Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রবাসী মেঘের দল

অঞ্জলি দাশ

 

‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ না হলেও বেশ ঘটা করেই শুরু হল। আকাশ ধোয়া বৃষ্টি তাপিত কলকাতাকে ভিজিয়ে দিল অবশেষে। ২০শে জুন সকাল থেকেই চলছিল একটানা। বৃষ্টির মধ্যেই রাত পৌনে বারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোলাম। কারণ আমাদের ফ্লাইট একুশে জুন ভোর তিনটে পঁচিশে। পিছনে পড়ে রইল এবারের বর্ষাকাল। কলকাতা ছাড়ার প্রায় বাইশ ঘণ্টা পর বাইশে জুন কলকাতার সময় রাত দুটোয় যখন আটলান্টা এয়ারপোর্টে নামলাম, তখনও সেখানে একুশে জুনের বিকেল সাড়ে চারটে। ইমিগ্রেশানের ঝামেলা সেরে বাইরে বেরিয়ে দেখি হাসিমুখে অপেক্ষা করে আছে আকাশলীনা, অর্পণ আর কলকাতায় ফেলে আসা সেই সজল মেঘের দল। এয়ারপোর্ট থেকে বাইশ মাইল পথ সঙ্গে সঙ্গেই রইল সে বৃষ্টি। রোজমন্ট ভাইনিং রিজের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। আরও খানিক পর সন্ধে সাড়ে আটটায় আকাশ ঝকঝকে নীল, ওক গাছের পাতার ফাঁকে এক চিলতে রোদও দেখা গেল। এখানে সূর্যদেব একটু দেরিতে অস্ত যান।

তাহলে সঙ্গে ছিল… আমি ছেড়ে এলেও সেই বৃষ্টিমেঘ পথ চিনে চিনে আমার আগেই তবে অতলান্তিক পেরিয়ে এসে অপেক্ষা করছিল। উড়ান শুরুর সাড়ে চার ঘণ্টা পর জানালা দিয়ে একঝলক তাকিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল গালফের তীব্র রোদের রশ্মিতে। তখন একটু মন কেমন করছিল। মনে হচ্ছিল, এবারের বর্ষা তাহলে আর আমাকে ভেজাবে না। একা ভিজবে আমার বন্ধ জানালা। বারান্দার গ্রিল। মধ্যরাতে মেঘের গুরুগুরু শুনে শিহরিত হবে ঘরের একা অন্ধকার।

মাটির নিচের জলে টান পড়লেও এই একটা সময়ে আমরা কলকাতাবাসীরা খুব সজল থাকি। মেঘের জলে মাথা ভিজতে না ভিজতেই পায়ের পাতা ডুবে যায়। অজস্র সমস্যা। তবু, তবু বর্ষাকাল আমার প্রিয়।  অন্য পাঁচটা ঋতু তাদের নিজের নিয়মে আসে, চলে যায় সাধারণ প্রতিবেশীর মতো। মনোযোগ ছাড়াই। শুধু বর্ষাকাল এলেই মনে হয় কে যেন আমার ব্যক্তিগত জানালায় ভেজা চিঠি রেখে গেল। কার জন্যে যেন প্রতীক্ষায় ছিলাম। তার আগমন ঘটল। বৃষ্টি আমার সঙ্গ ছাড়েনি।

আমার বৃষ্টি মানেই নিজের মধ্যে ডুব। আনন্দ বিষাদ মেশামিশি এক সজল উদযাপন। বৃষ্টি মানে রবীন্দ্রনাথে নিমজ্জন। বৃষ্টি মানেই মনের মধ্যে গুনগুন ‘পূব সাগরের পার হতে কোন এল পরবাসী…’। কবিতার খাতায় অন্যমনে শব্দ ঝরে…

‘ভুল বানান দিয়ে শুরু হয়েছিল গ্রীষ্মকাল,
তারপর দীর্ঘ অপেক্ষার দিন, কখন মেঘের জল ধুয়ে দেবে
অসঙ্গত ধুলো…’।

কিংবা—

‘তখনও চোখের পাতা ভেজা ছিল বলে
তুমি নির্দ্বিধায় স্নান সেরে নিলে…।
দহন দিনের মুখ ধুয়ে দিতে দিতে
মধ্যরাত যখন গান বাঁধছিল,
তার হাতে তুলে দিলে গলা বুঁজে আসা বাঁশি…’

এইসব শব্দগুচ্ছ যেমন আসে কখনও, তেমনি আসে আমার বৃষ্টিপ্রেমের প্রতি কোনও কোনও প্রিয় মানুষের প্রশ্রয়ও। ঘরের কাজে ব্যস্ত… ফোন বাজে… ফোন তুলে অপেক্ষা করি, কেউ কথা বলে না, শুধু মেঘের ডাক, শুধু বৃষ্টির শব্দ… শুনি… অপেক্ষা করি… একটু পরে একটা ভাঙা ভাঙা গলা… ’হ্যাঁ রে শুনতে পাচ্ছিস?’ শুধু এইটুকু বলে ফোন ছেড়ে দেন নবনীতাদি। কিংবা কখনও হয়তো প্রথম বৃষ্টির দিন ভরদুপুরেই সন্ধের ছায়া… মেঘের বুকের তলায় শব্দ… ফোন বাজে… সাড়া দিই… কেউ কথা বলে না… দু’কলি গান ভেসে আসে… ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে…’ চৈতালী। উচ্ছাসে আমিও সদ্য লেখা দু’লাইন কবিতা শোনাই… মনের মধ্যে তুমুল উৎসব, বিরামহীন ঝরুক। আমন্ত্রণ আমিও তো পেয়েছি। ভিজতে থাকি এক ঋতু জুড়ে।

বৃষ্টি নিয়ে এইরকম পাগলামিকে কেউ বলতেই পারে আদিখ্যেতা। কিন্তু আমার কাছে চিরকালই খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে, এখনও আসে। একসময় যখন প্রেমের বর্ষাতি মাথায় নিয়ে দু’জনে পায়ের পাতা ডুবিয়ে, কখনও হাঁটুজল ভেঙে পত্রিকার কাজে কলেজস্ট্রিট পাড়ার লেটারপ্রেসে যেতাম, তখন মনে মনে ভাবতাম, আমাদের যদি মাটির দেয়াল দেওয়া একটা ছোট পাতার ঘরও হয়, তাকেও এমনি ভিজতে দেব। তারও দরজা খুলে রাখব। আমাদের সঙ্গে সেও ভিজবে। ভিজতে ভিজতে মটির দেয়াল ধুয়ে গেলে আবার গেঁথে নেব। স্বপ্নের সেই মটির দেয়াল আটত্রিশ বছরের রোদ বৃষ্টি মেখে এখন পোক্ত হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজলে আর গলে যায় না তার দেয়াল। বৃষ্টি আমার সিক্ত সুখের ডালি।

আটলান্টায় এসে এক খামখেয়ালি বৃষ্টির সঙ্গে দেখা হল। বুঝলাম মাঝেমধ্যে দেখা হবে আমাদের। অপ্রত্যাশিতভাবে পথ আগলে দাঁড়াবে। গাড়ির জানালার কাচ ভিজিয়ে দেবে, খুব ইচ্ছে করলেও হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারব না। আবার রোদের মুচকি হাসি উপহার দিয়ে পালিয়ে যাবে। এখানে বৃষ্টি দাঁড়িয়ে থেকে ঝরে না। ছুটতে ছুটতে ঝরায়। এখানকার মানুষজন রোদ্দুর ভালোবাসে। টানা দু’মাস আমরা বৃষ্টিতে ভিজি শুনে অবাক হয়। এক ভদ্রমহিলা বললেন ‘মনসুন’-এর  কথা বইয়ে পড়েছেন। এখানে মেঘ সারাবছর নিজের খেয়াল খুশিতে খানিক জল ঝরায় বটে। সে বৃষ্টি ‘অটাম ফল’-এর সঙ্গেও ঝরে, ডিসেম্বর-জানুয়ারির বরফের সঙ্গেও ঝরে। এখানকার ঋতুচক্রে তার নিজের জন্যে বরাদ্দ জায়গা নেই। এই যে জলভরা মেঘ, তা হয়তো বা পূবের দেশ থেকে বেড়াতে আসে আমাদের মতো।

শুনেছি আটলান্টার ছত্রিশ শতাংশ মৃত্তিকা দখল করে আছে গাছগাছালির সবুজ। তাই হয়তো সজল মেঘ দু’দণ্ড জিরিয়ে যায়। যেখানে বসে লিখছি, তার সামনে টানা কাঁচের দেয়াল… তার ওপাশে ওক, মেপল, পিচ, জুনিপার, আরও কী সব নাম না জানা গাছের জটলা। তার ওপাশে চাট্টাউচি নদী। সবুজ শাড়ির পাড়ের মতো যা বয়ে গেছে আটলান্টার এ প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। এখান থেকেই নদীর বয়ে যাওয়ার শব্দ কানে আসে। সারাক্ষণ শুনতে পাই অচেনা পাখির সুরেলা ডাক। কিন্তু এই শেষ আষাঢ়ে একটানা ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই না। কাল অনেক রাতে অবশ্য একবার মেঘের ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। হয়তো খানিক জলও ঝরেছিল। থেমে গেলে মনে হয়েছে, স্বপ্নে এসেছিল।

অনেকক্ষণ ধরে পিচ গাছের ডালটায় একটা অরিয়ল বসে শিস দিয়ে চলেছে, তার পাতায় দেখছি বিন্দু বিন্দু জল। দেখতে দেখতে ভেতরে কেউ গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘এসেছিলে তবু আসো নাই, জানায়ে গেলে…’। এখনও গাছের ফাঁকফোকর ভরে আছে ধূসর মেঘে। সামান্য বৃষ্টি হলেও হতে পারে।