সংসদে বইমেলা, বইমেলার সংসদ

সংসদে

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

শীতকালের সকাল দিল্লিতে বড় ভয়ানক। যারা জানে তারা তা হাড়েহাড়ে টের পায়। আর যদি সে সময় পার্লামেন্ট চলে, তাহলে তো কথাই নেই, আমদের মতো সাংবাদিকদের নাভিশ্বাস ওঠা অনিবার্য। এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি ঘড়ির কাঁটা নটা পেরোচ্ছে। অগত্যা দৌড় দৌড় দৌড়। আজ আবারও লেট হবে মনে হচ্ছে। ব্রেকফাস্ট করা যাবে না। সেটা না হয় ক্যান্টিনেই ধরা থাক। কিন্তু ঠিক সময়ে না পৌঁছালে সেশন অ্যাটেন্ড করা যাবে না। জাতীয় রাজনীতির কত রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত হাতছাড়া হতে পারে। অতএব ছুট ছুট ছুট। কোনও রকমে স্নানটান সেরে দুদ্দার অটো ধরে মেট্রো হাঁকিয়ে সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট। জোরকদমে পা চালিয়ে পার্লামেন্টের ‘এন্ট্রান্সে’ পৌছে দেখি…

একি, এত সানাই বাজছে সংসদে! তাও কিনা সাতসকালে বিসমিল্লাহ খানের মিশ্র খাম্বাজ। অবাক কাণ্ড, এমনটা তো কখনও শুনিনি। তোরণটাও কেমন যেন অচেনা ঠেকছে। ফুলটুল দিয়ে সাজানো। বেশ ঝাঁ চকচকে ব্যাপার। হচ্ছেটা কী? কোনও অনুষ্ঠান? পার্লামেন্টারিয়ান’দের মিটিং? লাঞ্চ? কিন্তু তাতেও তো কখনও এমন সাজগোজ দেখিনি আগে। আজ হল কী এই জায়গাটার! এসব ভাবতে ভাবতেই ঢুকে পড়েছি ভিতরে। ঢুকতেই মুখোমুখি এক পরিচিত সিকিউরিটি অফিসারের সাথে। তাকেই জিজ্ঞেস করা যাক!

–কী ব্যাপার, আজ হাউস নেই?
–নাহ, এডজর্ন্ড হয়ে গেছে।
–সেকি কেন?
–স্পেশাল অকেশন ভাইসাব। অন্দর যাইয়ে পাতা লগ জায়েগা।

সিকিউরিটি ইনচার্জের এমন হাসিমুখ, গাছাড়া ভাব দেখে অবাকই হলাম। সংসদে এমনটা তো কখনও হয় না। এমন সময় চোখে পড়ল বিরাট সেই ফেস্টুন-টা। ‘উইন্টার বুকফেয়ার অফ পার্লামেন্ট’! ঠিক দেখছি ত! নাকি আমার চোখদুটোই গোল্লায় গেছে। পার্লামেন্টে বুকফেয়ার! এও কখনও হয়েছে নাকি! কিন্তু না, ভুল দেখিনি! সংসদের বিরাট চত্বর জুড়ে ছোট ছোট বুকস্টল। অথচ তা কোনও প্রকাশনা সংস্থার নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। কী কাণ্ড! এদিনও দেখতে হবে সত্যিই ভাবিনি।

ওই তো বাঁ দিকে এক কোণায় সিপিএমের স্টল। সীতারাম ইয়েচুরি, করুনাকরন বসে চা খাচ্ছেন। রঙ্গনাথন গুছিয়ে রাখছেন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, ‘হাউ টু বি এ গুড কমুনিস্ট’, জন রিডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’, ‘সিলেক্টেড ওয়ার্ক্স অফ মার্ক্স এন্ড এঙ্গেলস’ আরও কত কি! ওই তো সেলিমদা— মহম্মদ সেলিম গোটা কয়েক বিজেপি সাংসদকে ‘ডাস ক্যাপিটাল’ হাতে কী যেন হাতপা নেড়েটেড়ে বোঝাচ্ছেন। পাশেই দেখি কংগ্রেসের বুকস্টল। গান্ধির ‘মাই এক্সপিরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’, ‘সিলেকটেড লেটারস’, নেহরুর ‘দ্য ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’, ‘লেটারস টু ডটার’, শশী থারুরের ‘হোয়াই আই এম এ হিন্দু’, ‘অ্যান এরা অফ ডার্কনেস’, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী, ইন্দিরা-রাজীব গান্ধিকে নিয়ে লেখা বই… আরও কত কী! দেখি সুস্মিতাদি, আমাদের শিলচরের সাংসদ সুস্মিতা দেব স্টলের বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁকডাক করছেন ‘স্পেশাল ডিস্কাউন্ট! স্পেশাল ডিস্কাউন্ট!’ রাহুল গান্ধিও রয়েছেন দেখছি! হাতে একটা বই, উলটে পালটে দেখছেন! বইয়ের নামটা দেখতে পেলাম না। তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া দেখি তাঁর বাবা মাধবরাও সিন্ধিয়ার আত্মজীবনী এগিয়ে দিল এনসিপির সুপ্রিয়া সুলের দিকে। সুপ্রিয়া, শরদ পাওয়ারের মেয়ে। বেজায় বিদূষী। ওরে বাবা, প্রচুর বইও কিনেছে দেখি। কংগ্রেসের দীপেন্দ্র হুডা, রাজীব সাঁতো, গৌরব গগৈর মত ছোকরা সাংসদেরা স্টল সামলাচ্ছে। স্টলের ভিতরে নেহরু, ইন্দিরা, রাজীবের ছোট ছোট পোস্টার। পি এল পুনিয়া আর ভেনুগোপাল সেগুলির তদারকি করছেন। সনিয়াজিকে দেখছি না তো… অবশ্য ওনার শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছে না শুনছি। বিহারের সাংসদ রঞ্জিতা রঞ্জন দেখি কত বই বিক্রি হল তার হিসেব নিয়ে ব্যস্ত।

এসব দেখতে দেখতেই পৌছে গেছি পার্লামেন্টের অন্য প্রান্তে। ওমা, লো ভল্যুমে বাংলা গান বাজছে দেখি। এ তাহলে নির্ঘাৎ তৃণমূলের স্টল। যা ভেবেছি! ওই তো মুখ্যমন্ত্রীর মুখ আঁটা ব্যানার দেখতে পেলাম। অধিকাংশ বই মুখ্যমন্ত্রীর লেখা। ‘কথাঞ্জলী’ থেকে ‘ক্রোকোডাইল আইল্যান্ড’, ‘মা’ কী নেই সেখানে। ইদ্রিশ আলি দৌড়ে দৌড়ে বিজেপি আর সিপিএম সাংসদদের ধরে ধরে সেই বই কেনাচ্ছেন। আবার ছবিও তুলে রাখছেন৷ বাহ, যোগেন চৌধুরীর ‘পার্লামেন্টারি স্কেচ’ বেরিয়েছে দেখছি। রয়েছে সুগত বসু, কৃষ্ণা বসুর লেখা বই’ও। নিতে হবে দু’একটা। নাট্যকর্মী-সাংসদ অর্পিতা ঘোষ দেখি জর্জ ওরওয়েলের ‘পশুখামার’ হাতে পরেশ রাওয়ালকে কী যেন বোঝাচ্ছেন। দুজনে সাংসদ কম, অভিনেতা একশো গুণ ভাল। সুব্রত বক্সি দেখি ক্যাশবক্স সামলাচ্ছেন। সুদীপদা তাকে হেল্প করছেন। শিশির অধিকারী মনে হল অনেক দৌড়াদৌড়ি করে এখন একটু ঝিমোচ্ছেন। মানস ভুঁইয়া তাকে এগিয়ে দিচ্ছেন প্রেশারের ওষুধ। অভিষেক, দীনেশদা, তাপস পাল ধরাধরি করে বই গোছাতে ব্যস্ত। শুধু দেখি এক কোণে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে প্রসূনদা, বিখ্যাত ফুটবলার-সাংসদ প্রসূন ব্যানার্জি। ফুটবল নিয়ে কোনও বই নাকি আসেনি তাই তার মনখারাপ।

সংসদের প্রধান ফটকটা প্রায় জবরদখল করে বিজেপির বুকস্টল। সেখানে রয়েছে শ্যামাপ্রসাদ-দীনদয়াল উপাধ্যায়ের জীবনী, তাঁদের মৃত্যুরহস্য, সাভারকরের নোট বুক, আয়েঙ্গারের যোগাসন, গডসের লেখা ‘মে আই প্লিজ ইউর অনার’ আরও কত কী। রয়েছে গো-পালন পদ্ধতি, নিরামিষাশী রান্নার রেসিপি, হিন্দুধর্মের প্রকারভেদ, গঙ্গা শুদ্ধিকরণ তত্ত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি।

কী অদ্ভুত দৃশ্য! সংসদে এসে এমন জিনিস দেখতে হবে ভাবিনি। ওই তো প্রধানমন্ত্রী মোদি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গে ঝুঁকে পড়ে কথা বলছেন। সিংজি হাসছেন। তার হাতে ধরা সঞ্জয় বাড়ুর ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল পিএম’! সৌগত রায় কী যেন একটা বই এগিয়ে দিলেন রাজনাথ সিং-এর দিকে। দেখি ‘দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস’…। বৃদ্ধ আডবানি স্টলের এক কোণায় বসে মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন ‘দ্য হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান পার্লামেন্ট’! সুষমা স্বরাজ ঝুঁকে পড়ে তা দেখছেন। সংসদে বইমেলা হবে আর প্রণববাবু থাকবেন না তা কী করে হয়। কয়েক প্যাকেট বই কিনে এখন তিনি গান্ধিমূর্তির তলায় বসে চুপ করে পড়ছেন। এখন তাকে ডিস্টার্ব করা যাবে না। স্মৃতি ইরানি দেখলাম তাকে এক গ্লাস জল দিয়ে এলেন।

আর এসব অবাক চোখে দেখতে দেখতে দেখি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন শশী থারুর। এইমাত্র অরুণ জেটলিকে তার নতুন বই ‘দ্য প্যারাডক্সিকাল পিএম’ সই করে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলতেই জিজ্ঞেস করলাম,

–সংসদে বইমেলা হচ্ছে। এ তো ভাবতেই পারছি না। কী করে হল এটা বলুন তো?
–এটা ভারতবর্ষ। এখানে সব কিছু সম্ভব! বললেন তিনি।
–কিন্তু তাও কী করে?
–ফোন বাজছে, ধরুন!
–আজ্ঞে?
–আপনার ফোন বাজছে ধরুন! শশী হেসে বললেন।

সত্যিই তো ফোন বাজছে পকেটে। রিংটোনে মেহেদী হাসান। তাড়াতাড়ি বন্ধ করতে পকেটে হাত ঢোকালাম, আর…

আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। বেশ জোরেই বাজছে ফোনটা। ধড়মড় করে খাটের উপর উঠে বসে দেখি কোথায় পার্লামেন্ট, কোথায় বুকফেয়ার। একি কাণ্ড! আমি কি তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ ধরে! থ মেরে বসে থাকলাম খানিকক্ষণ। গত সপ্তাহ থেকে  শুরু হয়েছে কোলকাতা বইমেলা। প্রতিবারের মত এবারেও পার্লামেন্টের জন্য যেতে পারিনি। এই বছর নিজের একটি বইও বেরিয়েছে, তাও পারিনি যেতে। ফেসবুকে সকাল বিকেল বইমেলা নিয়ে পোস্ট দেখছি। কিন্তু উপায় নেই। কাজে বাঁধা। তাই দিল্লিতে বসে পার্লামেন্ট কভার করা আর এই সব উদ্ভট স্বপ্ন দেখা! মনটা সত্যি কেমন যেন হয়ে গেল! বাইরে একটু একটু করে ফরসা হচ্ছে শীতকালের দিল্লি।

আচ্ছা যদি সত্যি এমনটাই হত। সত্যি যদি কখনও পার্লামেন্টের ভিতরে বসত একটা আস্ত বইমেলা। হয়তো একদিনের জন্যই। সেই দিন শুধু বইয়ের জন্য মুলতুবি হত লোকসভা-রাজ্যসভা। সাংসদরা ওয়েলে নেমে গলা না ফাটিয়ে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নিজের নিজের পার্টির অথবা ব্যক্তিগত বই বেচতেন! ছোট ছোট বুকস্টল বসত চত্বরে। বইয়ের মধ্যে দিয়ে যদি চিনে নেওয়ার চেষ্টা চলত অন্যের মতাদর্শ, রাজনৈতিক ভাবধারাকে। কী জানি, মনে হয় এতটা দূরত্ব তৈরি হত না দলগুলির। এই ছোট ছোট ভারতবর্ষ ঘিরেই হয়তো সৃষ্টি হত আরেক ভারতবর্ষের। সেই ভারতবর্ষ শুধু বইয়ের। সেখানে সারা বছর শুধু বইমেলা, বই বিকিকিনি। সংসদের বইমেলা কখন পরিণত হত বইয়ের সংসদনামায়।

আমার ফোন এখনও বেজে যাচ্ছে। আমার ধরতে ইচ্ছা করছে না। ফোনের রিংটোনে মেহেদী হাসান– ‘আ ফিরসে মুঝে ছোড়কে জানে কে লিয়ে আ… রঞ্জিসী সহী!’

শুনেছি, ভোরবেলার স্বপ্ন সত্যি হয়! তাই যেন হয় ইচ্ছে-ঠাকরুণ, তাই যেন হয়!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...