Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিশ্বকাপ ২০১৮ : গ্রুপবিন্যাসের ঝাঁকিদর্শন

শুভাশিস রায়চৌধুরী

 

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছবি ‘ধন্যি মেয়ে’র সেই দৃশ্যটা আশা করি সকলের মনে আছে। যেখানে ট্রেনে করে কলকাতার সর্বমঙ্গলা ক্লাব হাড়ভাঙ্গা শিল্ডের ফাইনাল খেলতে চলেছে। হঠাৎ দলকে উদ্বুদ্ধ করতে ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দলের গোলরক্ষক তপেন চট্টোপাধ্যায়, মান্না দের মাখন গলায় গেয়ে উঠলেন ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’। বাঙালির আবেগ এতটাই জড়িয়ে রয়েছে সেই গানের সাথে, যে বাঙালি পারলে সেই গানকে রাষ্ট্রগানের মর্যাদা দিয়ে দেয়। গানটার প্রতিটা কথা যেন বাঙালির অ্যানাটমির নিখুঁত বর্ণনা। ফুটবল ছাড়া তাই বাঙালিকে ভাবাই যায় না। এটা যেন আমাদের আলাদা একটা আইডেন্টিটি। ফুটবল বাঙালির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও আমাদের ফুটবলপ্রেমের কিন্তু চারটে ক্যাটেগরি রয়েছে। একদল আছে যারা সারা বছর শুধু বিজাতীয় লিগ ফলো করে, একদল আছে যারা কেবলমাত্র দেশের ফুটবলেরই খবর রাখে, আরেকদল আছে যারা কোনওরকমের বাছবিচার না করে সবই ফলো করে এবং সব শেষে এই তিন ক্যাটেগরির তুলনায় কম সংখ্যক কিছু মানুষ আছেন যারা সারাবছর ফুটবলই দেখেন না বা খবর রাখেন না। তবে প্রতি চার বছর অন্তর এই চারটি ক্যাটেগরির মানুষের অবস্থাই ‘কারবাঁ’ ছবির হিট গানে নৃত্যরত লাস্যময়ী হেলেনের মতো হয়ে ওঠে। সকলেরই বুকের ভিতর থেকে যেন আওয়াজ আসে “দেখো, উও আ গ্যায়া, উও আ গ্যায়া”। যার আগমনে প্রতি চার বছরে অতিবড় দেশভক্ত বাঙালির ছাদে বিশালাকায় বিদেশি পতাকা ওড়ে, বসের কাছে ছুটির আবেদনের পাহাড় জমে, পুরনো টিভি পাল্টে ঘরে নতুন টিভি আসে, আর যার সমাপ্তির পরের দিনের সন্ধ্যাটা দশমীর মতো মনে হয়, সেটাই বিশ্বকাপ বলে পরিচিত। উঁহু, ‘ওয়ার্ল্ডকাপ’ নয়, বিশ্বকাপ।

চার বছর আগে মারাকানা স্টেডিয়ামে লিওনেল মেসির চোখের জল আর ফিলিপ লাহমের চওড়া হাসিতে যে উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল তা আবার ফিরে এসে কড়া নাড়ছে বাঙালি ফুটবলপ্রেমীদের দরজায়। আবার রাত জাগা শুরু হবে। আবার কেলোদার চায়ের দোকানে বসবে বিশেষজ্ঞদের আড্ডা। কদিন আগে পর্যন্ত ইস্ট-মোহন নিয়ে খেয়োখেয়ি করতে থাকা লালু-ভুলু একসাথে গলা ফাটাবে একটাই দলের জন্য। একই ক্লাবের সাপোর্টারদের একমাস মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে। এমনিতে যুবরাজ সিংহ লেখা বাংলা দৈনিক পাকামো মেরে ওরিজিনাল উচ্চারণ অনুযায়ী টোনি খোস, সের্খিও র‍্যামোস, অ্যাঙ্খেল দি মারিয়ার মতো আরও কিছু পরিচিত খেলোয়াড়ের নাম বদলে দেবে, তবেই না বাঙালির বিশ্বকাপ জমবে! তা বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনা যখন তুঙ্গে উঠেই গেছে তখন আর গৌরচন্দ্রিকা না করে আসল কথায় আসা যাক। সব ম্যাচ দেখতে পারলে তো কথাই নেই, কিন্তু সেটার সৌভাগ্য আর কজনেরই বা হবে? তাই গ্রুপ অনুযায়ী কিছু তথ্য এবং জরুরি কিছু বিশ্লেষণে চোখ রাখা যাক যাতে আপনার বিশ্বকাপ দেখার পথ হয়ে ওঠে আরও সরল।

গ্রুপ এ:

রাশিয়া, সৌদি আরব, উরুগুয়ে, ইজিপ্ট

এই গ্রুপে রাশিয়ার দিকে নজর থাকবে এবং তার সাথে আয়োজক হিসাবে তাদের ওপর থাকবে পাহাড়প্রমাণ চাপ। হাল আমলে তাদের সেরা পারফরম্যান্স বলতে গাস হিডিঙ্কের কোচিং-এ ২০০৮-এর ইউরোতে সেমিফাইনালে পৌঁছনো। সেই দলে খেলা আন্দ্রেই আর্শাভিন, কন্সট্যান্টিন জিরিয়ানভ, রোমান পাভলিউচেঙ্কো ইত্যাদিদের মতো স্টারেরা বহুকাল হল জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন। তাদের দেশ এখন নতুন নায়কের সন্ধানে। তবে ২০০৮-এর সেই ঐতিহাসিক রাশিয়ান প্রথম দলের তিন তারকা এবারের দলেও রয়েছেন, স্বভাবতই নজর থাকবে তাদের দিকে। তারা হলেন গোলরক্ষক এবং অধিনায়ক ইগর আকিনফিভ, সের্গেই ইগ্নাশেভিচ এবং এক কালে চেলসি ফুটবল ক্লাবে খেলে যাওয়া ইউরি জিরকভ। এরা ছাড়াও ভিয়ারিয়েল ক্লাবের উইঙ্গার ডেনিস শেরিশেভ রাশিয়ান প্রথম দলের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি রাশিয়ান লিগে খেলেন না তাই তার দিকে আলাদা করে নজর রাখতেই হবে। রাশিয়া দলের পরের রাউন্ডে যাওয়াতে একমাত্র কাঁটা হলেন ইজিপ্টের মহম্মদ সালাহ। রোনাল্ডো, মেসির সাথে এবারের ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার হওয়ার সেরা দাবিদার মহম্মদ সালাহ। ইজিপ্ট দলের প্রাণভোমরা এবং লিভারপুল ক্লাবের অন্যতম অস্ত্র সালাহ ইতিমধ্যেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার পুরস্কার পেয়েছেন। এর সাথে তিনি জিতে নিয়েছেন এ বছরের প্রিমিয়ার লিগ গোল্ডেন বুট, যা দেওয়া হয় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাকে। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে সালাহর চোট সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের চিন্তিত করে তুলেছিল, কিন্তু সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিনি নিজে জানান যে চোট সেরকম গুরুতর নয় এবং তিনি বিশ্বকাপে খেলবেন। ইজিপ্ট দলে সালাহ ছাড়াও চোখ থাকবে আর্সেনাল ক্লাবের মহম্মদ এল-নেনি, ওয়েস্ট ব্রম ক্লাবের আহমেদ হেগাজি এবং স্টোক সিটি ক্লাবের তরুণ মিডফিল্ডার রামাদান সোভির দিকে, যাকে ইতিমধ্যেই ইজিপ্টের মিডিয়া সে দেশের কিংবদন্তি খেলোয়াড় মহম্মদ আবুত্রিকার সাথে তুলনা করেছে। এরা ছাড়াও নজর থাকবে ইজিপ্টের গোলরক্ষক এবং অধিনায়ক পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী এসাম এল-হাডারির দিকে। এল-হাডারি বিশ্বকাপে ওনার প্রথম ম্যাচ খেলার সাথে সাথে সব থেকে বেশি বয়সে বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার রেকর্ড করবেন যা আগে কলম্বিয়ার ফারিদ মন্দ্রাগন এবং ক্যামেরুনের রজার মিল্লার ছিল। আঠাশ বছর পর ইজিপ্ট বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলছে, তাও আবার সালাহর মতো একজন সুপারস্টারের উপস্থিতিতে। এ হেন দলকে কি সমীহ না করে থাকা যায়? বাকি দলেরা তাই ইজিপ্টকে যে হাল্কা ভাবে নেবে না সেটা বলাই বাহুল্য। এই গ্রুপে রয়েছে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে। ১৯৫০-এ শেষবার বিশ্বকাপ জিতে তারাই জয়ী দেশগুলোর মধ্যে সব থেকে বেশি দিন বিশ্বকাপের খরা দেখছে। এবারে সে খরা কাটবে কিনা সেটা সময়ই বলবে কিন্তু এই গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডে যেতে তাদের কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কোচ অস্কার তাবারেজ সেই ২০০৬ থেকে উরুগুয়ে দলের দায়িত্বে রয়েছেন। ২০১০ বিশ্বকাপে চতুর্থ স্থান এবং ২০১১ কোপা আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া তাবারেজের হাত ধরেই। গত বিশ্বকাপে ইতালি এবং ইংলন্ডের সাথে শক্ত গ্রুপে পড়েও তাদের হারিয়ে পরের রাউন্ডে উঠেছিল উরুগুয়ে, কিন্তু সেখানে তাদের কলম্বিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়। তাবারেজ এবারে তাই একটু বাড়তি সতর্ক থাকবেন। উরুগুয়ে দলে ইউরোপের বড় ক্লাবে খেলা স্টারেদের অভাব নেই। তাদের মধ্যে অন্যতম বার্সেলোনার লুইস সুয়ারেজ, প্যারিস সাঁ জাঁ ক্লাবের এডিনসন কাভানি, আতলেতিকো মাদ্রিদের ডিয়েগো গোডিন এবং হোসে মারিয়া হিমেনেস। এদের সাথে থাকবেন অভিজ্ঞ গোলরক্ষক ফারনান্দো মুসলেরা। এরা ছাড়াও নজর থাকবে ইন্টার মিলানের ম্যাতিয়াস ভেসিনো এবং জুভেন্টাসের রডরিগো বেন্টাকুরের ওপর। সবশেষে আসা যাক সৌদি আরবের কথায়। ১৯৯৪-এ বিশ্বকাপ অভিষেকেই শেষ ষোলোতে গিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল সৌদি আরব। সেবার প্রায় মারাদোনার স্টাইলে বেলজিয়ামের সাথে গোল করে শিরোনামে চলে আসেন দলের খেলোয়াড় আল-ওয়াইরান। তারপর টানা চারটে বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলেছে সৌদি আরব কিন্তু একবারও গ্রুপ পেরোতে পারেনি। গত দুটো বিশ্বকাপে তাদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। সেই দুবার তারা মূলপর্বে উঠতেই পারেনি। দীর্ঘ আট বছরের পরে এবারে মূলপর্বে খেলছে সৌদি আরব। তাদের কোচ হলেন গতবছর কোপা আমেরিকা সেন্টেনারিও চ্যাম্পিয়ন চিলি দলের কোচ হুয়ান আন্টোনিও পিজ্জি। দেখা যাক পিজ্জি সৌদি আরবকে চিলিতে থাকাকালীন তার সাফল্যের কতটা অংশ দিতে পারেন। নজর থাকবে আল-ইত্তিহাদ ক্লাবের ফাহাদ আল-মুয়াল্লাদ এবং আল-নাসার ক্লাবের মহম্মদ আল-সাহলাওয়ির দিকে। যদিও উরুগুয়ে, রাশিয়া এবং ইজিপ্টকে টপকে পরের রাউন্ডে সৌদি আরবের যাওয়ার আশা কম।

এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য ম্যাচ:

গ্রুপ বি:

স্পেন, পর্তুগাল, মরক্কো, ইরান

এই গ্রুপের মূল আকর্ষণ অবশ্যই তিনবার ইউরো এবং একবার বিশ্বজয়ী স্পেন। ২০১০-এর স্বপ্নের লাইন আপ না থাকলেও তারা এবারের বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম ফেভারিট। নজর থাকবে তাদের পুরো দলটার ওপর। আলাদা করে যদি কারও নাম নিতেই হয় তাহলে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, সের্জিও র‍্যামোস, সের্জিও বুসকেতস্, ডেভিড সিলভা এবং জেরার পিকের নাম নিতেই হবে, কারণ ২০১০-এর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের এই সদস্যদের এটাই হয়তো শেষ বিশ্বকাপ হতে চলেছে। এরা ছাড়াও এই তারকাখচিত স্পেন দলে রয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলের গোলরক্ষক ডেভিড ডে হিয়া, অনেক ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে যিনি এই মুহূর্তে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক। ইনি ছাড়া এই দলে রয়েছেন পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা রিয়েল মাদ্রিদের ডানি কারভাহাল, নাচো, এবং ইস্কো। র‍্যামোস, পিকে এবং জর্ডি আলবার সাথে কারভাহাল আর নাচোর উপস্থিতি স্পেনের ডিফেন্সকে এক কথায় দুর্ভেদ্য করে তুলেছে। রিয়াল মাদ্রিদে এই মরসুমে দারুণ খেলা ইস্কো আর্জেন্টিনার সাথে প্রস্তুতি ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দারুণ ছন্দে রয়েছেন। তার এই ছন্দে থাকা ফরওয়ার্ড লাইনে স্বস্তিতে রাখবে ডিয়েগো কোস্তা এবং লুকাস ভাস্কেজকে। এর সাথে সোনায় সোহাগা হিসাবে থাকবে জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের মিডফিল্ডার থিয়াগোর বিদ্যুৎ গতিতে পাস বাড়ানো। এতসব মশলা যেখানে উপস্থিত সেখানে রান্নাটা চমৎকার হবে সেটা আশা করা যেতেই পারে। তবে এই অতিরিক্ত তারকার উপস্থিতিই একমাত্র সমস্যা হয়ে উঠতে পারে স্পেনের। ফুটবলারদের ইগোর সংঘর্ষ যাতে না হয় তার জন্য কোচ লোপেতেগিকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। খুব বড় অঘটন না ঘটলে এই গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডে যেতে স্পেনের কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এই গ্রুপের আরেকটি হেভিওয়েট দল হল ২০১৬ ইউরো জয়ী পর্তুগাল। এই দলকে বাকি দলের সমীহ করার প্রধান কারণ সেখানে এই মুহূর্তে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার ক্রিস্তিয়ানো রোনাল্ডোর উপস্থিতি। রোনাল্ডো শুধু একজন ফুটবলারই নন, তিনি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ফুটবল ভক্তদের কাছে আইকনও বটে। রোনাল্ডো পাঁচ বার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন, জিতে নিয়েছেন পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং সেখানে সাতবার টপ স্কোরার হয়েছেন। তেত্রিশ বছর বয়সেও তিনি যেন বছর তেইশের যুবকের মতোই ফিট। তাই কেবলমাত্র রোনাল্ডোকে দেখতেই অনেকে এবার বিশ্বকাপ দেখবেন এটা বলাটা অত্যুক্তি হবে না বলেই মনে হয়। রোনাল্ডোর থেকে নজর যদি সরে তাহলে নজরে আসবেন ভিয়ারিয়েলের হয়ে দারুণ ছন্দে থাকা গনসালো গেডেস। প্যারিস সাঁ জাঁ থেকে লোনে ভিয়ারিয়েলে আসা ইস্তক বেশ নজর কেড়েছেন তিনি। রোনাল্ডোর সাথে তার জুটিটা জমবে বলেই আশা করা যায়। এরা ছাড়া নজর রাখতে হবে লেস্টার সিটি ক্লাবের মিডফিল্ডার আদ্রিয়েন সিলভার দিকে। পর্তুগালের আক্রমণভাগ শক্তিশালী হলেও তাদের প্রধান দুর্বলতা হল ডিফেন্স। ডিফেন্সের দুই স্তম্ভ পেপে এবং ব্রুনো আলভেসের বয়স যথাক্রমে পঁয়ত্রিশ এবং ছত্রিশ। বিপক্ষের দ্রুতগতি সম্পন্ন ফরওয়ার্ডদের বিরুদ্ধে এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়া মাথা গরম করে কার্ড দেখার প্রবণতা পেপের বরাবরের দুর্বলতা। পর্তুগালের সবথেকে বড় সুবিধা তারা গ্রুপের সবথেকে শক্ত ম্যাচটা স্পেনের সাথে প্রথমেই খেলে নিচ্ছে, কিন্তু যদি কোনও কারণে তারা মরক্কো ম্যাচটায় পয়েন্ট হারিয়ে ফেলে সেক্ষেত্রে একটা অঘটন ঘটলেও ঘটতে পারে। তবে আপাত দৃষ্টিতে পর্তুগালের পরের রাউন্ডে যাওয়ায় কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয়। এই গ্রুপের ডার্ক হর্স হল মরক্কো। কুড়ি বছর পরে এটলাস পাহাড়ের দেশ মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদের কাছ থেকে সেরকম কোনও প্রত্যাশা নেই তাই চাপমুক্ত হয়ে খেললে তাদের পক্ষে অঘটন ঘটানো অসম্ভব নয়। পর্তুগাল এবং স্পেন ম্যাচ থেকে যদি তারা পয়েন্ট ছিনিয়ে আনতে পারে তাহলে পরের রাউন্ডে যাওয়ার একটা আশা মরোক্কোর থেকেই যায়। দলের প্রধান শক্তি হল তাদের ডিফেন্স। জুভেন্তাসের মেহেদি বেনাশিয়া এবং বহুবছর এ এস মোনাকোতে খেলে যাওয়া নাবিল দিরার, এই দুই অভিজ্ঞ ফুটবলারকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে ডিফেন্স সামলানোর জন্য। এরা দুজন ছাড়া নজর থাকবে সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকার আইয়ুব এল-কাবির দিকে। এই গ্রুপের শেষ দল ইরান। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে ইরান আর ভারত একই গ্রুপে ছিল। দুই লেগ মিলিয়ে মোট ৭-০ গোলে হার হয় ভারতের। এই দুটি ম্যাচেই গোল করেন ইরানের তরুণ স্ট্রাইকার সর্দার আজমুন। তেইশ বছর বয়সী এই স্কিলফুল ফুটবলার খেলেন রাশিয়ার রুবিন কাজান ক্লাবে। মাত্র তেইশ বছর বয়সেই আজমুন তেইশটি গোল করে ফেলেছেন জাতীয় দলের হয়ে। আজমুনের দিকে নজর তো থাকবেই সাথে নজর থাকবে কোচ কার্লোস কুয়েরোজের দিকে। পোড় খাওয়া এই পর্তুগিজ ম্যানেজার একদা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সহকারী হিসাবে বহুদিন কাজ করেছিলেন। তার ফুটবলবুদ্ধিতে যদি এই গ্রুপের হেভিওয়েট দলগুলোর পচা শামুকে পা কাটে তাহলে গ্রুপটা জমে যেতে পারে।

এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য ম্যাচ:

গ্রুপ সি:

ফ্রান্স, পেরু, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া

ফ্রান্সের কোচ এবং ১৯৯৮-এর বিশ্বজয়ী দলের অধিনায়ক দিদিয়ের দেশঁর কাছে এবার বিশ্বকাপের দল গঠন ছিল সব থেকে শক্ত কাজ। ভাল মানের ফরাসি ফুটবলারদের এতটাই আধিক্য যে সেরা দল বাছতে গিয়ে দেশঁকে বাদ দিতে হয়েছে এই মুহূর্তে ইউরোপে খেলা নামী কিছু খেলোয়াড়কে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অ্যান্থনি মার্শিয়ল, আর্সেনালের আলেকজান্দ্রে লাকাযেত, টটেনহ্যামের মুসা সিসোকো এবং মার্সেইয়ের দিমত্রি পায়েতকে। তারমানে দেশঁ যাদের দলে নিয়েছেন তাদের এলেমটা নিয়ে একবার ভাবতেই হয়। বিশ্বকাপ জিতলে দেশঁ ছুঁয়ে ফেলবেন কোচ এবং অধিনায়ক হয়ে বিশ্বকাপ যেতার রেকর্ড, যার একমাত্র নজির রয়েছে জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের। ১৫ই জুলাই লুঝনিকি স্টেডিয়ামে এই কৃতিত্ব ছুঁয়ে ফেলতেই পারেন দেশঁ কারণ ফ্রান্স এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার। দলে রয়েছেন অধিনায়ক অভিজ্ঞ গোলরক্ষক হিউগো লরিস। রয়েছেন বার্সেলোনা এবং রিয়েল মাদ্রিদের ডিফেন্সের দুই স্তম্ভ স্যামুয়েল উমতিতি এবং র‍্যাফায়েল ভারান। মাঝমাঠে আছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্টার পল পোগবা, লেস্টার সিটি এবং চেলসির প্রিমিয়ার লিগ জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি ন’গোলো কাঁতে আর জুভেন্তাসের নিয়মিত সদস্য ব্লেইস মাতুইদি। ফরওয়ার্ড লাইনে রয়েছেন এই মুহূর্তে ইউরোপের অন্যতম স্ট্রাইকার আন্তোয়া গ্রিজম্যান। তাকে সঙ্গ দিতে বেছে নেওয়ার তালিকায় থাকবেন চেলসির অলিভিয়ের জিরু, বার্সেলোনার ওসুমানে ডেম্বেলে এবং প্যারিস সাঁ জাঁর কিলিয়ন এমবাপে। কারেন্ট ফর্মের ভিত্তিতে এই বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ দল বেছেছেন দেশঁ। যাদের নাম নেওয়া হল প্রত্যেকেই এই বছর দারুণ ছন্দে রয়েছেন। এই গ্রুপ থেকে তাই ফ্রান্সের পরের রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯৯%। ফ্রান্সের সাথে এই গ্রুপে রয়েছে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনকারী দেশ পেরু। দক্ষিণ আমেরিকা গ্রুপে পঞ্চম হয়ে নিউজিল্যান্ডের সাথে ইন্টার কন্টিনেন্টাল প্লে অফ খেলে যোগ্যতা অর্জন করেছে পেরু। গতবছর তাদের স্টার এবং অধিনায়ক পাওলো গুরেরো ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ায় তার বিশ্বকাপ খেলাতে প্রশ্নচিহ্ন পড়ে গেছিল। বিশ্ব অ্যান্টি ডোপিং এজেন্সির আপিলে তার ব্যান একবছর থেকে বাড়িয়ে চোদ্দ মাসের করা হয়, কিন্তু পরবর্তীকালে সুইস ফেডারাল ট্রিবিউনাল সেই রায়ের উপর স্টে অর্ডার বসায় এবং গুরেরোর সামনে সুযোগ এসে যায় বিশ্বকাপ খেলার। এছাড়াও এই গ্রুপের বাকি দলের অধিনায়ক হিউগো লরিস, মাইকেল ইয়েদিনাক এবং সিমন কেয়ারের সই করা চিঠি জমা পড়ে ফিফা দপ্তরে যাতে লেখা ছিল গুরেরো বিশ্বকাপে খেললে তাদের কোনও আপত্তি নেই। এতসব বিতর্ক সত্ত্বেও একদা বায়ার্ন মিউনিখে দাপটের সাথে খেলে যাওয়া গুরেরো বিশ্বকাপ খেলবেন এবং তার দিকে চেয়ে থাকবে গোটা পেরু। তিনি ছাড়াও দলে জেফারসন ফারফানের মতো গোলস্কোরার এবং আন্দ্রে কারিওর মতো গতিশীল উইঙ্গার রয়েছেন। আর আছেন সাও পাওলো ক্লাবের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ক্রিস্তিয়ান কুয়েভা, যার ওপর অনেক দায়িত্ব থাকবে খেলা তৈরি করার। তবে গ্রুপের বাধা টপকাতে গেলে ডেনমার্কের কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে পরতে হবে পেরুকে। এই গ্রুপে অস্ট্রেলিয়া দলটা হয়তো সব থেকে দুর্বল। ফ্রান্স তো বটেই, এমনকি ডেনমার্কও বেশ অনেকটাই এগিয়ে তাদের থেকে। ১৯৭৪ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলার পর এই নিয়ে পর পর চারবার বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলছে অস্ট্রেলিয়া। তাদের হাল আমলের সাফল্য বলতে ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে এএফসি এশিয়ান কাপ জয় করা। দলে অধিকাংশ ফুটবলার ইউরোপের ক্লাবে খেলেন, কিন্তু ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে খেলা বদলে দেওয়ার মতো খেলোয়াড় এই দলে নেই বললেই চলে। দলের সব থেকে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হলেন বহু যুদ্ধের সাক্ষী আটত্রিশ বছর বয়সী স্ট্রাইকার টিম কাহিল এবং তেত্রিশ বছর বয়সী মিডফিল্ডার এবং অধিনায়ক মাইকেল ইয়েদিনাক। গোলরক্ষক ম্যাথু রায়ান এবারের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ব্রাইটনের হয়ে কিছু ভাল পারফরমেন্সের জন্য অভিজ্ঞ ডানি ভুকোভিচের জায়গা নিয়ে নেবেন বলে আশা করা যায়। মোটের ওপর একটা ম্যাচে বাকি কোনও দলের পয়েন্ট খেলেও অস্ট্রেলিয়ার পরের রাউন্ডে যাওয়ার রাস্তা বেশ কঠিন। অপরদিকে ডেনমার্কের সামনে পেরু ম্যাচটা উতরে দিলে সুযোগ থাকবে পরের রাউন্ডে যাওয়ার। লড্রাপ ভাইদের সাথে একদা মাঠ কাঁপানো পিটার স্মাইকেল না থাকলেও বাবার উত্তরাধিকারী হিসাবে দলে রয়েছেন পুত্র ক্যাস্পার স্মাইকেল। লেস্টার সিটির স্বপ্নের প্রিমিয়ার লিগ জয়ের অন্যতম সদস্য দেশের হয়েও একই ভেল্কি দেখাবেন কিনা সেটা সময় বলবে, তবে এই বিশ্বকাপে তার দিকে ডেনমার্কবাসীর নজর থাকবে। ক্যাস্পার ছাড়াও নজর থাকবে অধিনায়ক সিমন কেয়ারের দিকে। তবে এই দলের সব থেকে বড় স্টার হলেন টটেনহ্যাম হটস্পারের মিডফিল্ডার ক্রিস্তিয়ান এরিকসেন, যিনি গোল করতে ও করাতে সমান দক্ষ। তিনি যদি এবারের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ফর্মটা ধরে রাখতে পারেন তাহলে ডেনমার্কের পরের রাউন্ডে যাওয়ার পথটা আরও প্রশস্ত হবে। এরিকসেনের সাথে স্প্যানিশ ক্লাব সেল্টা ভিগোর উইঙ্গার পিওনে সিস্তোর জুটিটা যদি ঠিকঠাক কাজ করে তাহলে ফ্রান্সের ম্যাচে পয়েন্ট ভাগাভাগি করতেও হতে পারে ডেনমার্ককে।

এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য ম্যাচ :

গ্রুপ ডি:

আর্জেন্টিনা, ক্রোয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, আইসল্যান্ড

এই গ্রুপটাকে বলা যেতে পারে এই বিশ্বকাপের সবথেকে অনিশ্চয়তায় ভরা গ্রুপ। আপাতদৃষ্টিতে এই গ্রুপ থেকে আর্জেন্টিনা এবং ক্রোয়েশিয়ার পরের রাউন্ডে যাওয়া উচিত কিন্তু নাইজেরিয়া এবং আইসল্যান্ড বিশ্ব ফুটবলে জায়ান্ট কিলার ট্যাগধারী দুই দেশ। নাইজিরিয়া ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ অভিষেকেই সে বছরের সেমিফাইনালিস্ট বুলগেরিয়াকে গ্রুপ ম্যাচে হারিয়ে শেষ ষোলোয় উঠেছিল। ১৯৯৮-এ স্পেনকে গ্রুপলিগ থেকে ছিটকে দিয়েছিল এবং তারপরে বহু অঘটন ঘটিয়েছে আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে। গত নভেম্বরেই আর্জেন্টিনাকে পিছিয়ে থেকে ৪-২ গোলে পর্যুদস্ত করে তারা। সেই আর্জেন্টিনাই কপালের ফেরে তাদের গ্রুপ সঙ্গী। তাই নাইজেরিয়ার আরেকবার অঘটন ঘটানোর সম্ভাবনা ফেলে দেওয়া যায় না। নাইজেরিয়া দলের অধিনায়ক এবং একদা চেলসিতে এগারোটা সিজন খেলে যাওয়া অভিজ্ঞ জন ওবি মিকেলের দিকে নজর থাকবে। ওনার সাথে আরেক বর্তমান চেলসি তারকা ভিক্টর মোজেসের উপরেও নির্ভর করবে অনেক কিছু। তবে নাইজেরিয়া দলের মূল সম্পদ হল আক্রমণাত্মক ফুটবল এবং তাই তাদের আক্রমণভাগের দুই প্রধান অস্ত্র আর্সেনালের অ্যালেক্স ইওবি এবং সিএসকেএ মস্কোর আহমেদ মুসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আগের বিশ্বকাপেও নাইজিরিয়া এবং আর্জেন্টিনা একই গ্রুপে ছিল এবং এক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর আর্জেন্টিনা ম্যাচটা ৩-২ গোলে জিতে নেয়। সেই ম্যাচে নাইজেরিয়ার হয়ে দুটি গোলই করেছিলেন আহমেদ মুসা। অনিশ্চয়তায় ভরা এই গ্রুপের রং একটা ম্যাচেই বদলে যেতে পারে এবং তা হলে নাইজেরিয়ার পরের রাউন্ডে যাওয়ার রাস্তা সোজা হবে। এই গ্রুপের আরেক জায়ান্ট কিলার আইসল্যান্ডের এটাই প্রথম বিশ্বকাপ। ২০১৬ সালে তারা নিজেদের প্রথম ইউরো কাপের মূলপর্বে উঠে সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিল। সেবার তারা শেষ ষোলোতে তারকাখচিত ইংল্যান্ড দলকে হারিয়ে পৌঁছে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। এবারেও তারা সেরকম কোনও অঘটন ঘটালে ফুটবলপ্রেমীরা আশ্চর্য হবেন না। দলের মূল আকর্ষণ হলেন এভার্টন ক্লাবের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার গিলফি সিগরসন। তার সাথে নজর থাকবে একই পদবীর রাগ্নার সিগরসনের দিকে, যিনি গত ইউরোতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন। এরা দুজন ছাড়াও ডাচ ক্লাব পি এস ভি আইন্ডহোভেনের তরুণ স্ট্রাইকার আলবার্ট গুডমুন্দসনের চোরাগোপ্তা গতির ওপরে ওপরে আস্থা রেখেছেন কোচ হাইমির হলগ্রিমসন। আইসল্যান্ডের এই দলের সব থেকে বড় শক্তি হল যে তারা তারকানির্ভর ফুটবল খেলে না। দলগত সংহতির ওপর ভরসা রেখে খেলাটাই এদের প্লাস পয়েন্ট। তাই নিজেদের দিনে এরা এই গ্রুপের অনেক হিসেবনিকেশ ওলটপালট করে দিতে সক্ষম হবে বলেই বিশ্বাস। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আইসল্যান্ড এবারের বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনের গ্রুপে ক্রোয়েশিয়াকে দুই নম্বরে ফেলে সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে। মূলপর্বের গ্রুপে তাদের সামনে আবার ক্রোয়েশিয়া। সেই খেলায় কী যে হবে তা অতি বড় ফুটবল বিশেষজ্ঞও এখন থেকে বলতে পারবেন না। এই সূত্র ধরে আসা যাক ক্রোয়েশিয়ার কথায়। এই গ্রুপের দলগুলির মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী দল হল ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯৮-তে অভিষেকেই ব্রোঞ্জ মেডেল জিতে নেওয়া সাবেক যুগোস্লাভিয়া ভেঙে তৈরি হওয়া এই দেশটা গত দুই দশকে বহু স্টারের জন্ম দিয়েছে। ডাভর সুকেরের দেশের এটা পঞ্চম বিশ্বকাপ হতে চলেছে। মাঝে শুধু ২০১০ বিশ্বকাপে তারা যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এই দলে এই মুহূর্তে ইউরোপের প্রথম সারির লিগগুলোতে খেলা কিছু স্টার ফুটবলার রয়েছেন যারা নিজেদের দিনে একাই ম্যাচের রং বদলে দিতে পারেন। যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন দলের অধিনায়ক এবং রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিভাবান মিডফিল্ডার লুকা মডরিচ, রিয়াল মাদ্রিদেরই ম্যাতেও কোভাসিচ, বার্সেলোনার ইভান রাকিতিচ। এইরকম ঝাঁঝালো মিডফিল্ডের বাড়ানো বলে গোল করার জন্য থাকবেন জুভেন্তাসের মারিও মান্ডুকিচ এবং ইন্টার মিলানের ইভান পেরিসিচ। যে কোনও দলের ডিফেন্সের জন্য এরকম আক্রমণভাগ দুঃস্বপ্নের কারণ হতে পারে। ১৯৯৮-এ ব্রোঞ্জ পাওয়ার পর বাকি বিশ্বকাপগুলোতে গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে ক্রোয়েশিয়াকে। এবার তা পাল্টায় কিনা সেটা দেখতে উৎসুক থাকবেন ক্রোট ফুটবলপ্রেমীরা। সব শেষে আসা যাক এই গ্রুপ এবং বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অন্যতম প্রধান দাবিদার এবং গতবারের ফাইনালিস্ট আর্জেন্টিনার কাছে। এবারের যোগ্যতা অর্জন পর্বে কোনওমতে পাশ মার্ক্স পেয়ে কোচ সাম্পাওলির দল রাশিয়া চলেছে। বলা ভাল তাদের রাশিয়া নিয়ে চলেছে বহু ফুটবল বিশেষজ্ঞের মতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার লিওনেল মেসি। পর্তুগালের ক্রিস্তিয়ানো রোনাল্ডোর মতো মেসিও পাঁচবার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন। জিতেছেন চারটে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ফিফা বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল। বিশ্ব ফুটবলে এই মুহূর্তে সব থেকে চর্চিত নাম হল লিওনেল মেসি। তিনটি কোপা আমেরিকা এবং একটি বিশ্বকাপের ফাইনালে হারার যন্ত্রণা ভোলাতে মেসি এবারে প্রস্তুত। এটাই হয়তো দেশের হয়ে তার শেষ টুর্নামেন্ট, তাই এবারে নিজের দুশো শতাংশ উজাড় করে দিতে পারেন তিনি। মেসির ওপরেই যে আর্জেন্টিনা দল নির্ভরশীল সেটা বলাই বাহুল্য তবে মেসি ছাড়াও এই দলে রয়েছে অভিজ্ঞতাআর তারুণ্যের মিশ্রণ। দলে একদিকে যেমন রয়েছেন হ্যাভিয়ের ম্যাসচেরানো, দি মারিয়া, ওটামেন্দির মতো কিছু প্রবীণ খেলোয়াড়, সেরকমই রয়েছেন প্যারিস সাঁ জাঁর জিওভানি লো সেলসো, জুভেন্তাসের বিস্ময় বালক পাওলো ডিবালা, বোকা জুনিয়র্সের ক্রিস্তিয়ান প্যাভনের মতো ছটফটে তরুণেরা। তবে প্রচুর বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এবারে বিশ্বকাপে এসেছে আর্জেন্টিনা। প্রথমে যোগ্যতা অর্জন পর্বে ক্রমাগত হোঁচট, তারপর চোট আঘাতের কারণে দলের প্রথম গোলরক্ষক সের্জিও রোমেরো এবং উইঙ্গার ম্যানুয়েল লানজিনির ছিটকে যাওয়া। এত সব বাধা অতিক্রম করে শেষ হাসিটা আর্জেন্টিনা এবং মেসি হাসবেন কিনা সেটা সময় বলবে কিন্তু অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও খুব বড় অঘটন না হলে এই গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডে চলে যাবে আর্জেন্টিনা।

এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য ম্যাচ :

গ্রুপ ই:

ব্রাজিল, কোস্টারিকা, সুইজারল্যান্ড, সার্বিয়া

এই গ্রুপে চোখ রাখবেন বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ কারণ এই গ্রুপে রয়েছে এবারের বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম ফেভারিট ব্রাজিল। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ষোলো বছরের খরা চলছে, তারা কোনওমতেই চাইবে না সেটা বেড়ে কুড়ি হয়ে যাক। ব্রাজিলের ফুটবল আবেগ আর উন্মাদনা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বলার নেই তাদের দেশের ফুটবলার তৈরির ক্ষমতা নিয়ে। ব্রাজিলবাসীরা গতবার নিজের দেশে সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার যন্ত্রণা হয়তো ভোলেনি। এবারের ব্রাজিল দলের কাছে তাই কাপ জয়ের অতিরিক্ত অনুপ্রেরণা থাকবে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ব্রাজিল দল গত বারো বছরের শ্রেষ্ঠ দল। দক্ষিণ আমেরিকার যোগ্যতা অর্জন পর্বে একনম্বর হয়েছে এই ব্রাজিল দল। শেষ কয়েকটা ম্যাচ বাকি থাকতেই তারা মূলপর্বে চলে যায়, এমনি ছিল তাদের দাপট। বিশ্বকাপে ডিফেন্সে রিয়েল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের হ্যাটট্রিককারী মার্সেলোর সাথে ভরসা যোগাবেন অভিজ্ঞ থিয়াগো সিলভা। মাঝমাঠে আছেন বার্সেলোনার কুটিনহো এবং পাওলিনহো। তাদের সাথে থাকবেন ম্যানচেস্টার সিটির ফারনান্দিনহো আর রিয়েল মাদ্রিদের ক্যাসিমিরো। ব্রাজিলের ফরওয়ার্ড লাইন নিয়ে যাই বলা হোক সেটা কম পড়বে। বিশ্বের সব থেকে দামি ফুটবলার এবং অসম্ভব প্রতিভাধর নেমার ব্রাজিল দলের আক্রমণের প্রধান অস্ত্র। গতবার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার সাথে চোট পেয়ে তার বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি সেই আফসোসটা এবার সুদে আসলে তুলে নিতে চাইবেন। নেমারের সাথে আক্রমণভাগে থাকবেন লিভারপুলে মহম্মদ সালাহর পার্টনার রবার্তো ফারমিনহো যিনি এই সিজনে দারুণ ফর্মে আছেন। এরা দুজন ছাড়াও ব্রাজিলের কোচ তিতের হাতে আরও দুজন উৎকৃষ্ট আক্রমণভাগের ফুটবলার আছেন যারা হলেন জুভেন্তাসের ডগলাস কোস্তা আর ম্যানচেস্টার সিটির গ্যাব্রিয়েল হেসু। এই গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডে ব্রাজিল তো যাবেই, সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। তদুপরি এই ব্রাজিল এবারে চ্যাম্পিয়ন না হলেই সেটা হবে এই বিশ্বকাপের সবথেকে বড় অঘটন। ব্রাজিল ছাড়া এই গ্রুপে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। আগে অনেকবার বিশ্বকাপ খেললেও ২০০৬ থেকে টানা মূলপর্বে খেলে আসছে তারা। বিশ্বকাপের ইতিহাসে তারা তিনবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেললেও গত তিনটি বিশ্বকাপে তারা একবার গ্রুপলিগ থেকে এবং দুবার শেষ ষোলো থেকে বিদায় নিয়েছে। তাদের বিশ্বকাপ জয়ের আশা নেই বললেই চলে, তবে এই গ্রুপ থেকে কোস্টারিকা আর সার্বিয়ার সাথে তুল্যমূল্য লড়াই করে তারা পরের রাউন্ডে যেতেই পারে। দলে চেনা মুখ বলতে আর্সেনালের অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার এবং দলের অধিনায়ক স্তেফান লাইখস্টাইনহার, এসি মিলানের ডিফেন্ডার রিকার্ডো রডরিগেজ, আর্সেনালের মিডফিল্ডার গ্রানিট ঝাকা। তবে দলের খেলা অনেকটাই নির্ভর করবে তাদের স্টার স্ট্রাইকার জার্দান শাকিরির ওপর। গত ইউরো এবং বিশ্বকাপে শাকিরি ভাল ফর্মে ছিলেন। এবারেও তিনি একই ফর্মে থাকলে পরের রাউন্ডে যেতে পারে সুইজারল্যান্ড। এই গ্রুপের আরেক দল হল কোস্টারিকা যারা আগের বিশ্বকাপের চমক ছিল। গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড, ইতালি এবং উরুগুয়ের সাথে এক গ্রুপে পড়েও সেই গ্রুপ থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ডে যায় কোস্টারিকা। শেষ ষোলোতে গ্রিসকে হারিয়ে তারা প্রথমবারের জন্য খেলে নেয় কোয়ার্টার ফাইনাল। এবার তারা স্বাভাবিকভাবেই চাইবে আগেরবারের মতো ফল করতে। গতবারে বিশ্বকাপের পর তাদের গোলরক্ষক কিলর নাভাস ডাক পায় রিয়েল মাদ্রিদের মতো বড় ক্লাবে। তিনি গত দুটি সিজন ধরে রিয়েলের প্রথম গোলরক্ষক, তাই তার দিকে নজর রাখতেই হবে। এছাড়াও দলের অধিনায়ক ব্রায়ান রুইজ সেই দেশে স্টারের সম্মান পান। তিনিও গত বিশ্বকাপে দারুণ খেলেছিলেন এবং এই বিশ্বকাপে একইরকম ফর্মে থাকতে চাইবেন। এরা ছাড়া পঁচিশ বছর বয়সী ফরওয়ার্ড জোয়েল ক্যাম্পবেলকে আর্সেনাল ক্লাব গত ছয় বছর ধরে বিভিন্ন ক্লাবে লোনে খেলিয়ে পরিপক্ব করেছে। দেখা যাক তিনি এবারের বিশ্বকাপে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন কিনা। কোস্টারিকা যদি গতবছরের ফর্মের ধারেকাছে থাকে তাহলে সার্বিয়া আর সুইজারল্যান্ডের বাধা পেরিয়ে পরের রাউন্ডে যাওয়া তাদের কাছে যথেষ্ট সোজা হবে। এই গ্রুপের শেষ দল সার্বিয়া। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার থেকে ভাঙতে ভাঙতে সার্বিয়া দেশ হিসাবে এটা তাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। প্রথমবার তারা যোগ্যতা অর্জন করে ২০১০ বিশ্বকাপে। এই গ্রুপটা এমনই যে এখানে দ্বিতীয় হওয়ার জন্য তিনটি দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। সার্বিয়া সেই তিন দলের মধ্যে পরের রাউন্ডে যাওয়ার অন্যতম দাবিদার। তাদের দলে ইউরোপের কিছু নামী ক্লাবে খেলা অভিজ্ঞ ফুটবলার রয়েছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একদা চেলসিতে খেলা ব্রানিস্লাভ ইভানোভিচ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নেমানিয়া ম্যাটিচ, এ এস রোমার অ্যালেক্সান্ডার কোলারভ যিনি দলের অধিনায়কও। এরা ছাড়াও নজর থাকবে ফুলহ্যামের স্ট্রাইকার আলেকজান্ডার মিত্রোভিচের উপর, যিনি এই সিজনে সতেরো ম্যাচে বারো গোল করেছেন।

এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য ম্যাচ :

গ্রুপ এফ:

জার্মানি, সুইডেন, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া

এই গ্রুপে রয়েছে বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি। গতবারের স্বপ্নের জার্মান দল থেকে মিরোস্লাভ ক্লোসে, ফিলিপ লাহম, ব্যাস্তিয়ান শোয়াইনস্তাইগার, লুকাস পোডলস্কি, পার মার্টেসাকাররা না থাকলেও কোচ জোয়াকিম লো দারুণ দল গড়েছেন। এবারের বিশ্বকাপে ভাল ফল করতে পারে জার্মানি যেমনটা তারা সিংহভাগ বিশ্বকাপেই করে এসেছে। এই গ্রুপ থেকে সুইডেন এবং মেক্সিকো ম্যাচ উতরাতে একটু কষ্ট করতে হলেও পরের রাউন্ডে জার্মানি যাচ্ছেই সেটা এখন থেকেই বলে দেওয়া যায়। চোট সারিয়ে দলে ফিরেছেন গোলরক্ষক, অধিনায়ক এবং গত বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক ম্যানুয়েল ন্যয়ার। তিনি কোনও কারণে আবার চোট আঘাত পেলে দ্বিতীয় গোলরক্ষক হিসাবে তৈরিই আছেন বার্সেলোনার হয়ে এবছরে তুখোড় ফর্মে থাকা টের-স্টেগেন। ডিফেন্সে ভরসা যোগাবেন গতবারের বিশ্বজয়ী ম্যাট হামেলস্ এবং জেরম বোয়াটেং। রাইট ব্যাকে কিংবদন্তী ফিলিপ লাহমের জায়গায় এবারে খেলবেন বায়ার্ন মিউনিখে দারুণ ফর্মে থাকা তরুণ জশুয়া কিমিচ। মাঝমাঠে থাকছেন অভিজ্ঞ মেসুত ওজিল, স্যামি খেদিরা, ইল্কে গুন্ডোগান এবং রিয়েল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের হ্যাটট্রিককারী টোনি ক্রোস। ফরওয়ার্ড লাইনে থাকবেন এই মুহূর্তে বিশ্বের সব থেকে কার্যকারী স্ট্রাইকার এবং ২০১০-এ সোনার বুটজয়ী থমাস মুলার আর বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের মার্কো রয়েস। কোচ জোয়াকিম লোয়ের সব থেকে বড় শক্তি হল তার রিজার্ভ ফুটবলারদের সম্ভার। কেউ তার দলের জন্য অপরিহার্য নয়। একজন চোট পেয়ে বসে গেলে বা না খেলতে পারলে তার জায়গায় খেলার মতো যোগ্য লোক রয়েছে লোয়ের হাতে। এই দলগত সংহতির ওপর ভর দিয়ে তাই আরেকবার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখতেই পারে জার্মান ফুটবলপ্রেমীরা। গ্রুপের পরবর্তী দল হল সুইডেন, যারা বারো বছর পর বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলছে, তাও আবার তাদের সুপারস্টার জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচকে দলে না নিয়েই। দলের কোচ জান অ্যান্ডারসনকে সাংবাদিকরা ইব্রাহিমোভিচকে না নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করতে তিনি রেগেমেগে তাদের বলেন যে তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড় এবং তার দল ইব্রাহিমোভিচকে ছাড়াই বারো বছর পর বিশ্বকাপের মূলপর্বে উঠেছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন না করে খামকা কেন অন্য একজনকে নিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে সেটা তার বোধগম্য হচ্ছে না। এখানেই বোঝা যায় যে অ্যান্ডারসন জোয়াকিম লোর মতো দলগত সংহতিতে বিশ্বাস করে দল গড়েছেন এবং দলের সাফল্য নিয়ে আশাবাদী। দলে চেনা মুখ বলতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডিফেন্ডার ভিক্টর লিন্ডেলফ, সোয়ানসি সিটির মার্টিন ওলসন এবং হাল সিটির সেবাস্তিয়ান লারসন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের এই তিন পরিচিত ফুটবলার ছাড়া আলাদা করে নজর থাকবে লিপজিগের উইঙ্গার এবং প্লেমেকার এমিল ফর্সবার্গের ওপর। মেক্সিকোর বাধা টপকে দিলে সুইডেনের পরের রাউন্ডে যাওয়াটা কঠিন হবে না। মেক্সিকো বিশ্বকাপের এক চেনা মুখ। তারা হাল আমলে প্রায় প্রতিবারই মূলপর্বে খেলেছে এবং প্রতিবারই শেষ ষোলোতে হেরে বিদায় নিয়েছে। তাদের অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার এবং বার্সেলোনার প্রাক্তনী রাফায়েল মার্কেজ এই নিয়ে নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলবেন এবং তার সাথে ছুঁয়ে ফেলবেন নিজের দেশের আন্টোনিও কারবাহাল এবং জার্মান কিংবদন্তী লোথার ম্যাথাউসের সর্বাধিক বিশ্বকাপ খেলার রেকর্ড। তার সাথে নজর থাকবে গতবার বিশ্বকাপের বিস্ময় গোলরক্ষক গিলেরমো ওচোয়ার দিকে। গতবার ব্রাজিলের সাথে উনি যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন। এছাড়াও নজর থাকবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রাক্তন কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের জহুরির চোখে খুঁজে আনা স্ট্রাইকার হ্যাভিয়ের ‘চিচারিতো’ হারনান্দেজ। তিনি যদিও এখন সেরকম ফর্মে নেই কিন্তু কথায় বলে Form is temporary but class is permanent, তাই ছন্দ ফিরে পেলে চিচারিতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতেই পারেন। এরা দুজন ছাড়াও অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার জিওভানি ডস স্যান্টোস আর তরুণ ফরওয়ার্ড হিরভিং লজানোর উপরে অনেক আস্থা রয়েছে মেক্সিকান কোচ হুয়ান কার্লোস ওসোরিওর। সুইডেন-মেক্সিকো ম্যাচটা ঠিক করে দেবে জার্মানির সাথে কারা দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে। এই গ্রুপের সবথেকে দুর্বল দল হল দক্ষিণ কোরিয়া। ২০০২-তে গাস হিডিঙ্কের নিজেদের দেশে বিশ্বকাপে চতুর্থ হলেও তারপরে দক্ষিণ কোরিয়ার আর সেই ঝাঁঝ দেখা যায়নি। ২০১০-এ শেষ ষোলোতে গেলেও গতবার তারা গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায় নেয়।২০১৫-তে এ এফ সি এশিয়া কাপের ফাইনালে তাদের হার হয় অস্ট্রেলিয়ার কাছে, অর্থাৎ এশিয়াতেও তারা নিজেদের আধিপত্য আস্তে আস্তে হারিয়েছে। এই দক্ষিণ কোরিয়া দল ধারে ভারে তাদের ২০০২-এর সেরা দলটার থেকে অনেক পিছিয়ে। এবারেও তাই এই গ্রুপ থেকে গ্রুপ লিগ টপকানো তাদের পক্ষে বেশ কঠিন হবে। তবুও নজর থাকবে টটেনহ্যাম হটস্পারের সন হিউং-মিন এবং এবারের উয়েফা ইউরোপা লিগের সেমিফাইনালিস্ট রেড বুল সালজবার্গের হোয়াং হি-চ্যানের উপর।

এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য ম্যাচ :

গ্রুপ জি:

ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, পানামা, তিউনিশিয়া

এই গ্রুপটা বেশ সহজ এবং সোজাসাপটা গ্রুপ। অবশ্যই ইংল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের জন্য। মস্ত বড় কোনও অঘটন না ঘটলে এই দুই দল হাসতে হাসতে পরের রাউন্ডে চলে যাবে। প্রথমে আসা যাক ইংল্যান্ডের কথায়। ১৯৬৬-তে বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে প্রতিবার ভাল দল গড়েও ইংল্যান্ড একবার ছাড়া সেমিফাইনালের মুখ দেখতেই পারেনি এটা ইংল্যান্ড সমর্থকদের একটা বড় দুঃখের জায়গা। ২০১৭-তে যুব বিশ্বকাপ ঘরে তোলার পর এবার মূল বিশ্বকাপটা ইংল্যান্ডে যায় কিনা সেটাই দেখার। কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। একসময়ে ইংল্যান্ড দলের নিয়মিত মুখ গ্যারেথ সাউথগেট এবার ইংল্যান্ড দলের কোচ। তিনি এবার এমন আক্রমণাত্মক দল বানিয়েছেন যেন দল একটা গোল খেলে দুটো গোল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। দলে রয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দাপানো কিছু আক্রমণভাগের খেলোয়াড় যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন দলের অধিনায়ক এবং টটেনহ্যাম হটস্পারের এবছরের সর্বাধিক গোলদাতা হ্যারি কেন। এছাড়াও আছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মার্কাস র‍্যাশফোর্ড, ম্যানচেস্টার সিটির রাহিম স্টারলিং, লেস্টার সিটির জেমি ভার্ডি এবং আর্সেনালের ড্যানি ওয়েলবেক। যে কোন দলের কাছে এরকম আক্রমণভাগ থাকলে সেই দলের কোচের ছক সাজাতে মারাত্মক সুবিধা হয়ে যায়। ইংল্যান্ড দলের মাঝমাঠে রয়েছেন টটেনহ্যাম হটস্পারের দুই প্রধান ফুটবলার ডেলে আলি আর এরিক ডায়ার। একই ক্লাবে খেলার দরুন এদের বোঝাপড়া যে ছন্দে থাকবে তা বলাই বাহুল্য।এরা ছাড়াও মাঝমাঠে থাকবেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জেসি লিনগার্ড এবং লিভারপুলের জর্ডান হেন্ডারসন। শক্তপোক্ত মাঝমাঠ হলেও ফরওয়ার্ড লাইনের মতো বৈচিত্র্য নেই এখানে, শক্ত দলের বিরুদ্ধে এই ব্যাপারটা একটু ভোগাতে পারে ইংল্যান্ডকে। ডিফেন্সে অভিজ্ঞ গ্যারি কাহিল, অ্যাশলে ইয়াং, কাইল ওয়াকার থাকলেও তা চিন্তায় রাখবে সাউথগেটকে। গ্রুপের অপর শক্তিশালী দল হল বেলজিয়াম, যাদের এই মুহূর্তে খাতায় কলমে ইউরোপের সবথেকে শক্তিশালী দল বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। দলে রয়েছেন অধিনায়ক এবং চেলসি ফুটবল ক্লাবের অন্যতম ফুটবলার এডেন হ্যাজার্ড, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সুযোগসন্ধানী স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু, ডর্টমুণ্ডের মিশি বাতশুয়াই, টটেনহ্যাম হটস্পারের মুসা ডেম্বেলে, ম্যানচেস্টার সিটির কেভিন ডি ব্রুইন এবং ভিনসেন্ট কম্পানি, নাপোলির ড্রিস মার্টেন্স, চেলসির গোলরক্ষক থিবো কর্তোয়া। এনারা প্রত্যেকেই বিশ্ব ফুটবলের এক একটা সাড়াজাগানো নাম। এই দলের গভীরতা এমনই যে ভাবতে অবাক লাগে দলে জায়গা পাননি ফর্মে থাকা এ এস রোমার অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার রাদজ্জা নায়াঙ্গোলান। আগেই বলেছি পরের রাউন্ডে বেলজিয়ামের যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। তবে এই দলের প্রত্যেকে যদি নিজেদের নামের ওজন অনুযায়ী খেলতে পারেন তাহলে এই বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদারদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে বেলজিয়াম। গ্রুপের বাকি দুই কম শক্তিধর দল হল তিউনিশিয়া এবং পানামা। তিউনিশিয়া দলে পরিচিত মুখ বলতে ফ্রেঞ্চ ক্লাব রেনের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ওয়াহবি খাজরি এবং একদা লেস্টার সিটিতে খেলা ইউহান বেনালুয়ান।তারা বারো বছর পর বিশ্বকাপের মূলপর্বে উঠে তাদের দেশবাসীর আশা ইতিমধ্যেই পূরণ করে দিয়েছে, তাই বিশ্বকাপে এই গ্রুপ থেকে শেষ ষোলোতে যাওয়া তাদের কাছে বিশ্বকাপ জয়েরই সমান হবে। আপাতত তাদের প্রথম লক্ষ্য থাকবে গ্রুপে অন্তত পানামাকে হারানো। এই বিশ্বকাপেই পানামার অভিষেক হতে চলেছে। তাদের কোচ এরনান দারিও গোমেজ বিশ্বের মাত্র চারজন কোচের একজন যারা তিন বা তার বেশি দেশকে বিশ্বকাপের মূলপর্বে তুলেছেন। এর আগে এই নজির ছিল বোরা মিলুতিনোভিচ, ওঁরি মিশেল এবং কার্লোস আলবার্তো পেরেইরার। পানামা দলের অধিকাংশ ফুটবলারই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাবগুলোতে খেলে। তাদের দলের একমাত্র চেনা মুখ ডিফেন্ডার রোমান টোরেস। পানামাও চাইবে তাদের প্রথম বিশ্বকাপে অন্তত একটা ম্যাচ জিততে এবং তা তিউনিশিয়ার সাথে।

 

এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য ম্যাচ:

গ্রুপ এইচ:

পোল্যান্ড, সেনেগাল, কলম্বিয়া, জাপান

আগের গ্রুপের মতো চূড়ান্ত অঘটন না ঘটলে এই গ্রুপেও দুটি দলের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়া উচিত। তারা হল পোল্যান্ড এবং কলম্বিয়া। হতে পারে পোল্যান্ড বারো বছর পর বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলছে কিন্তু তাদের দলের গভীরতা বলে দেয় যে তারা সহজে হাল ছাড়বে না। বরুসিয়া ডর্টমুন্ড আর বায়ার্ন মিউনিখে গোলের বন্যা বইয়ে দেওয়া চরম স্কিলফুল স্ট্রাইকার রবার্ট লেওয়ান্ডোস্কি এবং নাপোলির আর্কাদিউস মিলিকের জুটি যে কোনও দলের ডিফেন্সের কাছে ত্রাস হয়ে যেতে পারে। এরা দুজন ছাড়াও ডর্টমুন্ডের অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার লুকাস পিচেক এবং এ এস মোনাকোর কামিল গ্লিকের উপর নির্ভর করবে পোল্যান্ডের ডিফেন্স। মাঝমাঠে গ্রেগর ক্রিচভাকের খেলার ওপর নির্ভর করবে ফরওয়ার্ডে লেওয়ান্ডোস্কি এবং মিলিকের সাপ্লাই লাইন, তাই বিপক্ষের নজর থাকবে তাকে আটকানোর দিকে। ক্রিচভাকের সাথে উইংয়ে উলফসবার্গের অভিজ্ঞ জাকুব ব্লাসজিকোস্কির বোঝাপড়াই এবারের পোল্যান্ড দলের মূল সম্পদ। সেনেগালের সাথে কোনওরকম অঘটনে পয়েন্ট না খোয়ালে পোল্যান্ডকে শেষ ষোলোতে দেখা যাবে। গ্রুপের পরবর্তী দল কলম্বিয়া হয়তো ধারে ভারে এই গ্রুপের সব থেকে শক্তিশালী দল এবং তার কারণ অবশ্যই বায়ার্ন মিউনিখের হামেস রডরিগেজ। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে বায়ার্নে আসা ইস্তক রডরিগেজ দারুণ ফর্মে রয়েছেন। গতবারের গোল্ডেন বুটজয়ী এবারেও নিজের ভেল্কি দেখাতে প্রস্তুত থাকবেন বলেই আশা করা যায়। রডরিগেজ ছাড়াও কলম্বিয়া যার দিকে চেয়ে সেই রাদামেল ফালকাও গতবার চোটের কারণে বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি। এবারে তিনিও মুখিয়ে থাকবেন গতবারের দুঃখ ভোলাতে। এছাড়াও দলে জুভেন্তাসের হুয়ান কুয়াদ্রাদো, এসি মিলানের ক্রিস্তিয়ান জাপাতা, ভিয়ারিয়েলের কার্লোস বাকার, আর্সেনালের ডেভিড ওস্পিনার মতো স্টারেরা রয়েছে। চ্যাম্পিয়ন না হলেও নক আউট পর্বে বেশ অনেকটা দূর পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা রাখে এই কলম্বিয়া দল। দলের হাল আমলের সাফল্যের পিছনে আর্জেন্টিনীয় কোচ হোসে পেকারম্যানের অবদান অনেকটাই। ২০০২-তে অভিষেকেই কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যাওয়া সেনেগাল বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্র থেকে যেন হারিয়েই গিয়েছিল। সেবারে প্রথম ম্যাচেই ফ্রান্সকে কুপোকাত করে সকলকে চমকে দিয়েছিল তারা। দীর্ঘ ষোলো বছর পর সেনেগাল আবার মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর মাঝে গত হয়েছেন ২০০২-এর স্বপ্নের দলের কোচ ব্রুনো মেতসু। হারিয়ে গেছে পাপা বৌবা দিওপ, খালিলু ফাদিগা, এল হাজি দিউফের মত সেই দলের ফুটবলারেরা। কিন্তু ফিরে এসেছেন আলিউ সিসে। ২০০২-এর সেই দলের অধিনায়ক এবারে সেনেগাল দলের কোচ। দলে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে খেলা প্রতিভাবান ফুটবলারেরা রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম লিভারপুলে মহম্মদ সালাহ আর রবার্টো ফারমিনহোর স্ট্রাইকিং পার্টনার সাদিও মানে। মানের ওপরে সেনেগালের সাফল্যের অনেক কিছু নির্ভর করবে। মানে ছাড়া দলে পরিচিত মুখ বলতে রয়েছেন নাপোলির ডিফেন্ডার কালিদু কৌলিবালি, ফ্রেঞ্চ ক্লাব রেনের স্ট্রাইকার দিয়াফ্রা সাখো এবং স্টোক সিটির মামে বিরাম দিউফ। সেনেগালকে শেষ ষোলোতে যেতে গেলে ২০০২-এর মতোই অঘটন ঘটাতে হবে কলম্বিয়া বা পোল্যান্ডকে হারিয়ে। এই গ্রুপে ধারেভারে সবথেকে দুর্বল দল হল জাপান। যদিও ১৯৯৮-এ বিশ্বকাপ অভিষেকের পর থেকে তারা প্রতিবারই মূলপর্বে খেলেছে, পাঁচবার এ এফ সি এশিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন হলেও বিশ্বকাপে ২০০২ আর ২০১০-এ শেষ ষোলোয় যাওয়া ছাড়া আর কিছুই সেরকম করতে পারেনি তারা। এবারেও এই গ্রুপ থেকে কলম্বিয়া, পোল্যান্ড আর সেনেগালের বাধা টপকে তাদের পরের রাউন্ডে যাওয়ার আশা খুব ক্ষীণ। তবুও নজর থাকবে একদা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং বর্তমান বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের মিডফিল্ডার শিনজি কাগাওয়ার দিকে। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের হাতে গোনা কয়েকটি ভুলের মধ্যে কাগাওয়া অন্যতম হলেও তার স্কিল নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। কাগাওয়া ছাড়া নজর থাকবে লেস্টার সিটির শিনজি ওকাজাকি আর মার্সেইয়ের হিকোরি সাকাইয়ের দিকে।

এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য ম্যাচ :

এই গেল এবারের বিশ্বকাপের আটটি গ্রুপের প্রিভিউ। যারা এই প্রথম উৎসাহ নিয়ে বিশ্বকাপ দেখতে বসছেন বা অনেকগুলি বিশ্বকাপ দেখলেও অতটা খবর রাখেন না, আশা করব এটা তাদের জন্য বিশ্বকাপের গাইডবুকের কাজ করবে। তো আর দেরি কিসের? শুরু হয়ে যাক বিশ্বের সুন্দরতম খেলার মহাউৎসব।