কলকাতা, পুনশ্চ

অভি বিশ্বাস

 

বিচিত্র ইতিহাস এ শহরের।

১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস যখন তাঁর সমস্ত জরুরি দফতর মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে আনলেন, শুরু হল একশো চল্লিশ বছরের এক অভূতপূর্ব যাত্রা। ভারতবর্ষ পেল তার রাজধানী। লন্ডনের আদলে গড়ে উঠল সেই মহানগরী, যা একদিন মান্যতা পেল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর হিসেবে।

আর শেষ ১৯১১-য়। উগ্র স্বাদেশিক প্রগলভতার টুঁটি চিপে ধরার জন্যে রাজা পঞ্চম জর্জ যখন আদেশ দিলেন রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যেতে। দিল্লিতে।

তারপর, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাও ভাগ হয়ে গেল।

ফেলে যাওয়া বিলাতি আদব-কায়দা ওপার বাংলা থেকে টলতে টলতে আসা রুক্ষ, বিধ্বস্ত বাস্তবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল।

উত্থান হল সমাজতন্ত্রের, সাম্যবাদের। শুরু হল এক নতুন অধ্যায়।

বড় বিচিত্র ইতিহাস এ শহরের।

বিস্ময়ের, গর্বের, নবজাগরণের, লড়াইয়ের, উন্মাদনার, অবক্ষয়ের, টিঁকে থাকার।

যুগ যুগ ধরে কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর, চলচ্চিত্র নির্মাতারা পৃথিবীর সর্বত্র থেকে এসেছেন, থেকেছেন, সয়েছেন এই শহরকে। আর তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে ধরে রেখেছেন শহরের বর্ণময় ইতিহাসকে।

কিন্তু এ সবই ফেলে আসা সময়ের কথা।

আমার কলকাতা আরও সাম্প্রতিক। নতুন শতাব্দীর।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশ এক সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন উপলব্ধি করে। একটা পরিচিত, ছোট গণ্ডি ছেড়ে আমরা হঠাৎ করে বিশ্বায়নের গ্ল্যামারাস পুলে লাফ দিয়ে পড়ি। সাধারণ মধ্যবিত্তের স্বপ্নে ঢুকে পড়ে বিদেশে গিয়ে শিক্ষালাভ, বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি, নিজের বাড়ি, নিজের গাড়ি, প্রবাসে বসবাস। নিম্নবিত্তের স্বপ্নে ঢোকে প্রথমে মধ্যবিত্ত হওয়া, এবং তারপর একই রেখায় জীবনের স্বপ্নগুলোকে সাজিয়ে নেওয়া।

২০১১ সালে, ঘটনাচক্রে রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার ঠিক একশো বছর পরে, বাংলায় কমিউনিস্টদের পতন পূর্ব-ভারতের লাল দূর্গ ধ্বংস করে নিয়ে আসে আরেক নতুন প্রতিশ্রুতি। সারা শহর পরম আগ্রহে গায়ে মেখে নেয় পরিবর্তনের নতুন রং।

আর আজকের কলকাতা?

ঔপনিবেশিক স্থাপত্য, বিশ্বায়নের পসরা আর স্থানীয় উৎসব-অনুষ্ঠানের মনমাতানো ছবির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক দ্বিধাগ্রস্ত ভূমিখণ্ড। মুক্ত অর্থনীতি আর বিরাজমান সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মাঝে আড়াআড়িভাবে আটকে থাকা এক টুকরো সাদা কাগজ।

বিশ্বায়নের নেশায় গোটা দেশ যখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে চলেছে, কলকাতায় যেন সময় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে।

এ শহরে নেই কোনও দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট বা বিরোধ। স্ফুলিঙ্গ যদি বা জ্বলে ওঠে, খুব তাড়াতাড়ি নিভে যায়। নিভে যাওয়ার পর মনেই হয় না কখনও জ্বলেছিল। মানুষ দূর থেকে হাত বাড়িয়ে সেই আগুনের তাপ নেয়, যারা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের দেখে নাটক দেখার মত করে।

এ শহর অচঞ্চল। অপাংক্তেয়। শো-ভাঙা দর্শকদের ফেলে যাওয়া খালি থিয়েটার হলের মত।

এরই সঙ্গে সঙ্গে একবিংশ শতাব্দীর এই প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় আমরা হয়ে উঠেছি তথ্য এবং চিত্রের দাস। আমাদের চাওয়া-না চাওয়া নির্বিশেষে তথ্য এবং চিত্রের দৈনন্দিন ডোজ গ্রহণ করতে আমরা বাধ্য। টিভির পর্দায়, খবরের কাগজে, স্মার্টফোনে প্রতিনিয়ত দেশ, শহর, মাঠ, রাস্তা, মানুষের মুখ বদলে যেতে যেতে থাকে, আর আমরা তা দেখতে থাকি এক আশ্চর্য নির্লিপ্ততায়। একই পোশাক, একই খাবার, একই চিন্তা, একই স্বপ্ন, একই ভয়। নেই কোনও ক্ষোভ, নেই উদ্দীপনা।

এই গা-বাঁচানো, নির্লিপ্ত জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত ভিন্ন মতবাদ, বিরুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির শ্বাসরোধ করে।

অপ্রত্যাশিত কিছু যদি ভেতরটাকে নাড়া দেয়, এমনই একটা ভাবনা নিয়ে আমি এই নতুন যুগের কলকাতার দিকে ক্যামেরার লেন্স ফেরাই। নির্লিপ্ত শতাব্দীর নির্লিপ্ত আমি একান্ত আলাপচারিতায় মেতে উঠি ভারতের এই তৃতীয় জনবহুল শহরের এক সম্পূর্ণ মানববর্জিত রূপের সঙ্গে।

দেখি সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প থেকে ফুটবল প্রেম, সামঞ্জস্যহীন উন্নয়ন থেকে স্থানীয় আর বিশ্বব্যাপীর সহাবস্থান— এবং সর্বোপরি মানুষের পরিস্থিতি— যেন বর্তমান সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিভূ। শহরের বহুস্তরীয় ইতিহাসের এক পুনর্লিখিত দলিল। ছবির ওপর ছবির ওপর ছবি। লেখার ওপর লেখার ওপর লেখা। আর তার সঙ্গে অগুনতি ক্ষুদ্র, সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য এবং নিজস্বতা… জিগস পাজলের সেই অজস্র ছোট ছোট টুকরোগুলো, যা দিয়ে তৈরি জীবন। মানুষের। এই শহরের।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...