন। একই সাথে অন্যান্য সিনেমার মতো focal theme রূপে উঠে আসে দেশভাগ, নীতিগত আদর্শ, দুর্নীতি, স্বাধীনচেতা শিল্প ও জীবনের লড়াই, তাদের বেঁচে থাকার কাহিনী, এবং শ্রেণিসংগ্রামের জ্বলন্ত দলিল।

এই ছায়াছবিতে ব্যবহৃত সঙ্গীতের রূপটিও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সিনেমাটিতে গীত রচনা করেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, বিজন ভট্টাচার্যের মতো খ্যাতনামারা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য-র রচনাও এই ছবিতে স্থান পেয়েছে। লোকসঙ্গীতে রনেন রায়চৌধুরী এবং গণসঙ্গীতের গায়নে হেমাঙ্গ বিশ্বাস যথাযথ অনবদ্য। আবহপ্রদানে ওস্তাদ বাহাদুর খান (সরোদিয়া) এবং সহকারী সঙ্গীত পরিচালনায় শ্রী মন্টু ঘোষের অবদান অনস্বীকার্য। সর্বোপরি ঋত্বিকের ‘সিনেমা সঙ্গীতের কাণ্ডারি’ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র এই সিনেমার সঙ্গীত পরিচালকরূপে এককথায় অতুলনীয়। রবীন্দ্র ও গণনাট্যসঙ্গীতকে যেভাবে তিনি ব্যবহার করেছেন এই ছায়াছবিতে, অন্যান্য সিনেমায় এই ধরনের দু’টি বিপরীত মেরুকে একজায়গায় একত্রিত করা এক নজিরবিহীন কৃতিত্ব। আসুন, এবার সরাসরি ঢুকে পড়া যাক সিনেমাটিতে।

সিনেমার শুরুতেই নামলিপি ওঠার সময় ব্যবহৃত introductory music-ও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সরোদ, সারেঙ্গী ও সুরশৃঙ্গার-এর সাথে তালতন্ত্রের এক অনবদ্য orchestration এখানে শ্রুতিগ্রাহ্য। সমগ্র যন্ত্রানুষঙ্গটি প্রথমে নাটকে ব্যবহৃত সঙ্গীতের ঢঙে এবং পরে তা পর্যবসিত হয় গ্রামবাংলার লোকজ বিয়ের গানে।  প্রচলিত এই বিবাহসঙ্গীতটি — ‘আমের তলায় জামুর ঝুমুর/কলাতলায় বিয়া/আইলেম গো সুন্দরী জামাই/টোপর (ভুটুক) মাথায় দিয়া’ — সিনেমার নানান অংশে ঘুরেফিরে উঠে এসেছে। এমনকি সিনেমার শেষ দৃশ্যেও এই গানের রেশ মানুষের মন ছুঁয়ে যায়।

এরপর এই সিনেমায় নাটকের একটি দৃশ্যে (যেহেতু নাটক বা থিয়েটারকেন্দ্রিক ছবি) নায়িকা অনসূয়াকে একটি দৃশ্য পাঠ করার সময় আবার সেই বিয়ের গান (আমের তলায় জামুর ঝুমুর) ভেসে ওঠে। নেপথ্যে ভেসে ওঠে ট্রেনের ছুটে যাওয়ার শব্দ। পরবর্তী দৃশ্যে দেখা যায় নায়িকা অনসূয়া কাহিনীর chief protagonist ভৃগুর প্রতি আকর্ষিত হয়। অনসূয়া ভৃগুর বাড়িতে আসে। এই পর্যায়ে সরোদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনসূয়া ও ভৃগুর মায়ের কথোপকথনের সময় হালকা লয়ে বেজেছে সরোদ এবং পরবর্তী দৃশ্যে অনসূয়া যখন ভৃগুর ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের আটপৌরে পৃথিবীটা দেখে, সেখানেও পাখির ডাকের সঙ্গে resemblence-এ বেজেছে সরোদের মূর্চ্ছনা। ছবির এই দুই জায়গায় সরোদের ব্যবহার ও তার মার্জিত চলন দৃশ্যটিকে পরিপূর্ণতা দেয়।

পূর্বেই বলা হয়েছে ষাটের দশকের গণনাট্য আন্দোলনকে মাথায় রেখে এই কাহিনীচিত্র তৈরি হয়েছে। বস্তুত এতে ব্যবহৃত থিয়েটারের গানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। যেমন রিহার্সালের দৃশ্যে আমরা শুনি সমবেত কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গানটি — ‘এসো মুক্ত করো/মুক্ত করো/অন্ধকারের এই দ্বার’। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের গাওয়া এই গানটি একদা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের অসামান্য সংযোজনায় এটি পূর্ণতা লাভ করে।

পরের দৃশ্যে আবার ঘুরেফিরে আসে সেই লোকজ সুর ও সঙ্গীতের ধারা। Open stage rehearsal করতে গিয়ে ভৃগু ও তার দলবল নদীর তীরে পিকনিক করতে আসে। এখানে একটি দৃশ্যে অনসূয়া, বাস থেকে জিনিসপত্র নামানোয় ব্যস্ত ভৃগুর হাত ধরে টেনে নিয়ে তাকে অপার্থিব নদীর মনোরম দৃশ্য দেখাতে নিয়ে যায়। অনসূয়ার ছোঁয়ায় ভৃগু চমকে ওঠে। রোমাঞ্চিত হয়। নেপথ্যে সঙ্গীতকার সমবেত উলুধ্বনি ও সেই বিয়ের গানের আবহ সৃষ্টি করে এই দৃশ্যে romantic element-টির পুনর্জাগরণ ঘটান।

পদ্মার তীরে আয়োজিত পিকনিকের প্রেক্ষাপটে সঙ্গীত পরিচালক নৌকো বাওয়ার গান, ভাটিয়ালি ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন। একই সঙ্গে উঠে এসেছে সেই বিখ্যাত কোরাস — ‘দোহাই আলি!’ ভাটিয়ালি গানের উপযুক্ত ব্যবহারে কিস্তিমাত করেন রনেন রায়চৌধুরী। সিনেমার একটি দৃশ্যে আমরা দেখি, থিয়েটারের সদস্যরা দু’দলে ভাগ হয়ে বাইচ প্রতিযোগিতায় নামছে। পদ্মার বুকে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তারা গান গায়। নৌকো টানার গান। এরপরেই আমরা দেখি, দুই নাট্যকর্মীকে যারা পদ্মার তীরে বসে গান গাইছে। রনেন রায়চৌধুরীর কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গান — ‘এপার পদ্মা, ওপার পদ্মা/মাঝে জাগনার চর/তারই পারে বসে আছে/শিব সদাগর’। অসাধারণ এই গানটি সিনেমার বাড়তি সম্পদ।

এরপরে আমরা দেখতে পাই সেই বিখ্যাত দৃশ্য। কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার অসমাপ্ত রেললাইনের ট্র‍্যাকে পদ্মার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশাপাশি, অনসূয়া ও ভৃগু। তারা ওপারে বাংলাদেশ দেখে তাদের ফেলে আসা দিনের কথা বলে। তাদের কথায় উঠে আসে দেশ-ভাগ, মন্বন্তর, ফেলে আসা স্বপ্ন এবং পরিবারের কথা। এই দৃশ্যে নেপথ্যে আরও একবার দৃশ্যের মান বজায় রাখতে বেজে উঠেছে সেই বিয়ের গান। এখানে এই দৃশ্যে ব্যবহৃত বিয়ের গান ভৃগু ও অনসূয়ার সম্পর্কটিকে আরও ভালো করে রাঙিয়ে তোলে।

বিয়ের গানটির (আমের তলায় জামুর ঝুমুর) আরেকটি অসাধারণ treatment এবং সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিক দেখা যায় এরই পরের দৃশ্যে। যেখানে অনসূয়া তার দুঃখ কষ্টের কথা বলতে বলতে মাথায় হাত দিয়ে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। ভৃগু শঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামলাবার চেষ্টা করে। ঠিক এই মুহূর্তে আবার নেপথ্যে বেজে ওঠে সেই বিয়ের গান। কিন্তু এবারে সেটিকে অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনায়। নেপথ্যে পুনরায় বিলাপের সুরে শোনা যায় একনাগাড়ে চলতে থাকা ‘দোহাই আলি’ ‘দোহাই আলি’ রব। শব্দটা আস্তে আস্তে জোরে হতে থাকে। সিনেমায় আমরা দেখতে পাই, ক্যামেরা প্রবল বেগে সেই অসমাপ্ত রেললাইনের ট্র‍্যাক ধরে বাংলাদেশের দিকে সজোরে ধেয়ে যায়, এবং তীব্র সংঘাতের শব্দের সাথে সাথে পর্দা কালো হয় যায়।

সংঘাতের আরও এক দৃশ্যকে পরিচালক অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। থিয়েটার কর্মী প্রবাল এসে যখন ভৃগুকে অনসূয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার কথা বলে, তখন বাইরে সশব্দে প্রচণ্ড অ্যাক্সিডেন্ট হয়। ভৃগু কিয়ৎকাল হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। সংঘাতের দৃশ্য ও মানসিক চাপানউতোর মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

অন্যান্য সিনেমার মতন ঋত্বিক বারবার দেখানোর চেষ্টা করেছেন কলকাতা শহরের এক ‘অন্যমুখ’। ক্যামেরার চোখে আমরা দেখি শহর কলকাতার আকাশ, কলকাতার ব্যাপ্ত রাস্তা, উঁচু বাড়ি, লোকজন এবং নেপথ্যে বেজে ওঠা কীর্তনের সুর। কলকাতা শহরের মধ্যে দিয়েই ক্যামেরা প্যান করে ভৃগুর ঘর। শহর কলকাতার দৃশ্যে কীর্তনাঙ্গের সুর এই দৃশ্যটিকে এক অসামান্যতায় নিয়ে যায়। ইট-কাঠ-পাথরের শহুরে আবরণের ভেতরে ফুটে ওঠা মধ্যবিত্ত আটপৌরেতাকে significantly তুলে ধরে এই কীর্তন। অন্যান্য সিনেমার মতো বাঁশির প্রয়োগও এখানে বিদ্যমান। একটি দৃশ্যে যেখানে ভৃগু ও অনসূয়া একসাথে নদীর ধারে ঘুরতে বেড়ায়। কিছু বাচ্চারা সামনে খেলাধুলো করে। এই দৃশ্যের নেপথ্যে রাখালিয়া বাঁশি বাজে। দৃশ্যটির সহজাত বাচনভঙ্গি ও পরিবেশনের সূত্র ধরে বাঁশির এই ব্যবহার দৃশ্যটিকে আরও জীবন্ত করে তোলে।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসামান্য কিছু ব্যবহারও এই সিনেমাটিতে চোখে পড়ে। বিশেষ করে সেই বিখ্যাত দৃশ্যটি যেখানে নাটকের দলবল নিয়ে ভৃগু ও অনসূয়া কার্শিয়ং-এ হাজির হয়। কার্শিয়ং-এর অসাধারণ সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্যে মোহিত হয়ে আবেগপ্রবণ নাট্যকর্মী ঋষি উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে, ‘আকাশভরা সূর্য তারা/বিশ্বভরা প্রাণ’। সঙ্গীতকার জর্জ বিশ্বাসকে দিয়ে এই গানটি প্রচলিত ছকের বাইরে গিয়ে গাওয়ান। দেবব্রত ‘জর্জ’ বিশ্বাসের কণ্ঠে এই গানটি আজও বাঙালি দর্শকের হৃদয়ে ঢেউ তোলে। গানের সাথে ব্যবহৃত তানপুরা ও সেতারের অনবদ্য সংমিশ্রণ গানটিকে এক অন্য মার্গে নিয়ে যায়। একই সাথে পরিপূর্ণতা পায় দৃশ্যটিও।

অপর একটি দৃশ্যে আমরা দেখি থিয়েটারের দলবল শহর ছেড়ে রায় বনাঞ্চলভূমিতে শো করতে যায়। শো-এর শেষে রাতে সবাই মিলে ঘুরতে বেরোয়। হঠাৎই সব ছাপিয়ে, রাতের অন্ধকার চিরে ভেসে ওঠে অনসূয়ার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত — ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে/সবাই গেছে বনে/বসন্তের ঐ মাতাল সমীরণে, হায়’। গীতা ঘটকের কণ্ঠে এই গানটি দর্শকদের মনে দোলা দেয়। বাদ্যযন্ত্রহীন এই গানটির শেষে সরোদ ও জলতরঙ্গের ব্যবহারও মন ছুঁয়ে যায়।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি গণনাট্য সঙ্গীতও এই সিনেমায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতন্ত্ররূপে বিদ্যমান। এই ছায়াছবিতেই একটি নাটকের রিহার্সালের সময় গাওয়া হয়েছে — ‘ঘুরঘুট্টি আন্ধার রাতে/নিস্তরঙ্গ কালো জলে/ বাইনের নৌকা ভাসে’। সমবেত কণ্ঠে (কোরাস) গাওয়া এই গানটি অসম্ভব প্রাণের স্পর্শ পায় সুরকারের দৌলতে। নৌকার দাঁড় টানার ছন্দে গাঁথা এই গানটি সিনেমার একটি বড় সম্পদ।

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে আরও একটি বিখ্যাত গণসঙ্গীত এই সিনেমায় দৃশ্যমান। যেহেতু থিয়েটারকেন্দ্রিক সিনেমা, সেহেতু এই সিনেমায় রিহার্সাল ও রিহার্সালের দৃশ্যে বহুবার ঘুরে ফিরে গান উঠে আসে। তেমনই একটি দৃশ্যে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে এবং কোরাসে গাওয়া — ‘হেইয়ো হো/বল মা ভৈঃ মা ভৈঃ’ গানটি অসাধারণ দক্ষতায় গাওয়ানো হয়েছে। আবার অন্য একটি দৃশ্যে নাটকের শেষে থিয়েটার দলের অন্য সক্রিয় নাট্যকর্মী জবা দুঃখ মনে, ব্যথিত হৃদয়ে গান গায় — ‘পথ যতই হবে বন্ধুর’। ঢিমে লয়ে, খালি গলায় গাওয়া এই গানটি পরিচালক অনবদ্যভাবে থিয়েটার জগতের দুঃখ, কষ্ট, অভাব ও প্রতারণার সাক্ষ্যরূপে প্রতিস্থাপন করেছেন।

সরোদের ব্যবহার ঋত্বিকের অন্যান্য সিনেমার মতো ‘কোমল গান্ধার’-এও উপস্থিত। সিনেমায় প্রায় সবখানেই কমবেশি আমরা সরোদের আভাস পাই। একটি রাস্তার টেবিলে বসে অনসূয়া ও ভৃগু মুখোমুখি বসে থাকে। অনসূয়াকে এই শহর কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে। ভৃগু তাকে সান্ত্বনা দেয়। শহর ছেড়ে যাবার দুঃখে অনসূয়া ভেঙে পড়ে। তার বিষাদের দৃশ্যকে আরও প্রাঞ্জল করে তোলে বাঁশির করুণ সুর। অথবা অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে যেখানে দলীয় রাজনীতির শিকার হয় অনসূয়া, ভৃগুর থিয়েটারের দল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। দলের সাথে নাট্যকর্মীর এই বিচ্ছেদের সরোদ ও বাঁশির করুণ সুর দর্শকের মনে দাগ কাটে। পুনরায় অন্য একটি দৃশ্যে যখন ভৃগু ও অনসূয়া খোয়াই-এর ধারে হাঁটে, সেখানেও নেপথ্যে সেতার, সরোদ ও বাঁশির ঐকতান লক্ষণীয়।

সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর লেখায় ও সলিল চৌধুরীর সুরে সেই বিখ্যাত ‘অবাক পৃথিবীর গান’-ও এখানে সুরকার ব্যবহার করেছেন। সিনেমার একটি দৃশ্যে যেখানে একে একে সবাই দল ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তখন ব্যাকস্টেজ থেকে নেপথ্য সঙ্গীত রূপে সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে — ‘অবাক পৃথিবী/অবাক করলে তুমি/জন্মেই দেখি/ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’ — এই গানটি ভেসে ওঠে। সামনে ভৃগু ও শিবু মুখোমুখি বসে থাকে, আবহে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ শোনা যায়।

এরপর আরও কিছু unparallel এবং unorthodox treatment of music দেখতে পাওয়া যায়। সিনেমার শেষার্ধে ভৃগুর ঘরে অনসূয়া এসে ঢোকে। ভৃগু একা একা বই পড়ে। নেপথ্যে সরোদে অদ্ভুত সুরে ভৈরবী বেজে ওঠে। উল্লেখনীয় ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ সাহেবের ভৈরবীর কোমল রেখাব ও গান্ধারের আন্দোলন মনকে ছুঁয়ে যায়।

তারপর বয়স্ক বামপন্থী মাস্টারমশাইদের সম্মেলন উপলক্ষে মিছিল দেখতে পাওয়া যায়। সুরকার অদ্ভুতভাবে এই বয়স্ক মাস্টারদের মিছিলের সাথে তাদের চোরা বেদনা, জীবনের টানাপোড়েন ইত্যাদিকে যন্ত্রানুষঙ্গের সাহায্য না নিয়ে শুধুমাত্র একটি শ্যামাসঙ্গীতের হাল্কা চলনে দৃশ্যটিকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন।

সিনেমার শেষাংশে অনিবার্য ভঙ্গিতে দু’টি লোকসঙ্গীতকে ব্যবহার করা হয়েছে। শেষাংশের একটি দৃশ্যে নেপথ্যে বেজে উঠেছে একটি গান – ‘সুরে আছেন সুলেমান/ সুরে আসমান/ওই নাম জপো বান্দা/আল্লা কালাম/লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ/মহম্মদ তার নাম’। আবহে বেজে ওঠে সরোদ। মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় অনসূয়া ও ভৃগু। দু’জনে দু’জনের হাত ধরে। চির মিলনের ক্ষণে সরোদ ও জলতরঙ্গের মূর্চ্ছনায় মোহিত হন দর্শকেরা।

সর্বোপরি শেষ দৃশ্যে ইসলামি গানের রেশ ধরে বাউলাঙ্গে — ‘আমি কী ছলে জল আনতে গেলাম/সোনার গৌরী দেখতে পেলাম’ — গানটি আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আবহে দেবীর বোধন এবং সাথে সাথে অনিবার্য ভঙ্গিতে বেজে ওঠা ‘বিয়ের গান’ — ‘আমের তলায় জামুর ঝুমুর’ বেজে ওঠে। অদ্ভুত এক সাঙ্গীতিক রেশের মধ্যে দিয়ে সিনেমা শেষ হয়। বিয়োগান্ত নয়, মিলনান্তক ভঙ্গিতে। আরও একবার আমরা রোমাঞ্চিত হলাম।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ‘কোমল গান্ধার’-এ এক ছোট্ট চরিত্রে সিনেমায় প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে দেবব্রত ‘জর্জ’ বিশ্বাসের। নিজের চরিত্রাভিনয়ে তিনিও এককথায় অনবদ্য।


এরপর আগামী সংখ্যায়