Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘বাহোঁ মেঁ চলে আও’ : একটি রাজনৈতিক আলিঙ্গন ও শরদৃষ্টির আখ্যান

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

“…অতঃপর গদগদ চিত্তে, আবেগমথিতঘনবিহ্বল দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন। উত্তেজনায় কাঁপছে শরীর৷ তবু দৃঢ় পদক্ষেপে অর্ধেক পৃথিবী পার হয়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন রাজার সামনে। হাসিমুখের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল কুচি কুচি রোদ্দুরের আলোক কণার মতো বিশ্ব চরাচরে। অথচ যার জন্য এত আয়োজন, সে বিস্মিত, হতবাক। বুঝে উঠতে পারছেন না কী হতে চলেছে পর মুহূর্তে। এ কী কোনও অজানা ঝড়ের পূর্বাভাস নাকি কোনও তীব্র বিস্ফোরণের আগের মুহূর্ত। চাপা উত্তেজনা সর্বত্র। তিনি ইশারা করলেন। দু’হাত, কাঁধ ঝাঁকিয়ে উড়ে এল সেই সংকেত। এসো, সময় হয়েছে। উঠে দাঁড়াও। কিন্তু অপরপক্ষ তখনও দ্বিধান্বিত। সুতরাং, এগোতে তো হবেই একজনকে। তাই তিনিই। হ্যাঁ, তিনিই এগোলেন। ঝুঁকলেন। এবং কোনও কিছু বোঝার আগেই উষ্ণ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হল দুই  দেহ। শরীরে মিশল শরীর, মননে মিশল মন, বোধে মিশল চেতন, এক রাজনীতিতে আরেক রাজনীতি। শঙ্খধবনি হল আকাশবাতাস জুড়ে। শুরু হল পুস্পবৃষ্টি। জয়ধবনি, মাঙ্গলিক। সূচনা হল নতুন সন্ধিক্ষণের। সেই সন্ধিক্ষণ যা একাল-সেকাল-পরকালের অতীতাতীত। এই অপার্থিব মিলন হয়ে রইল কালাকালোত্তীর্ণ।”

ব্যস! এই যথেষ্ট। আর নয়। ঢের হয়েছে৷ নাহ, এটা কোনও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য বা চৈতন্যপ্রেমের সংশ্লিষ্ট নয়। সংশ্লিষ্ট নয়, আলাওল-বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের প্রেমভাবনির্যাসের প্রথমপাঠ। এমনকি নয়, হরগৌরী মিলনের স্বর্গীয় অনুভব। হাজার হোক কলিযুগ। এত কিছু ‘স্বর্গোত্তম’ অনুভূতির প্রকাশ না হলেও, অনেকটা এরকমই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল কংগ্রেস সুপ্রিমো রাহুল গান্ধী ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সংসদীয় আলিঙ্গনের মুহূর্তে। এই সময়ে যা নিয়ে চর্চা ও পালটা চর্চার চারাগাছটি কেন্দ্রীয় ও বিকেন্দ্রীয় রাজনৈতিক পরিসরে ক্রমে সুবিশাল মহীরুহের আকার নিয়েছে৷

মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবে বাজি ধরেছিল বিরোধীরা। জানা ছিল সংখ্যাতত্ত্বে ভর দিয়ে এ যুদ্ধ জেতা অসম্ভব৷ কিন্তু অনাস্থা মানে শুধু সংখ্যা নয়, নীতির লড়াইও তা জানা ছিল সকলেরই। তাই ‘শেষ কামড়’ই শেষ কথা বলবে, এই আশায় করা হয়েছিল ভর। রাহুল বুঝেছিলেন অনাস্থা প্রস্তাবে তার ভূমিকা আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের ভিত গড়বে। আর সেই মতোই সাজিয়েছিলেন তার ঘুঁটি। ‘থার্ড রাউন্ডে’ ব্যাট হাতে তাই ক্রিজে এলেন খোদ অধিনায়ক৷ বলতে নেই, ভালোই ব্যাটিং করলেন তিনি। লং অনের উপর দিয়ে সপাটে নেমে এল নোটবাতিল, জিএসটি, ব্যাঙ্কিং দুর্নীতি। হুক করলেন রাফায়েলে। দু একটা খুচরো রান পেলেন ‘মোদিজি আমার চোখে চোখ রাখছেন না কেন?’-র মতো লোপ্পা বলে৷ কিন্তু দরকার ছিল একটা মোক্ষম সিক্সার। আর তার জন্য দরকার রাষ্ট্রহিংসা, গেরুয়া রাজনীতি আর সংখ্যালঘু নিপীড়নের ক্রিজে স্টেপ আউট করে কেন্দ্রের ফুলটসে ছক্কা হাঁকানোর। এর জন্যই দরকার ছিল হিংসার বদলে ভালোবাসার সুপ্রাচীন গল্পগাথার।

এবং তাই করলেন কংগ্রেস সুপ্রিমো। স্টেপ আউট করলেন নির্দ্বিধায়। ‘যদি মারো কলসির কানা/তাই বলে কি প্রেম দেব না’ আউড়ে কুড়ি ফুটের ‘ওয়েল’ ঘুরে সরাসরি পৌঁছলেন মোদির কাছে। হতবাক মোদি, হতবাক ট্রেজারি ও বিরোধী বেঞ্চ। হতবাক সোনিয়া গান্ধীও। কিন্তু রাহুল অবিচল। নিমেষে ৫৬ ইঞ্চির অগভীর সমুদ্রে মিলিয়ে দিলেন নিজেকে। সংসদে যেন উঠে এল একটুকরো নবদ্বীপ। ধন্য ধন্য পড়ে গেল সদনে। চিকচিকে চোখে অবাক দৃষ্টি নিয়ে ছেলের কাণ্ডকারখানা আগাগোড়া দেখে গেলেন সোনিয়া। হাসি উপচে পড়ল স্পিকার, বিজেপি সংসদীয় দল ও বিরোধীদের মুখে। ফিরে আসতে গিয়ে কাছে ডেকে নিলেন স্বয়ং মোদি। মেলালেন হাত। রাজ্য জয় করার হাসিমুখে নিয়ে আসনে ফিরলেন রাহুল। কিন্তু খেলা তখনও বাকি ছিল।

রাহুলের এই ‘হাগপ্লোমেসি’ নিয়ে ততক্ষণে দুভাগ হয়ে গেছে পর্যবেক্ষক মহল। একাংশের মতে, উচিত কাজই করেছেন রাহুল। কেন্দ্রীয় হিংসার মুখে দাঁড়িয়ে তার এই সৌহার্দ ও ভালোবাসার বার্তা নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক পরিসরে ঐতিহাসিক এক পদক্ষেপ। সংসদীয় ইতিহাসে এমন বেপরোয়া প্রেম নিবেদন দেখা পাওয়া ভার। কারণ কেন্দ্রীয় বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে “আমার বিরুদ্ধে আপনাদের যাই ক্ষোভ বা বিদ্বেষ থাকুক না কেন, আমার তা নেই”– এমন সোজাসাপ্টা অথচ মর্মভেদী ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ অন্য মাত্রা দিয়েছে রাহুলকে। এখন তিনি আর ‘পাপ্পু’ নন। নিঃসন্দেহে অনেক পরিণত রাহুল। নয়তো তার ভাষণে প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে দুরমুশ করার পাশাপাশি কিনা করতে পারেন– “সেই আবেগই আপনাদের থেকে বের করব”-র মতো ধারালো মন্তব্য যাতে একাত্ম হয়েছিল গোটা দেশ। যদিও নিজের আসনে ফিরে দলীয় সাংসদ কে সি ভেনুগোপালের উদ্দেশ্যে তার সেই ‘চোখ টেপা’ চুড়ান্ত নিম্নরুচির পরিচায়ক বলেও মনে করছেন অনেকে। বিদ্বজ্জনেদের মতে রাহুলের বডি-ল্যাংগুয়েজ ঠিক ও ভুল দুই’রই সমার্থক। তাদের মতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার দরাজ আলিঙ্গনের উদারনীতিবাদ ওই একটি অযাচিত ‘চক্ষু ইশারা’য় ম্লান হয়েছে। যেন নিজেই নিজের পায়ের তলার পাটাতন সরিয়ে ফেললেন। পরে এই প্রসঙ্গে স্পিকার সুমিত্রা মহাজন বলেন, ‘কোলাকুলি বা সৌহার্দ্য প্রদর্শন অসাংবিধানিক কিছু নয়। কিন্তু জায়গাটি সংসদ। তাই সেখানে শিষ্টাচারের কথা মাথায় রেখে চলা উচিত। স্থান-কাল-পাত্র রহিত হওয়া উচিত না।’ তবে স্পিকার এও বলেন, ‘সংসদের মধ্যে এই ভাবে প্রকাশ্যে চোখ টিপে ইশারা করাও চরম অসম্মানজনক।’ এতে রাহুলের ‘স্ব-অবস্থান’ই প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন তারই দলের সাংসদেরা।

অন্যদিক দিয়ে দেখলে, রাহুলের ‘হাগপ্লোমেসি’র পর দেশের ও দশের কাছে ক্রমশ ভরসা হারাতে বসা মোদি তার অনাস্থা ভাষণে নতুন কোনও সমীকরণ তুলে আনেন কিনা তাই দেখার ছিল অপেক্ষা। সেই সুযোগও ছিল তার। কিন্তু সেই ‘বাড়া ভাতে ছাই’ ফেলে এলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। রাহুলের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার তাড়াহুড়ো নিয়ে কটাক্ষের পাশাপাশি তার ‘চোখ মারা’ দেখাতে গিয়ে মুখ ও হাতের ইশারায় ততোধিক বিকৃত, নিম্নরুচির, অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে মুখ ডোবান মোদি। সেটিও যে একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রেত তা মোদির বোঝা উচিত ছিল।

প্রশ্ন উঠেছে, সংসদে এই ‘ভাগবত’ প্রেম নিবেদন ও চক্ষুন্মীলন থেকে কী পেল ১২৫ কোটির দেশ? শুধুই রাজনৈতিক প্যাঁচপয়জার, ও আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের শরীরি ভাষ্য? হ্যাঁ, শুনতে নেতিবাচক লাগলেও তার বাইরে আর কিছুই নয়। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জগতে কালের নিয়মে যা ম্লান হবে একদিন। শুধুই প্রাপ্য সেই অমোঘ মুহূর্ত কিছু। তার বেশি কিছু নয়। কারণ শুধুমাত্র ‘শো বাজি’ ও ‘চোখের ইশারা’ দিয়ে রাজনৈতিক রণকৌশল টিকিয়ে রাখা যায় না। রাখা যায় না দীর্ঘমেয়াদি কোনও প্রভাব। শুধুই জল্পনা ও কল্পিত ভাবলোকের প্রতিধবনি ছাড়া উঠে আসে না কিছুই। বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থ সেখানে হয় না চরিতার্থ। কারণ রাজনীতি এতটা ছেলেখেলার জায়গা নয়। ‘হাগপ্লোমেসি’ ও ‘উইংকপ্লোমেসি’-র এই পরীক্ষায় রাহুল-মোদি দুজনেই যে দিনের শেষে সুবৃহৎ অশ্বডিম্বের অধিকারী হয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। কারণ, কোথাও না কোথাও উভয় নেতৃত্বের হাস্যকর, শিশুসুলভ আচরণের কাছে ঢাকা পড়ে গেল সংসদীয় গরিমা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও ‘ন্যাচারাল ম্যাচুরিটি’র নিদর্শন। অলক্ষ্যে মুচকি হাসলেন বাবাসাহেব আম্বেদকর বা মাভালংকরের মতন সংসদ রচনাকারেরা। যা সাদা চোখে দেখতে পেলাম না আমরা।

পরিশেষে ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে উঠে আসে আরেকটি গল্প। ‘হাগপ্লোমেসি’র আঁতুরঘর রূপে যা সর্বত্র পরিচিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পুত্রশোকাহত ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাণ্ডবরা হাজির হলে পুত্রসম ভীমকে তিনি আলিঙ্গন করতে চান। কৃষ্ণ তার সেই অভিসন্ধি বুঝতে পেরে ভীমের বদলে তার লৌহমূর্তি এগিয়ে দেন যাতে একদা গদাভ্যাস করতেন দুর্যোধন। ভীমের পরিবর্তে সেই লৌহমূর্তি নিমেষে ধৃতরাষ্ট্রের উষ্ণ ও ভয়াল বাহুবন্ধনে চূর্ণবিচূর্ণ হয়। রক্ষা পান ভীমসেন।

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ধৃতরাষ্ট্র বা লৌহনির্মিত ভীমসেনের ভূমিকায় মোদি বা রাহুল যে কেউ নামতে পারেন, কিন্তু গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে আকাশে উড়ে যাওয়া ওই লৌহচূর্ণ যে ১২৫ কোটি মানুষের নীরব, নিস্পন্দ ও অসহায় অভিব্যক্তি তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তারা জানেন, আসন্ন সংসদীয় অধিবেশনে বা নির্বাচনী প্রচারের সময় এমন বহু ‘হাগপ্লোমেসি’ বা ‘উইংকপ্লোমেসি’ জাতীয় প্রচুর হাস্যকর উপাদানের সাক্ষী থাকবেন সকলেই। বাস্তবসম্মত, জনহিতকর জাতীয় কিছু সেখানে আশা করা বৃথা। বাকিটা হে পাঠক, সরল সমীকরণ মাত্র। ছক কষে দেখে নিন সত্যাসত্য, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির এই মহাভারতীয় খণ্ডকাব্য৷