প্রতিভা সরকার
লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক ও সমাজকর্মী
মেঘালয়ের সৌন্দর্য অতুলনীয়। কিন্তু সেই সুন্দরের লুণ্ঠনও তেমন, অবাধ আর অকল্পনীয়। দুষ্প্রাপ্য খনিজের লোভে উড়িয়ে দেওয়া হয় পাহাড়ের পর পাহাড়, ট্যুরিজমের রমরমায় গলা টিপে ধরা হয় এমনকি সেভেন সিস্টারস নামে বিখ্যাত সাত ঝোরার। যে বিশাল চট্টানের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এসে তারা প্রস্রবণের রূপ পেয়েছে, সেই চট্টানের ওপরই গড়ে উঠছে বিলাসবহুল রম্য প্রাসাদ, ট্যুরিস্ট দেবতার মন্দির।
এ নিয়ে অনেক লিখেছি, অনেকখানে লিখেছি, তাতে আটকায় না কিছুই, তবু ভাবি মানুষ তো জানতে পারছেন কিছুটা হলেও। আজ লিখি শুধু অবাধ লুণ্ঠনই নয়, এই নয়ছয়কে বুক চিতিয়ে বাধা দেওয়ার মতো মানুষও আছেন মেঘালয়ে। এবং তারা বেশিরভাগই নারী। এর আগে লিখেছিলাম এগনেস খারশিং, অমিতা সাংমার কথা, আজ লিখব স্পেলিটির কথা, স্পেলিটি লিংডো ল্যাংরিন, মেঘালয়ের অ্যান্টি-ইউরেনিয়াম ক্যাম্পেনের প্রধান মুখ। ৯৫ বছর বয়সে শেষদিন অব্দি ইউরেনিয়াম হাঙরদের সঙ্গে লড়াই জারি রেখেছিলেন স্পেলিটি।
কীভাবে পৌঁছলেন তিনি এই অবস্থানে?
তার আগে বলে নিই আমাদের পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের ইউরেনিয়াম উত্তোলনের কাহিনি, বিকলাঙ্গতা আর অজানা অসুখে ছারখার হয়ে যাওয়া জাদুগোড়ার মতো আরও অনেক নামহীন গ্রামের কাহিনি। বিভূতিভূষণের বসতবাড়ি ঘাটশিলায় বেড়াতে গিয়ে শুনি জাদুগোড়া খুব কাছে। চলে যাওয়া কোনও ব্যাপারই নয়। এমনিতে দেখতে তো আর পাঁচটা গ্রামের মতোই, কিন্তু ঘরে ঘরে বিশ্রী অসুখ, ডাক্তাররা ধরতে পারেন না তো চিকিৎসা করবেন কী! বাচ্চারা জন্মাচ্ছেই বিকলাঙ্গ হয়ে। সাজোয়ান মরদেরা শয্যা নিচ্ছে, আর উঠছে না।
আগে কিন্তু সব স্বাভাবিক ছিল, এইরকমটা শুরু হয়েছে ১৯৬৭ সালে ইউরেনিয়াম কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (UCIL) এখানে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করবার কিছুদিন বাদে। ঝাড়খণ্ডের এই ছোট্ট গ্রামেই প্রথম শুরু হয়েছিল ভারতীয় ইউরেনিয়াম খনি খনন। দেশের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলিতে যত কাঁচা মাল লাগে, তার ২৫ শতাংশ আসে জাদুগোড়া মাইন থেকে।
এইখানে খুব সংক্ষেপে ইউরেনিয়াম উত্তোলন কাহিনি বলে নেওয়া ভালো।
যখন ইউরেনিয়াম আকরিক মাটির নীচ থেকে তোলা হয়, তখন তার ৯৯.২৮ শতাংশই বেকার যায়, কারণ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে যে ইউরেনিয়াম আইসোটোপ ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে মূলত ইউরেনিয়াম ২৩৫, যদিও আকরিকের মধ্যে বিপুল পরিমাণ থাকে ইউরেনিয়াম ২৩৬ আর ইউরেনিয়াম ২৩৮ এবং অন্যান্য উপাদান! এই কাজে না লাগা বিপুল বর্জ্যকে পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত জলের তোড়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জমা করা হয় কতগুলি কৃত্রিম পুকুরে (tailing pond)। রেডিয়াম আর ম্যাঙ্গানিজ আলাদা করে নিয়ে নেওয়ার পর বাদ বাকি বর্জ্য ঐখানেই জমা হতে থাকে।
জাদুগোড়ায় এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার পর এইবার শুরু হয় দূষণের হুঙ্কার। গোটা এলাকা জুড়ে মেয়েদের মেন্সট্রুয়াল সাইকেলে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, গর্ভেই শিশু নষ্ট হয়ে যেতে থাকে, কিম্বা মৃত বাচ্চা প্রসব হতে থাকে। জাদুগোড়ার আশেপাশে টেইলিং পন্ডের পাঁচ কিমি রেডিয়াসের মধ্যে থাকা ৩০,০০০ মানুষ এই দূষণের শিকার হয়ে পড়ে। কিন্তু সরকারি তদন্ত কমিটির মতে ইউরেনিয়াম উত্তোলন এই কোনও কিছুর জন্যই দায়ী নয়। তারা জানিয়ে দেয় এইসব অসুখবিসুখ, মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে এবং ইউরেনিয়াম মাইনিং-জনিত কোনও জটিলতাই এর মধ্যে নেই।
বিকেলে যখন ছবির মতো ঘাটশিলা স্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য বসেছিলাম, দূরে পেছনের রাস্তায় পিঁপড়ের মতো ট্রাকের দৌড়োদৌড়ি। কেউ মাটির পেট চিরে নিয়ে যাচ্ছে বহুমূল্য আকরিক, কেউ সেগুলো বিভিন্ন প্ল্যান্টে খালি করে আবার ছুটে যাচ্ছে খনিমুখে। মাঝখান থেকে দূষণে ভরে যাচ্ছে সুবর্ণরেখা, জাদুগোড়ার মতো গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে রোগের প্রকোপে।
দশকের পর দশক ধরে ল্যাংরিনের অসমসাহসী লড়াই ছিল এই দূষণের বিরুদ্ধে। আমরা তার নাম না শুনলেও মেঘালয়ে তিনি ছিলেন এক আইকন, যিনি নিজের জমিতে ইউরিনেয়াম উত্তোলনের জন্য UCIL-এর অনেক কোটি টাকার প্রস্তাব হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। “অর্থ স্বাধীনতার সমার্থক নয়,” এই ছিল ল্যাংরিনের বিখ্যাত উক্তি।
আশির দশকে সরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমিক মিনারেলস ডিরেক্টোরেট ফর এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড রিসার্চ (AMD), যার কাজ হল দেশের ইউরেনিয়াম উৎসগুলো খুঁজে বার করা, মেঘালয়ের ইউরেনিয়ামে ধনী গ্রামগুলোতে এক সমীক্ষা চালায়। দেখা যায় ল্যাংরিনের বাড়ি জমি অবস্থিত এক বিশাল ইউরেনিয়াম ভাণ্ডারের ওপর। কিন্তু আশেপাশের গ্রামগুলিতে এইসব কাজকর্ম যে প্রভাব ফেলেছিল, সচেতন ল্যাংরিন তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল বুঝতে পেরে মাইনিং কোম্পানিগুলিকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তার জমিতে কোনও খোঁড়াখুঁড়ি চলবে না। যেহেতু খাসি পরিবার মাতৃতান্ত্রিক এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুমতি ছাড়া জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না, UCIL-এর চেষ্টা সফল হয় না। ল্যাংরিনের এই একক প্রচেষ্টাই এক আন্দোলনের জন্ম দেয়। ইতোমধ্যে জাদুগোড়া দূষণের খবর পৌঁছে যায় মেঘালয়ে। জনমত প্রবল হয়ে ওঠে ইউরেনিয়াম মাইনিংয়ের বিরুদ্ধে।
এই দেশের সবচেয়ে বড় এবং উৎকৃষ্টতম ইউরেনিয়াম ভাণ্ডার রয়েছে মেঘালয়ে। ডোমিয়াসিয়াত অঞ্চলে, যেখানে ল্যাংরিনের বাড়ি জমি, সেখানে ১৯৮৪ সালে আবিষ্কৃত ভাণ্ডারে কম করেও ৯.২২ মিলিয়ন উচ্চ মানের ইউরেনিয়াম আকরিক মজুত আছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষ জন, বিশেষ করে দ্য খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ছাত্ররা পরিবেশ দূষণ এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ইস্যুতে উত্তোলনের তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে। ল্যাংরিন হাত মেলান ছাত্রদের সঙ্গে, হয়ে ওঠেন ইউরেনিয়াম বিরোধী আন্দোলনের মূল প্রবক্তা। সবাই ভাবতে থাকে, একজন সাধারণ বৃদ্ধা মহিলা, সন্তানের মা, তিনি যদি এই বিপুল অঙ্কের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারেন, তাহলে তারাই বা পারবে না কেন! এইভাবে একটা পুরো প্রজন্ম তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। নিজের জমি বিক্রি করতে অসম্মত হয়ে তিনি বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন গোটা এলাকার পরিবেশ, জন্ম দিয়েছিলেন এক পরিবেশ আন্দোলনের। তিনি প্রথম ধাক্কাটা না দিলে, আজ ঐ এলাকায় তৈরি হত অনেক অনেক জাদুগোড়া। লোভের কাছে বিকিয়ে যেত নদী জঙ্গল পাহাড়। এরপর থেকে ইউরেনিয়াম মাইনিং বিরোধী আন্দোলনে ব্যবহৃত হতে থাকল ল্যাংরিনের মুখ আঁকা বিশাল পতাকা। এক নির্লোভ পরিবেশকর্মী সাহসী মানবীর যোগ্য উত্তরণ ঘটল চিরন্তন প্রতীকে।
অ্যাগনেস খারশিং, আর এক পরিবেশ কর্মী, যার কথা আগেও লিখেছি, যিনি পরিবেশ মাফিয়াদের হাতে প্রচণ্ড প্রহৃত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন, তাঁর মতে স্পেলিটি লিংডো ল্যাংরিন এক “লেজেন্ড”-এর নাম। এক চলমান কাহিনি, জীবন্ত উপকথা, মৃত্যু যাকে মুছে দিতে পারে না।
স্পেলিটি লিংডো ল্যাংরিন অমর রবেন!