Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সারাজীবনের নজরুল ও আশপাশের কথাবার্তা

ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

 

নজরুলজয়ন্তীর দিন সকালে অফিসের পথে গাড়িতে চলমান এফ এমে একটা গান শুনে মনটা, আসলে কানটা, একেবারে বিষিয়ে গেল। তারপরেও যেটা অপেক্ষা করছিল সেটা চমক। ভয়ংকর চমক!

এ কালের একজন নামী শিল্পী গাইলেন সৃজনছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ। ধ্রুপদ স্টাইলেই গাইবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গাইলেন বেশ খারাপ করে। ধ্রুপদের শিক্ষা না থাকলে যা হবার কথা তাই হল আর কি। খুব কষ্ট করে গেয়েছেন, মনে হচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কান ধোওয়ার লক্ষ্যে গাড়ির রেডিও মিউট করে জ্ঞানবাবুর গাওয়া গানটা ইউটিউবে শুনে এ যাত্রা রক্ষে পেলাম!

কিন্তু তারপর যেটা হল সেটা এক ধরণের অ্যাট্রসিটি বললেও কম বলা হয়! এখনকার আরও একজন বিশাল নামী গায়ক গাইলেন। প্রথমটায় ভেবেছিনু সাবান-টাবানের অ্যাড দিচ্ছে বুঝি! যেমন তার বৈচিত্র্য, তেমনই বৈকট্য! এমনিতে গানটাও-– সত্যি বলতে কি-– বেশ বাজে লাগে আমার। খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগরজলে। কিন্তু এই গান যে এত ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে আমি আগে বুঝিনি!

নজরুলের গান আর কবিতা ছোটবেলা থেকেই শুনছি-– আরও অনেকের মতনই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওঁর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অতি সামান্যই আমার ভালো লাগত। তাতে ওঁর হয়ত অতটা দোষ নেই। ওঁর গান গাইতে গেলেই শিল্পীদের এমন প্যাঁচপয়জার দিতে দেখতাম যে গানটা শেষতক আর ভালো লেগে উঠত না। এক মিলিমিটার ট্র্যাকের মধ্যে কতটা গিটিকিরি গুঁজে দেওয়া যায়-– বেশিরভাগ তারই প্রতিযোগিতা যেন! কানে ব্যথা হত।

তবে কবিতার স্বাদ পেয়ে গেছি কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তিতে। বিদ্রোহী, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে ইত্যাদি তো জানে সকলেই। মনেও রাখে। এইদুটো মনে পড়ছে? হে মোর রাণি, হার মানি আজ শেষে / আমার বিজয়কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে। বা, তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ, ক্ষমা করো হজরত / ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমার দেখানো পথ, অথবা শাতিল আরবের ওই লাইনগুলো-– লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ বেদুইনদের চাঙ্গা শির নাঙ্গা শির / শামসের হাতে আঁশু-আঁখে হেথা মূর্তি দেখেছি বীর নারীর… এখনও ভাবলে গা শিরশির করে। কবি নজরুলের সঙ্গেই আমার প্রথম ঘনিষ্ঠতা। কম্পোজার নজরুল এলেন অনেক পরে।

আমাদের রবীন্দ্র-আকুলতার শুরু না কি ১৯৬১-তে, কবির জন্মশতবর্ষের হৈহাল্লার পর থেকে। আমার জন্মের পর, সুতরাং, রবি ঠাকুর দেবতারূপে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। বাকী সকলে নেহাত ঘেঁটু, মনসা ইত্যাদি স্থলাভিষিক্ত। প্রথম এক থেকে দশ রবি-রবি-রবি, তারপর থেকে নজরুল, দ্বিজেন্দ্র, রজনী ইত্যাদি কম্পোজারদের নম্বর। বাংলা গানের বাজার, আর গান-শুনিয়ে বাঙালি বাবুর চিন্তার জমিনটিতে অতঃপর কেবলই রবিশস্যের চাষ। ওই সর্ষের ক্ষেতে ফুল হয়ে ফুটে উঠলেন রবিঠাকুর। দোষ কারও নয় গো মা! এমতাবস্থায়, ঘরে-ঘরে চর্চা থাকলেও নজরুলের গান তার বাজারী গরিমার কিছুটা হারাল। ফলে, নামী শিল্পীদের ঝোঁক থেকে গেল-– সৌরমণ্ডলের বাইরে-– সমকালীন ‘আধুনিক’ গানে। রবিঠাকুরের গানে দাঁত বসানোও সহজ নয়। বিশ্ব আছেন, ভারতী আছেন, আছেন তাঁদের শত ছেলে… সুতরাং, খেলাটা সীমাবদ্ধ হয়ে থাকল রবীন্দ্র বনাম সমকালীন গীতিকার-সুরকারদের মধ্যে। সেই সময়ে কলকাতার সবথেকে জনপ্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে পেলেন না নজরুল। সত্যি কথা বলতে নজরুলের বেশিরভাগ গান গাওয়া তাঁর সাধ্যাতীত ছিল। সেই অপ্রিয় প্রসঙ্গে আর ঢুকছি না। এর ওপরে, নজরুলগীতির নামী শিল্পীরা বয়েসের ভারে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে অপারগ। সেও একটা সমস্যা ছিল বৈ কী!

ফলতঃ, নজরুল তাঁর গান নিয়ে এলেও আমার সাড়া পেলেন না।

ব্যতিক্রম কিছু অবশ্যই ছিল। ছেলেবেলা থেকে শোনা কিছু গান– ওই ছুটকো-ছাটকা ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল ইত্যাদি। মোহম্মদ রফির উচাটন মন ঘরে রয় না, পাষাণের ‘ভাঙ্গালে’ ঘুম, আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন ইত্যাদি… আর আশির দশকে অবশ্যই অনুপ জলোটার গানগুলো। সখি, সে হরি কেমন বল। বা, তিমির বিদারি অলখবিহারী কৃষ্ণমুরারী আগত ওই। বহুদিন ধরে মনে রেখেছি গানগুলো। এমনকি, মোরা তব চরণে ‘শরণাঙ্গত’-– সেটাও। এছাড়া, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, ফিরোজা বেগম, সুপ্রভা সরকার এঁদের কথা শুনতাম খুব। তবে গান তেমন ভালো লাগত না। তার কারণ, সম্ভবত, তাঁদের গাইবার ধরণ মনে ধরত না ওই বয়েসে।

নজরুলের গান ভালো লাগতে শুরু করল অনেক পরে। ভালো লাগা বলতে যা বোঝায় সেটা হল মোটে বছর পনেরো আগে। যখন জোগাড় করলাম জ্ঞানবাবুর গানগুলো।

তিরিশ বছরে এত শুনলাম নজরুলের গান, কিন্তু এই গানগুলো শুনলাম কই?! ছেলেবেলা থেকে যেই গানগুলো বেশি শুনেছি সেগুলোর প্রায় সবই হয় দেশভক্তির নয়তো চটুল প্রেমের, বা চটুলভাবে গাওয়া প্রেমের গান। এই প্রথম আমি সেই গানগুলো পেলাম যাদের জন্য নজরুলকে সার্থক সঙ্গীতস্রষ্টা বলে মনে করতে পারি। বুঝতে এতটা সময় চলে গেল। আজি নন্দলালমুখচন্দ্র নেহারি, আয় মা উমা রাখব এবার ছেলের সাজে সাজিয়ে তোরে, ভারত শ্মশান হল মা তুই শ্মশানবাসিনী বলে, মা গো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়, শূন্য এ বুকে, মম মধুর মিনতি শোনো… এই ভক্তির গানগুলোতে শুদ্ধভক্তি তো আছেই। আরও আছে দেবার্চনার মোড়কে দেশভক্তির কথা।

ইদানীং শুনছি আমাদের ‘আসলি’ দেশের ‘আসলি’ দেশভক্তেরা ঠিক করেছেন একজন ‘ছহি হিন্দু কবি’ হিসেবে কাজীসাহেবকে প্রতিষ্ঠা করবেন। এই নিয়ে দু-চার কথা না বললেই নয়।

একদিকে মনে তীব্র ঘৃণার সঞ্চার করে-– যেমন করে হাঁপানি রুগী কঠোর অধ্যাবসায়ে অন্তঃস্থ কফকে ফেলার নিমিত্ত মুখগহ্বরে নিয়ে আসেন – দেশকে বিধর্মী (ও দলিত) মুক্ত না-করে তাঁদের শান্তি হচ্ছে না। আর একদিকে ভোট বড়ো বালাই! বাঙালির আবার ভোট ছাড়া প্রগতিশীলতার বালাইও আছে! এই জন্যেই কবি বলেছেন-– মায়াচুম্বুক কলে ফেলছে ঘরে জগতের জীবে! যাই হোক, নজরুল হবেন হিন্দু কবি। কারণ তিনি হিন্দু দেবদেবী নিয়ে ভজনার গান লিখেছেন। সৈয়দ মুর্তজা বা নাসের মামুদও লিখেছিলেন। আলিরাজার কালীকীর্তনের কথাও আমরা জানি। এঁরা কেউ না। নজরুল। কারণ নজরুলের ব্র্যান্ড ভ্যালু আছে। নজরুল ব্র্যান্ড দিয়ে হিন্দু সুপারব্র্যান্ডকে জোরদার করে তোলা হবে।

কিন্তু নজরুলকে হিন্দু কবি বলে দাগিয়ে দিলে তাঁর অসংখ্য ইসলামী গানের কী হবে? আমাদের বাংলায় ইসলামী সঙ্গীতের একটা সুপ্রাচীন ধারা আছে, এবং নজরুল সেই ধারাকেও তাঁর সৃষ্টির ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই প্রাচীন ইসলামী গান যদি শোনা যায়-–

আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালুহু

শেষ করা তো যায় না গেয়ে তোমার গুণগান

তুমি কাদের গফফার, তুমি জলিল জব্বার

অনন্ত অসীম তুমি রহিম রহমান।।

আল্লাহ-র এই নাম সংকীর্তনে ‘অনন্ত অসীম’ যেই মুহূর্তে যোগ হল, গান হয়ে উঠল বাংলার। কোনও মুসলমানের বা কোনও হিন্দুর নয়। এই যে ভক্তিমার্গ, আমাদের অন্ত্যজ সংস্কৃতি এই মার্গের পথিক। নজরুল এই পথ চিনেছিলেন এই পথের ধুলো অঙ্গে মেখে। জমিদারী বোটে বসে নয়। নজরুলের রক্তে এই ভক্তি অবলীলায় মিশবে এ আর নতুন কী কথা!

আসলে, দেশভক্তেরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, আমাদের দেশে ভক্তিচর্চার যে ধারা প্রবাহিত হয়েছে, তার প্রতি এঁরা কখনই শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারেননি। ঈশ্বরভক্তি এঁদের মুখ্য চাহিদা নয়, চাহিদা-– সসাগরা পৃথিবী যেন শুধু ওঁদেরই ভোগ্যা হন। এর নাম ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ। এই যুদ্ধটা মনে মনে চালাতে হয়। এই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার প্রধান শক্তি হিসাবে সমাজের সবথেকে ‘নীচু’ এবং ‘অশিক্ষিত’ স্তর থেকে উঠে এসেছে ওই ভক্তিবাদ যার কথা আগে বললাম। এই ভক্তিবাদ ব্রহ্মণ্যবাদের অচলায়তনের বিরূদ্ধে দৃপ্ত বিদ্রোহ। এই ভক্তিবাদে এইসব দেশভক্তদের বিশ্বাস নেই। নজরুলেও বিশ্বাস নেই এঁদের। বিশ্বাস শুধু ধান্দায়।

গানের কথায় ফেরা যাক।

শুধু জ্ঞানবাবু কেন? ইন্দুবালার কণ্ঠে রুমুঝুম রুমুঝুম কে এলো নুপূর পায়ে, সখি বলো বঁধুয়ারে, অঞ্জলী লহো মোর, কেউ ভোলে না কেউ ভোলে, মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর। আঙুরবালার এত জল ও কাজল চোখে, আমার যাবার সময় হল, আসিলে এ ভাঙ্গা ঘরে, বিদায়সন্ধ্যা আসিল ওই। যূথিকা রায়ের ওরে নীল যমুনার জল। হরিমতীর ঝরা ফুলদলে কে অতিথি। ধন্য হয়ে গেলাম। শুনে ফেললাম ললিতমোহন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে হে প্রবল দর্পহারী আর জয় নারায়ণ অনন্ত রূপধারী বিশাল।

এই জয় নারায়ণের প্রসঙ্গে বলি, এমন কিছু গান পেলাম, যার মূল গান হিন্দীতে। আর সেই মূল গানের বাংলায় রূপান্তর করেছেন নজরুল ও রবিঠাকুর দুজনেই। যেমন-– চরণধ্বনি শুনি তব / মুরলীধ্বনি শুনি’ ব্রজনারী, বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা / জয় নারায়ণ অনন্ত রূপধারী বিশাল।

বলার কথা এই যে, রবিঠাকুর যেমন সঙ্গীতসমুদ্র থেকে মণিমুক্তো তুলে নিয়ে নিজের কাজকে সাজিয়েছিলেন, নজরুল ঠিক তা করেননি। বৈষ্ণবের পদে ভাবপ্রসঙ্গে নুনের পুতুলের কথা আসে। নুনের পুতুল যেমন সাগরে নিজেকে নিঃশেষে মিশিয়ে দেয়, ভক্তও তেমনি ‘সর্বনাশ’ করে নিজেকে বিলীন করেন ঈশ্বরে। নজরুলের ক্ষেত্রে এই ভক্তিভাবের রূপটাই যেন দেখতে পেয়েছি। সঙ্গীতের সমুদ্রে ডুব দিয়েছেন। ডুবে থেকেছেন, যতদিন মন সঙ্গ দিয়েছে।

এই দু’জনের প্রসঙ্গে আরও একটা কথা মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের গানকে আমরা যতটা নষ্ট করতে পেরেছি, সেই অনুপাতে নজরুলের গান অনেক ভালো অবস্থায় আছে বলে মনে হয়। প্রচলিত সঙ্গীতকাঠামোগুলোর কাছে নজরুলের গানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণই তাঁর গানকে একরকম বাঁচিয়ে দিল, এই কথাই মনে হয় আজকাল। সকলের চেনা যে সুর, সেই সুরেই নজরুল নিজের গানকে বাঁধলেন। ধ্রুপদ ধ্রুপদ থাকল, ঠুংরী ঠুংরী, ঝুমুরেরও শব্দভার ছাড়া আর কিছু বইতে হল না যা তার নিজের নয়।

কিন্তু, কাঠামোর বাইরে রবিঠাকুরের প্রতিটা গানের শরীরের ভেতর বসে থাকেন স্বয়ং তিনি। তাঁর গানের যেন তিনিই একেশ্বর। সবকিছুর পুনঃসংজ্ঞায়ন করবার চেষ্টা তাঁর আজীবনের। সেই পথে যেতে গিয়ে তাঁর গান হল নির্জন এককের গান। কেউ বলেন— একলা মানুষের কণ্ঠে হাজার পাখির গান। তবে মানুষটা একলাই। একা। তাঁর গান গাইতে গেলে বিভিন্ন পথে শিক্ষা আবশ্যক, কিন্তু যথেষ্ট নয়। টেকনিক ছাড়াও রবি ঠাকুরের গানে যা আছে, তার নাম রবিঠাকুর। তাঁর গানের বারামখানায় বসে থাকেন রবিঠাকুর স্বয়ং।

আজ বহু বছর হল, তিনি আর সাড়া দিচ্ছেন না গানের ভেতর থেকে। তাঁর গান সত্যি অর্থে সর্বহারা হয়েছে। শৃঙ্খলিত, সর্বস্ব অপহৃত। তাঁর গান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকেই। এখন এ গান হাজার মানুষের গান।

যাই হোক, ফেরত আসি নজরুলের কাছেই। নজরুল প্রয়াত হয়েছেন ১৯৭৬ সালে, ঢাকায়। তবে ১৯৪১ সালের পর থেকে আস্তে আস্তে অসুস্থতা তাঁকে গ্রাস করল। সেই গ্রাসের কবল থেকে মুক্তি পেলেন না আর। তাঁর জীবনের শেষ সময়কালটা দেখে তারিখের হিসাবে মনে হচ্ছিল, জ্ঞানে থাকলে শেষ জীবনে হয়ত নকশালবাড়ির স্লোগান লিখে যেতেন মুজফফর আহমেদের বয়ঃকনিষ্ঠ এই বন্ধুটি। বলা তো যায় না কিছু!

 

 

পুনঃ- জানলাম, ১৯১৪ সালের চব্বিশে মে না কি রবিঠাকুর একটা গানে লিখেছিলেন-– ‘মোর জীবনে রাখাল ওগো ডাক দেবে কি সন্ধ্যা হলে?’ সে অবশ্য অনেকদিন আগের কথা। নজরুলের বয়েস তখন মোটে পনেরো। এই ছবিটা দেখে এই গানের কথাগুলোর সঙ্গে মিল পেলাম তাই দেওয়া।