Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বস্তারে বর্ষা

সৌমিত্র দস্তিদার

 

চারপাশটা কালো হয়ে গেছে। হঠাৎ। হঠাৎই। শনশন করে হাওয়া বইছে। মাথার ওপরের বিশাল আকাশ যেন এখনই ভেঙে পড়বে মাটিতে। জঙ্গলের গভীরে, এই শীতের দুপুরে অকাল রাত নেমে এসেছে। ট্যা ট্যা করতে করতে টিয়ার ঝাঁক উড়ে পালাচ্ছে। জায়গাটা বস্তারের দক্ষিণে। ডকুমেন্টারি করব বলে ঘুরে বেড়াচ্ছি মাওবাদী গেরিলাদের সঙ্গে পাহাড়ে জঙ্গলে। ছোট্ট যে স্কোয়াড আমাদের নিত্যসঙ্গী তার টিম লিডার বা বলা ভালো ইউনিট কমান্ডার গণেশ অন্ধ্রের তরুণ। সাত আটটা ভাষা জানে, ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন এই ছাত্রটি এমনিতে হাসিখুশি। কয়েকদিন ধরে একসঙ্গে আছি, ফলে ভালোই সখ্যতা হয়ে গেছে। শুনলাম ওর বউও মাওবাদী নেত্রী। অন্য স্কোয়াডে আছে। কয়েকদিন পরে আমাদের এই চলমান ইউনিটে যোগ দেবে। সে যখন দেবে তখন দেবে। এখন এই আসন্ন বৃষ্টির সম্ভাবনায় সম্ভবত গণেশের মুখও আকাশের মতোই থমথমে। ব্যাজার। আমাদের আশপাশের অন্যান্য গেরিলা– জমরু, জিতরু, পুষ্পাও চিন্তিত। আমার মনে হচ্ছিল বৃষ্টি এলে ওদের রসদ ভিজে যাবে তাই এত চিন্তা। রসদ বলতে হাতের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, একে-৪৭, পিঠের স্যাক, যাতে আছে রাতে শোওয়ার জন্যে প্লাস্টিক বা জিল্লি আর ঠাসা বই ও দু’চারটে জামাকাপড়। মাওবাদী গেরিলাদের শিক্ষা কিন্তু বাধ্যতামূলক। নিরক্ষর থাকা চলবে না। পার্টির নির্দেশ। শুধু নিজেরা শিখলেই হবে না, তাদের ঘাঁটি এলাকার সমস্ত গ্রামের বাসিন্দাদেরও অন্তত সাক্ষর করা মাও রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মেঘ ডাকছে। সারা জঙ্গলে তার সেই ডাক প্রতিফলিত হচ্ছে গভীর সঙ্গীতের মতো। আলোর ঝলকানির মতো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পুরো দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছের নীচে আশ্রয় নিয়েছি। তবে বর্ষায় গাছের তলা যে আদৌ নিরাপদ নয় সেটুকু ধারণা আমার মতো শহুরে বাবুরও আছে। ভরসা একটাই– বৃষ্টি এখনও টিপটিপ করে হচ্ছে আর বাজ একবারই কড়কড় শব্দে দূরে কোথাও পড়েছে। এখন দু-একবার মেঘ ডাকলেও বাজ পড়েনি। মনে হল, এরকম সময়ে কলকাতায় অনেক বাড়িতে শাঁখ বাজে। উলুধ্বনি হয়। অনেকেই একমনে ঠাকুর ঠাকুর করেন বিপদ থেকে বাঁচতে। গণেশকে ভাবলাম জিজ্ঞেস করি– তোমরা তো এই বিপদেও ঠাকুরের নাম নাও না। তাহলে কি মনে মনে মার্কস, লেনিন, মাও সে-তুংয়ের নাম জপ করো! কিন্তু গণেশ এমন রাগী রাগী মুখটা করে আছে, ওর দিকে তাকাতেই ভয় করছে। এমন সময় মাওয়ের আশীর্বাদেই বোধহয়, বলা নেই কওয়া নেই আকাশ পরিষ্কার করে রোদ উঠল। নিমেষে বদলে গেল সবার মুখের ছবি। আলো ঝলমলে বস্তারের রূপই আলাদা। কে বলবে কিছুক্ষণ আগেও এখানে মেঘের মুখ ভারি হয়ে ছিল। পুষ্পা চেঁচিয়ে উঠল– দেখো, দেখো আকাশের দিকে তাকাও। তাকিয়ে দেখি চমৎকার নীল আকাশ জুড়ে মায়াবী রামধনু উঠেছে। আমি রামধনু দেখছি আর অবাক হয়ে দেখছি শিশুর মতো তারা হাততালি দিচ্ছে রামধনু দেখে। এই মেঘবালিকাদের গায়ে জলপাই রঙের পুরোদস্তুর মিলিটারি পোষাক। হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র। যাদের জন্যে সারা দেশ আজ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ‘চরম সন্ত্রাসবাদী’ গেরিলারা তাদের নিয়ে যাবতীয় জল্পনাকে তোয়াক্কা না করে নিবিষ্টভাবে আকাশের রঙের খেলা দেখছে শিশুর সারল্যে। আবার আমরা হাঁটছি। রোজ ১০-১২ কিলোমিটার হাঁটতেই হবে। পথে যেতে যেতে দূরে, বেশ দূরে জলের শব্দ পাচ্ছি। কিছুটা পথ পেরিয়েই দেখি নদী। ওপারে ওড়িশা। নদী এখানে বেশ স্বচ্ছ। জলের রং আকাশের মতোই নীলচে। সামনের গাছে প্রজাপতির রঙও নীলচে। কনে দেখা আলোয় বস্তারকে সুন্দর, মায়াবী লাগছে। বৃষ্টি এখানে কম। তীব্র গরম আদিবাসী জীবনে নিত্যসঙ্গী। লোকগাথা বলে– একদা এই জনপদে সূর্যের তাপ এত প্রবল ছিল যে জীবনযাপন করাই ছিল কঠিন, দুঃসাধ্য। এখানকার জাগ্রত দেবী– দান্তেশ্বরীর কাছে গিয়ে বিহিত চাইল বাসিন্দারা গরম থেকে রেহাই পেতে। দেবী সম্পূর্ণ নগ্ন হলেন ভক্তদের বাঁচাতে। যতদূর দেবী পরিধেয় বস্ত্র দিয়ে ঢাকতে পারলেন তীব্র তাপ থেকে, সে জায়গাটাই বস্তার। বস্ত্র থেকে চলতিভাষায় বস্তার। এসবই গাথা, বিশ্বাস, জনশ্রুতি। ঠিক বেঠিক বলা কঠিন। ঠিক এটাই যে বস্তারের প্রাচীনত্বে কোনও সন্দেহ নেই। নদীর ধারে গাছের গায়ে আরাম করে হেলান দিয়ে জিতরু বাঁশি বাজাচ্ছে। আকাশে আবার একটুকরো মেঘ দেখা গেছে। গণেশ সবাইকে বকাবকি করে তাড়াতাড়ি নদী পার হতে নির্দেশ দিচ্ছে। স্বরূপা কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলছে– গণেশের এত হাঁকডাক, সতর্কতা সব তোমাদের শহরের বাবুদের জন্যে। তিরতিরে কিশোরীর মতো যে নদী এখন বয়ে চলেছে ধীর গতিতে, সেই ভয়ঙ্কর ভয়াল রূপ নিয়ে চরাচর ভাসিয়ে দেবে সামান্য বৃষ্টিতেই। এখন বুঝলাম ঠিক সেজন্যেই পুরো মাওবাদী টিম কিছুক্ষণ আগে আকাশের হাবভাবে কেন অত উদ্বেগে ছিল। এতদিন বাদেও বর্ষার সময় কেন জানি না আমি মনে মনে বস্তারে চলে যাই। বৃষ্টির শব্দে আমার কানেও বেজে ওঠে আদিবাসী মাদলের বোল।