দুই প্রধান এবং বাংলার ফুটবল

শুভাশিস রায়চৌধুরী

 

বাঙালির জাত্যভিমানের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ফুটবল। আমরা যারা বাঙালি এবং ফুটবল ভালোবাসি তারা মনে মনে এই ধারণাই পোষণ করি যে আমাদের সঙ্গে আর যাই নিয়ে লাগতে এসো না কেন বাছা কিন্তু ফুটবল নিয়ে কদাপি নয়। যদিও সে ধারণা সম্পূর্ণ ভুল সেটা বলা মনে হয় না ঠিক হবে। তার কারণ অবশ্যই আমাদের অতীতের গৌরব। যেখানে আমাদের বাংলা বত্রিশবার সন্তোষ ট্রফি জিতেছে সেখানে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী পাঞ্জাব জিতেছে মাত্র আটবার। চারগুণ এগিয়ে থেকে আমাদের এ অহংকার খাতায় কলমে অবশ্যই ন্যায্য। কিন্তু ব্যাপারটাকে যদি একটু তলিয়ে দেখা যায় তাহলে সেই অহংকারের বুদবুদ ফাটতে এক মুহূর্তও লাগবে না। এখানে একটা ব্যাপার শুরুতেই বলে দেওয়া ভালো। শুধু কটা সন্তোষ ট্রফি জিতেছে সেটা ভারতের একটা রাজ্যের ফুটবলের মানের একমাত্র মাপকাঠি না, তবে অন্যতম একটা মাপকাঠি তো বটেই। এর সঙ্গে আসে সেই রাজ্য থেকে জাতীয় দলে কজন খেলছে অথবা সেই রাজ্যের ক্লাবগুলির দেশের প্রধান লিগে কীরকম ফল করছে ইত্যাদি অনেক বিষয়। সব মিলিয়েমিশিয়ে যদি দেখা যায় তাহলে খুব সহজেই বোঝা যায় যে ফুটবল এখনও বাঙালির থাকলেও তাতে বাংলার ক্লাবগুলির আধিপত্য যেন একটু পড়তির দিকে।

ভারতীয় ফুটবলের শ্রেষ্ঠ ক্রাউডপুলার যে মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল সেটা কোনও ভারতীয় ফুটবলপ্রেমী অস্বীকার করতে পারবে না। সুকুমার রায়ের ভাষায় বললে বাংলার ফুটবলকে নাইয়েখাইয়ে সযত্নে শুকোতে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব এই দুই ক্লাবই পালন করে আসছে বহুদিন ধরে। কিছু বছর আগে পর্যন্ত এদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যা করে আসছিল মহামেডান ক্লাবও, কিন্তু পেশাদারিত্বের অভাবে সেই ক্লাবের সম্বল এখন শুধুই অতীতের গৌরব। গোদের ওপর বিষের ফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে ফেডারেশনের ঔদাস্য, যার কারণে সমর্থকদের মাঝে লেগে গেছে আই লিগ এবং আইএসএল নিয়ে কাজিয়া। এতদিন ধরে আই লিগকে ফেডারেশন ঠিকমতো প্রোমোট করতে পারেনি কিন্তু রিলায়েন্স পয়সা ঢেলে যেই আইএসএল শুরু করল অমনই তাকে সুয়োরানির মর্যাদা দিয়ে ফেডারেশন আই লিগকে বানিয়ে ফেলল দুয়োরানি। দেশের অন্যতম লিগ হিসাবে আইএসএল এখন ফেডারেশনের নয়নের মণি। এর ফলস্বরূপ সবার নজর এখন আইএসএলের দিকে। ভারতের জাতীয় দলের কোচ স্টিফন কনস্ট্যান্টাইন নিজের দলে একমাত্র একজনকে নিয়েছেন আই লিগ থেকে। ইস্টবেঙ্গলের সালাম রঞ্জন সিং। বাকি একুশ জন খেলোয়াড় নিয়েছেন আইএসএল থেকে। অবশ্য তাঁকে দোষও দেওয়া যায় না। দেশের সেরা সব ফুটবলাররা যারা আগে আই লিগে খেলতেন তারা এখন আইএসএলেই খেলেন। আইএসএলের ক্লাবগুলির মোটা অঙ্কের অফার, বিদেশে ট্রেনিং, উন্নত সুযোগসুবিধার জন্য ফি বছরেই বহু খেলোয়াড় আই লিগ ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে আইএসএলে। আলোচনাটা যেহেতু বাংলার দুই প্রধান ক্লাব নিয়ে সেহেতু এটাও বলে রাখা দরকার যে জাতীয় দলে নারায়ণ দাস, প্রীতম কোটাল, প্রণয় হালদার, প্রবীর দাস, শুভাশিস বোসদের মতো খেলোয়াড় থাকলেও তাঁদের কেউ আর কলকাতার দুই প্রধানে খেলেন না। অথচ একটা সময়ে জাতীয় দলের সিংহভাগ খেলোয়াড়ই আসতেন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল থেকে।

ফেডারেশনের ঔদাস্যের ঘাড়ে কামান রেখে চালালেও বাংলার দুই প্রধানের দোষও এতে কম কিছু নেই। একটা ধুঁকতে থাকা দেশের ফুটবল ফেডারেশন ধনী রিলায়েন্সের ছুঁড়ে দেওয়া হাড় সঙ্গে সঙ্গে মুখে তুলে নেবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু আমরা যখন বুঝেই গেছি যে ফেডারেশন রিলায়েন্সের সুতোর টানে নেচে আইএসএলকেই দেশের প্রধান লিগ বানাতে উদ্যত সেখানে আমরা সেই প্রধান লিগের অংশ হওয়ার চেষ্টা কেন করব না? বাংলার দুই প্রধান ক্লাব আইএসএল খেলব খেলব করেও এখনও আই লিগেই রয়েছে, কারণ আইএসএলে খেলতে নাকি যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন তা এই দুই দলের কাছে ছিল না। যেখানে কয়েক বছর আগে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্লাবগুলো নামী দামি স্পনসর পেয়ে গেল সেখানে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো বিশাল ফ্যানবেসের একশো বছরের ঐতিহ্যশালী ক্লাবেরা স্পনসর পাচ্ছে না সেটা মানতে কোথায় যেন একটু কষ্ট হত। দুই প্রধানের মাথারা নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সমর্থকদের অনুভূতি আর খেলোয়াড়দের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলতে এই বাহানা ব্যবহার করতেন তা বলাই বাহুল্য। খেলোয়াড়রা পেশাদার তাই তাঁরা ইস্ট-মোহন ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু সমর্থকেরা তো আর দলবদল করতে পারে না! তাই তাঁদের চোখের জল সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুকিয়ে গেছে। তবুও প্রশংসা করতে হয় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থকেরা গঠনমূলক আন্দোলন করে কয়েকমাস আগে ক্লাবে নিয়ে এসেছে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগকারী। হয়তো তারা পরের বছর আইএসএল খেলবে কিন্তু মোহনবাগান ক্লাবের ব্যাপারে এখনও রয়েছে ধোঁয়াশা। কী হবে কেউ জানে না। আদৌ কিছু হবে কিনা সেই ব্যাপারটাও চরমরকমের অস্পষ্ট।

আইএসএলে কলকাতার একটি দল এটিকে আছে বটে, কিন্তু তাদের সমর্থক সংখ্যা দুই প্রধানের তুলনায় নগণ্য। সেই দল দুইবার আইএসএল জিতলেও বাংলায় তাদের জনপ্রিয়তা নেই। দুই প্রধানের একশো বছরের ঐতিহ্যের সামনে তাদের রং অনেকটাই ফিকে। ইস্টবেঙ্গল যদি পরের বছর আইএসএলে খেলে সেক্ষেত্রে এটিকে যে এক বিরাট চাপের সম্মুখীন হবে সেটা বলাই বাহুল্য। কোনওভাবে যদি মোহনবাগানও পরের বছর আইএসএলে খেলে তাহলে দুই প্রধানের মাঝে স্যান্ডুইচ হয়ে এটিকে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে। তবে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল আইএসএল খেললেও যে বিরাট কিছু পরিবর্তন হবে তা নয়। সবার আগে বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি। বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে দল চালাতে হবে যা করা হয় বিশ্বের ফুটবলোন্নত দেশগুলিতে। সমর্থকদের হতে হবে ধৈর্যবান এবং সর্বোপরি সময় দিতে হবে দলকে। এইসব যদি ঠিকমতো করা যায় তার ফল কী হতে পারে সেই উদাহরণ দিয়েছে বেঙ্গালুরু এফসি। মাত্র পাঁচ বছর আগে গড়ে ওঠা ক্লাব নিজেদের প্রথম বছরেই জিতে নিয়েছিল আই লিগ। মাত্র চারবার আই লিগ খেলে তারা দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর একবার রানার্স। জিতে নিয়েছিল দুটো ফেডারেশন কাপ। গতবছর তারা আই লিগ থেকে আইএসএলে এসে প্রথম বছরেই রানার্স হয়েছিল আর জিতে নিয়েছিল সুপার কাপ। অর্থাৎ ক্লাবের জন্ম ইস্তক এমন কোনও বছর যায়নি যেটায় বেঙ্গালুরু এফসি কোনও সর্বভারতীয় ট্রফি জেতেনি। পাঁচ বছরে পাঁচটা ট্রফি, ঈর্ষণীয় পারফরমেন্স। এই পাঁচ বছরে তারা স্থাপন করেছে আরও একটি অনন্য নজির। প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসাবে তারা এএফসি কাপে রানার্স হয়েছে। এএফসি ক্লাব র‍্যাঙ্কিং-এ উঠে এসেছে বত্রিশ নম্বরে। বেঙ্গালুরু এফসি ভারতের সমস্ত ক্লাব ফুটবল সমর্থকদের শিক্ষা দিয়েছে শুধু পয়সা থাকলেই এই গৌরব অর্জন করা সম্ভব না। সেই পয়সাটাকে সঠিক খাতে ব্যবহার করতে শিখতে হবে, তবেই সাফল্য আসবে। ফুটবল খেলাটা এখন শুধু আর মাঠের নব্বই মিনিটেই সীমাবদ্ধ নেই। আর শুধু ফুটবল কেন, যে কোনও স্পোর্টসের ব্যাপ্তি এখন অনেক বড়। স্পোর্টস এখন বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের মতোই সঠিক সূত্রের ব্যবহারে সঠিক ফল লাভ সম্ভব। ঐতিহ্যের কল থেকে টিপ টিপ করে জল পড়ছে। যে কোনও মুহূর্তে তা থেমে যাবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...