স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি

বিষাণ বসু

 

স্বাধীনতার পর দেশ যত এগিয়েছে, দেশের বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবা ততই চলে গেছে সাধারণ ও নিম্নবিত্ত মানুষের হাতের বাইরে। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের বৃহত্তর অংশের সদর্থক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও বিপুল জনসংখ্যার চাপ ধুঁকতে থাকা সরকারি স্বাস্থ্যপরিকাঠামো নিতে পারছে না। অথবা এও বলা যেতে পারে যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত সচ্ছল শ্রেণি আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে বেসরকারি ও বাজারনিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যপরিকাঠামোয়। মানবসেবার ধারণা বিযুক্ত চিকিৎসার এই পণ্যায়ন জন্ম দিচ্ছে নানা জটিলতার, কায়েমি স্বার্থের, দুর্নীতির এবং সবকটি ক্ষেত্রে আক্রান্ত সর্বস্বান্ত হচ্ছে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ। চিকিৎসার এই খোলা বাজারে দাঁড়িয়ে মানবিক অথচ নির্মোহ চোখে নানা সমস্যার বিশ্লেষণ করলেন চিকিৎসক বিষাণ বসু, তাঁর সদ্যোপ্রকাশিত গ্রন্থ 'কিনে আনা স্বাস্থ্য'-এ। এবারের হুইলার্স স্টলে তা থেকেই অংশবিশেষ।

একটা চালু কথা আছে, মাছ কখন জল খায় আর রাজপুরুষ কখন ঘুষ নেন, স্বয়ং দেবতাও জানতে পারেন না, মানুষ তো কোন ছার!!

তা ধরুন, উদাহরণ হিসেবে, পুলিশের কথা বলি। পুলিশের দুর্নীতির কথা বলতে গেলে, আপনার চোখে ভাসে রাস্তার মোড়ে লরি দাঁড় করিয়ে, হাত বাড়িয়ে উৎকোচ গ্রহণ। এই ইমেজটাই সবার আগে মাথায় আসে। তাই না? আর, রাস্তায় পুলিশ লরি দাঁড় করালেই আপনার মনে হয়, দেখেছো, ব্যাটা ঘুষ নেবে!! অর্থাৎ, সব পুলিশকেই আপনি ঘুষখোর ভেবে বসেন এবং পুলিশের যেকোনো কাজের পেছনেই আপনি অসদুদ্দেশ্য খোঁজেন। মানে, পুলিশ যদি সত্যিসত্যি তল্লাশি করার জন্যেও লরি দাঁড় করান, বা গাড়ির কাগজপত্র দেখার জন্যে, আপনার ভরসা হয় না। আর, যেহেতু আপনি ধরেই নিয়েছেন যে পুলিশ মাত্রেই দুর্নীতিপরায়ণ আর তাঁদের সব কাজকম্মোই বিভিন্ন অসদুদ্দেশ্যে পরিচালিত, তাই পুলিশের উপর দুষ্কৃতিরা চড়াও হলে, আপনার বিশেষ কোনো হেলদোল হয় না। একটি ইমেজের ছাঁদে সবাইকে বাঁধতে চাইলে, বা সাধারণীকরণ করতে চাইলে, এইটাই সমস্যা।

অবস্থার ফেরে, ডাক্তারেরাও এখন সেই অবস্থায় পৌঁছেছেন। কিছু ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা করানোর বিনিময়ে কমিশন পেয়ে এবং নিয়ে থাকেন, এর উপর ভিত্তি করে আপনি ধরেই নিচ্ছেন যে, ডাক্তার মাত্রেই কমিশনখোর আর পরীক্ষানিরীক্ষা মাত্রেই কমিশনের লোভে করানো। অতএব, পুরো ডাক্তারি পেশাটার উপরেই আপনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছেন। আর, ডাক্তার আক্রান্ত হলে, সামান্য সহানুভূতিটুকুও জাগা দূরে থাক, উলটে, অনেকসময় মনে হচ্ছে, বেশ হয়েছে, ঠিক শায়েস্তা হয়েছে।

না, আমি একবারও বলছি না যে, ডাক্তারদের মধ্যে কেউই কমিশনের লোভে পরীক্ষানিরীক্ষা করান না, বা তাঁদের সেই কাজ নিন্দনীয় নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি, একই মাপে ফেলে সবার বিচারটি দায়িত্বজ্ঞানহীন, এবং এমন ধাঁচের ভাবনার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী।

এছাড়াও, বিষয়টার অন্য পিঠটাও ভেবে দেখুন। পুলিশের দুর্নীতি বলতেই আপনি যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘুষ খাওয়া বোঝেন, তাহলে আপনি পরিস্থিতির অতিসরলীকরণ করে ফেলছেন। মোক্ষম দুর্নীতির ছবিগুলো থেকে আপনার চোখ সরে আসছে। ধরুন, এই রাজ্যের কিছু  উদাহরণ নিই। যেমন, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণগুলো একে একে বিনষ্ট করা। যেমন, একটি গণ-আন্দোলনের নেতৃত্বকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে আন্দোলনকেই শেষ করা। যেমন, একটি বোমা বিস্ফোরণে মানুষ মারা গেলেও, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ আসার আগেই তড়িঘড়ি জায়গা সাফ করে প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করা। হ্যাঁ, এই দুর্নীতিগুলো বা এর পেছনে যে রাজনৈতিক স্বার্থ বা শ্রেণীস্বার্থ, সেইগুলো আপনার নজরে পড়ে না।

চুনোপুঁটি নিয়ে যদি আপনাকে ভুলিয়ে রাখা যায়, তাহলে রাঘববোয়ালদের ভারী সুবিধে।

সামনে বসে থাকা চিকিৎসককে চিটিংবাজ চশমখোর ভেবেই আপনার গায়ের ঝাল মিটে গেলে, বৃহত্তর সমস্যাটি আপনার নজরের বাইরে রয়ে যায়। চিকিৎসা ব্যবস্থাটিই, অন্তত বাজারচলতি যে চিকিৎসাকাঠামোটা রয়েছে আপনার বা আমার চিকিৎসার জন্যে, সেইটাই যে গলদে ভরা, সেকথা আপনার ক্ষোভের বৃত্তের বাইরে রয়ে যায়। ডাক্তারের উপর ক্ষোভ উগরে দিতে পারলে, ডাক্তারকেই একেবারে কমিশনখোর-অর্থপিশাচ ধরে ঘেন্না করতে পারলে, আপনার ক্ষোভের তাৎক্ষণিক উপশম হচ্ছে। আর সেই সেফটি ভালভের সুবাদে বেঁচে যাচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণীস্বার্থ। ক্ষমতার মানুষেরা সেইটাই চান। আপনার এমন ভুলে থাকায় তাঁরাও খুশী, ডাক্তারকে গালি দিতে পেরে আপনিও খুশী।  তাই না? একটু ভাবুন। ততোক্ষণ পরের গল্পটা বলি।

দ্বিতীয় গল্পটা একটু দূরের। আমেরিকার ফ্লোরিডায়। অবশ্য এমন ঘটনা আমাদের আশেপাশেও ঘটে, কাশ্মীর বা চেন্নাইয়ে বন্যার সময় আচমকা বিমানের ভাড়া কয়েকগুণ হওয়ার ঘটনাগুলো তো বেশীদিনের নয়। কিন্তু, একটু বিদেশী উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা জমকালো হয়।

তা, ফ্লোরিডায় সেবার বড়ো ধরণের ঘূর্ণিঝড় হয়। সব ভেঙেচুরে তছনছ। যাতায়াত ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ পরিষেবা সবই বিপর্যস্ত। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি। এই অসহায় সময়ে, বেশ কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ী মোটা টাকা মুনাফার সন্ধানে মাঠে নামেন। জিনিসপত্রের দাম হয় আকাশছোঁয়া। এমনকি, বাড়ির উপর গাছের ডাল পড়ে থাকলে, সেই ডাল সরানোর জন্যে হাঁকা হয় চারগুণ দাম।

পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে আদালত এই বর্ধিত মূল্যকে বেআইনি ঘোষণা করেন। এবং সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পান।

কিন্তু, আদালতের এই বিচার কিছু অর্থনীতিবিদের পছন্দ হয় না। যাঁরা কিনা বাজার অর্থনীতি বা মুক্ত বাজারের অপার ক্ষমতায় আস্থা রাখেন, তাঁরা তো চটে লাল।

একজন বললেন, এইভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়া ভালো। দাম বাড়লে আরো বেশী মানুষ জিনিসটা বানাতে থাকবেন। অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। উৎপাদন বাড়লে জিনিসের দাম কমবে। ক্রেতার ভালো। একইকথা পরিষেবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আরেকজন বললেন, বাড়তি বা লাগামছাড়া দাম আবার কী!! দাম তো একটা গতিশীল ব্যাপার। চাহিদা আর জোগানের অঙ্কেই দাম নির্ধারিত হবে। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, বেশী দাম পেলে জোগান বাড়বে, তাইতে দাম কমবে। দাম বেঁধে দেওয়াটাই একটা ভ্রান্ত ধারণা।

এসবের উত্তরে আদালতের বিচারক যে কথাটা বললেন, সেইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তিনি বললেন, মানুষ যখন বিপদে পড়ে, বা ক্রাইসিসের সময়, এইসব চাহিদা-জোগান ইত্যাদি বাজার অর্থনীতির ধারণা সেখানে প্রযোজ্য নয়। কেননা, মুক্ত বাজার বা ক্রেতার পছন্দের অধিকার সেইখানে থাকে না। মুক্ত বাজারে মানুষের দামে না পোষালে, তিনি জিনিসটা না কিনে চলে যেতে পারেন। বিপদে পড়লে, মানুষ জিনিসটা কিনতে বাধ্য, যে দামেই হোক না কেন। আর, তিনি যদি জিনিসটা কিনতে না পারেন, আর্থিক অসামর্থ্যের জন্যে, তাহলে তিনি আরো গভীর সঙ্কটে পড়েন। এইখানে বাজারকথিত চয়েসের স্বাধীনতা বা বেছে নেওয়ার অধিকার রক্ষিত হবে কেমন করে!!

যেমন বললাম, ফ্লোরিডার সেই বিচারকের কথাটি আমাদের স্বাস্থ্যপরিষেবার ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। তাই না?  বাজার অর্থনীতির নিয়মে স্বাস্থ্যপরিষেবাকে চলতে দেওয়ার বিরুদ্ধে কয়েকটি অমোঘ যুক্তি রয়েছে। প্রথমত, বাজারের অত্যাবশ্যক শর্ত, তথ্যের সাম্য। অর্থাৎ, ক্রেতা এবং বিক্রেতা দুজনেই কেনার জিনিসটা নিয়ে সমান অবগত থাকবেন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে, হাজার গুগলের সহায়তা সত্ত্বেও, চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে এই তথ্যের সাম্য আসা একেবারে অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, ফ্লোরিডার বিচারকের যুক্তিটি। কেনার বাধ্যবাধকতা কাজ করলে বাজারের নিয়ম খাটে না। আপনার যদি দামে না পোষায়, এবং তদসত্ত্বেও যদি আপনি কিনতে বাধ্য হন, তাহলে বাজারের নিয়ম চললো কি? তৃতীয়ত, বাজারের নিয়ম অনুসারে, ক্রেতা এবং বিক্রেতার সম্পর্কটি সরাসরি এবং সেইখানে তৃতীয় ব্যক্তির সরাসরি লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রশ্ন নেই (মধ্যবর্তী মুনাফাভোগী বা দালালের প্রশ্ন আনছি না)। কিন্তু, খরচে না পোষালে একজন সংক্রামক ব্যধির রোগী যদি চিকিৎসা না করানোর সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ক্রেতার সেই সিদ্ধান্তের মাসুল জোগাতে হচ্ছে বৃহত্তর সমাজকে। আর, চার নম্বর যুক্তিটি, কিছুটা দর্শনের। চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে সম্পর্কটি বিশ্বাসের। পরিস্থিতির হাজার বদল সত্ত্বেও, এই বিশ্বাসের সম্পর্ক না থাকলে, আর যাই হোক, চিকিৎসা হয় না। এই বিশ্বাসের মধ্যে বাণিজ্য ঢুকলে বিশ্বাস অটুট থাকে কী? আর, বাজারের অনিবার্য নিয়ম বা শর্ত হলো, এই মুনাফা উপার্জন। আমার কথা নয়, অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো সেই ষাটের দশকের গোড়াতে, যখন স্বাস্থ্যপরিষেবায় বাজারের প্রবেশ অনিবার্য বলে ভাবানোর পদ্ধতিটি শুরু হচ্ছে, বলেছিলেন, “the very term ‘profit’ denies trust relations”. কাজেই, বাজার এবং বিশ্বাস হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না। বাজারের নিয়মে স্বাস্থ্যপরিষেবা চলবে, আবার একইসাথে রোগী-চিকিৎসকের সনাতন বিশ্বাসের সম্পর্কটি অটুট থাকবে, এ ভাবনায় যথেষ্ট যুক্তি নেই।

তাহলে, স্বাস্থ্যের মতো একটি অত্যাবশ্যক বিষয়কে বাজারের সদিচ্ছার হাতে ছেড়ে দেওয়া, স্বাস্থ্যের মতো একটি জরুরী বিষয়কে পণ্য হিসেবে ভাবতে শেখানো বা স্বাস্থ্যকে শুধুই চিকিৎসার সাথে এক করে বিবেচনার অভ্যেস তৈরী করে বাণিজ্যের জমিটি তৈরী করা, এইসবের পেছনে রাষ্ট্র-কর্পোরেট যেমনভাবে একাকার হয়ে রয়েছে, আসুন সেই দুর্নীতিকে চিনতে শিখি। সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হই।

আগেই বলেছি, চুনোপুঁটি নিয়ে ভুলে থাকলে রাঘববোয়ালদের ভারী সুবিধে হয়। সত্যি বলতে কি, রাঘববোয়ালেরাই সামনের দিকে উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে রেখেছে, যাতে ওই চুনোপুঁটিরা সামনে ঘুরঘুর করে, আর আপনার নজরটি যাতে সেইখানেই আটকে থাকে। সিস্টেমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ চুনোপুঁটির উপরে উগরে দিয়ে আপনি যতোদিন সন্তুষ্ট থাকবেন, রাঘববোয়ালেরা ততোদিন করেকম্মে খেতে পারবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্নীতি নিয়ে, বা সেই দুর্নীতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাবার জন্যে কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা করতে হলে, প্রথমেই এই কথাগুলো মাথায় রাখুন। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করতে হলে, বৃহত্তর প্রেক্ষাপটটা মাথায় রেখেই করতে হবে। অবশ্যই বেশ কিছু চিকিৎসক, সংখ্যায় তাঁরা কিছু কম নন, বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকারের দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে। সিস্টেমের যে দুর্নীতি, তার এত রমরমা হতেই পারত না অন্তত একশ্রেণীর ডাক্তারের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া। আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য, কোনোভাবেই, তাঁদেরকে পাশ কাটিয়ে আপনার নজর অন্যত্র ঘুরিয়ে দেওয়া নয়। আমার বক্তব্য, সিস্টেমের সমস্যাটা নিয়ে সচেতন হলে, চালু মডেলটার মধ্যে প্রতিপদে যেমন করে দুর্নীতির বীজ পোঁতা আছে সেইটাকে চিনতে শিখলে বাকি চুনোপুঁটিদের সামলানো মুশকিল হবে না।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি যে খুব পোক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে নেই, ঘোর সরকারপন্থীরাও, আশা করি, সে কথা মেনে নেবেন। স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে আমরা ক্রমশই নেমে চলেছি। থাইল্যান্ড বা শ্রীলঙ্কার কথা ছেড়েই দিন, নেপাল বা বাংলাদেশও আমাদের থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের  এই নড়বড়ে স্বাস্থ্যের হাল নিয়ে ভাবতে বসে অমর্ত্য সেন তিনটি মূল ব্যর্থতার কথা বলেছেন।

এক, প্রাথমিক স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে চূড়ান্ত অবহেলা।

দুই, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে অত্যধিক নির্ভরতা এবং সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিকে লাটে তুলে দেওয়া। দুইয়ের মধ্যে নিবিড় সংযোগ রয়েছে।

তিন, স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন আলোচনার অভাব এবং স্বাস্থ্যকে অ্যাজেন্ডা হিসেবে তুলে আনায় অনীহা।

স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন আলোচনা শুরু করতে চাইলে উপরের কথাগুলো এড়িয়ে গেলে চলবে না। স্বাস্থ্য বিষয়ে কোনো সিরিয়াস আলোচনা শুরু করতে চাইলে, বা দুর্নীতিকে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি বড়ো সমস্যা হিসেবে দেখতে চাইলে, বা দুর্নীতির জন্যেই আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই হাল, একথা ভাবতে চাইলে, অমর্ত্য সেন নির্দেশিত তিনটি পয়েন্ট গভীরভাবে ভাবা জরুরী।

একটু অতিসরলীকরন হরে যাচ্ছে মেনে নিয়েও সংযোগটুকু বলি। জনস্বাস্থ্য বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগে আর্থিক লাভ নেই। রোগ না হলে চিকিৎসাজনিত বাণিজ্যিক লাভ নেই। লাভহীন পরিষেবায় বিনিয়োগ আসে না। সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা পাওয়া গেলে, মানুষ কর্পোরেট হাসপাতালে ছোটেন না। কাজেই, জনস্বাস্থ্য-প্রাথমিক স্বাস্থ্যে অবহেলা, সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে অপটু করে রাখা একটি সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই রাজনীতি, এই শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার রাজনীতিকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হলে সাধারণ মানুষকে অসচেতন রাখা জরুরী। তাই, স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে যেটুকু আলোচনা নজরে আসে, সেটুকু ওই চিকিৎসায় গাফিলতি বা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের তাকলাগানো গল্প বা বেগুন খেলে ক্যানসার হয় কিনা এইধরণের আলোচনা। আপনি যদি ন্যূনতম ব্যয়ে সংখ্যাগুরু জনসাধারণের জন্যে সর্বাধিক কার্যকরী স্বাস্থ্যব্যবস্থা কোন পথে আসতে পারে, এমন আলোচনা চান – নাঃ, দিনভর মিডিয়ার কলকাকলিতে ভরা এই সময়ে দাঁড়িয়ে, এমন আলোচনার হদিশ পাবেন না।

১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাক দিয়েছিলেন, সকলের জন্যে স্বাস্থ্য। অনুদার অর্থনীতিতে অভ্যস্ত আমাদের দেশ তড়িঘড়ি সেই ডাকে লিখিত সাড়াও দিয়েছিলো। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয় নি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের কাছে স্বাস্থ্য পৌঁছানো যায় নি। যদি দুর্নীতির কথা বলতে হয়, এই প্রতিশ্রুতিভঙ্গ কি দুর্নীতি নয়?

সবার জন্যে স্বাস্থ্যের স্লোগান আজ আর লোকজনের মনে নেই। স্বাস্থ্যের জায়গায় এসেছে স্বাস্থ্য পরিষেবা। হেলথের স্থানে হেলথকেয়ার। স্বাভাবিক, শুধু স্বাস্থ্য দিয়ে ব্যবসা হয় না। পরিষেবা দিতে পারলে, তবেই দুটো পয়সার মুখ দেখা যেতে পারে। অতএব, আপনাকে বানানো হয়েছে স্বাস্থ্যসচেতন। আগে সুস্থ মানুষ বলতে বুঝতেন এমন কেউ, যাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না। আর এখন? এখন সুস্থ মানুষ মানে, যিনি সকালবেলা দুটো ওষুধ খান, নিয়মিত চেক-আপ করান ডাক্তারের কাছে, আর সন্ধ্যেবেলা কাটান জিমে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে, এই বদলটার অভিঘাত বোঝা জরুরী, এই বদলের আর্থিক লাভ কার ঘরে কোন পথে পৌছাচ্ছে, তার ছবিটা স্পষ্ট করা জরুরী। উচ্চরক্তচাপের সংজ্ঞা বদলে এক ধাক্কায় কয়েক কোটি মানুষ রোগীতে পরিণত হলেন। নর্মাল ব্লাড সুগারের ক্রাইটেরিয়া বদলে, কয়েক কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগতে শুরু করলেন। আগে যদি মানুষ গাঁটের ব্যথায় ভুগতেন, রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেড়েছে কিনা দেখা হত – চিকিৎসা শুরু হয় উপসর্গ থাকলে, শুধুমাত্র রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা দেখে নয়। ইতোমধ্যেই এই নিয়ে শোরগোল শুরু হয়েছে – নিয়মিত চেক-আপে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা যাচাই করা জরুরী – এবং বলা শুরু হয়ে গিয়েছে, এই মাত্রা বেড়ে গেলেই চিকিৎসা শুরু করা খুব জরুরী। কাজেই, এই লিস্টে ইউরিক অ্যাসিড ঢুকতে আর বেশী দেরী নেই। আর, এই সবই সম্ভব হলো, সুস্থ মানুষকেও চেক-আপে ডেকে এনে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করার মাধ্যমে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দুর্নীতি এইখানেই লুকিয়ে।

আর, এই বিষবৃক্ষের চারাটি কিন্তু পোঁতা হয়েছিলো আপনার আমার চোখের সামনেই, যখন স্বাস্থ্য শব্দটির সংজ্ঞা বদলে গিয়েছিলো, যখন নীতিনির্ধারকেরা স্বাস্থ্য নামক অস্বস্তিকর শব্দটি বদলে স্বাস্থ্যপরিষেবার কথা বলতে থাকলেন। দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার সময়ে, নিজেদের দায় এড়াতে পারি কী? আপনার-আমার কি আরো সচেতন হওয়া উচিৎ ছিলো না? আর, এইজন্যেই, অমর্ত্য সেন বারবার করে বলেছেন, ইনফর্মড পাব্লিক ডিসকাশন অন হেলথকেয়ারের কথা, যেটা এদেশে একেবারেই অমিল। স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করতে বসলে, আপনি ডাক্তারদের আদ্যশ্রাদ্ধ বা চেন্নাই-ভেলোর বা অ্যালোভেরা জুসের গল্প জুড়বেন, কিন্তু কেমন করে দেশের সবার জন্যে একখানা জুৎসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা স্বাস্থ্যকাঠামো গড়ে তোলা যায়, এমন আলোচনার কথা তুললেই আপনার উৎসাহ নিভে যায়।

না হয় যুগের হাওয়া মেনে নিয়ে হেলথ ছেড়ে হেলথকেয়ারকেই শিরোধার্য করলাম। কিন্তু, সেই হেলথকেয়ার বা স্বাস্থ্যপরিষেবাকেও তো সবার মাঝে পৌঁছোতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্তমান ডিরেক্টর জেনারেল টেদ্রস ঘেরেয়েসুস তাঁর প্রথম বার্তাটিতেই জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিষয়ে সব পথের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ একটাই – সবার জন্যে, সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যপরিষেবা। আমাদের দেশেও তো এই একই লক্ষ্যে সরকারবাহাদুর কমিশন বসিয়েছিলেন। শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশন। সেই রিপোর্ট প্রকাশের পরে এতোগুলো বছর গড়িয়ে গেলেও সরকার যে হিরণ্ময় নীরবতাটি পালন করছেন, দুর্নীতির কথা বলতে হলে সেই নীরবতাকে এড়াবো কেমন করে?

স্বাস্থ্যের পেছনে জাতীয় আয়ের এক শতাংশ খরচ করলে যা হয়, তা-ই হয়েছে। পশ্চিমী দেশে এই বরাদ্দ চার কি পাঁচ শতাংশ, এমনকি চীনেও বরাদ্দ তিন শতাংশ। এর সাথে সাথে, ওইসব দেশের জাতীয় আয়ও আমাদের দেশের চাইতে অনেক বেশী। তাহলে, দেশের স্বাস্থ্যবাজেটের হাল সহজেই অনুমেয়। আমরা বিশ্বের উচ্চতম স্ট্যাচু তৈরীর পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে পারি, উচ্চতম স্ট্যাচু খাড়া করার সাথে সাথেই তার সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে আরো উঁচু স্ট্যাচু তৈরির পরিকল্পনা করতে পারি, কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারি না। সরকারি দলের গোভজনার বিপরীতে বিরোধী দল তাঁদের ম্যানিফেস্টোয় গরুর উন্নতিকল্পে কী কী করা যেতে পারে তার হিসেব দাখিল করতে পারেন, কিন্তু জনস্বাস্থ্য বা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধির কথা উচ্চারণ করতে পারেন না। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলতে হলে, এই বিষয়গুলো ভাবুন।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে ছিটেফোটাটুকু বরাদ্দ হয়, তারও কি উপযুক্ত ব্যবহার হয়? সেই টাকাই বা যাচ্ছে কোন খাতে? জনস্বাস্থ্যে বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যে বরাদ্দ নামমাত্র। সিংহভাগ যাচ্ছে ব্যয়বহুল চিকিৎসার পেছনেই। এইবার নতুন ঘোষিত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে সরকার রাখঢাক না করেই জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য বাদ দিয়ে বাকিগুলোর ব্যাপারে তাঁরা সরাসরিই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে হাত মেলাবেন। যেমন প্রয়োজন, পরিষেবা কিনবেন। অতএব, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের একটি বড়ো অংশ যে বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের হাতে পৌছাবে, এ নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ আছে কি? প্রাথমিক স্বাস্থ্য সরকার নিজের হাতে রেখেছেন, না কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যের মতো অলাভজনক ক্ষেত্রে বেসরকারী প্রভুদের উৎসাহ থাকে না। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা নিয়ে আলোচনা চাইলে, এই প্রসঙ্গগুলো সামনে আসুক।

হালে তো পরিস্থিতি আরো চরমে পৌঁছেছে। সরকারবাহাদুর গরীবগুর্বোর চিকিৎসার দায় সরাসরি না নিয়ে চিকিৎসাবীমার হাতে ছাড়তে চলেছেন। সরকার বীমার প্রিমিয়াম ভরবেন, গরীব মানুষ কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে নেবেন, বীমা সংস্থা টাকা দেবেন। শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু বাস্তবটা তো অতো সরল নয়। হাসপাতাল যে বিল করবেন, বীমা সংস্থা নাকি তা-ই মেটাবেন, কেননা থার্ড পার্টি কর্তৃক বিল খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা থাকছে না, এই বীমা বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল, ট্রাস্টবেসড। পরিবারপিছু বীমাকৃত টাকাটি যদি একজনের চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তীতে আরেকজন সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে কি হবে, জানা নেই। বীমা কোম্পানিগুলো একসাথে বিপুল সংখ্যক ক্লায়েন্ট পেয়ে খুশী নিঃসন্দেহে, কর্পোরেট হাসপাতালগুলিরও চোখ নিশ্চয়ই চকচক করছে বাড়তি ব্যবসার আশায়, কিন্তু আমজনতার কী হবে?

অন্য আরেকটি ক্ষেত্রে বীমার অভিঘাতের বিষয়টি দেখতে চাইলে নিশ্চয়ই খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

কৃষিবীমা বা শস্যবীমার উদাহরণটি দেখা যাক। ম্যাগসেসে পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক পি সাইনাথ রীতিমতো হিসেব কষে দেখিয়েছেন, ঠিক কীভাবে লাভের গুড় পৌঁছচ্ছে কর্পোরেট প্রভুর হাতে, কেমন করে আপনার আমার করের টাকা ঢুকছে কর্পোরেট প্রভুদের খাতায়। প্রধানমন্ত্রী বীমা ফসল যোজনায় বীমার দায়িত্বে রয়েছেন রিলায়্যান্স, এসার প্রমুখ বহুজাতিক। মহারাষ্ট্রের একটি অঞ্চলের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দুলাখ আশি হাজার কৃষক সয়াবিনের চাষ করেছিলেন। একটি জেলায়, কৃষকেরা বীমার প্রিমিয়াম বাবদ দেন ঊনিশ কোটি টাকার কিছু বেশী, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার বীমার প্রিমিয়াম বাবদ জমা দেন সাতাত্তর কোটি টাকা করে। সব মিলিয়ে বীমা সংস্থা, এই ক্ষেত্রে রিলায়্যান্স, প্রিমিয়াম বাবদ পান একশো তিয়াত্তর কোটি টাকা। পুরো ফসল নষ্ট হয়ে গেলে, ক্ষতিপূরণ বাবদ রিলায়্যান্স দেন তিরিশ কোটি টাকা। একটি জেলায় এক বছরে মুনাফা একশো চল্লিশ কোটি টাকা। জেলার সংখ্যা দিয়ে গুণ করে দেখতে পারেন। আমি অঙ্কে তেমন দক্ষ নই। তবে, সব মিলিয়ে কয়েক হাজার কোটি তো হবেই, কী বলেন?

ফসল বীমার চাইতে আরো বড়ো মাপের এই যে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প, শুরুতেই না হলেও, যার আওতায় আসার সম্ভাবনা শেষমেশ দেশের প্রায় সত্তর কি আশি শতাংশ, নাকি তামাম ইচ্ছুক নাগরিকেরই, সেইখানে বীমাসংস্থার মুনাফার হিসেবটা একটু ভেবে দেখেছেন কি? আর, বাজেটে জেটলিসাহেব যখন এই প্রকল্পের ঘোষণা করছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের শেয়ারের দামের উর্ধ্বগতিটি যিনিই চাক্ষুষ করেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না যে, এই প্রকল্পের ফলে লাভবান হবেন কারা।

ভেবে দেখুন, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের ঢালাও লাইসেন্স মিলছে কোন পথে? রীতিমতো নিয়ম বেঁধে দেওয়া হচ্ছে যে আদ্ধেক আসনে কতো টাকা নেওয়া হবে, সেই নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা থাকবে না। সেইসব মেডিকেল কলেজ থেকে লাখ লাখ কি প্রায় কোটি টাকার বিনিময়ে ডিগ্রী পাবেন কারা? আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, যে, তাঁরা আমজনতাকে স্বাস্থ্যপরিষেবা দেবেন, তা-ও ন্যায্যমূল্যে? তাঁরা তাঁদের কোটি টাকার শিক্ষার দাম উশুল করবেন কোন পথে? স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি বিষয়ে সরব হওয়ার মুহূর্ত, তাঁদের দোষারোপ করতে হলে, এই প্রশ্নও করুন, ডাক্তারিশিক্ষার এমন ফেলো কড়ি মাখো তেল ব্যবস্থাটি রেখেছেন কাঁরা, এবং কাদের স্বার্থে।

সমস্যা হচ্ছে এই যে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে, এসবের কথা নিয়ে ভাবার লোক কম। দুর্নীতি বলতেই আমাদের মাথায় ভাসে, ঘুষখোর বা কমিশনখোর চিকিৎসকের মুখ।

দেখুন, দুর্নীতি কী? দুর্নীতির সংজ্ঞাটা কী?

হ্যাঁ, একটা সনাতন সংজ্ঞা অবশ্যই, প্রাপ্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত লাভ বা স্বার্থসিদ্ধি। এইখানে, দুর্নীতির পরিধি বা পরিসরটি কিছু সীমিত। কিন্তু, এই নব্য-উদার অর্থনীতির যুগে, এই সীমিত সংজ্ঞা বোধহয় আর যথেষ্ট নয়। এইখানে মরিস সাহেবের সংজ্ঞাটি হয়তো বেশী প্রযোজ্য। দুর্নীতি মানে, ইলেজিটিমেট ইউজ অফ পাব্লিক পাওয়ার টু বেনিফিট আ প্রাইভেট ইন্টারেস্ট। জনগণ প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজির স্বার্থরক্ষা। দুর্নীতি বলতে আপনি যদি এই দ্বিতীয়টা বোঝেন, তাহলে, একমাত্র তাহলেই, আপনি সমস্যার গোড়ায় পৌঁছাতে পারবেন।

আপনি যদি দুর্নীতির প্রথম সংজ্ঞায় বিশ্বাস রাখেন, অর্থাৎ, দুর্নীতিকে ব্যক্তিনিবদ্ধ ধারণায় আটকে রাখতে চান, তাহলে সেই দুর্নীতির কারণ বা তার থেকে উত্তরণের পথ অনেক, এবং দুর্নীতির সামাজিক কারণ অনুসারে সমাধানও বিবিধ।

আপনি যদি আধুনিকতাবাদী হন, তাহলে ভাবতে পারেন, সামাজিক দুর্নীতি একটি অনগ্রসর সমাজব্যবস্থার প্রতীক, বা সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর অন্তিম দীর্ঘশ্বাসতুল্য, এবং আধুনিক ভাবনার প্রসারই পারে এই দুর্নীতি রোধ করতে। কিন্তু, আধুনিক ছাড়ুন, একেবারে উত্তরাধুনিক সমাজেও, কর্পোরেটের ঢালাও দুর্নীতি নিয়ে আপনি কী বলবেন? প্রচলিত অর্থে চূড়ান্ত আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা যেখানে রয়েছে, সেইসব ঝাঁচকচকে কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতে দুর্নীতির যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ ঘটেছে, তাই নিয়েই বা আপনি কী বলবেন?

আপনি যদি টেকনোক্র্যাট হন, তাহলে বলবেন, এই সমস্যার সমাধান আছে টেকনোলজির আরো বেশী প্রয়োগে, যেখানে মানুষের উপর নির্ভরশীলতা কম, এবং স্বচ্ছতা অনেক বেশী। কিন্তু, টেকনোলজি কোনও নিরপেক্ষ নিরবলম্ব বস্তু নয়, তার নিয়ন্ত্রক মানুষই। বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে টেকনোলজি ব্যবহৃত হলে, তার কাছ থেকে নিরপেক্ষ আচরণ আশা করার যুক্তি কতোটুকু?

আপনি যদি একটু দর্শনমনস্ক হন, তাহলে বলবেন, মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অধঃপতনই এই দুর্গতির মূলে। আপনার সাথে সহমত হয়েও বলি, আচমকা একধাক্কায় সমাজের সার্বিক নৈতিক মানের উন্নতি করা সম্ভব কি? ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালও নব্য চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ডাক্তারি পড়তে ঢোকার সময়ে যেমন করে এথিক্সে ভরসা রাখতেন, ডাক্তারি করার সময়েও তেমনই রাখুন। অর্থাৎ, তাঁরা মেনে নিচ্ছেন, ডাক্তারি পড়ার সময়ে একজন ছাত্রের নীতিবোধের পরিবর্তন ঘটছে। জানি না এইটা সত্যি কিনা। কিন্তু, রিসেন্ট আপডেটের নামে শুধুই কোম্পানি-স্পনসর্ড সেমিনারে যাওয়ার অভ্যেস হতে থাকলে, বা কনফারেন্স যাওয়ার সময় যাতায়াত-খাওয়াথাকার জন্যে ওষুধকোম্পানির দ্বারস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক মনে হতে থাকলে, বা নিদেনপক্ষে কলেজ সোশ্যালের সময় কোম্পানির দাক্ষিণ্যের আশায় থাকলে সঠিক-বেঠিকের হিসেবটা গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বৈকি!! ইন্টার্নশিপ থেকেই পেন কিনে লেখার অভ্যেস ভুলতে শুরু করেন প্রায় সব্বাই, তারপর অনেকেই অনেককিছু বিনেপয়সায় পেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, বা তিনি যেইটা বিনেপয়সায় পাচ্ছেন, তাঁর হয়ে সেই মূল্য চোকাচ্ছেন কে, এই প্রশ্নটি করতেও ভুলে যান। এইবার প্রশ্ন এইটাই, আপনি সব ছাত্রের নৈতিক মানের উন্নয়নে ব্রতী হবেন,,নাকি এমন একটা ব্যবস্থা চাইবেন যেখানে কলেজ-হাসপাতালে এই ওষুধ কোম্পানির অবাধ বিচরণটিই আটকানো সম্ভবপর হয়।

আপনি যদি ভাবেন, সঠিক নিয়মকানুন বা নিয়মের প্রয়োগ বা নজরদারি দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব, তাহলেও কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। স্বাস্থ্যপরিষেবাকে যদি প্রতিযোগিতার হাতে ছাড়া হয়, যা বাজারের অনিবার্য নিয়ম, তাহলে হাজার নিয়ম বা নজরদারি দিয়েও কি পরিস্থিতির বদল হতে পারে? ধরুন, একই ওষুধ পঞ্চাশটি কোম্পানি বিভিন্ন দামে বিক্রি করেন। তাহলে, চিকিৎসক ঠিক কোনটি বাছবেন? কোম্পানি চিকিৎসকের কাছে ঠিক কীভাবে বিপণন করবেন? হ্যাঁ, এখন চিকিৎসককে জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, একই ওষুধ বিভিন্ন দামে বিক্রির বিরুদ্ধে কোনো নির্দেশিকা নেই। তাহলে, অনেকগুলো ব্র‍্যান্ডের মধ্যে বাছবেন কে? রোগী অর্থাৎ ক্রেতা তো বাছছেন না। তাহলে? আগে বাছতেন ডাক্তার, আর এখন বাছবেন ওষুধের দোকানদার। অধিকাংশ ডাক্তারবাবুই বাছতেন কোম্পানির বিশ্বাসযোগ্যতা মেনে, যেমন যে কোম্পানির রিসার্চের ফল হিসেবে এই ওষুধটি এসেছে ইত্যাদি ইত্যাদি, কয়েকজন বাছতেন হয়তো কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভদের পরামর্শ শুনে বা কোনো লাভের আশায়। কিন্তু, ওষুধের দোকানদার বাছছেন কোন নিক্তির হিসেবে? পাশাপাশি দুটো কর্পোরেট হাসপাতালে কাছাকাছি মানের পরিষেবা বিক্রি হয়, কিন্তু খরচের ফারাক অনেক। আপনি কোথায় যাবেন চিকিৎসার জন্যে? কীভাবে বিচার করবেন? বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কোন নৈর্ব্যক্তিক হিসেব আপনার কাছে আছে? হ্যাঁ, নিশ্চিত জেনে রাখুন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় হাসপাতালগুলির যে র‍্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয়, তা-ও একধরনের বিজ্ঞাপনই। তাহলে, আপনি বাছবেন, বা বাছছেন, কোন হিসেবে? এই প্রতিযোগিতা, বিপণনের এই ভূমিকা থাকলে, হাজার নজরদারি দিয়েও দুর্নীতি বন্ধ হবে কি?

অতএব, প্রথমেই স্পষ্ট করে বুঝুন, দুর্নীতির শিকড় লুকিয়ে এই চিকিৎসা ব্যবস্থাটারই মধ্যে। স্বাস্থ্য-চিকিৎসা যে একটি পণ্য, চিকিৎসার মতো একটি অত্যাবশ্যক বিষয়কে যে মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতার হাতে ঠেলে দেওয়া যায়, এমন ভাবনার মধ্যেই দুর্নীতির বীজটি লুকিয়ে। কয়েকশো ওষুধ প্রস্তুতকারক তাঁদের প্রোডাক্ট বিক্রির জন্যে প্রাণপণ বিপণন করে চলবেন, কয়েক হাজার ল্যাব বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার একই পরীক্ষা করবেন এবং সেই পরিষেবার খরিদ্দার খুঁজবেন, পাশাপাশি অবস্থিত একই ধাঁচের দুই কর্পোরেট হাসপাতাল রোগী আকর্ষণের প্রতিযোগিতায়  বিভিন্ন প্যাকেজের ব্যবস্থা করবেন বা ডাক্তারবাবুরা যাতে রেফার করেন সেইখানে তাঁদের জন্যে বিভিন্ন উপঢৌকনের ব্যবস্থা রাখবেন, আর আপনি ভাববেন, যে, স্রেফ নজরদারির কড়াকড়ি করলেই সমস্ত অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে?

আবারও বলি, এই ব্যবস্থা বলবত রেখে কোনোভাবেই দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ করা সম্ভব নয়। যে ব্যবস্থায় ওষুধ কোম্পানির বার্ষিক বাজেটের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশই মার্কেটিং-এর জন্যে বরাদ্দ, সেই ব্যবস্থা জিইয়ে রেখে দুর্নীতির মোকাবিলা সম্ভব নয়। যে ব্যবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালকে মোটা টাকা মাইনে দিয়ে মার্কেটিং টিম পুষতে হয়, আর হাসপাতালের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই মার্কেটিং টিমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, সেই ব্যবস্থা বজায় রেখে দুর্নীতির মোকাবিলা সম্ভব নয়।

তাহলে পথ কী?

না, এককথায় সমাধান দিতে পারবো না। কোনো জাদুকাঠির দিশা আমার কাছে নেই। তবে, কোথায়, কোন জায়গায় গলদটা, কোনটা ঠিক নয়, সেইটুকু জানাও জরুরী। সেইটুকু না জানলে উত্তরণের দিশা মিলবে কি? আমাদের প্রাচীন দর্শনেও তো নেতি নেতি করেই সত্যের সন্ধান স্বীকার করা হয়েছে।

রাষ্ট্র যতোদিন না সব নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিচ্ছেন, বা সবার সামর্থ্যের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যপরিষেবার ব্যবস্থা করছেন, ততোদিন সুরাহা মিলবে না। ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার ছাড়া অন্য পথ নেই। ঠিক কেমন করে সেই জায়গাটায় পৌঁছানো যায়, সেই নিয়ে আলোচনা হোক না। সবাই মিলে আলোচনা করলে একটা সমাধানের পথ মিলবে না, এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। অন্তত, আলোচনা, কথোপকথনটুকু তো শুরু হোক। এতো বিষয় নিয়ে সান্ধ্য টিভিতে বিতর্কের আসর বসে, দেশের সব নাগরিকের সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যপরিষেবা কোন পথে আসতে পারে, সেই নিয়েও একদিন বিতর্ক বা আলোচনা হতে বাধা কীসের?

আলোচনার ধরতাই হিসেবে, শুরুতে বলা অমর্ত্য সেনের কথাতেই ফিরি। প্রয়োজন, জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যে নজর। জাতীয় আয়ের এক শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্যোন্নতি সম্ভব নয়। বেসরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবাকে শিরোধার্য করে, এবং যথেষ্ট তথ্য ছাড়াই বেসরকারি হাসপাতালে চালু মডেলটিকেই সেরা মেনে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন হলে ভরাডুবি অনিবার্য। আর, এই প্রসঙ্গগুলি মূলস্রোতের আলোচনায় না এলে, এই অনাচারের ট্র‍্যাডিশন চলতেই থাকবে।

জানি একই কথা বারবার বলছি, আপনি নিশ্চিত বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু, দেখুন, আপনাকে ভুলিয়ে রাখা কতো সহজ। স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে বসলেই ডাক্তারগুলো আজকাল ডাকাত বা সব ব্যাটা কমিশনখোর-অর্থপিশাচ ইত্যকার শব্দবন্ধ আপনার জিভের ডগায় চলে আসে। আর, আপনার সেই কথায় প্রশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী, ওষুধকোম্পানির অর্থে বিদেশযাত্রা করে, বিদেশের মাটিতে বসে, ডাক্তারদের আদ্যশ্রাদ্ধ করবেন। আপনাদের সেই কথায় সস্নেহ প্রশ্রয় দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলবেন, অতো টাকা দিয়ে ডাক্তারেরা কী করবেন, হীরের চচ্চড়ি খাবেন? আপনি হাততালি দেবেন, ভাববেন, একদম দারুণ বলেছেন, যাকে বলে একেবারে সলিড দিয়েছেন। এদিকে আপনার টাকায় তৈরী একখানা আস্ত হাসপাতাল তুলে দেওয়া হবে কর্পোরেটের হাতে, ন্যায্য মূল্যের দোকানের নামে সেই দোকানের বরাত পান বৃহৎ কনগ্লোমারেট, সেই কনগ্লোমারেট ওষুধ বিক্রয়কারী বরাত পাওয়ার অনতিবিলম্বেই পরিণত হন ওষুধপ্রস্তুতকারকেও, এবং তাঁদের প্রস্তুত ওষুধ কিনতে থাকেন সরকার। আর, সারা দেশের দিকে চেয়ে দেখলে, স্বাস্থ্যব্যবস্থাটাই তুলে দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের-বীমাব্যবসায়ীদের হাতে।

প্রায় বাঁধা বুলির মতো করেই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আবারও ঘোষণা করলেন সবার জন্যে স্বাস্থ্যপরিষেবার কথা। শুধু ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার বা সবার জন্যে স্বাস্থ্যের স্লোগান বদলে গিয়ে হলো ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব স্বীকার করা সত্ত্বেও এই ছোট্টো শব্দের অদলবদলটির তাৎপর্য্য কিন্তু ছোটো নয়।

ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ শব্দবন্ধের মধ্যেই মেনে নেওয়া আছে বেসরকারী স্বাস্থ্যব্যবসাকে। বলা হয়েছে, বেসরকারি ব্যবস্থার সাথে সরকারি ব্যবস্থাকে মেলানোর কথা। মেনে নেওয়া হয়েছে সরকারি ব্যবস্থার তুলনায় বেসরকারী ব্যবস্থার অধিকতর দক্ষতাকে। আপাতদৃষ্টিতে কথাগুলো সর্বজনগ্রাহ্য, এবং সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু, এই গ্রাহ্যতা আর স্বীকৃতিটুকুও কি এক বিশেষ পথে বিপণনের ফল নয়?

এই ধরুন, নব্বই দশক নাগাদ, মুক্ত অর্থনীতির আবির্ভাবের সাথেসাথেই আপনি জানতে শুরু করলেন, যে, সরকারি হাসপাতাল সাক্ষাৎ নরক, সেখানকার ডাক্তারেরা ফাঁকিবাজ দুর্ব্যবহারী ইত্যাদি ইত্যাদি – আর, হ্যাঁ, এখন কলকাতাতেই এসে গিয়েছে বিশ্বমানের চিকিৎসা, চিকিৎসাপরিষেবা, ওই পাঁচতারা হোটেলতুল্য হাসপাতালগুলিতে। ঝাড়া সিকি শতকের মগজধোলাইয়ের পরে, আপনাকে যদি কেউ উল্টোটা বোঝাতে আসে, কেউ যদি বলেন আপনাকে যে, যে সংখ্যার চিকিৎসক মিলে যে সংখ্যার রোগী সামলানো হয় সরকারি স্বাস্থ্যকাঠামোয়, আর সেই চিকিৎসার রেজাল্ট অধিকাংশ অসুখের ক্ষেত্রেই বিশ্বের গড়ের চাইতে কম নয়, একে যদি আপনি সাফল্য না মানেন, একে যদি আপনি দক্ষতা বলে স্বীকার না করেন, তাহলে আপনার কাছে দক্ষতার সংজ্ঞা ঠিক কী, এই প্রশ্ন কেউ যদি সত্যিসত্যিই আপনাকে করে,   আপনি তো তাঁর মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েই সন্দেহপ্রকাশ করবেন, তাই না?

লক্ষ্য করুন, মুক্ত অর্থনীতি দেশে হইহই করে ঢুকল যে সময়, ঠিক সেই সময় থেকেই রাজনৈতিক নেতারা চিকিৎসার জন্যে দ্বারস্থ হতে শুরু করলেন কর্পোরেট হাসপাতালের – তাঁদের চিকিৎসা বিষয়ে আপনাকে আপটুডেট রাখতে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরা তাক করা রইল সেই কর্পোরেট হাসপাতালের দরজায় – আপনার চোখের সামনে সদাদৃশ্যমান রইল সেই হাসপাতালের চকচকে দরজা, উর্দিপরা সিকিউরিটি, ইংরেজি-মেশানো বাংলায় কথা বলা আধিকারিকের মুখ – চিকিৎসার বিষয়ে আপনার অ্যাসপিরেশনের সাথে জড়িয়ে গেল ওই হাসপাতালের মুখ – একে কি বিজ্ঞাপন বাদে অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব?

না, সরকারি ব্যবস্থা নিখুঁত নয়। এবং দুর্নীতিও সেইখানে অনেক। অন্তত এদেশে তো বটেই। কিন্তু, মুনাফার লক্ষ্যে চালিত বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিভিন্ন ম্যালপ্র‍্যাক্টিস বা দুর্নীতিকে যেমন করে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে, তেমনটি সরকারি ব্যবস্থায় হয় না। তবু, ঠিক ওই একই সময় থেকেই আপনি জানতে শুরু করলেন প্রসূতিকে বেড়ালে আঁচড়ে দেওয়ার খবর, দেখতে পেলেন ইঁদুরে খুবলে নিয়েছে নবজাতকের আঙুল। না, কোনোটিই মিথ্যে খবর নয় – এবং খুব খুউব দুর্ভাগ্যজনক, নিন্দনীয় – কিন্তু, এর বাইরে আর বিশেষ কিছু খবর সরকারি হাসপাতাল বিষয়ে আপনার জানার সুযোগ হল না। বিজ্ঞাপনের আরেক পিঠ? কালো না থাকলে আলোর সৌন্দর্য কখনও কি অমন চোখ ধাঁধাতে পারে??

চলতি গান থেকে ধার করে বলি, গভীরে যাও, আরো গভীরে যাও। সমস্যার গোড়ায় পৌঁছোতে পারলে সমাধান খুঁজে পাওয়া খুব দুরূহ নয়। সমস্যাটা পুরোপুরি অনুধাবন করলে, বোঝা কঠিন নয়, যে, সব নাগরিকের সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যকে নিয়ে আসতে হবে, আসতেই হবে। আর, সব নাগরিকের সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যকে আনতে হলে, জনস্বাস্থ্য এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যে গুরুত্ব দিতে চাইলে, সরকারি ব্যবস্থাকে আরো মজবুত না করলে চলবে না।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে, সেই দুর্নীতির অবসান চাইলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে গভীর আলোচনা প্রয়োজন। সেই আলোচনাকে মূলস্রোতে নিয়ে আসা প্রয়োজন। না, ঠিক লোকাল ট্রেন বা পানের দোকানের গুলতানির পর্যায়ের আলোচনা দিয়ে হবে না, সত্যি বলতে কি, সেই আলোচনায়, আগেই বলেছি, ক্ষমতার স্বার্থসিদ্ধিই হয় আর স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। একটু গভীরে যান। ভাবুন।

প্রশ্ন করতে শিখুন, কেন কোনো রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে স্থান পায় না স্বাস্থ্যের বিষয়টি? আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যের এই নড়বড়ে হাল কেন উঠে আসে না মিডিয়ায়? ঠিক কোন কায়েমী স্বার্থে এই জরুরী বিষয়টি রয়ে যাচ্ছে আপনার নজরের বাইরে? ঠিক কোন চুষিকাঠিতে ভুলে আপনি ভুলে যাচ্ছেন এই জরুরী প্রশ্নগুলোকে?

অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। তবু, এখনও সচেতন হোন। রুখে দাঁড়ান। অন্তত, প্রশ্নগুলো করুন।

আর কিছুই বলার নেই। বব ডিলান অবলম্বনে সুমনের দুলাইন –

কতো হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে,
বড্ডো বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।।

 

কিনে আনা স্বাস্থ্য: বাজার-পুঁজি-মুনাফা আর আপনি
বিষাণ বসু
প্রকাশক: ধানসিড়ি
প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ২০২০


*বানান অপরিবর্তিত 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4647 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...