Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিশ্বায়নের দিনগুলিতে কূপমণ্ডূকতা : বিজৃম্ভনজনিত উদ্বাস্তু-বিষয়ক ভাবনাসমষ্টি

ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

 

মানুষ নয়, জিনিস…

পড়ছিলাম দোয়ার কথা। উনিশ বছরের মেয়ে দোয়া। আদি বাড়ি সিরিয়ায়। সেখান থেকে উৎখাত হয়ে জীবিকা নয়, জীবনের সন্ধানে প্রথমে ঈজিপ্ট, তারপর গ্রিস। পড়ছিলাম একটা ছোট ডিঙিতে চেপে আরও তিনশোজনের সঙ্গে সাগরপাড়ি দেবার গপ্পো। ওইটুকু নৌকোয় এত চাপাচাপি যে হাঁটু ভাঁজ হয়ে বুক চেপে ধরে। প্রেমিক বাসেমের সঙ্গে ইয়োরোপ পাড়ি দিয়েছিল দোয়া, সমৃদ্ধির সন্ধানে। জীবনের নয়, জীবিকার সন্ধানে। পড়ছিলাম, কেমন করে অন্য একটা নৌকো ওদের নৌকো থেকে মেয়ে লুঠ করতে আসে, কিন্তু না-পেরে আক্রোশে ডুবিয়ে দিয়ে চলে যায় দোয়াদের নৌকো। ডুবন্ত নৌকোয় কীভাবে মরে যায় প্রায় দুশো মানুষ, যাবার আগে দুই মা তাদের বাচ্চাদের রেখে যায় দোয়ার কাছে, আর একশোজন কোনওক্রমে ছুঁতে পায় গ্রিসের জমি। যে বীরত্বের জন্য দোয়াকে পুরস্কৃত করল গ্রিক সরকার, সেই বীরত্ব সে কোনওদিন দেখাতে চেয়েছিল কি?

বছর পঞ্চাশের রহিমা কদুর বাড়ি ছিল মায়ানমারে। ছয় সন্তানের জননী রহিমার বাড়িতে মায়ানমারের আর্মি যখন আগুন লাগাতে এল, মেয়ে তখন ম্যালেরিয়ায় ভুগছে। ওঠার শক্তি নেই। তড়িঘড়ি নাতিনাতনির হাত ধরে জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। আর্মি ফিরে গেলে, আগুন নিবে গেলে বাড়ি ফিরে পোড়া খুলি দেখে মেয়েকে শনাক্ত করেন রহিমা। একজন মা হিসাবে নিজেকে ব্যর্থ মনে করেন, আজও। সন্তানকে বাঁচাতে না পারার শোক তাঁকে তাড়া করে বাংলাদেশের মাটিতেও।

এরকম গল্পের শেষ নেই। উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে আমরা যে দু-চারটে কথা শুনি, এমন অনেক গল্প জুড়ে ওই সামান্য কথাক’টা তৈরি হয়। তারপর তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে, ততদিন, যতদিন না সেইসব কথার থেকে জন্ম নেবে বিধ্বংসী মেঘদল।

ক’বার তুমি অন্ধ হয়ে…

রাষ্ট্রসংঘের রিফ্যুজি এজেন্সির হিসাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন প্রায় সাড়ে ছয় কোটি উদ্বাস্তু। ভেঙে বলতে গেলে, এঁদের মধ্যে চার কোটি মানুষ আভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত (internally displaced persons), দু’ কোটি হচ্ছেন সঠিক অর্থে উদ্বাস্তু বা refugee বলতে আমরা যা বুঝি, আর একত্রিশ লক্ষ শরণার্থী (asylum seekers)। এই যে সাড়ে ছয় কোটি সংখ্যাটা, এর মধ্যে দেশহীন মানুষ আছেন এক কোটি। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে শতকরা সাতান্ন ভাগের আগমন দক্ষিণ সুদান, আফঘানিস্তান এবং সিরিয়ার থেকে। সারা বিশ্বের স্থানচ্যুত মানুষদের মধ্যে শতকরা পঁচাশি ভাগের আশ্রয়দাতা ইরান, লেবানন, পাকিস্তান, উগান্ডা এবং তুরস্কের মতন উন্নয়নশীল দেশগুলো (প্রথম পাঁচে এরাই), হইচই বেশি করলেও উন্নত দেশগুলো মোটেও এর সিংহভাগ দায় স্বীকার করেনি। এখানে আরও বলা হচ্ছে, প্রতিদিন যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের ফলে গৃহহীন হচ্ছেন চুয়াল্লিশ হাজার চারশো মানুষ, আর প্রতি দু’সেকেন্ডে স্থানচ্যুত হচ্ছেন একজন। আর একটা কথা। ২০১৭ সালে যারা বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হবার জন্য আবেদন করেন, তাঁদের মধ্যে পঁয়তাল্লিশ হাজার পাঁচশো জন শিশু! এই সংখ্যাটা ২০১৪ সালে ছিল এর অর্ধেক।

কিঞ্চিৎ পিছনের দিকে এগিয়ে গেলে দেখতে পাব সর্বত্র একই রক্তক্ষয়ের কাহিনি, কারণ তার যা-ই হোক না কেন। ২০১১ সালে সুদানের থেকে স্বাধীনতা পেয়ে মাত্র দু’বছরের মধ্যেই ২০১৩ থেকে দক্ষিণ সুদানে দুই বিবদমান গোষ্ঠীর লড়াই চেহারা নিয়েছে গৃহযুদ্ধের। গৃহযুদ্ধের কারণে প্রাণহানি ছাড়াও প্রচুর মানুষ পড়েছেন তীব্র খরা, বিধ্বংসী মরুকরণ আর দুর্ভিক্ষের কবলে। দক্ষিণ সুদান — এদিকে — নাম কিনেছে ত্রাণকর্মীদের পক্ষে পৃথিবীর সবথেকে বিপজ্জনক দেশ হিসাবে। ২০১৭ সালে এখানে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন চব্বিশজন ত্রাণকর্মী। এর ফলে পীড়িতজনের কষ্টলাঘবের সম্ভাবনা কমে আসছে আরও, আর যেনতেন প্রকারে মানুষ চাইছেন দেশের সীমানা পার করে অন্যতর বিপন্মুক্ত অঞ্চলে চলে যেতে।

আফঘানিস্তানে বর্তমানে নথিভুক্ত উদ্বাস্তু সংখ্যা প্রায় পঁচিশ লক্ষ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর ঠিকানা এই দেশ। সত্তরের দশকে সোভিয়েতের হাতে যার সূত্রপাত, তার পরিণতি হালের তালিবান সমস্যায়। এই দুয়ের ধাক্কায় লক্ষ লক্ষ আফঘান ভিটেমাটি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন পাকিস্তান আর ইরানে। আশার কথা এই, যে এঁদের অনেকেই এখন দেশে ফিরেছেন। আরও অনেকের ফেরার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

আট হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা সিরিয়ার ওপর গৃহযুদ্ধের খাঁড়া নেমে আসে ২০১১ সালের মার্চ মাসে। আজ পর্যন্ত মোটামুটি এক কোটি একত্রিশ লক্ষ সিরিয়াবাসী এই যুদ্ধের বলি হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ছাপ্পান্ন লক্ষ মানুষ, আর দেশের মধ্যেই বেঘর হয়েছেন একষট্টি লক্ষ। মনে করা হচ্ছে, পীড়িত মানুষের মোট সংখ্যার অর্ধেকই শিশু। লেবানন ও জর্ডন এই উদ্বাস্তুদের প্রাথমিক গন্তব্য হলেও মানবসভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম এই সঙ্কটের বলি এই বিপুলসংখ্যক মানুষ পরে পাড়ি দিয়েছেন ইয়োরোপের পথে। এই লেখা লিখতে বসেছি যখন, যুদ্ধ শুরু হবার এই আট বছর পরেও এই সঙ্কটের কোনও সমাধান দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধ চলছে। চলতে থাকা যুদ্ধের কারণে ঊনত্রিশ লক্ষ মানুষকে আজ পর্যন্ত কোনওরকম সাহায্য পৌঁছে দেওয়াই সম্ভব হয়নি।

হায়দর ম্‌শাইমেশ ও সভ্যতার সংকট

লেবাননের হায়দর ম্‌শাইমেশের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ২০১৫ সালে, তেহরানে। তখন আল বর্জ পাহাড়ের চুড়োয় বরফ গলিয়ে গ্রীষ্ম আসছে সেখানে। চার বছর হল কদ্দাফি খুন হয়েছেন লিবিয়ায়। সিরিয়াতেও শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধ, ওই মোলাকাতের চার বছর আগেই। হায়দর মার্কামারা বামপন্থী না হলেও মানবদরদী বটেই। অনুবাদে ‘সভ্যতার সংকট’ পড়া হায়দর বলেছিল, কীভাবে উদ্বাস্তুদের আসার ফলে তার দেশে জনসংখ্যা বেড়ে গেছে বহুগুণ, আর পাল্লা দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানানরকমের সমস্যা। সুখের কথা এই, তার ক্ষোভ ছিল পাকিয়ে-তোলা ‘বিপ্লব’গুলোর ওপর। শরণার্থীদের ওপর নয়।

কিন্তু কজনই বা পড়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী ওই বৃদ্ধের আতঙ্কপ্রলাপ? শরণার্থী, উদ্বাস্তু, দেশহীন মানুষের সংখ্যা উপর্যুপরি বাড়ার সঙ্গে জোর পেকে ওঠে আরেক বিতর্ক — উদ্বাস্তুদের ঠাঁই দেওয়াটা সত্যিই কতটা যুক্তিযুক্ত। অনেকেই মনে করছেন, তাঁদের নিজেদের সমস্যার শেষ নেই, এবং এমত অবস্থায় এই বিপুলসংখ্যক বহিরাগতের দায়িত্ব নিতে চাওয়া আসলে একরকমের মূর্খামি। পশ্চিম ইয়োরোপ প্রথমে উদার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বহুসংখ্যক উদ্বাস্তুকে গ্রহণ করলেও এখন তারা কিঞ্চিৎ ইতস্তত করছে। ‘ইয়োরোপিয়ান মূল্যবোধ’ শিকেয় তুলে পশ্চিম ইয়োরোপের প্রমুখ দেশগুলো তুরস্ককে ঘুষ দিয়ে সেখানেই আটকে রেখে দিতে চাইছে উদ্বাস্তুদের, যাতে তারা গ্রিস পর্যন্ত পৌঁছে না যায়। ফ্রান্স, অস্ট্রিয়ার মতন দেশে জনমত মোটেও উদ্বাস্তুদের নেবার পক্ষে নয়। এঞ্জেলা মার্কেল, জার্মানির চ্যান্সেলর, নিজের দেশে উদ্বাস্তুদের জায়গা দিতে যতটা আগ্রহী, এ-বিষয়ে ততটাই অনাগ্রহ তাঁর দেশের মানুষের। পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলোও এদের নিতে অরাজি। এদের বক্তব্য, পশ্চিমের দেশগুলো ধনী, আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের আশ্রয় দেবার ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা তাদের আছে, যা এদের নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামভীতি। প্যারিসে আতঙ্কীদের হামলার ঘটনার পর এক ডজনেরও বেশি আমেরিকার রিপাব্লিকান গভর্নর বলেছেন ঠিক এই কারণেই সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের আমেরিকায় জায়গা দেওয়া উচিৎ নয়, কারণ তারা সকলেই সন্ত্রাসী! রাজনীতিবিদদের যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে প্রচারমাধ্যম। ‘সংবাদমাধ্যমের চোখে উদ্বাস্তু ও শরণার্থীরা’ — এই মর্মে ‘আর্টিকল ১৯’ নামে একটি সংস্থা এই দশকের গোড়ার দিকে বৃটিশ সংবাদমাধ্যমের ওপর একটি গবেষণা করে। তাতে দেখা যায়, সংবাদমাধ্যমের একত্রিশ শতাংশ হেডলাইন আর ছাপ্পান্ন শতাংশ লেখা জুড়ে শুধু শরণার্থী সন্ত্রাসীদের বর্ণনা, যাতে ‘শরণার্থী মানেই সন্ত্রাসী’, এই জাতীয় একটা ধারণা মানুষের মনে গেঁথে যাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। ভুল ধারণা তৈরির পাশাপাশি রয়েছে অতি-বর্ণনা। ২০০২ সালে ডেইলি মেলের পঁচিশ শতাংশ আর ডেইলি এক্সপ্রেসের চব্বিশ শতাংশ নিবন্ধই ছিল শরণার্থীদের নিয়ে।

জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী অস্ট্রেলিয়াও পড়েছে সমস্যায়। আফঘানিস্তান আর ইরাকের শরণার্থীরা, মায়ানমারের রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ার দিকে আসতে গেলে তাদের চালান করে দেওয়া হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দুটো দ্বীপে, নতুন যুগের প্রাইভেট কোম্পানি-পরিচালিত কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে তাদের আসতে দেওয়া যাবে না যে! ক্যাম্বোডিয়াকে ঘুষ দিয়ে সেখানে কিছু লোককে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে জল ঢেলেছেন অস্ট্রেলিয়ারই কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ। চেষ্টা চলছে ইন্দোনেশিয়াতেও কিছু শরণার্থী চালান করার, যাতে মানুষ পাচার আর থাইল্যান্ডের বাঁধা শ্রমিক হয়ে যাবার চক্রে তারা আবার ফিরে যেতে পারে। ২০১৫ সালের শেষের দিকে অস্ট্রেলিয়ার কোস্টগার্ড ক্রিসমাস দ্বীপে পৌঁছনো শরণার্থীদের একটা নৌকোকে আটকায়, তারপর পাঠিয়ে দেয় ইন্দোনেশিয়ায়।

অধিকারের আধিক্য

উদ্বাস্তু-প্রসঙ্গে যে সব আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন আছে, তা জানলে উদ্বাস্তুরা কতটা অভিভূত হতে পারে তা আন্দাজ করা মুশকিল। যাই হোক, জেনেভা কনভেনশন এর অন্যতম। এটা একটা কনভেনশন বললে ভুল হবে। আদতে জেনেভা কনভেনশন বলতে আমরা যা বুঝি, তা হল অনেকগুলো আন্তর্জাতিক কূটনীতিক সম্মেলনের ফলে তৈরি কতগুলো নিয়ম। এই নিয়মগুলো প্রযোজ্য হয় সশস্ত্র সংঘাতের সময়ে ধৃত, পীড়িত বা আহত সৈনিক, চিকিৎসাদল, বা রাজায়-রাজায় যুদ্ধে মুমূর্ষু সাধারণ নাগরিকের শুশ্রূষা বা দেখভালের ক্ষেত্রে। ১৮৬৪ সালে এই নিয়মাবলি তৈরির সূত্রপাত, আর ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মোটামুটি এখনকার চেহারায় পৌঁছনো। একটা মজার কথা এই, যে মাঝে ১৯২৯ সালে এই নিয়মাবলিকে বেশ কিছুটা পুষ্ট করা হয়, এবং জার্মানি তাতে স্বাক্ষর করে। নিধনযজ্ঞের আগে মানবতার পুজো?

ইহুদিনিধনের পরেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে, লড়াইয়ে অংশ না-নেওয়া সাধারণ মানুষদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে এই নিয়মগুলোকে আরেকটু বলিষ্ঠ করা হয়। আরও অনেক দেশের মতন সদ্যস্বাধীন আমাদের দেশও এই নিয়মাবলিতে স্বাক্ষর করে। এরপর, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বীভৎসতার থেকে শিক্ষা নিয়ে, ১৯৭৭ সালে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আরও কিছুটা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে এক নম্বর প্রোটোকল ও গৃহযুদ্ধে পীড়িতদের এই নিয়মের আওতায় আনার জন্য দু’ নম্বর প্রোটোকল যুক্ত করা হয়। এই দুটি প্রোটোকলে আমাদের দেশ এখনও স্বাক্ষর করেনি।

উদ্বাস্তু-সংক্রান্ত বিষয়ে বলবৎ নিয়মগুলো মোটের ওপর এইরকম –

এর মধ্যে প্রথম নিয়মাবলির কথা একটুখানি বলা যাক। ১৯৫১ সালের ‘রিফ্যুজি কনভেনশন’-এ উদ্বাস্তুদের কিছু অধিকারের কথা বলা আছে, যেমন — (১) কোনও দেশ থেকে বহিষ্কৃত না-হবার অধিকার (আর্টিকল ৩), (২) কোনও দেশে বেআইনি অনুপ্রবেশের জন্য শাস্তি না-পাবার অধিকার (আর্টিকল ৩১), (৩) কাজের অধিকার (আর্টিকল ১৭ থেকে ১৯), এবং (৪) বাসস্থান, শিক্ষা, ত্রাণপরিষেবা এবং সহায়তা পাবার অধিকার (আর্টিকল ২৩)। এছাড়াও, রাষ্ট্রসংঘের ইউনিভারসাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস স্বীকার করে নিয়েছে মানুষের দেশ ছাড়বার অধিকার (যদিও অন্য কোনও দেশে ঢুকে পড়বার অধিকারের কথা এই ডিক্লারেশনে বলা হয়নি)। যদিও, কোনও আইনের মতন করে এই সমস্ত নির্দেশিকার পালন নিশ্চিত করার মতন কোনও সংস্থা এই পৃথিবীতে নেই। তার ফলে যা হবার তাই হচ্ছে, এবং বিভিন্ন দেশ তাদের সুযোগসুবিধা মতন উদ্বাস্তুদের জীবন নিয়ে, বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে ছেলেখেলা করছে। এই প্রসঙ্গে আমেরিকার গল্প এসে যায়। হাইতির উদ্বাস্তুদের ঠেকিয়ে রাখলেও ক্যুবার উদ্বাস্তুদের জন্য নিজের দরজা খুলে দিয়েছিল আমেরিকা, কারণ দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ফিদেল কাস্ত্রোর ক্যুবার বিরুদ্ধে বিদেশনীতির একটা হাতিয়ারের দরকার ছিল। হাইতির ক্ষেত্রে এরকম কোনও ‘প্রয়োজন’ বোধ করা হয়নি। উপরোল্লিখিত আমেরিকান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস-এ স্পষ্ট বলা আছে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-রাজনৈতিক মত নির্বিশেষে এই নিয়ম বলবৎ হবে। তবে আমরা এ-ও জানি, যে কোনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যের আমেরিকায় ঠাঁই মেলা কতটা দুরূহ।

ভারত, আমার ভারতবর্ষ…

আমাদের কাছে রিফ্যুজি মানেই তো দেশ ভাগ। তবে দেশ ভাগ হবার পর যারা এদেশে এলেন, তাঁরা আদতে ভারতীয় হলেও (যেহেতু ভাঙার আগেও দেশটার নাম ছিল ভারত) উদ্বাস্তু আখ্যা কেন পেলেন, সেটাই এক প্রশ্ন। তবে ১৯৪৭-এর পর সত্যিকারের উদ্বাস্তু আমরা পেলাম ১৯৫৯ সালে, যখন দালাই লামা তাঁর এক লক্ষ শিষ্যসেবককে নিয়ে তিব্বত থেকে পালিয়ে এলেন এই দেশে। চিন সরকারের তীব্র আপত্তি অগ্রাহ্য করেই সেই ধর্মগুরু ও তাঁর শিষ্যদের আশ্রয় দিয়েছিল আমার দেশ, রিফ্যুজি কনভেনশনের বাধ্যতা না-থাকা সত্ত্বেও। ১৯৫১-র রিফ্যুজি কনভেনশন বা ১৯৬৭ সালের প্রোটোকলে স্বাক্ষরকারী একশো চল্লিশটা দেশের তালিকায় না-থাকা সত্ত্বেও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে বেশি-সংখ্যক উদ্বাস্তুর ঘর, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই তথ্য বিস্ময়কর ঠেকে।

এই ভারতের সাগরতীরে পরের উদ্বাস্তুস্রোত এল ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, যখন কাতারে কাতারে মানুষ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে এই দেশে আশ্রয়ের খোঁজে এলেন। কিছু কিছু হিসাবের মতে, প্রায় এক কোটি মানুষ ওই সময় এই দেশে চলে আসেন। বসতি করেন বাংলাদেশ-লাগোয়া ভারতের রাজ্যগুলোতে। ১৯৭১-এর পর সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যা বেড়ে যায় হঠাত, এই জনপ্লাবনের ফলে।

এর পর ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৭-র মধ্যে প্রায় দু’ লক্ষ তামিল শ্রীলঙ্কা ছেড়ে ভারতে চলে আসেন, সেই দেশের গৃহযুদ্ধের ফলে। ১৯৭৯-র সোবিয়েত আগ্রাসনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আফঘানিস্তান ছেড়ে এই দেশে আসা উদ্বাস্তুদের সংখ্যাও প্রায় দু’ লক্ষ।

উদ্বাস্তুদের নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হালে, রোহিঙ্গা সমস্যার সময়, যখন চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে এই দেশে থাকতে দিতে অস্বীকার করলেন আমাদের বর্তমান সরকার। ভালো হোক চাই মন্দ, উদ্বাস্তু শরণার্থীদের প্রতি এই আচরণ আমাদের ‘অতিথি দেবো ভব’ দেশে এই প্রথম দেখা গেল। কারণস্বরূপ বলা হল, ভারত যেহেতু ১৯৫১ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী নয়, এই শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার দায়ও তাই তার নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে আসা চাকমা আর হাজং শরণার্থীদের ক্ষেত্রে অবশ্য মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে।

তবে, আমরা শরণার্থীর আশ্রয় হব কি হব না, সে নিয়ে আমাদের দেশেও বিতর্ক যথেষ্ট। এই মুহূর্তে জনমত সম্ভবত শরণার্থীদের আশ্রয় না-দেবার দিকেই, এই সময়ে যখন সারা দেশে চাগাড় দিয়ে উঠছে ফ্যাশিবাদ। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা দরকার। আশ্রয় দেবার পক্ষে যে মত, তার দুটো ধারা আছে। একটা ধারা সনাতন সমাজনীতির ধারা। অর্থাৎ মানবতার প্রশ্নে আশ্রয়দান। আর একটা ধারার চর্চা খুব বুদ্ধিমান মানুষদের মধ্যে। সেটা অর্থনীতির ধারা।

মানুষ নয়, জিনিস… ২

“Migration is the oldest action against poverty which selects those who most want help”। জন কেনেথ গলব্রেথের একটি অমোঘ উক্তি। পেটের জ্বালার কথা আর কী।

২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড একটা গবেষণাপত্র বের করে। এই গবেষণাপত্রের মূলমন্ত্র ছিল ইয়োরোপে উদ্বাস্তুপ্লাবনকে সংহত করে আশ্রয়দানকারী দেশের উন্নয়নের কাজে লাগানো। এই গবেষণাপত্রে দেখা যায়, এই কাঁচামাল নেহাত ফ্যালনা নয়, এবং এদের প্ল্যানমাফিক কাজে লাগাতে পারলে ২০২০ সালের মধ্যে ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নের জাতীয় আয় বাড়তে পারে ০.২৫ শতাংশ-বিন্দু। অঙ্কটা আপনার খুব ছোট মনে হলে জানিয়ে রাখি, ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নের জাতীয় আয় প্রায় বিশ ট্রিলিয়ন ডলার। জার্মানি, সুইডেন আর অস্ট্রিয়ার ক্ষেত্রে এই লাভের পরিমাণ হতে পারে ০.৫ থেকে ১.১ শতাংশ-বিন্দু।

গল্পটা একটু অন্যরকম লাগছে কি?

তাহলে আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার। ই ইউ-২৮ দেশগুলোর গড় বয়স ৪২.৮ বছর। যাকে ‘এজিং পপুলেশন’ বলে আর কী। ইয়োরোপিয়ন ইউনিয়নের পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোপা থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে ই ইউতে আসা শরণার্থীদের মধ্যে বিরাশি শতাংশের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের কম, যার মধ্যে একান্ন শতাংশের বয়স আঠেরো থেকে চৌত্রিশের মধ্যে, আর বাকিদের বয়স (একত্রিশ শতাংশের) আঠেরোর কম। অর্থাৎ, এই রিফ্যুজিদের আগমন একেবারে হেলাফেলা করার মতন জিনিস নয়! ‘এজিং পপুলেশন’ দিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরকে আর কবে টিঁকিয়ে রাখতে পেরেছে?

হাঙ্গারিয়ান ধনকুবের জর্জ সোরশ মানবহিতৈষী বলে বেশ নাম কিনেছেন। সারা জীবন টাকা কামিয়ে শেষ বয়েসে ধম্মোকম্মো করার বাসনায় দাতব্য সংস্থা চালান আজকাল। ২০১৬ সালে তিনি ঘোষণাও দিয়েছেন — এই উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি কিছু করেই ছাড়বেন, এবং আপাতত তিনি এ-বাবদ পাঁচশো মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন।

কে এই জর্জ সোরশ?

বুদ্ধবাবুর মুখ্যমন্ত্রীত্বের কালে চ্যাটার্জি-সোরশ কোম্পানির কথা আমরা সকলেই শুনেছি। উইকিপিডিয়া বলছে, এই সোরশ হলেন হাঙ্গারিয়ান-আমেরিকান ইনভেস্টর, বিজনেস ম্যাগনেট, ফিলান্থ্রপিস্ট, পোলিটিকাল অ্যাকটিভিস্ট এবং লেখক। যুক্তরাজ্যে তাঁর পরিচয় ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের সংহারক হিসাবে। আর তাঁর আরও একটা পরিচয়, তিনি হলোকস্টের থেকে বেঁচে ফেরা একজন মানুষ।

রিফ্যুজিদের সঙ্গে সোরশের নামটা বেশ জোরালো করে জুড়ে দিলেন যিনি, তাঁর নাম বিক্তর ওরবান। হাঙ্গেরির এই রাষ্ট্রপ্রধান কিঞ্চিৎ চরমপন্থী বলে চিহ্নিত। এই বছরের এপ্রিল মাসে তিনি ঘোষণা করেন যে ‘সোরশ প্ল্যান’ হাঙ্গেরির সর্বনাশ ডেকে আনবে। কারণ সোরশ তাঁর এক বক্তৃতায় বলেন, যে ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নের কর্তব্য প্রতি বছর অন্তত এক লক্ষ করে উদ্বাস্তুকে জায়গা দেওয়া, এবং ‘ফ্রন্টলাইন’ দেশগুলোকে (যে দেশগুলো যুদ্ধরত অঞ্চলের কাছাকাছি, যেমন তুরস্ক) অর্থসাহায্য করা। আগেই বলেছি, পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলো উদ্বাস্তুবিরোধী। ফলে হাঙ্গেরির ঘোষিত উদ্বাস্তুবিরোধী নীতির কাছে সোরশের এই বক্তব্য ছিল বজ্রাঘাতের সামিল। ওরবানের কোপ এতই প্রবল ছিল, যে হাঙ্গেরির পথেঘাটে সোরশের নামে রীতিমত পোস্টারিং করে বিরোধিতা করতে শুরু করলেন তিনি। শুধু এই নয়। সোরশের পিছনে ওরবান এমন পড়লেন, যে তাঁর দাতব্য সংস্থার হেড আপিস তিনি বুদাপেস্ত থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হলেন বার্লিনে। এখানে ইতিহাসের চাকাটা একবার ঘুরল।

সোরশের প্ল্যানে আরও একটা কথা ছিল। ইয়োরোপের দেশগুলো যেহেতু অর্থসংকটে ভুগছে, এবং এই পরিমাপের উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করতে গেলে যেহেতু একটা বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সোরশ তাদের বুদ্ধি দিলেন টাকা ধার করতে। অর্থাৎ, খরচের ওপর রাশ টানা নয়, প্রকারান্তরে আরও আরও খরচ করা, প্রয়োজনে সে টাকা ধার করে হলেও। সোরশের মতে, ইয়োরোপিয়ন ইউনিয়নের ঋণক্ষমতা যথেষ্ট, এবং এতদিন সে তার সদ্ব্যবহার করেনি। এইবার সে সেটা করুক, এবং ধার নিয়ে উদ্বাস্তুদের মদত দিক। তাঁর বক্তব্য — “The EU should provide €15,000 ($16,800) per asylum-seeker for each of the first two years to help cover housing, health care, and education costs — and to make accepting refugees more appealing to member states. It can raise these funds by issuing long-term bonds using its largely untapped AAA borrowing capacity…”।

অর্থাৎ, এইখানে এমন একটা বিরোধ দেখা গেল, যা দেখতে আমরা অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিরোধটা রাজনীতি আর অর্থনীতির। একদিকে কট্টরপন্থী রাজনীতির মাথা চাড়া দেওয়া, অন্যদিকে ব্যবসায়ী মহলের সস্তা শ্রমিক যোগান পাবার লক্ষ্যে উদ্বাস্তুসমস্যার সদ্ব্যবহার ঘটানো। এই বিরোধ ইয়োরোপে আজও চলছে।

নিন্দুকে বলে, আমেরিকা যেখানেই ঘাঁটি গাড়তে চায়, সোরশ সেখানেই তাঁর ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের একটি শাখা খুলে বসেন। ১৯৮৯-পরবর্তী সময়ে সোবিয়েত ইউনিয়নে এবং পূর্ব ইয়োরোপে সোরশের বামবিরোধী কাজ যথেষ্ট আলোচিত। আমেরিকা-ইংল্যান্ডের যৌথ যুদ্ধবাজিকে সাহায্য দেবারও অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে — প্রথমে লিবিয়ায় ও এখন সিরিয়ায়। সুতরাং, একদিক থেকে সোরশকেও ভাবা হয় এই উদ্বাস্তুসমস্যার অন্যতম রূপকার, জনক। সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের কাছে জার্মানির দরজা যে খোলা, এই বক্তব্যের একনিষ্ঠ প্রচারকও আমাদের সোরশসাহেব।

তাঁর বিরুদ্ধে একটা প্রধান অভিযোগ, তিনি নাকি চান (বা অন্য কেউ চেয়ে থাকলে তাঁদের হয়েই কাজ করেন) ত্রিশ বছরের যুদ্ধের শেষে ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফ্যালিয়া শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ইয়োরোপে যে জাতিরাষ্ট্রগুলো তৈরি হয়েছিল, তাদের সীমারেখাগুলো মুছে যাক, আর সমস্ত ক্ষমতা ইয়োরোপিয়ন ইউনিয়নের মুখহীন, অনির্বাচিত আমলাদের হাতে গচ্ছিত হোক।

সোরশ তাঁর ইয়োরোপিয়ন প্ল্যানে বলছেন — “Safe channels must be established for asylum-seekers, starting with getting them from Greece and Italy to their destination countries. This is very urgent in order to calm the panic.” এই গন্তব্য দেশগুলো কারা? কে ঠিক করে দিল কোথায় যাবে সিরিয়ার উদ্বাস্তুরা?

সিরিয়ার উদ্বাস্তুরা কোথায় গিয়েছে সবথেকে বেশি সংখ্যায়? জার্মানি, জার্মানি এবং জার্মানি। জার্মানি যে দুহাত প্রসারিত করে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে, এই কথাটা সিরিয়ার উদ্বাস্তুরা জানল কীভাবে?

রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর ভ্লাদিমির শালাকের গবেষণার বিষয় ট্যুইটারের ইন্টারনেট কন্টেন্ট অ্যানালিসিস। Scai4Twi নামে একটি বিশ্লেষণী পদ্ধতির তিনি উদ্ভাবক। ১৯০০০ রিফ্যুজি-বিষয়ক ট্যুইটকে বিশ্লেষণ করে (রিট্যুইট বাদ দিয়ে) তিনি দেখেছেন তার তিরানব্বই শতাংশই জার্মানি যে গন্তব্য হিসাবে কত প্রশ্নাতীতভাবে যোগ্য সে-বিষয়ক।

এবারে আসি আসল কথায়। এই তিরানব্বই শতাংশ ‘চলুন বেড়িয়ে আসি জার্মানি’-মার্কা ট্যুইটগুলো করা হয়েছে জার্মানির বাইরে থেকে। তাদের উৎস আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড!  

তুমি রবে নিরুত্তর…

সোরশ এবং তাঁর কার্যকলাপের সমর্থক যারা, তাঁদের কেউ কেউ বলছেন গ্লোবালিস্ট। গ্লোবালিস্ট, কারণ এঁরা নাকি চান দুনিয়ার সমস্ত কাঁটাতার মুছে দিয়ে একটা অখণ্ড পৃথিবী্র পত্তন করতে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিও-র পত্তনের পর যেমন ভাবা গেছিল ঠিক তেমন ঘটেনি। এই সমঝোতায় স্বাক্ষরকারীরা নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যশুল্ক কমিয়ে আনলেও যা ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠল তাঁকে বলা যায় অ-শুল্ক বাধা বা নন-ট্যারিফ মেসার্স। অর্থাৎ, শুল্ক দিয়ে অন্য দেশের পণ্য আটকাতে না পারলে আটকাব অন্যভাবে। এই অ-শুল্ক বাধার রবরবার পর সারা দুনিয়া জুড়ে এখন আঞ্চলিক বাণিজ্য সমঝোতা চলছে। অর্থাৎ, একটা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে হলে একরকম সুবিধা, আর তাঁর বাইরে হলে অন্যরকম, বা একটু কম সুবিধা। ইয়োরোপের ক্ষেত্রে আমরা যা দেখলাম, তা হল এই বাণিজ্য অঞ্চল ক্রমে একটা ব্যাপক চেহারা নিল, আর বদলে গেল প্রকৃতপক্ষে একটা বৃহত্তর দেশের চেহারায় — যার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক একটা, মুদ্রা অভিন্ন, নিরাপত্তাও পর্যবেক্ষিত হয় এক জায়গা থেকে। যেখানে যেতে ভিসা লাগে একটাই — সে যে কোনও প্রান্তেই যাওয়া হোক। এই আঞ্চলিক বাণিজ্য সমঝোতাগুলো ঘিরেই কেউ কেউ সেই স্বপ্ন দেখছেন, আর কেউ কেউ দুঃস্বপ্ন।

এই গ্লোবালিস্টদের সমর্থনে যারা এলেন, তাঁদের মধ্যে এক প্রমুখ ব্যক্তিত্ব আমাদের হেনরি কিসিঞ্জার সায়েব, যিনি বছর দুই আগে ‘নিউ ওয়র্ল্ড অর্ডার’ নামে একটা বইও লিখে ফেলেছেন। কেউ কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে এঁদের বলছেন কমিউনিস্ট, বা কমিউনিস্টদের দালাল। কিন্তু আমরা এঁদের কী বলব?

একদিকে রাষ্ট্রসীমা মুছে The world will live as one-এর রোম্যান্টিকতা, আর একদিকে গোপন ভয় — একটা চূড়ান্ত একমেরু পৃথিবীর জঘন্যতম রূপ দেখার ভয়। ওই আগে যেমন বললাম — সেই পৃথিবীর শাসন থাকবে কিছু একনিষ্ঠ কর্মীর হাতে। তারা গ্লোবাল এন্টারপ্রাইজের চলমান অশরীরী।