এখন গানবাজনা মানেই ‘ক্লোনিং’

চিত্রা স্বামীনাদন

 

বছর বারো আগের কথা। চেন্নাইয়ের এক পাঁচতারা হোটেলে মুলাকাত হয় হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুই মহীরুহের। জন্মসূত্রে দুজনেই ভারতীয় হলেও, এঁদের একজন প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছিলেন নিজের দেশ হিসাবে। আলাপচারিতা হল দুই বন্ধু – প্রখ্যাত বংশীবাদক পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া আর বিশ্বখ্যাত সেতারবাদক উস্তাদ রঈস খানের।

এই মুলাকাতকে লিপিবদ্ধ করেন সাংবাদিক চিত্রা স্বামীনাদন। ২০০৫ সালের ২৯-এ অগাস্ট এই ছোট সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় ‘দ্য হিন্দু’ কাগজে। সেই সাক্ষাৎকার আমরা উদ্ধার করে আনলাম রসিক পাঠকদের জন্য। উস্তাদজীকে স্মরণ করি তাঁরই কথায়-আলাপে।

 

হরিপ্রসাদ – (ফোটোগ্রাফারের দিকে তাকিয়ে) সো, ইয়ু আর গোয়িং টু শুট আস?

 

রঈস – কোনো অস্ত্রই আমাদের যন্ত্রের থেকে বেশী শক্তি ধরে না। মেলডি ইজ সো ওভারপাওয়ারিং।

 

হরিপ্রসাদ – ওয়াহ! সাহব। ইস বাত পে কুছ চায়ে ঔর টোস্ট হো যায়ে। (ফোটোগ্রাফারের উদ্দেশ্যে) প্রকৃতিকে ব্যাকগ্রাউইন্ডে রেখে ছবি তুলুন। (সাংবাদিক চিত্রা স্বামীনাদন সম্মতিতে মাথা নাড়ছেন দেখে) দেখুন, আমার চিন্তাভাবনা সবসময় কেমন মহিলাদের সঙ্গে ম্যাচ করে যায়।

 

রঈস – উল্টোটা কিন্তু সত্যি না-ও হতে পারে! (হাসি)

 

হরিপ্রসাদ – আরে, সুইমিং পুলটা দারুণ তো! (জলের ওপরে ভাসমান পুষ্পপাত্র দেখিয়ে) এটা দেখে ওই অ্যাডটার লাকি শাহরুখ খানের কথা মনে হচ্ছে না?

 

রঈস – ইয়ু আর আনস্টপেবল। তবে দেখুন, এই ইয়ার্কি-ঠাট্টা করেই এতটা জীবন কাটিয়ে দিলাম। কোনোকিছুই তো সহজে পাই নি আমরা। আঙুল দিয়ে যতক্ষণ না রক্ত ঝরেছে, ততক্ষণ রেওয়াজ করেছি। পায়ে হেঁটে, বাসে চেপে, ট্রেনে, এমনকি গরুর গাড়িতে পর্যন্ত চেপে দূরদূরান্তরের গ্রামে কনসার্টে পৌঁছেছি।

 

হরিপ্রসাদ – সঙ্গীতের প্রতি আমাদের প্যাশন এখনও যে অক্ষুণ্ণ আছে, সেটা মনে  এই সব কারণেই।

 

রঈস – কিন্তু যেভাবে সব বদলে যাচ্ছে, তাতে আমি বেশ শঙ্কিত। ‘ইনোভেশন’ শব্দটার মানে কী অদ্ভুত হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলুন? শ্রোতারাও এত আনপ্রেডিক্টেবল, যে বাজাতে বসে বুঝতেই পারি না তাঁরা কি চাইছেন।

 

হরিপ্রসাদ – আমার তো মনে হয় দোষ আমাদেরই। নতুনত্বের নামে আমরা স্টেজ পারফরমেন্সের সময়ে ভেজাল মিশিয়ে চলেছি।

 

রঈস – এ কথা বলছেন কি করে? আমার মত যারা, আমরা তো এখনও কনভেনশনাল ফরম্যাট ফলো করছি।

 

হরিপ্রসাদ – জেন নেক্সট শিল্পীদের দেখুন। এরা সব বাণিজ্যিক বাধ্যতার শিকার। দর্শক-শ্রোতা, স্পন্সর আর ইভেন্ট ম্যানেজারদের খুশি করা – এটা একটা ব্যালান্সিং অ্যাক্ট। কিন্তু এরা করে কি, শ্রোতার মনোযোগ কাড়ার জন্য অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে।

 

সব জায়গায় এই একই কাণ্ড। সবথেকে খারাপ লাগে যখন দেখি দক্ষিণ ভারতেও এই একই অবস্থা। অথচ এদের আমরা ভাবতাম ঐতিহ্যপ্রিয়। আমার মনে পড়ে ওইসব দিনগুলোর কথা, যখন এস এস ভাসনের ফিল্মের রেকর্ডিং আসতাম, আর মাসের পর মাস সারা তামিলনাডু চষে ফেলে প্রোগ্রাম করতাম কর্ণাটিক মিউজিকের স্টলওয়ার্টদের সঙ্গে।

 

রঈস  – এখনকার অবস্থায় আপনার অস্বস্তি হয় না?

 

হরিপ্রসাদ – দেখুন, এতে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। আমি আশা রাখি এই সময়টা কেটে যাবে। এই বাঁশী হল আমার ঈশ্বর, স্বর আমার মন্ত্র। আমার বৃন্দাবন গুরুকুলের (হরিজীর স্কুল) শিষ্যরা আমার সন্তানের মত। আমাকে ফোকাসড রাখার জন্য এই ক’টা জিনিসই যথেষ্ট।

 

রঈস – আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কিন্তু কোনো জঁরের মিউজিকের ওপর বিরক্ত নই। পপ বা জ্যাজ। কিন্তু যে বাজাবে সে ভালো করে শিখে তারপর বাজাক। প্যাচওয়র্ক আমার অসহ্য লাগে। এতে করে কোনোদিন কিছু অ্যাচিভ করা যায় না।

 

হরিপ্রসাদ – দেখুন, যতদিন ভালো রসিক শ্রোতা থাকবে, গানবাজনাও ততদিন বেঁচে থাকবে। কিছুদিন আগে আমি গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়াতে একটা কনসার্টে ভোর বেলা পারফরম করলাম। অনুষ্ঠান ছিল সকাল ছটার থেকে। কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে সকাল পাঁচটা থেকে ওই জায়গা ভর্তি হয়ে গেল। মুশকিল হচ্ছে, এখন ক্ল্যাসিকাল আর্টের জন্য রেডিও আর টেলিভিশন ডেড মিডিয়া হয়ে গেছে। আর আমাদের কালচার ডিপার্টমেন্টের কথা তো যত কম বলা যায় ততই ভালো। ওঁরা মনে করেন পুরস্কার-টুরস্কার দিয়েই ওঁদের কাজ শেষ হয়ে যায়। এখন এমন একটা অবস্থায় এসেছি যে কোনো কিছু ভালো না লাগলে আমি সেইখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই। যেমন, আমি আর শিব কুমার শর্মা ঠিক করেছি যে ফিল্মে আর মিউজিক করব না।

 

রঈস – আমিও আশির দশকেই এই পাট চুকিয়ে দিয়েছি। মদন মোহন, বসন্ত দেশাই, সি রামচন্দর, রোশন, লক্ষ্মীকান্ত – পেয়ারেলালের সঙ্গে কাজ করার পর মনে হয় এখনকার গানবাজনার মধ্যে প্রাণটাই নেই। এই ইলেক্ট্রনিক জমানায় গানবাজনা মানে ক্লোনিং। কম্পোজিং নয়। আমি তাই অতীতেই পড়ে থাকতে ভালোবাসি। মনে মনে গুণগুণ করি ‘পিয়া তো সে নয়না লাগে রে’, ‘রশমে উলফৎ কো নিভায়েঁ’, ‘ম্যাঁয় তো তুম সঙ্গ’, ‘লগ যা গলে…’

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...