গোঁফ — ১ম পর্ব

এস হরিশ

 

অনুবাদ: ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

পূর্ব-প্রসঙ্গ: লেখকের কথা

তামাশাবাজের দল

প্রায় সকলেই মনে করে, এই ঈনমপেচি— মানে প্যাঙ্গোলিন বা আলুঙ্কু— হল সারস বা প্যাঁচার মতোই দৈবী প্রাণী। মৃত শিশুদের আত্মারা এদের শরীর নিয়ে দেখা দেয়। কিন্তু এরা যে কিছুটা আহাম্মক, এ-কথা পাভিয়ন ঠিকই জানত। পাভিয়নের বাড়ি চোড়িয়াপ্পারা ক্ষেতের ধারে। মকরম আর কুম্ভম-এর মাসগুলোতে খুব ভোরে উঠে পুবদিকে ভানিয়নদের বাসার কাছে যে আমগাছটা ছিল পাভিয়ন সেখানে আম আনতে যেত। ছোট ছোট আমগুলো এক মুঠোর মধ্যে ধরে এক এক বাটি কাঞ্জিতে চিপে নেওয়া যেত। আমগুলোর যদিও ভোরের আগে গাছ থেকে এমনিতেই ঝরে পড়ার কথা, কিন্তু একটা খাটিয়ে ঈনমপেচি সারা রাত ধরে আম পেড়ে পেড়ে পাভিয়নের কাজ আরও অনেকটাই সহজ করে দিত। সূর্য ডুবলেই সে এসে জুটত পাকা আমের লোভে, কিন্তু পেট ভরে আম না খেয়ে সবকটা আম একসঙ্গে নিয়ে যাবে বলে সেগুলো জমিয়ে একটা ঢিপি বানাবার চেষ্টা করত— একটা করে… দুটো করে… তিনটে করে…। কিন্তু সেই ঢিপি তৈরি তার কখনওই শেষ হত না। সারা রাত ধরে একটার উপর একটা রাখতে গিয়ে আমগুলো কেবল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যেত। এইরকম চেষ্টা করতে করতে দিনের আলো ফুটে উঠলে ওই ঈনমপেচির সময় শেষ হয়ে যেত, আর সে ফিরে যেতে বাধ্য হত। একটা আমও তার খাওয়া হত না। আর, সে চলে গেলেই পাভিয়নের কাজটুকু ছিল আমগাছের কাছে এসে ঝুড়িতে গুছিয়ে রাখা আম কটা স্রেফ তুলে নেওয়া।

যাদের ঘরে গোলাভরা ধান আর ভাঁড়ারভরা চাল, কার্কিতকম মাসের এক রাতে পাভিয়ন একমুঠো চালের জন্য গেছিল তাদের বাড়ি। খালি হাতে যখন ফিরে আসছে, অল্প আলোয় দেখে রাস্তায় বলের মতন কী যেন একটা। ঈনমপেচি, আর কী! বাচ্চারা দেখলে খুশি হবে, ক্ষিদে-টিদে ভুলে থাকবে কিছুক্ষণের জন্য, এই ভেবে পাভিয়ন তাকে তুলে নিয়ে ঝুড়িতে ভরে নিল। হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে, বেড়া-টেড়া আর ছোট ছোট নালা পেরোতে পেরোতে পাভিয়নের কানে এল: ‘আস্তে চলো, পাভিয়া, আস্তে।’

পাভিয়ন বুঝতে পারল, সে কে সেটা ঈনমপেচি জানে, কিন্তু তার জন্য রাগ-টাগ কিছু সে করছে না।

ওদিকে সাপমুখো দুর্দান্ত শোল— মাছধরিয়েরা যাকে পাপ্পু বলে ডাকে— ছিল একদমই আলাদা চরিত্রের। মাছেদের মধ্যে পাপ্পুর নাম অবশ্য আলাদা। নিন্দুর আর কাইপুড়ার অগুনতি খাল আর নালার অবিসংবাদী রাজা ছিল পাপ্পু, যদিও এই গোটা জলদুনিয়ার মালিক ছিলেন সোনামাগুর মহারাজ। ব্যাং আর ঘাসফড়িং গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে পাপ্পুর চেহারাটা হয়েছিল দুখানা তাগড়া পাঁকালমাছের সমান, আর ছানাপোনা হয়েছিল হাজারে হাজারে। এই পূর্ণবয়সে এসে মাছধরা টোপ আর কঞ্চির ঝুড়ির ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে পাপ্পু হয়ে উঠেছিল সব মাছেদের সর্দার। দুপুর গড়ালে জলের উপর ভেসে উঠে সে সূর্যের তাপ নিত। ওইরকমের একটা দুপুরে, বা তার ঠিক পরে-পরেই, ওই খালে পাভিয়ন এসেছিল তার সরু নৌকোটা নিয়ে। তার মন তখন অবশ্য ছিল অন্যদিকে, আর তা ছাড়া পাপ্পুকে সে দেখেওনি। পাভিয়নের এই খালবিলে চলাফেরার অভিজ্ঞতা বহু বছরের। নৌকো নিয়ে পাপ্পুর পথ এড়িয়ে দ্রুত এগোচ্ছিল সে। চলতে চলতে নৌকোটা যেন দুলে উঠল হঠাৎ। কেন হল এরকম? পাভিয়ন বুঝতে পারে না। আন্দাজ করতে পারে না, ঠিক সেই সময় এমন একটা ঘটনার সূত্রপাত ঘটবে যার ফলে সে আর তার ছেলে— বাবচন— একটা ধাঁধায় পড়ে এই জলদুনিয়ায় পথ হারিয়ে ঘুরপাক খাবে। জীবনে প্রথমবার।

পাভিয়নের ঘর ছিল একটা অগোছালো ধানের ঢিপির মতো, যার কিছুটা ছিল জমির আলের উপর আর কিছুটা নেমে গেছিল ঢালু হয়ে খালের দিকে। ওই ঘরের কিছুটা উত্তরে ওই খালেই পড়া একটা নালার উপর ঝুঁকে পড়ে জল দেখছিল বাবচন। খালের জলে থুথু ফেলে দেখছিল দারিকিনা আর চকমকে ছেবলি আসে কি না। জমির সীমানা মজবুত করার জন্য দেওয়া কাদামাটির পুরনো আল ভেঙে উঠে আসা কয়লার টুকরো নিয়ে জলে ভাসিয়ে দিয়ে দেখছিল টুকরোগুলোর ভেসে যাওয়া। মা চেল্লা এগুলো জমিয়ে জমিয়ে অথিরামপুড়ার একজন ক্রিশ্চান মাপ্পিলার কাছে বিক্রি করে, বাবচন জানে। ওই মাপ্পিলা তারপর এগুলোকে বিক্রি করে কামারের কাছে। কামার এগুলো দিয়ে আগুন জ্বেলে বেলচা, কোদাল আর লাঙলের ফলা তৈরি করে। এভাবেই মাটির জিনিস আবার ফিরে আসে মাটিতেই।

পাভিয়নের নৌকো এগিয়ে আসছে দেখেও মাথা তুলে তাকায় না বাবচন। জলকে ঠান্ডা রাখে যে শ্যাওলার গালচে, তারই মধ্যে দিয়ে লম্বা দাঁড়ে পথ করে নিয়ে তার নৌকো আসে। এখানে পাভিয়নের উপস্থিতি এতটাই স্বাভাবিক, প্রত্যাশিত— যেমন হেলে পড়া বিকেলসূর্যের আলোয় নারকেলগাছের ছায়া, বা একটা দুব্বোঘাসের আঁটি চিবোনো গরু। সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও মনে হয় সে ওখানেই কোথাও একটা আছে। পাভিয়ন কোথায়, কেউ জানতে চাইলে বাবচন আর তার মা চেল্লা পড়ত মুশকিলে, যদিও পাভিয়ন হয়তো তাদের চোখের সামনেই খাল বেয়ে চলে গেছে। কোনদিকে? পুব না পশ্চিম? না কি ওখানেই আছে, আশেপাশে কোথাও? এসবেরই মধ্যে স্বাভাবিকের থেকে একটু আলাদা কাজ বলতে ছিল একটাই। সকালের আলো ফুটলে খোলা মাঠে পায়খানা করতে যেত পাভিয়ন। ঝোপের আড়ালে বসে, সামনে একটা ঝরা নারকেলপাতা পর্দার মতো ধরে সে নিজের সঙ্গে লম্বা আলাপে মেতে উঠত। আশেপাশে প্রাতঃকৃত্য করতে বসা অন্য কেউ ওই আলাপ শুনলে হয়তো ভেবেই বসত যে পাভিয়ন কারও সঙ্গে কোনও গুরুগম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ত রয়েছে।

বাবচনের দিকে চেয়ে ইশারায় তাকে নৌকোয় উঠে বসতে বলে পাভিয়ন। কিন্তু হাত নেড়ে না বলা অবধি বাপের কথা বাবচন বুঝতে পারে না। একটু আশ্চর্য হলেও হাঁচোড়পাঁচোড় করে নৌকোয় উঠে পড়ে সে। উঠতে গিয়ে জলে পড়ে এমন অবস্থা— কোনওমতে হাত-টাত ঘুরিয়ে তাল রাখে। দুটো ধার চলে যাওয়া কাস্তে আর একটা ছোট চটকাপড়ের পোঁটলা— নৌকোয় জিনিস বলতে এই। নৌকোটা দুলে উঠতে পাভিয়ন খিস্তি দিয়ে ওঠে। বাবচনকে নয়। হিসেবের বাইরে কিছু হলেই বা হওয়ার সম্ভাবনা দেখলেই খিস্তি দেওয়া পাভিয়নের একটা স্বভাব। গেলবার কুট্টনকারির ক্ষেতে ধানের বীজ পোঁতার পর যখন বিশ দিনেও কিছু বেরোল না, বাঁধের উপর হাঁটতে হাঁটতে চিৎকার করে কাদার মধ্যে পচতে থাকা ওই বীজগুলোকে সে খিস্তি করেছিল। কথায় আছে, নৌকোয় উঠতে পড়ে গিয়ে যে বেঁচে যায় তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলাই ভাল, কারণ কারও কোনওদিন কোনও কম্মেই সে আসবে না।

নৌকোর পাটায় বসে বাবচন। বাপের নৌকোয় বসার অনুমতি পেয়ে মনে মনে বেশ একটু গর্বও হয় তার। অবশ্য নৌকোর ধারে ঝুঁকে জলে আঙুল চালানোর ইচ্ছেটা মনেই চেপে রাখে সে। বছরে কয়েকবার নারকেলের ডাল দিয়ে উত্তম-মধ্যম দেওয়া ছাড়া ছটা বাচ্চার দিকে বিশেষ নজর দেয় না পাভিয়ন। মেয়েদের হুট করে দেখলে হয়তো চিনতেও পারবে না সে। তার বাচ্চাকাচ্চাদের মধ্যে এই প্রথম কেউ তার ছ্যাঁদাওয়ালা ঘাসনৌকোয় পা রাখল। নৌকোর অবস্থা এমন যে চালাতে গেলে ফুটো দিয়ে জল ঢুকে মাঝেমধ্যেই বিপদে ফেলে।

দুপুরবেলার কথা। থমকে থাকা গরমে সবজে আর কালো ঘাসফড়িঙের দল ওড়াউড়ি করছে। এরই মধ্যে পাভিয়ন, জমিচাষের নিমিত্ত পুলয়ন হয়ে জন্ম যার, লম্বা দাঁড় দিয়ে ঘন কচুরিপানা ঠেলে নৌকো নিয়ে এগোচ্ছে। শুকনো, সদ্য চষা বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার চারদিকে উল্টোনো ময়লা বাসনের মতো পড়ে আছে। এখনও মুখ দেখায়নি ধানের অঙ্কুর। চাষের মেয়েছেলেরা কেউ নেই কোথাও। জলের নিচে তাগড়াই শোলমাছগুলো খুব সাবধানে ধীরে ধীরে চলাফেরা করছে, আর উপরে, আকাশে উড়ছে ঈগল। ততটাই সাবধান আর স্থিরপক্ষ। পল্লঠিমাছের কালো-কমলা ছানারা ইতিউতি ঘোরাঘুরি করছে, কাদা খুঁটছে, আর রঙচঙে বাঁশপাতামাছ গা ঢাকা দিয়েছে খালের ধারের লতাপাতার অন্ধকারে। পাভিয়নের পায়ের পুরনো ক্ষতের দিকে চোখ পড়ে বাবচনের। ঘায়ের ওপর কাদা লাগিয়েছিল বাপ। ওই ঘাসকাদা শুকোনোর সময় আচ্ছা-সে-আচ্ছা ঘায়ের জোলোভাব টেনে নিয়ে চটপট ঘা সারিয়ে দেয়।

নৌকো নিয়ে ওরা প্রথমে গেল দক্ষিণ দিকে, যেখানে চারটে খাল এসে মিলেছে। তারপর ঘুরল পশ্চিমে। অ্যাদ্দিনে পাভিয়ন ওদিকে বড়জোর পাইবাট্টোমকারুকাপ্পডম পর্যন্ত গেছে। তারপর মানিয়ন্থুরুটু, তারও পর চেক্কা আর কান্যকোনের ধানজমি। এখানে খালের দু-ধারে জমি চাষ করে কাইপুড়া আর নিন্দুরের লোকেরা। আর কিছুদূর গেলে চাষ করে ভিচুর আর পেরুন্থুরুটুর মানুষজন। ছোটবেলায় বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে পশ্চিমদিকের বিশাল জলায় ঢেউয়ের খেলা দেখে বাবচন ভাবত চোড়িয়াপ্পারা ক্ষেত ছাড়িয়েই মনে হয় কোনও বিশাল হ্রদ বা সাগর রয়েছে।

বাবচন ভেবেছিল, খালের ধারের বড় বড় ঘাসের পাশে পাভিয়ন নৌকোটা দাঁড় করাবে, তারপর জলের মধ্যে কাস্তে চালিয়ে গোড়ার থেকে কেটে নেবে বেশ কিছু ঘাস। কিন্তু তা না করে খালবিলের মধ্যে পথ করে নৌকো এগিয়ে নিয়ে চলে পাভিয়ন। আশপাশের কিছু ঘরে, যাদের বলদ আছে, পাভিয়ন নিয়মিত ঘাসের জোগান দেয়। নায়ারদেরও দেয়। ওদের গরু আছে। গেলবারের ডেলিভারিতে হয়তো কিছু পোকামাকড় থেকে থাকবে, বাবচন ভাবে। হয়তো ওদের গরু-টরুর পেট খারাপ হয়ে থাকবে। তাই বাপ ঝাড় খেয়ে এখন একেবারে তাজা, রসালো, মোটা গোড়া আর পাতলা ডগাওয়ালা ঘাস খুঁজছে। এবার যার কাছে ঝাড় খেয়েছে তার উঠোনে যতক্ষণ না ওইরকম ঘাসের একটা বান্ডিল ফেলতে পারে, ততক্ষণ পাভিয়নের শান্তি নেই, বাবচন মনে মনে ভাবে।

মাক্কোথরার পশ্চিমে পাভিয়ন তীরের দিকে নৌকো ঘোরায়। আসলে একটা ঘরের দিকে। অনেকগুলো কলাগাছের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরটা। ঘাসের আঁটি বাঁধার জন্য সবথেকে ভাল হল ছোট ছোট, মিষ্টি নজালিপুভন কলার গাছের ছাল থেকে কেটে নেওয়া আঁশ। এই আঁশ যদি গাছের গায়ে শুকায়, তাহলে এ দিয়ে গরু পর্যন্ত বেঁধে রাখা যায়।

বাবচন বিশেষ গা করে না। নৌকোয় বসে থাকে। নতুন তালপাতায় ছাওয়া এই ঘর তার সমাসন্ন ঘটনাবহুল জীবনে কী ভূমিকা নিতে চলেছে তা সে টের পায় না। দেখে— ঘরটার দেওয়াল, মায় দরজাটাও নারকেল পাতায় বোনা। খুঁটিগুলো গোলাপি ফুলে ভরে আছে। গত রাতের ঝড়ে উড়ে আসা শুকনো পাতা-টাতা ইতস্তত ছড়ানো। ঝড়ে ভেঙে পড়া একটা কলাগাছ পড়ে আছে ঘরটার উপর। একটা বুনো লতার ঝাড় একটা দেওয়ালের বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে।

কলাগাছের আঁশদড়ি আর পালয়নকোন্ডন কলার একটা আধকাঁচা কাঁদি নৌকোয় রাখে পাভিয়ন। একটা নারকেল গাছের গোড়ায় নিজের কাদায় মাখামাখি পা মুছে নেয়। ওই ঘরটার নারকেল পাতার দরজা খুলে যায় হঠাৎ। বাবচন হাঁ হয়ে দেখে, একটা মেয়েছেলে পাভিয়নের দিকে তেড়ে আসে। মেয়েছেলেটার থেকেও আগে তেড়ে আসছে তার বিশাল বড় বড় দুটো বুক। ওইরকম বুক বাবচন কক্ষনও দেখেনি। বিরাট, ফর্সা আর গোল, যেন কারও দিকে তাচ্ছিল্য নিয়ে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। ওগুলোর গোঁফ থাকলে কেমন দেখাত? বাবচন মনে মনে ভাবে। বুকের বোঁটাগুলো ছোট আর বসা। কিন্তু এমন সাংঘাতিকভাবে পাভিয়নের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, যেন দাঁত বের করা পাথরের মূর্তি।

বাবচনের মা চেল্লার বুকদুটো ঝুলতে ঝুলতে প্রায় পেটের কাছে এসে ঠেকেছে। ছ-ছটা বাচ্চা নির্মমভাবে চুষে শেষ করে দিয়েছে সব। মাইদুটো শরীরের দুধারে বাবুইয়ের বাসার মতো ঝুলে থাকে। দিনের কাজকম্মো করতে গেলে, সামনে ঝুঁকলে একে অপরকে ঠেলা মারে। বাবচন তো একবার দেখেছিল, কাজ করতে করতে চেল্লা একটা মাইকে পিঠের উপর ফেলে দিল। অন্যদিকে, বাবচনের ঘ্যানঘেনে বোনটার বুক যেন অল্প একটু ঠেলে উঠেছে। যদিও মাইয়ের মতন ফুটে ওঠেনি এখনও। এছাড়া, ওর বাড়ির পিছনদিকের নালাটা লাফিয়ে পার হয়ে যে মেয়েছেলেগুলো জমির কাজ করতে যায়, তাদের হাত-পায়ের মতই তাদের মাইগুলোও কালো, রোদে পোড়া। ওগুলোর দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। ক্ষেতে কাজ করার সময় ধারালো কাস্তের থেকে বাঁচানোর জন্য মাইগুলোকে পুরোনো কাপড়চোপড় দিয়ে ওরা আঁট করে বেঁধে রাখে। সন্ধেবেলায়, কাজ শেষ হলে ক্ষেত ছাড়ার সময় ওই বাঁধন খুলে দেয়।

ওই মহিলার চেহারার বা মুখ, কোনওটাই বাবচনের চোখে পড়েনি। চোখে পড়েছে শুধু বুকদুটো, নানান কথার সঙ্গে তাদের চেহারাও যেন বদলে বদলে যাচ্ছিল। বাবচন ভাবছিল, ওই মহিলার রাগ বাড়তে বাড়তে মনে হয় মাইদুটো রাগে ফেটেই পড়বে, নয়তো হাতের মুঠি হয়ে ঘুঁষি মেরে পাভিয়নের হাল খারাপ করে দেবে।

—আমার কলা পুলয়নদের জন্যে নয়! যখন খুশি আসবে আর কেটে নিয়ে চলে যাবে, এসব চলবে না!— ওই মেয়েছেলেটা চিৎকার করে বলে ওঠে।

নৌকোর দিকে ছুটে আসতে আসতে এমন একটা বাজে কথাও সে বলে, যা ওই বয়েসের কোনও মহিলার মুখেই আসা উচিত নয়। নৌকোর পাটায় বসে মনে খানিকটা সম্ভ্রম নিয়েই চোখের সুমুখে ছেয়ে থাকা ওই ভারী বুকদুটোর দিকে বাবচন তাকিয়ে থাকে। অন্তর থেকে পুজো করার মতন একটা ভাব জন্মায় তার, যেমন হয় সুদূর কাইপুড়ার চার্চে পাথরের ক্রুশের উপর পড়ন্ত বেলার আলো দেখলে।

—এই নাও, নাও তোমার কলা, পাভিয়ন বলে।

কলার কাঁদিটা, যার সদ্য-কাটা গোড়াটা রসে ভিজে আছে তখনও, ছুঁড়ে দেয় মহিলার সামনে।

—গেলো! গেলো! এই নাও!

ওই মহিলার খিস্তিখেউড়ের উত্তরে পাভিয়নও মহিলার বাপ কুট্টানাসারি আর মা কাওয়ালাক্কাথুর নাম নিয়ে কয়েকটা চোখা চোখা খিস্তি মারে। নৌকা পাড় থেকে সরাতে সরাতে পাভিয়ন ভাবে, এই মেয়ে মায়েরও এক কাঠি বাড়া।

—আছ কিন্তু থারাইলদের জায়গায়, ভুলে যেও না, পাভিয়ন এমনভাবে বলে, যেন তার কথায় পেছনে কোনও আইনি জোর আছে।

বাড়িটাকে চোখের আড়ালে রেখে খাল বেঁকে যায়। সমস্ত জায়গা জুড়ে সূর্য ছড়িয়ে দেয় নিস্তব্ধতার ঢাকনা। নৌকোয়, ঠান্ডা হাওয়ায় বসে বাবচন ভাবে, এতক্ষণের যা কিছু, সব স্বপ্নই ছিল মনে হয়। এদিকে পাভিয়ন রাগে বিড়বিড় করতেই থাকে।

সবচেয়ে ছোট স্বপ্নও কখনও কখনও একটা গোটা বছরের মতো, বা জীবনের মতোও, লম্বা মনে হতে পারে। এক সন্ধ্যায় পেটে খুব খিদে নিয়ে বাবচন নারকেলগাছের গোড়ার স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ স্মরণে রেখেছে সে। সেই স্বপ্নে সে এমন একটা কিছু খাচ্ছিল যা সে বাপের জন্মে খায়নি। একটা বিশাল বড় কলাপাতায় বাড়া হয়েছিল তার খাবার। খাবারগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চিনছিল সে। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর খাবারগুলোর নাম আর তার মনে পড়েনি। মুখে আর জিভে শুধু থেকে গেছিল স্বাদ। আর গন্ধ। একটা ষাঁড় কারিপাতার ঝোপের মধ্যে দিয়ে খেলা করে চলে গেলে যেরকম গন্ধ ছড়ায়, ঠিক সেরকম।

—তাও তো কিছু খাবারদাবার পেলি, বাবচনের অসুস্থ, ঘ্যানঘ্যানে বোনটা বলে।
—স্বপ্নেই দেখলাম শুধু।
—না না। তোর গায়ে গন্ধ পাচ্ছি যে! বোন হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। আমি জানি— গন্ধটা নারকেলতেলের।

মাঞ্জুরের একজন বানিয়ন তেলবিক্রেতা তার জিনিসপত্র নৌকোয় নিয়ে বাজারে গেছিল। মেয়ে তার তেলের পাত্রগুলোর থেকে গন্ধটা চিনেছে।

—নারকেল তেল দেখতে কেমন রে? বাবচন জিগ্যেস করেছিল তাকে।
—একবার দেখেছিলাম, নৌকোটা উল্টেছিল, তখন। হাল্কা সবজে রং। জলের নিচের ঝাঁঝির মতন খানিকটা, বুঝলি?

এ-কথা শুনে নিজের হাতটা নাকের কাছে তুলে গন্ধটা বোঝার চেষ্টা করেছিল বাবচন।

সূর্য ডোবে ডোবে। পাভিয়ন তবু নৌকো বেয়ে চলে। ওই মহিলার সঙ্গে ঝামেলার পর থেকে কাজকর্ম সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। বাবচন ভাবছিল, বাপ নৌকোটা খালের ধারের ছায়া বরাবর নিলে ভাল হয়। এক আঁজলা জল তুলে খায়, তারপর ভিজে হাতটা মুখে-ঘাড়ে বুলিয়ে নেয়। দিনের বেলা সাধারণভাবে খাওয়া হয় না বলে খিদে-টিদে নিয়ে বাবচন মুখ খোলে না। তবু মনে মনে ভাবে, ওই ছোট ছোট আধপাকা কলাগুলো সঙ্গে থাকলে কয়েকটা এখন জমিয়ে খাওয়া যেত।

সূর্য যেমন আলো দেয়, তেমনই এক ধরনের চোখ-ঝলসানিও দেয় যাতে চোখে আঁধার-আঁধার লাগে। বাবচনের চোখেও তেমনই অন্ধকার নেমে আসে। তারই মধ্যে দিয়ে সে দেখে— জীবনে প্রথমবার— তার চারদিকে সীমাহীন, অনন্ত চাষজমি। চাষ করা আর পতিত জমি, কোথাও জনপ্রাণী নেই। এই বিশাল জলাজমিকে চাষের জমি বানিয়ে, তার আলাদা আলাদা টুকরোকে আলাদা আলাদা নাম দিয়ে, গেল কই সব? বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার মতন কোথায় যেন চলে গেছে! খালগুলো খড়ের আঁটি বাঁধার দড়ির মতন একে অন্যকে কাটাকুটি করতে করতে জড়ামড়ি করে যেন গিঁট পাকিয়ে ফেলছে।

সামনে যতটা জমি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সারা জীবন নৌকো বাইলেও পাভিয়ন তা পার করতে পারবে না। পৃথিবীর মতন এরও মনে হয় শেষ নেই কোনও। সূর্য ঢলে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে গরম একটু কমতে শুরু করলে একটু ঘাসের অঞ্চল দেখে নৌকো দাঁড় করায় পাভিয়ন। এতক্ষণ কেন যে দাঁড়ায়নি তা ঠাকুরই জানে। এর থেকে অনেক ভাল-ভাল ঘাসের জায়গা চলার পথেই এসেছে। সর্বোত্তম জিনিসটা পাবার সম্ভাবনা থাকলেও মাঝারি জিনিসের দিকেই যাদের ঝোঁক, পাভিয়ন মানুষটা ঠিক তাদের মতন।

পাভিয়নের কাটা ঘাস একজোট করে বাবচন। আঁটি বেঁধে বেঁধে নৌকোয় সাজিয়ে রাখে। কাজকর্ম বেশ তাড়াতাড়িই হচ্ছিল, কিন্তু সময় একটা খেল খেলছিল বাপব্যাটার সঙ্গে। কুচুটে তামাশাবাজ করছিল কী, এক মিনিটকে করে দিচ্ছিল পাঁচ-পাঁচটা মিনিটের সমান। এক-একটা চব্বিশ মিনিটের নাড়িকাকে দুটো বা তিনটে নাড়িকা বানিয়ে দিচ্ছিল। এরকম কিছু একটা যে ঘটছে, বাপব্যাটায় খুবই বুঝতে পারছিল। এইসব তামাশাবাজেরা সময়ের যাওয়া-আসা কব্জায় রাখার কলকাঠি জানে খুব! এসবের পরে সব কাজকর্ম যখন শেষ হল, পাভিয়ন আর বাবচন মাথা তুলে দেখে, সূর্য এখানকার কর্তব্য শেষ করে দূরের দেশগুলোতে আলো দিতে চলে গেছে।

নৌকো ঘুরিয়ে জোরে জোরে বাইতে শুরু করে পাভিয়ন। একটা ক্ষেতের ধারে আসতে একটা কালো ছায়া গর্জন করতে করতে তেড়ে আসে তাদের দিকে। অন্ধকারে নৌকো চালাতে পাভিয়ন এমনিতে যথেষ্ট পটু। জোর হাওয়ায় নৌকো সামলে রাখতে নৌকোর সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকে সে। অন্ধকারে তার কালো চেহারা ঠিক ঠাহর করা যায় না। তারা যে হারিয়ে গেছে যে বিষয়ে বাবচনের মনে কোনও সন্দেহ থাকে না। এই পথে তো আমরা আসিনি, বাবা— সে বলে ওঠে।

পাভিয়ন রেগে যায়। জলে না থেকে জমিতে থাকলে সে হয়তো ছেলেকে একটা চড়ই কষিয়ে বসত। এইসব অঞ্চলে বাবচনের প্রথমবার আসা, যদিও পাভিয়ন— তার বাপ আর তারও বাপের মতো— এইসব জায়গার নাড়িনক্ষত্র জানে।

ওই কালো ছায়াটা বৃষ্টি হয়ে গেল এবার। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এক-একটা যেন ছোট নারকেল। বিদ্যুতের দুটো রেখায় আলো হয়ে গেল চারপাশ। হয়তো ভুল বলছে না বাবচন, পাভিয়ন ভাবে। চারদিক এত অন্ধকার, যে কোনও চেনা কিছুই চোখে পড়ছে না আর। হঠাৎ তার মনে পড়ল, সে যেখানে ঘাস কাটছিল, একটা চালাক চেম্বল্লিমাছ সেখানেই একটা তাড়ি জোগাড়েকে খুন করে।

এই ঘটনা অনেকদিনের, তার বাপের বাপেরও আগের সময়কার। ভিলুন্নির সেই চোভন একদিন সকালে যখন কাজে বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছে, তার চোভতি তাকে আটকায়।

—আজ যেও না গো, সে বলে।

মাত্র এক হপ্তা হল তারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিল।

—সরো সরো, চোভন বলে। গাছের থেকে রসের হাড়িগুলো না নামালে হাড়ি উপচে আগা পচে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে যে! সারা গাছ পোকায় ছেয়ে যাবে।
—তাহলে কথা দাও তাড়াতাড়ি ফিরবে। এদিক-সেদিক ঘুরবে না। আর চারদিকে ভাল করে দেখে-শুনে চলবে।

চোভতি তার সঙ্গীর অদ্ভুত অভ্যেসের কথা বিলক্ষণ জানত। খালে ভাল মাছ-টাছ দেখলেই সে দাঁড়িয়ে পড়ত। আর ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত, যতক্ষণ ওই মাছটা ধরার কোনও ফন্দি তার মাথায় না আসে।

চোভতির কথাগুলো চোভন এমনিতে মনেই রাখছিল, কিন্তু দু-নম্বর গাছটার থেকে নামতেই সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল। নিচেই, একটা খালে, যেখানে জল একটু কম, যেখানে কাদার মধ্যে ঝটপট করছিল একদল চেম্বল্লি। এই চেম্বল্লি— যার আরেক নাম কালো কাল্লাডা, বা কই— ছাল ছাড়িয়ে কাঁচালঙ্কার ঝাল বানিয়ে খেতে চমৎকার। একটা ছোট পাত্রে লঙ্কাবাটা দিয়ে চেম্বল্লিভাজার গন্ধই একপাত্র কাঞ্জির জন্যে দারুণ চাখনা হতে পারে। তাড়ির পাত্রটা নামিয়ে রেখে খালে নেমে একমুঠো ছোট মাছ তুলে কোঁচড়ে ভরে চোভন। হঠাৎই চোখে পড়ে একটা বেশ বড় মাপের চেম্বল্লি। আগুপিছু না ভেবে হাতের মাছটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরে ওই বড় মাছটা ধরতে যায় সে। মুখে ধরে রাখা মাছটা মরার আগে মনে করে তার আর মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস, আর বীরের মরণ বরণ করতে চেয়ে মারে একটা ঝটকানি। আনমনা চোভনের মুখটা একটু আলগা হয়ে আসে। সেই ফাঁকে মাছটা চোভনের গলা বেয়ে একেবারে পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যায়। চেম্বল্লির গায়ের দু-পাশে ধারালো কাঁটা, অন্য মাছেদের চেয়ে ঢের বেশি। বাড়িতে চোভতির অপেক্ষা বৃথা হয়ে যায়।

হতভাগ্য চোভনের আত্মা সেইদিন থেকে ওই অঞ্চল হয়ে যাওয়া নৌকো আর মানুষজনকে এমন বোকা বানায়, যে তাদের সময় আর দিকের হিসেব সব গড়বড় হয়ে যায়।

পাভিয়ন আর তার ছেলেও চোভনের ফাঁদে পা দিল। এক খাল থেকে আরেক খালে ঘুরে ঘুরে তাদের অবস্থা হল সঙ্গীন। এক-একটা জমির সীমানা দেখে চেনা মনে করে পাভিয়ন সেইদিকে যায়, আবার একটু পরেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে পিছিয়ে আসে। অনেকবার তো মনে হল বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বুঝি। এদিকে ক্ষিদে আর ঠান্ডায় কাহিল বাবচন গুটিসুটি মেরে ঘাড় গুঁজে নৌকোয় বসে থাকে, আর নৌকোর ছ্যাঁদা দিয়ে ঢুকে পড়া জল সুপুরিডালের খোল দিয়ে ছেঁচে ছেঁচে বাইরে ফেলে। মাঝে মাঝে নৌকোর আগায় বসা বাপকে অবাক হয়ে দেখে। ক্ষিদে তেষ্টায় পাভিয়নকে বিশেষ কাহিল করতে পারে না। কখনও-সখনও পরপর কয়েকদিনও না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে সে। আবার, খাবার সুযোগ মিললে দুটো মানুষের খাবার এমন অনায়াসে খেয়ে নেয়, যেন আগামীর উপোসের জন্য নিজেকে তৈরি রাখছে।

ঠান্ডা জলের মধ্যে বসে পা যত ঠান্ডা হয়ে আসছে, বাবচন তত মনে করার চেষ্টা করছে গরম-গরম, আলুনি কাঞ্জিজলের কথা। কিছু ধান-টান পেলেই চেল্লা তা দিয়ে কাঞ্জি না বানিয়ে কাঞ্জিজল বানাত, আর বাড়ির বাচ্চারা শুধু শুধু সেগুলো খেত। আহা, পৃথিবীর সবথেকে মধুর গন্ধ।

খালবরাবর যেতে যেতে একটা ঘাসহীন জায়গায় এসে নৌকো দাঁড়ায়। টাল সামলাতে বাবচন লাফিয়ে পাটায় উঠে পড়ে। নৌকো টলোমলো হতেই রেগে যায় পাভিয়ন। দাঁড়টা তুলে ছেলেকে মারতে গিয়েও সামলে নেয়। এর মধ্যে নৌকোটাও জলে বেশ কিছুটা বসে গেছে। লম্বা দাঁড় গেঁথে নৌকোটা জমির সঙ্গে আটকে নিয়ে মোটা মোটা ঘাসগুলো মুঠোয় ধরে ধরে সে আর বাবচন সামনের চাকাঘরটায় উঠে পড়ে। এই ঘরে আছে জমিতে জল ছাড়া-ধরার জন্য একটা জলচাকা। চাকাঘরটা একদম মিশকালো অন্ধকার। মেঝের কাদা এমনভাবে ঘাঁটা যেন দিনের বেলায় এখানে কেউ এসেছিল। বসার জায়গা নেই কোনও। বিদ্যুতের আচমকা আলোয় জলচাকাটাকে মনে হচ্ছিল যেন একটা আঠেরোহাতি রাক্ষস— জমির থেকে জলায় অগুনতি মাছ চালান করা আর জলের পর জল নিয়ে উথালপাথাল করা যার বাঁ হাতের খেল।

—আজ আর নয়, নিজেকেই বলে পাভিয়ন। বাবচনের দিকে চেয়ে বলে— আজ এখানেই থেকে গেলে কেমন হয় রে? কাল সকালে আবার রাস্তা খোঁজা যাবে না হয়।

কোনও সন্তানের কাছে এই প্রথম মতামত জানতে চাইল পাভিয়ন।

—আমার মনে হয় আরও কিছুটা যাওয়া উচিত। বাড়ি চলো না, ঠান্ডায় দাঁত ঠকঠক করতে করতে বাবচন বলে ওঠে।

বাধ্য ভাবে পাভিয়ন নৌকোয় ফিরে আসে।

—পুবের থেকে জল আসছে রে, সে বলে।

যে অল্প সময়টুকু তারা চাকাঘরে ছিল, তারই মধ্যে খালের জল বাড়তে শুরু করেছে। দূরে অন্ধকারের মধ্যে আলো ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট ঘরবাড়ি।

—কিসচান মাপ্পিলাদের বসতি, পাভিয়ন বলে ওঠে। মনে হচ্ছে ঘুরপাক খেতে খেতে কুট্টোমবুরমেই ফেরত এসে পড়েছি আমরা।

কথাটা বলেই ঢোঁক গেলার অবস্থা হয় তার। খালের চেয়ে অনেকটা বেশি চওড়া একটা নদী সামনে দিয়ে হেলেদুলে বয়ে চলেছে। নদীর মাঝখানের প্রবল স্রোতের থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে একটু একটু করে পাড়ের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে এগোতে থাকে তারা। যাওয়ার পথের লতাপাতা আর গাছগাছালির ঝাপটা থেকে মুখ বাঁচাতে হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দিতে থাকে বাবচন। নদীর ওপার থেকে কারও ডাক শুনতে পেয়ে নদীটা পার করে ফেলাই মনস্থ করে পাভিয়ন।

ওপার থেকে যারা ডাকছিল, তাদের মধ্যে একজন বাপ-ব্যাটার মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে। বলে—

—আমাদের পার করিয়ে দেবে গো?

লোকদুটোর পরনে মুন্দুধুতি আর ঢিলেঢালা জামা। দেখতে রোগাসোগা কিন্তু স্বাস্থ্যবান। উপর-অঙ্গে কিছু পরা কাউকে এই প্রথম দেখল বাবচন। ওরা নৌকোয় উঠতে দেখল, ওদের জামাকাপড় জলে ভেজেনি। দেখে মনেই হল না এইখানে বেশ ভালই বৃষ্টি হয়ে গেছে। ওরা নৌকোয় উঠতে নৌকোটা একটুও দুলল না। ওদের একজন কথা বলতে মনে হল, গলার আওয়াজটা বুঝি আসছে একটা ফাঁকা উলুখড়ের ভেতর থেকে। নৌকোটা বিশ্বস্ত বলতেই হবে, কেন না মাল যতই ওজনের থাকুক, ডোবায়নি কখনও। ডুবি-ডুবি করেছে, তবু ডোবায়নি।

—ঘাস কাটতে এসে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে আমাদের। এদিক দিয়ে গেলে কোনখানে পৌঁছুব? পাভিয়ন জানতে চায়।
—তিরুভরপ্পু। তারপর হ্রদ। এই জায়গার নাম কাল্লুমাডা। পশ্চিমে গেলে পাবে ওলাসা আর পারিপ্পু। যেভাবে এসেছ সেভাবেই ফিরে যাও।

নৌকো অপর পারে পৌঁছুল। কাছাকাছি একজন পুলয়ন থাকে, এ কথা জানতে পেরে পাভিয়ন পায়ে হেঁটে রওনা দিল সেইদিকে, খাবারদাবারের সন্ধানে। এদিকে একটা পাথরে বসে বাবচন নৌকোর ওপর নজর রাখতে থাকল।

ওই দুই তরুণও হাঁটা লাগাল। কিছুটা যেতেই ফিরে চাইল একজন।

—আমার নাম নারায়ণপিল্লা, সে বলে, আর এ হল শিভরামপিল্লা।
—বাবুরা যাচ্ছেন কোনদিকে? ঠান্ডায় আর সম্ভ্রমে জড়সড় হয়ে বাবচন জানতে চায়।
—যাচ্ছি মালয়া।
—মালয়ার পথ বুঝি এইদিকেই?
—এদিক ধরে প্রথমে আমরা যাব কোট্টয়ম। সেখান থেকে কিছুদিনের পথ পার হয়ে জাহাজ ধরব। তারপর আর কয়েক মাসের যাত্রা।
—ওখানে আপনাদের লোকজন আছে বুঝি?
—চাকরিবাকরি নেব। কোনও সমস্যা থাকবে না তারপর। ওখানে বৃটিশ টাকায় মাইনে দেয়, জানলে? এখানকার মতো ধান-টান দিয়ে নয়।
—আর ফিরবেন না তাহলে?’
—ফিরব ফিরব। কিন্তু এখানে শুনছি ভারী অন্নাভাব ঘটবে। দুর্ভিক্ষ হবে। একটাও ধান পাওয়া যাবে না আর। যুদ্ধ আসছে বলে শুনছি। ভারী সাংঘাতিক যুদ্ধ।

নদী পার করিয়ে দেওয়ার পুরষ্কার হিসেবেই যে ওরা এত কথা বলছে, এটা বুঝতে পারে বাবচন।

—হয়তো ফৌজে নাম লেখাতে পারি।

হঠাৎ করে চাঁদ উঠলে তার আলোয় বাবচন দেখে ওদের গায়ের সাদা পোশাক আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে একটু অস্বস্তির ভাব নিয়েই দেখে। ওদের পিছু নেবে মনে করে কয়েক পা এগোয়। জলের স্রোতের ধাক্কায় নৌকোটা একটু সরে যেতেই আবার পিছিয়ে এসে নৌকোটাকে ধরে। পাভিয়নের ফেরত আসার অপেক্ষায় থাকে বাবচন, যদিও সে জানে তার বাপ খালি হাতেই ফিরবে।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অসম্ভব ভালো লাগলো পড়ে। ভারতবর্ষেরই গল্প অথচ পড়তে পড়তে মনে হয় এ যেন এক অন্যকোনো অচেনা পৃথিবীর আখ্যান শুনছি। অনুবাদ অত্যন্ত সাবলীল। পরবর্তী কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।

1 Trackback / Pingback

  1. গোঁফ — ২য় পর্ব – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...