বঙ্গবন্ধু ১০০, মুক্তিযুদ্ধ ৫০: চতুর্থ বর্ষ, অষ্টম যাত্রা

স্টেশন মাস্টার

 

আমি হিমালয় দেখিনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে তিনি হিমালয়ের তুল্য। তাঁকে দেখেই আমার হিমালয়দর্শন হয়েছে।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে এই উক্তিটি করেন ফিদেল কাস্ত্রো। বস্তুত, দুর্দমনীয় সাহস ও একরোখা মনোভাবেই যেন বাংলাদেশ ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেখগুলোতে, ভারতসহ, শেখ মুজিবর রহমানের প্রধান পরিচয়।

তবু এই ভারতেরই এক পাশে রয়েছে পাহাড় আর সমুদ্রে বাঁধা একফালি জমি। এই জমিখণ্ডটির নাম এখন পশ্চিমবঙ্গ। এই জমির ওপর দিয়েই একদা উড়ে গেছে শাহ জালালের কবুতর। তখন এর নাম ছিল অন্য, তবু এখানে সে বসত গড়েনি। সে বসত গড়েছে সেই দেশে, যে দেশ জন্ম দিয়েছে সর্বার্থে দীর্ঘকায় শেখ মুজিবর রহমানের। সে দেশ আর এই একফালি ভূমিসূত্রের মাঝে বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের বন্ধুত্ব ভেদ করে মাথা তুলেছে অবিশ্বাস। তবু আমরা কথা বলি একই ভাষায়। এক বৃদ্ধ ঋষির গান শুনে চোখের জলে বুক ভাসাই, আর একই ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের হিম্মতঘন ডাক শুনে নিজেদের ভাবী মহাভারতের সন্তান। সেই একচিলতে নাড়ির টান থেকে আমাদের আজকের শতবর্ষে উপনীত তরুণ বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করছি।

আমরা আসলে স্পর্শ করতে চাইছি তাঁর ভাবনাকে, যে ভাবনায় একনিষ্ঠ হয়ে তিনি বাঙালি জাতিসত্তাকে ঠাঁই দিয়েছিলেন ধর্মের ঊর্ধ্বে। যে ভাবনায় ভর করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন— শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, সমগ্র বাংলা ও বাঙালির বন্ধু। সেই ভাবনা মহৎ হলেও কায়েমি স্বার্থের কাছে তা ছিল বিপজ্জনক। নিজের প্রাণ দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করে গেছেন।

ঘাতকের বুলেট যখন তাঁকে শেষ করে দিতে চাইছিল, চে-র মত আত্মবিশ্বাসে তিনি কিছু বলে যেতে পেরেছিলেন কি না, তা আমরা জানি না। এটুকু জানি, প্রতিদিন দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধুর ভাবনা জারিত হয়ে চলেছে একের পর এক প্রজন্মে। দেখতে ভাল লাগে, ধর্মগরিমান্ধের আস্ফালনের সামনে তাঁর সন্ততিদের তারুণ্যের স্পর্ধাপ্রদর্শন। ভাল লাগে শত বিকৃতিকে সরিয়ে রেখে, রাজনৈতিক বিভাজনকে দূরে ঠেলে প্রকৃত সংস্কৃতিপ্রেমীদের পাশাপাশি আসা, কাছাকাছি থাকা। ভাল লাগে একতার সুতোটাকে অন্যমনস্ক হাতে ছুঁতে পেরে। এ-সবই বঙ্গবন্ধুর ছড়িয়ে যাওয়া বীজ থেকে জন্মানো শস্যের মাতন।

এই বছর বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ‘মুক্তিযুদ্ধ’-এর সার্ধশতবর্ষ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাই আমরা স্মরণ করছি তাঁর অগণিত সহযোদ্ধাকে। আমাদের এই ডিসেম্বরের রিজার্ভড বগি বঙ্গবন্ধু ১০০, মুক্তিযুদ্ধ ৫০-এ লিখেছেন সেলিনা হোসেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি নিয়ে; রুখসানা কাজলের থেকে আমরা পেয়েছি একজন কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ; সৌমিত্র দস্তিদার মুক্তিযুদ্ধে মওলানা ভাসানীর ভূমিকায় আলোকপাত করেছেন সৌমিত্র দস্তিদার; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের আকাশবাণী কী ভূমিকা রেখেছিল সে কথা শুনিয়েছেন সৈয়দ কওসর জামাল; অর্ক ভাদুড়ি সামগ্রিকভাবে কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকার কথা লিখেছেন। আর মুক্তিযুদ্ধ এক ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য আমরা ইমতিয়াজ আলম খানের একটি স্মৃতিচারণ পুনর্মুদ্রণ করেছি পাকিস্তানের ডন পত্রিকা থেকে। ইমতিয়াজ একজন উর্দুভাষী— যাঁদের বিহারি বলা হত— যিনি সেই সময়ে কর্মসূত্রে ঢাকায় ছিলেন।

গতমাসের প্রয়াণের পরেই আমরা স্মরণ করেছিলাম অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। এই সংখ্যায় রইল আরও ক’টি লেখা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন ক্যাথরিন বার্জ ও সত্যব্রত ঘোষ। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের জীবন ও কাজ নিয়ে লিখেছেন হিন্দোল ভট্টাচার্যবর্ণালী ঘোষ দস্তিদার। এছাড়াও সদ্য প্রয়াত স্পেলিটি লিংডো ল্যাংরিনকে শ্রদ্ধা জানালেন প্রতিভা সরকার

অলোকরঞ্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ গদ্য পুনঃমুদ্রিত করা হয়েছে এবারের স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে।

প্রকাশিত হল একটি বিশেষ অনূদিত আলাপচারিতা, রোমিলা থাপারের সঙ্গে কথা বলেছেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক৷

এই সংখ্যা থেকে শুরু হল নতুন ধারাবাহিক– অরুণপ্রকাশ রায়-এর এ সফর সুফিয়ানা

এছাড়াও যথারীতি রইল সবুজ স্লিপার, কবিতা কর্নার, গল্পের কামরা, প্রবন্ধের ক্যুপ, ধারাবাহিক মালগাড়ি, উইন্ডো সিট, অনুবাদ কেবিন, কেবিন গ্রাফিত্তি, গদ্য কেবিন, হুইলার্স স্টল, ডিসট্যান্ট সিগনাল, অণুগল্পের হল্ট, ভালো খবর সহ সমস্ত নিয়মিত বিভাগ।

পরিশেষে, আমরা সম্মান জ্ঞাপন করছি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে, যাঁরা আরও বহু মুক্তিযুদ্ধে প্রতিদিন সামিল। সেই মুক্তিযুদ্ধ সর্বপ্রকার অসহায়তার থেকে মুক্তির যুদ্ধ, সব অজ্ঞানতার থেকে মুক্তির যুদ্ধ। লিলিপুটদের সম্বন্ধে গালিভার যা বলেছিলেন, সেই intrepidity of … diminutive mortals-এর থেকে মুক্তির যুদ্ধ। আমরা জানি, জিত বাংলাদেশের হবেই।

আরেকটি জরুরি ঘোষণা করে দেওয়া যাক। মেল ট্রেন প্রকাশিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে রওনা দেবে একটি স্পেশাল ট্রেন। দিল্লি-পঞ্জাবের সীমানায় ঘটে চলা কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে আজ থেকে আগামী কদিন রোজ প্রকাশিত হবে আমাদের এই বিশেষ সংখ্যা– যদি দু-একটা বীজ ভিজে ওঠে৷ সমস্ত জড়তা ছুঁড়ে ফেলে বিক্ষুব্ধ কৃষকদের পাশে এবং লুটেরা শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছি আমরা।

চলুন বন্ধুরা… পড়ুন… ভালো থাকুন… আন্দোলনের সঙ্গে থাকুন… শুভরাত্রি!

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...