Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দ্বিতীয় বর্ষ, চতুর্থ যাত্রা : সকার ইন দ্য টাইম অব কলেরা

স্টেশন মাস্টার

 

এই প্রথম, গত সওয়া এক বছরের নাতিসংক্ষিপ্ত অভিযাত্রায় এই প্রথমবার, মেল ট্রেনের রিজার্ভ্‌ড বগির বিষয় নির্বাচন করতে বসে চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলী আড়াআড়ি ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়াল!

যাঁরা আমাদের কাগজ (আদতে ওয়েব-পত্রিকা, কাগজ বা ছাপাখানার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই, তবু আমরা আদর করে কাগজই বলি) নিয়মিত পড়েন তাঁরা জানেন, মেল ট্রেন আসলে আমাদের মাসিক সংস্করণ, যা প্রতিমাসের পয়লায় প্রকাশিত হয়। আর রিজার্ভ্‌ড বগি হল সেই মাসিক সংস্করণের মূল বিষয়-ভাবনাকে ঘিরে চার-পাঁচটি নিবন্ধের একটি সমাহার, যাকে সচরাচর আপনারা প্রচ্ছদকাহিনি বা কভারস্টোরি বলে উল্লেখ করতে অভ্যস্ত। স্বীকার করে নেওয়া ভাল, মাসের একেবারে গোড়াতেই আমরা যখন অগস্ট সংখ্যার বিষয় নির্বাচন করতে বসি, তখন এক এবং একমাত্র বিশ্বকাপ ফুটবল ছাড়া আমাদের চোখের সামনে আর কিছু ছিল না। কিন্তু জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ক্রমাগত নক্ষত্রপতন, তারকাখচিত ও বিশ্বকাপের প্রধান দাবিদার দেশগুলির সারিবদ্ধ মহানিষ্ক্রমণ দেখতে-দেখতে আমাদের বারবারই মহাভারতের মহাপ্রস্থান পর্বের করুণ অধ্যায়টির দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকায় আমরা প্রায় বদ্ধপরিকর ছিলাম, অনেক হয়েছে — আর যা-ই হোক, ফুটবল নিয়ে একটি কথাও আমরা আর কোনওমতেই বলব না।

কিন্তু খেলাটার নাম যেহেতু ফুটবল, তাই, তারপরেও অভাবিত কিছু ঘটনা ঘটতেই থাকল। দলগত শক্তির বিচারে মদরিচ-রাকিতিচ-মান্দ্‌জুকিচ-রেবিচ-পেরিসিচদের ক্রোয়েশিয়া পুরোপুরি হিসেবের বাইরে থাকা দল না-হলেও তারা যে একেবারে সটান ফাইনালে চলে যাবে, সেটা সারা পৃথিবীর ফুটবল-অনুরাগীদের মতোই আমরাও ভাবতে পারিনি। কিন্তু তার বাইরেও, সেমিফাইনালে ওঠার পর বেলজিয়ামের লুকাকুর একটা বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার, বা সেমিফাইনাল ও ফাইনালের নির্ণায়ক দুই ম্যাচে ফ্রান্সের এমবাপের বিধ্বংসী অথচ শিল্পময় ফুটবল, এবং সর্বোপরি গ্রুপ পর্বেই প্রতিযোগিতা থেকে জার্মানির ছিটকে যাওয়ার পর দেশে ফিরে মেসুট ওজিলের বুট তুলে রাখার সিদ্ধান্ত ফুটবলের গোটা ক্যানভাসটাকেই একটা অন্য চেহারায় চোখের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। আবার নতুন করে ভাবনা শুরু করতেই হল যে, ফুটবল মানে কি শুধু সেইটুকুই যা রেফারির শুরুর আর শেষের লম্বা বাঁশির মাঝখানের সময়টায় চৌকো সবুজ মাঠটার মধ্যে ঘটতে দেখা যায়? নাকি, তার বাইরেও, খেলা শেষের বাঁশি বেজে যাওয়ার পরেও, অদৃশ্য একটা ফুটবল চলতেই থাকে অন্য কোথাও, অন্য কোনও মাঠে?

আর এখান থেকেই শুরু হল সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে তুমুল বিতর্ক। একদল অনড় থাকতে চাইলেন তাঁদের পূর্বঘোষিত ‘শর্মা ওদিকে আর নন’-সূচক অবস্থানে (সন্দেহ, তীব্র রোনাল্ডো-ক্রাশ বা অপরিমেয় মেসিপরায়ণতা-জনিত মোহভঙ্গই তাঁদের এ-হেন সাময়িক সকার-বৈরাগ্যের কারণ), এবং অপরপক্ষ তুমুল উৎসাহে বোঝাতে চাইলেন, কেন এবং কীভাবে শেষপর্যন্ত এই ফুটবলের মধ্যেই ধরা থাকে মার খেতে-খেতে বেঁচে ওঠার কিংবা পালটা মার দিতে-দিতে বেঁচে থাকার কিছু মৌলিক, আবহমান ও অনিঃশেষ সত্য। বিতর্ক যে শেষপর্যন্ত কাগজের সম্পাদকদের হাঁড়ি আলাদা করে দেয়নি তা তাঁদের সকলের ও প্রত্যেকের মহৌদার্য ও গণতান্ত্রিকতার প্রতি আমূল নিষ্ঠার মহাফল — কিন্তু সেই বিতর্কের ডায়ালেকটিক্সের মধ্যে থেকে কীভাবে মাসের শেষে সমাধানের তীরে পৌঁছনো গেল (এবং কাগজ বের করা গেল), মধ্য-জুলাইয়ের অলিপাবের উৎকণ্ঠিত সন্ধ্যাগুলি তার উৎকর্ণ সাক্ষী।

ফুটবল কী এবং ফুটবল কেন? আলোচনার কেন্দ্রে ছিল মৌলিকতম এই দুই প্রশ্ন। তারই টানে এর পর একে-একে এসে জড়ো হতে থাকে আরও নানা উপপ্রশ্ন — ফিরে দেখা শুরু হয় ইতিহাস। আমাদের মনে পড়তে থাকে স্টেডিয়ামে বসে ইরানের মেয়েদের খেলা দেখার বিরুদ্ধে কীভাবে জ্বলে ওঠে মৌলবাদের সবুজ চোখ, তার প্রত্যুত্তরে কীভাবে ইতিহাসের পূর্ণবৃত্ত রচিত হয় বোরখার ঢাকনা খুলে ইস্পাহানি মেয়েদের সোচ্চার মাঠে নেমে পড়ায় – যেন হিংসুটে দৈত্যের বাগানে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে-ঝাঁকে রঙিন প্রজাপতি… মনে পড়তে থাকে বরফমাখা কনকনে ঠাণ্ডার বিকেলে পোল্যান্ডের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর সুনিশ্চিত পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ফুটবলে মেতে ওঠা ইহুদি বন্দিদের কথা – বলের পেছনে যাঁদের প্রতিটি সম্মিলিত দৌড়, বলের গায়ে আছড়ে পড়া যাঁদের প্রতিটি স্পর্ধাবান লাথিতে মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাওয়ার অভ্রান্ত স্লোগান… মনে পড়তে থাকে চেন্নাইয়ের উপকণ্ঠে ব্যাসরপাডির দলিত খ্রিস্টান বস্তি থেকে জয়াসূতা বা ভীমাবাঈয়ের মতো মেয়েরা লাইন দিয়ে ইস্কুলে নাম লেখাতে এসেছে, কেবল প্রত্যেকে নিজস্ব স্টাড-বসানো বুট পাবে, সেই বুট পরে ফুটবল খেলার সুযোগ পাবে বলে – যে ফুটবল তাদের আজন্ম এঁদো বস্তিতে বেড়ে ওঠার মোনোক্রোম জীবনটাকেই পালটে দেবে ম্যাজিকের মতো।

হ্যাঁ, পালটে দেবে। ফুটবল তো জীবন পালটেই দেয়। কীভাবে, নিজেদের জীবন দিয়ে তার সাক্ষী এখনকার ফ্রান্সের অভিবাসী-বংশোদ্ভূত এমবাপে-পোগবা-উমতিতিরা, বা তাঁদের আগের প্রজন্মের অঁরি-থুরাম-জিদানেরা। সাক্ষী ডাচ ফুটবলের গুলিট-রাইকার্ড, জার্মানির ওজিল-বোয়াটেং, ক্রোয়েশিয়ার মদরিচ-পেরিসিচরা। বেলজিয়ামের লুকাকু বিশ্বকাপ চলাকালীনই যখন এক সাক্ষাৎকারে জানান, “গোল করলে আমি বেলজিয়ামের নাগরিক, আর গোল করতে না-পারলে আমি ঘানাইয়ান…” তখন বোঝা যায়, বিপক্ষের জাল লক্ষ্য করে তাঁর এক-একটা শটের পেছনে কতটা বঞ্চনার অভিমান পুঞ্জীভূত জমে থাকে। সেই বঞ্চনার ইতিহাসকেই পুঁজি করে বড় হয়ে ওঠেন লাতিন আমেরিকা বা পূর্ব ইউরোপের দরিদ্রতম ভূখণ্ড থেকে খেলতে আসা রিভাল্ডো-রোনাল্ডো-রোনাল্ডিনহো বা মদরিচ-রাকিতিচ-পেরিসিচরা। সাদা-চামড়ার হাতে মার খাওয়ার শতাব্দীলালিত রক্তক্ষরণ বুকে নিয়ে খেলতে আসে সেনেগাল, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া। রক্তের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা বঞ্চনার ইতিহাসের চাকা মাঠে নেমে ঘুরিয়ে দেওয়ার জেদ থেকেই উঠে আসে ফুটবল — সে আমাদের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের চিরাচরিত দ্বৈরথেই হোক, বা ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনার নব্বই মিনিটের ফকল্যান্ড যুদ্ধে।

আলোচনা এই পর্যন্ত পৌঁছনোর পর আমাদের চোখের সামনে একটা বিষয়ের অবয়ব ফুটে উঠতে থাকে ক্রমশ। খেলার শেষ বাঁশি বেজে যাওয়ার পর ফাঁকা হয়ে আসা স্টেডিয়ামের মাঝখানে রেফারির হাত ফসকে ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে চামড়ার একটা গোলক – যার সারা গায়ে সাত মহাদেশের হাজার সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলো, পেটের ভেতরে অনন্ত আকাশের লক্ষকোটি হাওয়া। সেন্টার সার্কলে একটা অদৃশ্য ড্রপ খেয়ে এর পর উড়তে শুরু করে সে। কুইডিচের সোনালি স্নিচের মতো তার পিঠের দু’পাশে দেখা দেয় স্বপ্নের দুই ডানা। সেই ডানায় ভর করে উড়তে-উড়তে সে পেরিয়ে যায় স্টেডিয়ামের ছাদ, রাস্তা, মিক্স্‌ড জোন। বাসগুমটি পেরিয়ে, রেলস্টেশন পেরিয়ে, শহর পেরিয়ে, গ্রাম পেরিয়ে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, নদী-নালা-পাহাড়-সমুদ্র পেরিয়ে, খরা-বন্যা-দুর্ভিক্ষ-মহামারী পেরিয়ে, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত পেরিয়ে সে যায়… সে যায় অনন্তের যাত্রায় যোগ দিতে…

এই ছবিটি স্পষ্ট হয়ে আসার পর আর সন্দেহ থাকে না যে, এটিই হতে চলেছে আমাদের দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যার মূল বিষয়-ভাবনা। আজকের হিংসাদীর্ণ পৃথিবীর মাথার ওপর দিয়ে স্নিচের সেই সোনালি উড়ালের রূপকল্পটির সঙ্গে কোন ম্যাজিকে যেন জুড়ে যায় মার্কেজের কলেরার দিনগুলিতে প্রেমের প্রেক্ষাপট… আমরা টের পাই, রাউলিং-কথিত সেই জাদু-স্নিচের মতোই আমাদের হাতের প্রায় নাগালে ভেসে বেড়াচ্ছে রিজার্ভ্‌ড বগি তথা মূল বিষয়-ভাবনার বহুকাঙ্ক্ষিত সেই নামটি — সকার ইন দ্য টাইম অব কলেরা। এবারের রিজার্ভ্‌ড বগিতে লিখেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সৌমিত দেব, আকাশ, সোহম দাস ও সোমেন বসু। একই সঙ্গে, ‘এই সময় ইন্ডিয়াটাইম্‌স’-এর ব্লগে প্রকাশিত’ ওই সংবাদপত্রের ক্রীড়া-সম্পাদক রূপায়ণ ভট্টাচার্যর একটি লেখা তাঁর অনুমতিক্রমে আমরা পুনঃপ্রকাশ করেছি।

জুলাইয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরোধাপুরুষ রমাপদ চৌধুরী। আমাদের স্মরণ বিভাগে তাঁর প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য, নীহারুল ইসলাম-এর কলমে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনদা, যাঁর ক্যান্টিনটি ছাড়া ইউনিভার্সিটির ক্যানভাস সম্পূর্ণ হয় না, প্রয়াত সেই মিলনদাকে নিয়ে লিখেছেন যাদবপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অভিজিৎ মুখার্জি। সদ্যপ্রয়াত কবি নিত্য মালাকার-কে স্মরণ করেছেন তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে খুব কাছে থেকে দেখা কবিতা ক্যাম্পাসের অলোক বিশ্বাস

এ-ছাড়াও এ-সংখ্যায় রইল কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, অণুগল্প, অন্যগদ্য, হুইলার্স স্টলধারাবাহিক-সহ অন্যান্য সব নিয়মিত বিভাগ, যেগুলির জন্য আপনারা সারা মাস ধরে অপেক্ষায় থাকেন। গত সংখ্যায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, এই সংখ্যা থেকে আমরা শুরু করলাম নতুন নিয়মিত বিভাগ, ভালো খবর। আপনাদের চাহিদা মেনে, আগামী সংখ্যা থেকে শুরু হবে অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আরও একটি নতুন বিভাগ।

শেষে কেবল একটিই অনুরোধ। আমাদের কাগজ আপনাদের কেমন লাগছে, সে-বিষয়ে যদি আরও বেশি মতামত পাই, তা হলে বড় উপকার হয়। অ্যানালিটিক্‌স আমাদের জানায়, আপনারা নিয়মিত এসে কাগজ পড়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাদের উপস্থিতি যদি আপনারা নিজেরাই মতামতের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন তা হলে সেই অনুযায়ী আমরা নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি শুধরে নিতে পারি।

 

ধন্যবাদসহ