মেধাবী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

বর্ণালী ঘোষদস্তিদার

 


লেখক অধ্যাপক, কথাকার, সঙ্গীতশিল্পী

 

 

 

চলে গেলেন পঞ্চাশের দশকে ‘কৃত্তিবাসে’র পঞ্চকবির চতুর্থ অঙ্গ জার্মাননিবাসী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। জন্মেছিলেন ১৯৩৩ সালে। বয়স হয়েছিল সাতাশি বছর।

তিরিশের দশকে বাংলা কবিতার যে রবীন্দ্রবিরোধী ঘরানা তৈরি হয়েছিল তার প্রধান সেনাপতি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘কল্লোল’ ‘কালিকলম’ ‘প্রগতি’ পত্রিকাকে ঘিরে তখন নব্যধারার কবিদের রবীন্দ্রবিরোধী কণ্ঠস্বরের বিপুল উল্লাস-উন্মাদনা। রবীন্দ্রনাথের অবশ্য এই উচ্ছল প্রতিবাদী প্রতিস্পর্ধা তারুণ্য সম্পর্কে স্বভাবসঙ্গত প্রশ্রয়ই ছিল। কারণ বিশ্বকবি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন যে বুদ্ধদেব সুধীন্দ্র বিষ্ণু দে অমিয় জীবনানন্দের মধ্যে একমাত্র জীবনানন্দই ছিলেন একমাত্র রবীন্দ্র-প্রবর্তিত অয়নরেখার ব্যতিক্রমী কক্ষচ্যুত। বাকিরা সবাই কমবেশি সেই রোম্যান্টিক পরম্পরাতেই আছেন। বিদ্রোহ যা কিছু তা বেশিটাই বাহ্যিক, আভ্যন্তরীণ নয়।

রবিঠাকুরকে যেমন মুগ্ধ প্রভাবিত করেছিল ইংরেজ রোম্যান্টিক কবিরা, ৩০-এর কবিদের তেমনই আচ্ছন্ন করেছিল দেশবিদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ, ব্যক্তি-অস্মিতা, মানবাধিকারের সংগ্রাম, আর সেই সূত্রেই বোদলেয়র, রিলকে, র‍্যাঁবো, মালার্মে, হাইনে প্রমুখ ইউরোপীয় কবির দল। অনুবাদের মাধ্যমে বোদলেয়র ও রিলকে-কে বাঙালি পাঠকের সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন বুদ্ধদেব। আর এই সূত্রেই এই প্রজ্ঞাবান, মননশীল অথচ রোম্যান্টিক মনের কবির মনে হয়েছিল শুধু বাংলা কবিতার চৌহদ্দিই নয়, বাঙালি কবিমননকে পাড়ি জমাতে হবে দেশ-জাতি ও সম্প্রদায়ের ভৌগোলিক গণ্ডির বাইরে। এই সুবাদেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসুর উদ্যোগেই খোলা হয়েছিল বিশেষ বিভাগ ‘তুলনামূলক ভাষাসাহিত্য’। এখানেই চর্চিত হতে লাগল দেশি-বিদেশি ক্লাসিক ও আধুনিক সাহিত্য। চলতে লাগল তুলনামূলক আলোচনা, প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার বিচিত্র বিন্যাস।

জার্মান ভাষায় সুপণ্ডিত বাঙালি কবি অলোকরঞ্জন এই বিভাগে অধ্যাপনায় যুক্ত হয়েছিলেন। ছাত্রছাত্রীসঙ্গ, কবিবন্ধু সংসর্গের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল নিয়মিত কবিতা লেখা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যৌবন বাউল’-এর পর ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তাক্ত ঝরোখা’। এরপর প্রকাশিত হয়েছে ‘ছৌ-কাবুকির মুখোশ’ (১৯৭৩), ‘গিলোটিনে আলপনা’ (১৯৭৭), ‘দেবীকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখে’ (১৯৮৩), ‘মরমী করাত’ (১৯৯০)। ‘মরমী করাত’ গ্রন্থটির জন্য তিনি ১৯৯২ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আলোকরঞ্জন পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, সুধা বসু পুরস্কার।

চল্লিশের দশকে বাংলা কাব্যজগৎ স্পষ্ট দুটি সমান্তরাল শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টপাধ্যায়, সমর সেন, রাম বসু, গোলাম কুদ্দুস প্রমুখের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, সাম্যবাদী, বামমুখী, রাজনৈতিক দর্শনমূলক কবিতার ‘গণকণ্ঠী’ ধারা। অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসুদের পরম্পরায় তৈরি হয় রোম্যান্টিক কবিতার ধারা। সমালোচকরা যদিও এই ধারার একটি শৌখিন নাম দিয়েছেন— ‘কলাকৈবল্যবাদী’। তবু কোনও কবিতা বা গদ্যই সমাজনিরপেক্ষ নয়। কোনও সৎ সৃষ্টিই মানুষের উত্তরণের শেষ কথাটি না বলে পারে না। তাই যতই বর্ণবিভাজন হোক না কেন কবিদেরও কোনও স্থূল তকমায় বন্দি করে যায় না।

কবি অলোকরঞ্জনও বুদ্ধদেব ঘরানার কবি হলেও “যুদ্ধ ঠিক শেষ হয়নি, অথবা এখন শান্তি শেষ”— জাতীয় আপাত কড়াধাতের সমাজশাসনের পংক্তিটি লেখেন অনায়াসেই। খুব চিৎকৃত ঢঙে নয়, রাজনীতি দেশকাল বৈষম্যের সমাজ সবকিছু নিয়েই অলোকরঞ্জনও প্রতিবাদী কথা কন মিতভাষে, বিনম্র ভঙ্গিতে।

এখন সবারই তিতুমীর নাম।
এ গাঁয়েই কেন, যেখানেই যাও—
হাসনাবাদে বা বেড়াচাঁপা গাঁয়ে
হাড়ুয়া বাঁশবেড়ুর তলায়
সব জায়গায় সব জায়গায়
ছেলেরাই কেন, যত বুড়োরাও
তিতুমীর নাম সম্বল করে
মরতে চলেছে। আমার নিজেরও
তিতুমীর নাম, ধরে বেঁধে নিয়ে
মেরে ফ্যাল তোরা আমায়, তবুও
নামটা বিকিয়ে দিতে পারব না।
[বাঁশের কেল্লা]

লিখলেন—

যুদ্ধ এখন আর ঘোষিত হয় না, বরং চলতেই থাকে।

অথবা—

শিল্পসরস্বতীকে নজরানা, দিতে হলেও
সুফি কবির ডানা ছেঁটে দেবার
স্পর্ধা কারো ছিল না;
নজরুল যতটা বিপ্লবী ছিলেন
ততটাই মঞ্জুল; এবং যখন
তুলসীদাস বারাণসীর ঘাটে
রামচরিত লিখছিলেন
হিন্দুরা মাতেনি মৌলবাদে—
[ঈর্ষাপ্রবণ]

সংহত জোরালো মেরুদণ্ডসম্পন্ন প্রত্যয়ী গদ্যেও অলোকরঞ্জনের কলম ছিল ধারালো। বর্গ-বিভাজন করতে গেলে তাঁকে হয়ত ‘বিপ্লবী-কবি’-র লেবেল আঁটা যাবে না— তবু কবিকে তো সমকাল থেকেই কুড়িয়ে নিতে হয় কাব্যের উপাদান। সময় সমাজ গরলপ্রসবী হলে কবি শিশিরস্নাত অপাপবিদ্ধ কুসুম কোথায় পাবেন? কবিতাসংগ্রহ-এর পূর্বকথা ‘মিতভাষ’-এ অলোকরঞ্জন লিখেছিলেন— “মার্কিন আক্রমণের দাপটে ঘনিয়ে এলো গালফ যুদ্ধ, আমার জন্য রেখে গেল পূর্বধার্য কাব্যমীমাংসার বদলে চ্যালেঞ্জসঞ্চারী কাব্যজিজ্ঞাসা। জগতজোড়া শরণার্থীদের সঙ্গে আমি তখন থেকে অষ্টপ্রহর সম্পৃক্ত ছিলাম।” একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবিরোধী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে বিশাল পৃথিবীর মানচিত্রে দেশ-দেশান্তরে প্রলয়ঙ্কারী যুদ্ধোন্মাদনায় বাস্তুহারা, ভিটেহারা ছিন্নমুল মানুষের কান্না-আর্তি। কবি তাঁদেরই পাশে আছেন আশ্রয় ও সান্ত্বনার বাণী নিয়ে।

শানিত কলমের ঋজুতায় তাঁর কণ্ঠ ঝলসে উঠেছিল—

আমি তোমাদের এখন যা কিছু বলেছিলাম সমস্তই পাথরে অবরুদ্ধ চিৎকার। স্নায়ুশিরার ভাঁজে ভাঁজে আমি জমিয়ে রাখি যাবতীয় বিক্ষোভ ডিনামাইট দিয়ে তোমাদের দীর্ণ করতে হবে আমাকে। ভালোবেসেই বিস্ফোরণের কাজটা ঘটাতে হবে।

স্বল্পগীত লালন বা রবীন্দ্রগানের মতোই কিঞ্চিৎ অ-লোকপ্রিয় স্বল্পপঠিত, অল্পচর্চিত কবি অলোকরঞ্জন। হয়ত তীক্ষ্ণ মেধার কারণেই ‘পপ্যুলিস্ট’ কালচারের বাইরে। বিদ্যানুরাগী, জ্ঞানানুসন্ধি আদ্যন্ত ‘অ্যাকাডেমিক পার্সন’। কিন্তু তাই বলে সময়ের অগ্নিপ্রদাহ থেকে ছিটকে পড়া নয়। মৌলবাদ সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত তাঁর লেখাগুলি হয়তো আজকের দিনে ‘দেশবিরোধী’ বা ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা পেত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...