পদ্যের পাদটীকা

পদ্যের পাদটীকা -- ফুয়াদ হাসান

ফুয়াদ হাসান

 

 

শব্দটি ছিল পাদটীকা। সেখান থেকেই নাকি জন্ম নিয়েছে পদ্য। পদ্য ও কবিতাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও, আজকের কবিতার সঙ্গে পদ্যের দূরত্ব বহুদূর। কবিতাকে পদ্য বললেও এখন আর কেউ পদ্যকে কবিতা বলে না।
***

 

পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থই এক-একটি উৎকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থ। প্রশ্ন আসতে পারে কাব্য হতে গেল কেন! গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল অথবা কোরআন— গদ্যে কেন রচিত হয়নি? ইতিহাসবেত্তারা বলবেন, ধর্মগ্রন্থগুলো রচিত হওয়ার যুগে গদ্যের আবির্ভাব হয়নি বলে। কিন্তু ট্র্যাজেডি হল, ধর্ম কবি বা কবিতাকে খুব একটা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেনি!
***

 

অ্যারিস্টটল কবিতা না লিখেও কাব্যতত্ত্ব উপহার দিয়েছিলেন আর প্লেটো কবিতা লিখে বলেছেন কবি ও কবিতার বিরুদ্ধে।
***

 

শিল্পের জন্য কবিতা না জীবনের জন্য— কলাকৈবল্যবাদীর সঙ্গে মানবতাবাদীর এ তর্ক বহু প্রাচীন। কাব্যের মহাকাব্য ঘেঁটে আমরা কালোত্তীর্ণ অসংখ্য শিল্পময় পদ্য পেয়েছি, দেখেছি জীবনমাখা কবিতাও। কালের কাছে দুটোই বিজিত হয়েছে, হয়েছে পরাজিত।
***

 

‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান’— দিয়ে শুরু করলেও মাঝবয়েসে আসতে হয়ে গেছে— ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’; অতঃপর শেষবেলায় এসে না-মেলা জীবনের প্রশ্ন-উত্তর! এদিকে দেবদেবীর চরণে সুরনৈবেদ্য রেখেও বলছেন, ‘ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন’ আর মৌলবিদের ‘মৌ লোভী’ তিরস্কার শেষে মসজিদের পাশে কবর দেওয়ার আকুতি!

স্ববিরোধী শব্দের সার্থক সমার্থক শব্দ— কবি!
***

 

বেশি কবিতা লিখলে বেশি কবিতা হবে— এমন নয়; সংখ্যায় কম কবিতা লিখলে কম কবিতা হবে— তাও নয়। অধিক কবিতা লিখলে খুব সস্তা হয়ে যায়, বলাটা হাস্যকর, তার থেকে হাস্যকর, কম লিখলেই শ্রেষ্ঠ কবিতা হয়ে যাবে, তেমন করে ভাবা।

জীবনভর কবিতা লিখেও কবি হওয়া হয়নি অনেকের আবার একটি কবিতা দিয়েই কাব্য-ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে কেউ, এমন কী জীবনে একটি কবিতা না-লিখেও!
***

 

কবিতার প্রথম পঙক্তি আসে নাকি স্বর্গ থেকে। তবে বাকি লাইনগুলো কি সব নরকের! কাব্যদেবী কবির ওপর ভর করেন বলেই বুঝি কবিতার জন্ম। ব্যর্থ কাব্যসমগ্রের দায়ও কি তবে সরস্বতী নেবেন!
***

 

নেফতালি রিকার্দো রেইয়েস বাসোয়ালতোর বাবা কবিতার প্রতি ছেলের আগ্রহ মোটেও সহ্য করতে পারছিলেন না, তাই ছদ্মনাম গ্রহণ করলেন— পাবলো নেরুদা। ছদ্মনাম ব্যবহারের এই প্রবণতা বহু পুরানো এবং এর পেছনে এমন কিছু ব্যক্তিগত কারণের পাশাপাশি অজস্র সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। ডাকু সর্দার রত্নাকর হয়ে গেছে বাল্মীকি মুনি। আজকাল অবশ্য কোনও কারণ ছাড়াই নাম নিয়ে কবিরজি চলছে। কেউ লম্বা নাম কেটে ছোট করছে, উল্টে দিচ্ছে, আবার কেউ নামের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে নতুন কোনও শব্দ। কবির নাম কি তবে কবিতার থেকে বড়, কবিতার থেকে গুরুত্বপূর্ণ!
***

 

‘Gitanjali— Song Offerings’-এ ইয়েটসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ দেখে দিয়েছিলেন এজরা পাউন্ড, বুদ্ধদেব বসু ‘কবিতা’র মাধ্যমে আলোতে এনেছিলেন জীবনানন্দকে। কাব্যরাজ্যের এমনও অসংখ্য নেপথ্যকাহিনি চিরকাল উপেক্ষিতই রয়ে যায়।
***

 

কাদম্বরী দেবী পারলে বিহারীলালের চেয়ে বড় কবি হতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে আর হুমায়ুন কবিরের মতো বড় কবি হতে পারবেন কিনা জানতে চেয়েছিলেন শামসুর রাহমানকে তাঁর বাবা। আজ কোথায় সে ভোরের পাখি, কোথাই বা সে হুমায়ুন কবির!
***

 

একজন ‘নাইট’ উপাধি নিলেন আবার জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ডে প্রতিবাদস্বরূপ ফিরিয়েও দিলেন, অন্যজন ‘বিদ্রোহী’ রূপ ধারণ করে জীবনভর জেল-জুলুম তো আর কম খাটলেন না অথচ সেই ‘আমি সৈনিক’ ব্রিটিশদের হয়েই অংশ নিয়েছিলেন প্রথম মহাসমরে!
***

 

কবিকে নবি বলেছেন কেউ, কেউ বলেছেন শয়তান; ব্রহ্মা বলেছেন কেউ, কেউ বা বলছে উন্মাদ। কবিকে কেউ বলছেন, কেউ কেউ কবি।
***

 

কবিতা কী যদি তা জানতে চাও তবে আমিও বলব, জানি না। যদি জানতে না চাও তাহলেও বলব, আমি কিচ্ছু জানি না!
***

 

কবিতার অনুবাদ ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করলে কাব্যগুণ নষ্ট হয় মন্তব্য করেছিলেন রবার্ট ফ্রস্ট। আজ অনূদিত হয়ে অজস্র ভাষায় পৌঁছে যাচ্ছে নানা ভাষার কবিতা ও তত্ত্ব।

কবিতা দীর্ঘ হলে তা আর কবিতা থাকে না–এমনই ব্যাখ্যা করেছেন কোলরিজ। তবে কি শুধু ছোট হলেই কবিতা কবিতা হবে!
***

 

কবি ও কবিতা নিয়ে একটি বড় সমালোচনা আলোচনায় আসে প্রায়ই–স্লোগানধর্মিতা। স্লোগানধর্মিতার অপরাধে কত কবিকে খারিজ করে দিয়েছি আমরা।

পৃথিবীর সব স্লোগান এক-একটি উৎকৃষ্ট কবিতা।
***

 

একটি শব্দের যা অর্থ তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ প্রকাশ পায় শব্দটি কবিতায় ব্যবহৃত হলে। কখনও সেই শব্দের প্রকাশ পায় ভিন্নার্থ, রূপকার্থ অথবা এমন এক অর্থ যা কস্মিনকালেও কেউ ভাবেনি। একটি শব্দের ওজন, শক্তিমত্তা তখনই অনেক বেশি পরিষ্কার হয়— শব্দটা কবিতায় ব্যবহৃত হলে।
***

 

আমার কবিতা যদি সমাজতন্ত্রের পক্ষে সামান্যতম প্রপাগাণ্ডাও ছড়াতে পারে তাহলেই আমি সফল— এমনটা মনে করতেন মায়াকভস্কি। সেই দলের বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বিপ্লবীদের লেখায়ও যায় কালোত্তীর্ণ প্রেমের পঙক্তিমালা তেমনই বোদলেয়ার-জীবনানন্দের মতো কলাকৈবল্যবাদীর কবিতায়ও স্পষ্টত চলে এসেছে হাতুড়ি-কাস্তের বিপ্লব।
***

 

শুধু এক চাঁদকেই তো কত রূপে, কত ভাবে এঁকেছে কবিদল। চাঁদমামা প্রয়োজনে হয়ে উঠেছে প্রেমিকার কপোল। এক শ্রেণিবিপ্লবী ঝলসানো রুটির উপমা দিলে অন্য মার্ক্সবাদী করছে কাস্তের সঙ্গে তুলনা। কেউ টাকমাথার সঙ্গে মিল খুঁজে পেলে, অন্য কেউ বলছেন করোটির মতো চাঁদ।
***

 

কবিতা শিল্পের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম— এটা নিছক কথার কথা নয়। আমরা শিল্পসার্থক গদ্যের ভেতরও কাব্যময়তা খুঁজি। কাব্যময় সুর-সঙ্গীতের কথা বাদই দিলাম, গল্প-উপন্যাসেও খুঁজি কাব্যিকতার ছোঁয়া, কোনও চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এমনকী একটি ছবিও ভালো হলে বলি— এ যেন কবিতা! শিল্পের অন্যান্য শাখাগুলোকে যেভাবে তুলনা করা যায় কবিতাকে কখনও সে-রূপ কারও সঙ্গে তুলনা করা যায় না, হয় না। কবিতা কোনওভাবে গল্প-সিনেমা অথবা অসামান্য কোনও আলোকচিত্র নয়। একটি কবিতার তুলনা শুধু কবিতাই— আর কিছু নয়।
***

 

পৃথিবীর সব কবিতা নাকি প্রেমের। সেই তর্কে না গিয়েও বলতে পারি, কোনও সার্থক প্রেমের কবিতা প্রেমের নয়— বিরহের। মানবসভ্যতা কমেডির চেয়ে ট্র্যাজেডিকেই বেশি ভালোবাসে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4647 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...