ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে — পর্ব ৪ (দ্বিতীয়াংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

Wren House

দুই.

জিনির দোকান ভালই চলছে।

অন্যের দোকানে বেশিদিন কাজের ইচ্ছা কোনওদিনই ছিল না। শেখার দরকার ছিল। সেটা হয়ে যেতেই নিজের এই ছোট্ট দোকান। কোন পশ মলে করতে পারলে নিশ্চয় আরও ভিড় হত। কিন্তু এটাই বা খারাপ কী। পলিন অ্যাভেনিউতে এই একতলা ছড়ানো বিল্ডিঙে সারি সারি ছোট ছোট দোকান। ড্রাইভিং স্কুল, চালায় এক লেবানিজ। তার পাশেই দাঁতের ডাক্তার, গুড স্মাইলস। ডাক্তার চাইনিজ। এদেশে দাঁতের ডাক্তারের খুব পসার। তার পরেই জিনির দোকান। হেয়ারজিনি। চুল কাটা, থ্রেডিং, ওয়াক্সিং এইসব। চুলের রংও হয়। অন্য পাশে একটা ইন্ডিয়ান স্টোর। তার ক্লায়েন্টেলের কথা ভাবলে পারফেক্ট লোকেশান। তার দোকানের খদ্দের বেশিরভাগ ইন্ডিয়ান, মেক্সিকান বা চাইনিজ। এরা ব্রায়ারউড মলে গিয়ে বেশি পয়সায় করবে না এইসব। হয়তো কোনওদিন জিনি আরও কোন বড় জায়গায় দোকান দেবে। এখন এটা করতেই অনেক ভাবতে হয়েছে। মাসে আটশো ডলার গুনতে হয় ভাড়ায়। দোকান সাজাতে হাজার দশেক। হীরক খুব কিন্তু কিন্তু করেছিল। মাসে মাসে এতগুলো টাকা বেরিয়ে যাবে, চলবে তোমার দোকান?

—আচ্ছা, না শুরু করলে কী করে জানব বলো তো?

একদিকে হীরকের জন্য ভাল হয়েছিল। বউ দোকানে চুল কাটে ব্যাপারটা ওর ভাল লাগেনি শুরুর থেকেই। বাঙালি মহলেও এর চর্চা হয়েছে। কিন্তু নিজের দোকান হলে এর দাম আবার আলাদা। বিজনেস করছে। যদিও এখনও নিজেই অনেকটা কাজ করে জিনি। আরও দুটো মেয়ে আছে। একজন মেক্সিকান, মারলিন। অন্যজন ভারতীয়, রাধিকা। এই মেয়েটা আন্ধ্রার, কুটাগিরি। জিনি চেয়েছিল এসিলা ওর সঙ্গে কাজ করুক। কিন্তু এসিলাকে পাওয়া যায়নি।

এসিলা জিনির জীবনে একটা অন্যরকম পাওয়া। আবার দেখতে গেলে এসিলাকে কিছুতেই পাওয়া হল না। এত সুন্দর মেয়েটা! মেয়ে হয়েও ওর সৌন্দর্যে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছে জিনি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল ওর দুনিয়াকে কেয়ার না করা ভাব। যেন জীবনের নৌকা চলছে স্রোতের টানে, তাকে কোনও দিকনির্দেশ দিয়ে কোথাও পৌঁছে যাওয়ার নেই। লোকে ওকে পেতে চায়, বন্যকে পোষ মানাবার উন্মাদনায়। ওর খেয়াল রাখতে চায়, যেভাবে শিশুকে পালন করতে হয়। সৌন্দর্য যে কীভাবে শারীরিক আকর্ষণ ছাড়িয়ে যেতে পারে এসিলাকে দেখে অনুভব করেছে জিনি। জিনিও তো প্রবলভাবে এসিলার দিকে ছুটে গেছিল। বেশ কিছু অদ্ভূত সুন্দর দিন কাটিয়েছে ওর সঙ্গে। একদিন কায়াক চালিয়ে সারা দুপুর ঘুরে বেরিয়েছে হুরনের জলে। খুশিতে ভেসে যাওয়া এসিলার মধ্যে শিশুর সারল্য জিনিকে মুগ্ধ করত। কতদিন এমন খুশির দিন যেন কাটায়নি। যেন রিনির সঙ্গে ছোটবেলা। আবার শিশুসুলভও নয়। চাপল্য আছে, সঙ্গে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গভীরতাও। হীরক আর তিস্তাকে ছেড়ে এসিলার সঙ্গে এই অভিযানগুলো সাবালক বয়সে এই প্রথম একক জীবনরসের স্বাদ এনেছিল। কলেজ পড়তে পড়তেই তো হীরকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। বাবা মা বোনের সঙ্গে একটা নিস্তরঙ্গ সুরক্ষিত অস্তিত্বের বাইরে যে অবাধ অনাবিল একটা জীবন না দেখা রয়ে গেল সেটা বোঝার সময় কোথায় পেয়েছে? কায়াক নদীর কিনারায় বেঁধে পায়ের জুতো খুলে যখন জঙ্গলে দুজনে হাত ধরে দৌড়াচ্ছিল, নিজেকে ট্রেনের সন্ধানে ছুটে যাওয়া অপু দুর্গার মতো মনে হচ্ছিল জিনির। পাতা পায়ে মাড়িয়ে পথ তৈরি করতে করতে যাচ্ছিল ওরা। কানে হাওয়ার শন শন শব্দ, অচেনা পাখির ডাক। সব ছাড়িয়ে জঙ্গলের ঝাঁঝালো গন্ধ। মাথা ঝিমঝিম করছিল। ন্যাচারাল লিভিং-এ বিশ্বাসী এসিলা দ্বিরুক্তি না করে নিজের শর্টস আর টি শার্ট খুলে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিল। ওর পিঠে ব্রায়ের স্ট্র্যাপের কোনও দাগ নেই। মনে হচ্ছিল যেন বনদেবী তার প্রজাদের দেখতে বেরিয়েছে। হই হই করে হাসছিল এসিলা। ওকেও উৎসাহিত করছিল, শরীরে বাতাসের ছোঁয়া নাও জিনি, প্রকৃতিতে ডুবতে শেখো।

কিছু কিছু মানুষ জন্মায় অসম্ভব আকর্ষণী শক্তি নিয়ে। তার চারপাশে সবাই নিয়তি নির্দেশের মতো তার কথায় ছুটে যায়। জিনিও তার শর্টস আর টি শার্ট খুলে গাছে ঝুলিয়ে দিল। কেউ এসে পড়বে না তো এসিলা?

—তাতে কী হবে? কী লুকাতে চাও তুমি? বলতে বলতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল এসিলা। ওর চোখ কিছু কথা বলতে চাইছিল। জানো তো জিনি, আমরা শরীরকে এতরকম কাপড়ে মুড়ে দিই, সঙ্গে আমাদের সত্তাকেও। হারিয়ে ফেলি নিজেদের। বাইরের এই আবর্জনা না সরালে নিজেকে পাবে কী করে?

এসিলার জীবনবোধের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল সেদিন জিনি।

পুরোটা জিনির পক্ষে সম্ভব নয়। সে হয়তো আরেক জন্মে। অন্তর্বাস ছেড়ে বেরোতে পারল না। কিন্তু এও যেন লিবারেশন ছিল ওর জন্য। চুঁচুড়ার মেয়ে জিনি, যাকে দোপাট্টা দিয়ে নারীত্ব ঢেকেও বইয়ের গোছা বুকের উপর দুহাতে জড়ো করে হাঁটতে হত, সে আজ ব্রা আর প্যান্টি পরে জঙ্গলের পথে ছুটে চলেছে। ভেবেই হাসি পেয়েছিল। আর কেউ যদি এসে আমাদের জামাকাপড় নিয়ে চলে যায় এসিলা?

—তাহলে যখন কায়াক চালিয়ে যাব, সবাই ভাববে জলকন্যারা নৌকাবিহারে বেরিয়েছে। তবে তোমাকে ভিক্টোরিয়াস সিক্রেটের মোড়ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এরপর আর কোন প্রশ্ন না করে জিনি সদ্য অর্জিত এই স্বাধীনতার স্বাদ নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে কোন অশ্লীলতার গন্ধ পাচ্ছিল না একদম। এমনি ছিল এসিলার প্রভাব, তার চারপাশের সবার উপরে। অথচ সে নিজেই জানে না তার পানসি কোনদিকে ছুটে চলেছে। কিংবা জানার তোয়াক্কা করে না। এসিলা যে করত না সেটা জিনি বুঝে গেছিল। জিনি ওর সঙ্গে একবার নাইটক্লাবে গেছিল। জঙ্গলপথে ছুটে চলা এসিলাকে সেদিন অন্যভাবে শারীরিক হয়ে যেতে দেখেছিল। একদম অপরিচিত একটা লোকের সঙ্গে সম্পূর্ণ শরীর মিশিয়ে নাচছিল। একসময় লোকটা এসিলাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে চলে গেল। খুব ভয় লেগেছিল জিনির। কিন্তু দেখে মনে হয়নি এসিলার অমতে কিছু হচ্ছিল সেদিন। জিনি সেদিন এসিলার ফেরার অপেক্ষায় থাকেনি আর। পরদিন এসিলার ফোন এসেছিল। সরি জিনি, কালকের জয়েন্টটা একটু বেশি নেওয়া হয়ে গেছিল।

এসিলা যে ড্রাগস নেয় সেদিনই জানতে পেরেছিল জিনি। তার এসব ব্যাপারে কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। এমন কোনও বন্ধুও তো ছিল না কোনওদিন। না হলে আগেই বুঝতে পারা উচিত ছিল। কিন্তু তবুও এসিলাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেনি একেবারে। তারপরেও দেখা হয়েছে। খবর পেয়েছে। প্রত্যেকবার এসিলার জীবন অন্যরকম, নতুন জীবনসঙ্গী। কখনও কাজ করছে, কখনও রুকস্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে পথে। কবে ফিরবে জানা নেই। কোনও কিছুই নিশ্চিত নয়, নিশ্চিন্ততা ব্যাপারটা ওর জীবনে থেকে নাকচ। ধ্বংসের দোরগোড়া থেকে সাফল্যের প্রত্যন্ত চুড়ায় পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা রাখত মেয়েটা। কোনও সময়ে খবর পেয়ে দেখতে গেছে রিহ্যাবিলেটশনে, তার কিছুদিন বাদেই খবর পেল এসিলা নিউ ইউর্কে গিয়ে বুক ডিল সাইন করে এল। বুক ডিলের জন্য পার্টি দিয়েছিল। ততদিনে এসিলার মা ফেরত এসে গেছে। এসিলা মাইডেন লেনে উঠে গেছে, এবার এক বান্ধবীর সঙ্গে। এই পার্টিতেও এসিলা যেভাবে সিমোন বলে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলছিল, ওদের সম্পর্কটা যে অন্যরকম বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। নাচতে নাচতে সিমোন গভীর চুম্বনে আবিষ্ট করেছিল এসিলাকে। লেসবিয়ানিজম সম্বন্ধে এর আগে কোনও ধারণা ছিল না জিনির। মনে হল কে জানে এসিলা কি তাকেও এইভাবে চেয়েছিল? যদিও এমন কিছুই করেনি যাতে মনে হবে মেয়েটা এরকম কোনও প্ল্যান ছকে তাকে বাড়িতে ডেকেছিল। এসিলার বিষয়ে ওরকমভাবে চিন্তাই করা যায় না। বরং জিনির মনে হয় মেয়েটা একটা মোমবাতি, যেটা দুদিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারদিকে তাই এত আলো, কিন্তু কতক্ষণ সেই আলো জ্বলবে কেউ জানে না। সেই আলো নিয়ে ও ঝড়ের সঙ্গে বাজি রেখে ছুটেছে, যেন বলেছে আয় দেখি নেভাতে পারিস কি না। কখনও অতলে ডুব দিয়েছে শেষ দেখার অকৃত্রিম বাসনা নিয়ে। এই পৃথিবীতে কিছুই যে চিরস্থায়ী নয় সেটা হাতেনাতে প্রমাণ করার এরকম অদম্য ইচ্ছা আর কারও মধ্যে দেখেনি জিনি। কোনওদিন।

ড্রাগ ওভারডোজে এসিলার মারা যাওয়ার খবর পেয়েছিল অনেক পরে। আসলে ওর সার্কেল আর এসিলার চারণভূমি তো এক নয়। তাই মাঝেমধ্যে খবর পেত। এসিলা আসাযাওয়ার পথে তার দোকানে ঢুঁ মেরেছে কখনও। এসিলার অন্য সব বন্ধুদের তুলানায় সে তো একদম সাধারণ, ছাপোষা। তবু যে তাকে এত পছন্দ করে বারবার এসে কেন এমন জড়িয়ে ধরেছে জিনি জানে না। কিন্তু অনেকদিন সেটাও বন্ধ ছিল। খোঁজ নিতে এসিলার বাড়িতে হাজির হয়েছিল একদিন। ওখানে ওর মা থাকে।

নিজের পরিচয় দেওয়ায় জোহানা বলল, তোমার কথা এসিলা আমায় বলেছিল অনেকবার। তোমাকে খুব পছন্দ করত।

বুকটা কেঁপে উঠেছিল জিনির। পাস্ট টেন্সে বলছেন কেন ভদ্রমহিলা। কিন্তু প্রশ্নটা করতে সাহস পায়নি।

জড়োসড়ো হয়ে সোফার কোনে বসেছিল জিনি। জোহানা বোধহয় বুঝতে পারেনি যে জিনি জানে না। যখন বুঝতে পারলেন, তখন নতুন করে মেয়ের শোকে চোখ ভাসল। এসিলা যে আমার জীবনে কী ছিল! কিন্তু থামতে জানত না। থমকে থমকে বলছিলেন। তারপর একদম চুপ করে গেলেন।

জিনিও মিস করে। আবার মনে হয় এছাড়া অন্য কিছু হয়তো হতে পারত না। হওয়ার ছিল না।

এসিলা যদি তার না-পাওয়া জীবনের হাতছানি হয়, মারলিন আর রাধিকা তার জীবনে এগিয়ে চাওয়ার পথনির্দেশ। সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর।

মারলিনের মুখের হাসি দেখে বোঝাই যায় না ওর জীবনের স্ট্রাগলের কথা। জিনির কাছে কাজটা তার পার্টটাইম— বারোটা থেকে ছটা। সকাল ছটা থেকে হাউজক্লিনিং-এর বিজনেস চালায়। কোম্পানির নাম মেইড মারলিন। ছয়জন কাজ করে। সবাই তার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই। আমরা মেক্সিকানরা সবাই মিলে এক বিশাল পরিবার, সব সময়ে একে অন্যের পাশে আছি। লোকের জন্য বাইরে দেখার দরকার হয় না। বলতে বলতে গর্ব ছলকে পড়ছিল মারলিনের। তেমনি গর্ব বর জেভিয়ারকে নিয়ে। ওর রুফিং-এর ব্যাবসা। এই কয়েক বছরেই বেশ জমে উঠেছে। পাগলের মতো ভালবাসে জেভিয়ারকে। সেটা নিয়েও কোন রাখঢাক নেই। কথায় কথায় বলবে, আমো আ জেভিয়ার।

মারলিন আসার পরে ওরা তিনজনে মিলে লাঞ্চ করে। ওই আধঘণ্টা কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখে না জিনি।

—আর জেভিয়ার? তোমাকে এমনি ভালবাসে? খেতে বসে রাধিকা প্রশ্নটা আটকে রাখতে পারেনি।

মারলিনের বড় বড় দাঁত ঠোঁটের লাল লিপস্টিকের ফ্রেমে জ্বলজ্বল করে উঠল। আমো আ জেভিয়ার! জিনির থেকে ছোট, কিন্তু বিয়ে হয়েছে কুড়ি পেরোনোর আগেই। এখনও জেভিয়ার বলতে পাগল।

—পাগলের মতো। তৃপ্তির হাসি মারলিনের মুখে। অথচ বিয়ের সাত মাসের মাথায় আমাকে একা রেখে জেভিয়ারকে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসতে হল। ভাবতে পারো রাধিকা?

মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলেছে মারলিন। বোঝা যায় সেই কষ্টটা এখনও ভুলতে পারেনি।

—কেন?
—কী করব? গুয়ানাজুয়াতোতে মাশরুমের কারখানায় কাজ করত। সপ্তাহ গেলে কুড়ি ডলার, তাতে চলে নাকি?

মারলিনের ইংরেজি অত ভাল নয়, মাঝেমাঝে না পেরে স্প্যানিশ কথা ঢুকে যায়। কিন্তু বোঝা যায়।

—এই দেশে এসে জেভিয়ারের আয় পাঁচগুণ হয়ে গেল, কিন্তু আমার পেটে তখন এইবেথ। ডাক্তারের পিছনে কম টাকা যায় বলো?
—তুমি একা সামলালে সব? জেভিয়ার যায়নি?
—কিয়ে পুয়েদো? জেভিয়ার ততদিনে টেক্সাসে। আঙুরক্ষেতে কাজ করছে। ওর কয়োটে লোকটা খারাপ না। তবে মাইকেলের খুব টাকার খাঁই। এল দিনেরো! ৩০০০ ডলার চাইল আমার আর এইবেথের ভিসার জন্য। কত টাকা বলো আমাদের জন্য!

মারলিনের বলার ভঙ্গির মধ্যে একটা ইন্টেনসিটি আছে, সততা। জিনির বাড়ির দাম শুনে একদিন বলেছিল, তোমরা ইপ্সিলান্তিতে বাড়ি নিলে না কেন? অনেক কমে পেতে।

টাকার অঙ্ক নিয়ে মেয়েটা খুব সচেতন। সেটা জিনি লক্ষ করেছে। প্রতিটা ডলার গুনে গুনে খরচ করার কথা ভাবে। জিনি হাসতে হাসতে বলেছিল, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই কেনা হয়ে গেছে মারলিন।

সেদিনের কথাটা জিনির মনে পড়ে গেছিল। হাসি চেপে বলল, কোথা থেকে টাকা জোগাড় করলে?

হাত উল্টাল মারলিন। আর কী, ধার করে। অনেক টাকা ওটা আমদের জন্য। তেনিয়ামোস আলগুনা অপশন? তুমি তো ফিশ ট্যাকো ভালবাসো জিনি? খাবে? নিজের বাক্স জিনির দিকে বাড়িয়ে দিল।

মাছের সঙ্গে ভাত ছাড়া চলত না জিনির। কিন্তু ফিশ ট্যাকোর কথা আলাদা। সামুদ্রিক মাছ বলে হয়তো, বেশ লাগে খেতে। একটা তুলে নিল। নিজের জন্য বাড়ি থেকে শুধু স্যালাড এনেছিল। ভালই হল।

রাধিকা ভেজিটেরিয়ান। ভাত আর রসম খাচ্ছে।

মুখের খাবার শেষ করে মারলিন বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মানে আবার তার কথায় ফিরতে চায়। টাকা তো দিলাম। কিন্তু মাইকেল কীরকম বদমাইশি করেছিল জানো?

আসলে জিনি জানে। এই গল্পটা মারলিন আগেও বলেছে ওকে। তবু শোনে। মারলিনের কথা শুনে বোঝা যায় ওর কাছে আমেরিকা আসাটা কত দামী। কী কষ্ট করেই না এসেছে। অথচ জিনিদের আসাটা কত সহজ হয়েছিল। তাদের এই দেশে জীবনও চলেছে এক নিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। হীরক যদি এটা বুঝত।

কিন্তু রাধিকা শোনেনি আগে। তাই ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন, কী করেছিল?

—মাইক শুধু আমার ভিসা করিয়েছিল, এইবেথের জন্য করেনি।
—আইও! এবার সত্যিই অবাক হয়েছে রাধিকা। তাহলে আবার ফেরত গেলে?
—হেনোসাদো? আমাদের গুয়ানাজুয়াতো থেকে সিউয়াদ আকুনা ছশো মাইল দূরে। সেখান থেকে বর্ডার পার করে ডেল রিওতে যাওয়ার কথা। অতদূর থেকে আর ফেরা যায়?
—তোমার মেয়ে?
—মাইক আর ওর বউ ছিল সঙ্গে। ওদের সঙ্গে এইবেথকে দিয়ে দিলাম। ওরা তো আমেরিকান। এক বছরের মেয়েকে কোলে দেখলে কোনও পেপার দেখতে চাইবে না।

রাধিকা জোরে জোরে মাথা নাড়ল। খুব রিস্ক নিয়েছ মারলিন। আমি আমার ছোট বাচ্চাকে কারো কাছে ছাড়তাম না।

ম্লান হাসল মারলিন। গরিবের কোনও চয়েস থাকে না রাধিকা। আমাকে চান্স নিতেই হত। দিওস না সালভো।

—তুমি টেক্সাস ছেড়ে মিশিগানে কেন এলে মারলিন? সেটা কখনও বলোনি।
—কী করতাম? ততদিনে জেভিয়ার জুনিয়ার এসে গেছে। আঙুরক্ষেতে কাজ করে জেভিয়ার কত আর টাকা পেত? ওর কাজিন ডেট্রয়েটে রুফিং-এর ব্যবসা খুলেছিল। জেভিয়ারকে ডেকে নিল। এখন জেভিয়ার নিজেই ব্যবসা চালায়। ওদের এরিয়া ভাগ করা আছে।
—ডেট্রয়েটে ল্যাটিনো পপুলেশান কেমন?

আবার মুখ জোড়া হাসি মারলিনের। এখন অনেক। তোমরা ডেট্রয়েটের মেক্সিকান টাউনে গেছ কখনও? চার জেনারেশান ধরে আছে অনেক মেক্সিকান। জেভিয়ারের কাজিনরাও অনেকদিনের, এখানেই বড় হয়েছে।

রাধিকা খুব কম কথা বলে। কিন্তু মারলিনকে কথা বলতে দিলে থামানো মুশকিল। খাওয়া শেষ হতেই তাই জিনি নিজে উঠে পড়ে। দুপুরে আধঘণ্টার জন্য কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয় না। লোক চলে এলে কখনও বসিয়ে রাখা পছন্দ করে না ও। তবে দুপুর তিনটে থেকে পাঁচটা ফাঁকা যায়। ওই সময় বাচ্চাদের স্কুল থেকে ফেরার সময়, মহিলারা আসতে চায় না। এইসময় শুধু মারলিন আর জিনি। রাধিকার ডিউটি দুটো অবধি। পাঁচটা থেকে ছটা একটু চাপ যায়। কোনওমতে সামলে নেয়। রাধিকাকে বলেছিল পুরো দিনের কাজ নিতে। কিন্তু মেয়েটা ভয়ে না না করে উঠেছিল। ওর নাকি দশটা থেকে দুটোই ভাল। বেশি টাকার দরকার নেই।

আস্তে আস্তে দোকানের পসার বাড়ছে। মারলিন আর রাধিকা দুজনেই পার্টটাইম। জিনির পুরোদিনের লোক হলেই ভাল। কিন্তু রাধিকাকে রাজি করানো যায়নি। বেশি চেপে ধরতে ছলছল চোখে জিনিকে বলেছিল, প্লিজ জিনি, আমি হাজব্যান্ডকে না জানিয়ে এই কাজ নিয়েছি। ছেলেকে আফটার কেয়ারে রাখতে হলে ও জেনে যাবে।

সেদিনই রাধিকা নিজের কথা বলেছিল। মারলিন ছিল না তখন। রাধিকার বর অনন্ত খুব অত্যাচার করে। রাধিকা থাকতে চায় না ওর সঙ্গে। ছেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। অপেক্ষা করছে সিটিজেনশিপ পাওয়ার জন্য। ততদিনে যত টাকা জমিয়ে নেওয়া যায়।

—কিন্তু কেন?
—আমাদের মধ্যে খুব ডাউরি আছে। অনন্ত আমেরিকায় থাকে বলে আরও বেশি। রাধিকার বাবা পুরোটা দিতে পারেনি। তার জের এখনো চলছে।
—এই দেশে এসেছে, তবুও এমন?

রাধিকার ম্লান হাসি ছাড়া কোনও উত্তর জানা ছিল না। শুধু জানে ছেলেটার জন্য ওকে এই দেশে থেকে যেতে হবে। এখন ডিভোর্স চাইলে তাকে ভাইজাগ ফিরে যেতেই হবে। দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে আছে। একবার সিটিজেন হয়ে গেলে নিজের পথ দেখবে।

এইখানেই মারলিন আর রাধিকা এক হয়ে গেছে। বাচ্চার ভবিষ্যৎ। আমেরিকায় ওদের জন্য একটা জায়গা বানিয়ে দেওয়া। তার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছে বারবার।

হীরককে যে কীভাবে এই কথাটা বোঝাবে জিনি। মাঝেমাঝেই ওর মধ্যে দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। জিনি বুঝতে পারছে ওদের দুজনের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। মারলিনের মতো সে কি বলতে পারে হীরক তাকে পাগলের মতো ভালবাসে? জিনির একটা জীবন তৈরি হচ্ছে যেখানে হীরক নেই। হীরকের একটা জীবন আছে, যেখানে জিনি কখনও ঢুকতে পারেনি।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে — পর্ব ৪ (শেষাংশ) – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...