Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

উস্তাদ রঈস খান

রামপ্রপন্ন ভট্টাচার্য

 

মে মাসে ছয় তারিখে, করাচীতে, গত হলেন বিশ্বের অন্যতম সেতারবাদক উস্তাদ রঈস খান। হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে হাসপাতালে যাবার পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন এই মহান শিল্পী। পিতার দিক থেকে মেওয়াতী ও মাতার দিক থেকে এটাওয়া (বা ইমদাদখানী) ঘরানার উত্তরসূরি খানসাহেবের শিরায়-ধমনীতে প্রবাহিত হত সঙ্গীত।

 

উস্তাদ মোহম্মদ খান, খানসাহেবের পিতা, ছিলেন সে-যুগের অন্যতম শ্রেষ্ট ‘বীণকার’, এবং একাধারে বীণা, সুরবাহার ও সেতারবাদক। উস্তাদ বিলায়েত খান এবং উস্তাদ ইমরাত খান – এ-যুগের যথাক্রমে দুই শ্রেষ্ঠ সেতার ও সুরবাহারবাদক, এঁরা সম্পর্কে খানসাহেবের মামা।

 

খানসাহেবের জন্ম ইন্দোরে, ১৯৩৯ সালে। স্বাভাবিক সঙ্গীতপ্রতিভার অধিকারী তিনি কৈশোরোত্তরণের আগেই বিভিন্ন মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। অতি অল্প বয়সেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর দখল কেমন ছিল, তা ভৈরবীর একটি অধুনা সহজলব্ধ রেকর্ডিং শুনলেই বোঝা যায়। এটি রেকর্ডিং সম্ভবত তাঁর প্রথম রেকর্ডিং। অচিরেই খানসাহেব ভারতীয় উপমহাদেশের এক অগ্রগণ্য সেতারবাদক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।

 

খানসাহেব বাজাতেন গান্ধার-পঞ্চম সেতার, যা তাঁর মামা উস্তাদ বিলায়েত খান জনপ্রিয় করেন। এই ধরণের সেতারের বিশেষত্ব হল – এতে গায়কী অঙ্গের সূক্ষ্ম কারুকাজ খুব সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। তবু এই সেতার তিনি বাঁধলেন তাঁর স্বনেচ্ছা অনুযায়ী – ডি স্কেলে, আর প্রধান তার হিসাবে সঙ্গে নিলেন চার নম্বরের তার। এই ত্র্যহস্পর্শে তৈরী হল তাঁর নিজস্ব শব্দ, যা একাধারে সুমধুর ও ভাবগম্ভীর।

 

দুই হাতের মধ্যে সমন্বয়ের ব্যাপারে উস্তাদজী ছিলেন কিংবদন্তীপ্রতিম। মীড়, মুড়কি, গমক (স্বর থেকে স্বরান্তরে ভেসে যাওয়ার জন্য সেতারের তার-আন্দোলনের বিবিধ পদ্ধতি), ছুটতান এবং সাপাট তান (স্বরাবলীর মধ্যে নানান নকশা তুলে অত্যন্ত দ্রুত এবং জটিল গতায়াত) – তাঁর এইসব বিষয়-সম্পর্কিত ভাবনা ও হাতেকলমে সেই ভাবনাকে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের মুগ্ধ করে। যে কোনো সঙ্গীতাংশের – সে যত দ্রুত লয়েরই হোক না কেন – উস্তাদজী তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন নিখুঁতভাবে, ভাবের প্রতি পূর্ণ সুবিচার করে।

প্রথম-প্রথম উস্তাদজী প্রথাসিদ্ধভাবে আলাপ-জোড়-উলটা ঝালা-বিলম্বিত-দ্রুত-ঝালা – এই চেহারায় বাজাতেন যা কি না সাধারণভাবে যন্ত্রসঙ্গীতের শিল্পীরা অনুসরণ করে থাকেন। পরবর্তীকালে, খেয়ালশৈলীর সঙ্গে আরও একাত্ম হবার লক্ষ্যেই বোধ হয়, উস্তাদজী শুরু করলেন ছোট ছোট ‘আওচার’-এর ব্যবহার। এরপর ‘অতি-বিলম্বিত’ (আলাপের ঢঙে বিস্তার, তারপর ছন্দের কাজ আর তান), দ্রুত (বিস্তার আর তানের বৈচিত্র্যসহ) ও ঝালা। খানসাহেবের সঙ্গীত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, সরল, প্রত্যুৎপন্ন ও হৃদয়োৎসারিত – ঠিক তাঁর ব্যক্তিত্বের মতই। ছন্দের কাজ ততটুকুই তিনি মেলাতেন যতটুকু তাঁর বাজনা ও মেজাজের সঙ্গে যায়।

 

খানসাহেবের লাইভ কনসার্টের ক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের মত সঙ্গীতশিক্ষার্থীদের একটা অনুযোগ ছিল। এইসব অনুষ্ঠানে শেষ দেড় দশক ধরে উনি সাধারণত চারুকেশী বা বাচস্পতি ( লিঙ্ক )  – এই দুটি রাগের বাইরে যেতেন না। এদিকে আমাদের চাহিদা ছিল অনেক বেশী।

খানসাহেব ছিলেন অনবদ্য গজলগায়ক এবং কম্পোজারও। জীবনের সেরা অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনেক ক’টাই খানসাহেব শেষ করেছেন গজল বা লোকসঙ্গীতের সুর বা ধুন দিয়ে। আফঘানিস্তানের ‘আনর আনর’ ( লিঙ্ক ) – এই লোকসঙ্গীতকে তো খানসাহেব একরকমের অমরত্ব দিয়ে গেলেন। মুম্বাইয়ের এক অনুষ্ঠানে আমি খানসাহেবকে মরাঠী অভঙ্গ গাইতে শুনেছি ও শুনে মুগ্ধ হয়েছি। লতা মঙ্গেশকরের মতন শিল্পীদের গানের সঙ্গে খানসাহেবের বাজানো অংশগুলো স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে।

সঙ্গীতবৃত্তে খানসাহেবের অনেক গল্প আজও খুব জনপ্রিয়। ১৯৭১-৭২ সালে দিল্লীর বিড়লা হলে ছয় থেকে সাত ঘন্টা নৃত্য পরিবেশন করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন সে-যুগের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী গোপী কিষাণ। সেই অনুষ্ঠানের দুই কি তিনমাস পরে সিতারা দেবী – আর এক স্বনামধন্যা নৃত্যপটীয়সী – নয় ঘন্টা ধরে নৃত্য পরিবেশন করেন। আমাদের উস্তাদজী হয়তো এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন। উনি বাজান প্রায় আঠারো ঘন্টা ধরে। তবলাসঙ্গতে তিন জন – উস্তাদ বশির আহমেদ খান, উস্তাদ লতিফ আহমেদ খান এবং পণ্ডিত শামতা প্রসাদ। অতক্ষণ ধরে বাজানোর মধ্যে মধ্যে খানসাহেব আঙুল ছুঁয়ে নিচ্ছিলেন বরফে।

উস্তাদ বিলায়েত খান, উস্তাদ ইমরাত খান আর উস্তাদ রঈস খান – এই ত্রয়ীর একত্রে লাইভ কনাসার্টের কথা কলকাতা ও মুম্বাইয়ের সঙ্গীতরসিকেরা উল্লেখ করেন। খানসাহেব একবার বলেছিলেন – লতাজীর গানের সঙ্গে বাজানোর সময়ে মদন মোহনের মত সঙ্গীত পরিচালকেরা তাঁকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেন গানের মেজাজ অনুযায়ী বাজানোর জন্য। অথচ একবারের জন্যও সেইসব গান দ্বিতীয়বার রেকর্ড করতে হয় নি – এমনই সুপ্রযুক্ত হত খানসাহেবের বাজনা।

 

জীবনটা একজন প্রকৃত সম্রাটের মতন বেঁচে গেলেন খানসাহেব। তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ সাঁতারু, ব্যাডমিন্টনে সুদক্ষ, লাইসেন্সপ্রাপ্ত পাইলট। ভালোবাসতেন গাড়ির রেস। এই দুনিয়া, যাকে ছেড়ে তিনি চলে গেলেন – তাঁকে মনে রাখবে একজন চিরপ্রেমিক, অমর সেতারবাদক হিসাবে। মনে রাখবে মঞ্চে তাঁর আভিজাত্যপূর্ণ উপস্থিতি এবং দেবোপম কান্তি।

 

লেখকের ওয়েবসাইট- http://ramprapanna.wixsite.com/sitar