কু-ঝিক্‌ঝিক্‌

কু-ঝিক্‌ঝিক্‌ | ঈশিতা ভাদুড়ী

ঈশিতা ভাদুড়ী

 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুরই বদল হয়ে যায়। আমাদের অল্পবয়সে বেড়াতে যাওয়াগুলোও বদলে গেছে কত। তখন বেড়াতে যাওয়াগুলো ভীষণই অন্যরকম ছিল। বছরে একবার বেড়াতে যেতাম আমরা বাবার সঙ্গে। সাধারণত শীতের ছুটিতে অথবা পুজোর ছুটিতে। শেষের দিকে দু-একবার ফার্স্ট ক্লাসে গেলেও সাধারণত আমরা সেকন্ড ক্লাসেই যেতাম। তখন দুটোই ক্লাস ছিল, ফার্স্ট ক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাস, এছাড়া নন-রিজার্ভ্‌ড্‌ কামরা। তখন বেশিরভাগ মানুষ সেকেন্ড ক্লাসে যাতায়াত করত। ট্রেনের টিকিট কাটা হত অনেকদিন আগে, বাবা লাইনে দাঁড়িয়ে কাটতেন, তখন তো অনলাইনে টিকিট কেনার ব্যাপারই ছিল না কোনও। টিকিট যদিও অনেকদিন আগে কাটা হত, কিন্তু আমরা জানতে পারতাম শেষ মুহূর্তেই। বাবা সারপ্রাইজ দিতেন আমাদেরকে। সাধারণত সন্ধে বা রাতের ট্রেনে আমরা যেতাম।

বাবার আবার সময়ের অনেক আগেই স্টেশনে পৌঁছে যাওয়ার অভ্যাস ছিল। একদম পছন্দ ছিল না, কিন্তু তবুও ট্রেন ছাড়ার প্রায় দু-ঘন্টা আগে পৌঁছে যেতাম আমরা স্টেশনে। আমাদের সমস্ত বেড়াতে যাওয়া-ই হাওড়া থেকে ছিল, শেয়ালদা স্টেশনের কোনও ভূমিকা ছিল না আমাদের কাছে। দু-ঘন্টা আগে গিয়ে হাওড়াতে বড়ঘড়ির কাছে বসে থাকতাম। সব সময় চেয়ার পেতামও না, স্যুটকেসের ওপর বসতাম, তারপর একটা করে চেয়ার খালি হলে দৌড়ে গিয়ে চেয়ার দখল করতাম, তখন এত বসার জায়গাও ছিল না। তারপর একসময় মাইকে অ্যানাউন্স হলে আমরা প্লাটফর্মে যেতাম। আমাদের অনেকগুলো ভিআইপি আর অ্যারিস্টোক্রেট কোম্পানির বড় বড় স্যুটকেস ছিল, দুপাশে ক্লিপ দিয়ে আটকানো, সামনে দুটো লক। এখনও সেগুলির কয়েকটি আছে। তা যাইহোক সেই স্যুটকেসগুলো কুলির মাথায় চাপিয়ে আমরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতাম। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে অবশ্য বাবা চার্ট দেখে নিতে ভুলতেন না।

আমাদের সঙ্গে লটবহর অনেক থাকত। মিলটনের বা ওইরকমই কোনও কোম্পানির জলের একটা পাঁচ লিটারের বোতল, খাবারপত্রের একটা ঝুড়ি, বাস্কেট মতন, তাতে রাতের খাবার যেমন থাকত, সেরকমই শুকনো খাবারও থাকত। এছাড়া বিছানার চাদর, আর, আমাদের সঙ্গে ভাঁজ করা হাওয়া দেওয়া বালিশ থাকত, ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে ছিপি আটকে দেওয়া হত। আমি অবশ্য ওই বালিশ পছন্দ করতাম না, চাদর পেতে খালি মাথাতেই শুয়ে পড়তাম।

বাবার সঙ্গে অবশ্যই চেন আর তালা থাকত, ট্রেনে উঠেই স্যুটকেসগুলো বার্থের নিচে ঢুকিয়ে চেন দিয়ে বেঁধে ফেলা হত। তারপর বাবা শার্ট প্যান্ট জুতো খুলে পাজামা ফতুয়া চটি পরে ফেলতেন। ট্রেনের পোশাক-আশাক অন্যরকম ছিল, মা সিন্থেটিক শাড়ি পরতেন। শায়াতে পকেট করে সেখানে টাকা নিতেন। আমাদের সঙ্গে মগ আর সাবানও থাকত, দুপুরবেলা বাথরুমে গিয়ে স্নানও করে ফেলতাম, আজকের দিনে ভাবা যায়?

আমাদের বাড়িতে যদিও হোল্ডল নামে একটা বস্তু ছিল, ত্রিপলের কাপড়ের, অনেক কিছু ভেতরে ঢুকিয়ে বেল্ট বেঁধে ছোট করে নিয়ে যাওয়া যেত, কিন্তু আমাদের বেড়াতে যাওয়ার সময় অবশ্য সেই বস্তু নিয়ে যাওয়ার স্মৃতি খুব কম। আমরা রাজগিরে গিয়ে প্রায় আড়াই মাস ছিলাম, সেইসময় মনে হয় ওই হোল্ডল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সঠিকভাবে মনে পড়ছে না। রাজগির খুবই স্বাস্থ্যকর জায়গা ছিল তখন, সেখানে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে খ্যাংড়াকাঠি আমি বেশ গোলগাল হয়ে গিয়েছিলাম। সে-সময়ে বাঙালি স্বাস্থ্যরক্ষা করতে রাজগির মধুপুর যেত।

রাতে মায়ের করে নিয়ে যাওয়া লুচি-আলুরদম অথবা সাদা আলুর তরকারি, ডিমের ডালনা খেতাম আর সঙ্গে ক্ষীর অবশ্যই থাকত। সকালবেলায় ‘চায়ে গরম’ হাঁকডাকে ঘুম ভাঙত, আমরা চা না খেলেও মায়ের খুব নেশা চায়ের। কোনও বড় স্টেশন থেকে পুরি-সব্জি কিনতেন বাবা অনেক ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে। সেই গরম গরম পুরি-সব্জি, আহা! দুপুরবেলা ট্রেনের ক্যাটারিং-এর খাবার, গর্ত গর্ত স্টিলের প্লেটে খাওয়া।

আমাদের সেইসব বেড়াতে যাওয়ায় হুইলার স্টলের ভূমিকা খুব ছিল। মুভেব্‌ল্‌ স্টলও ছিল তখন, এগিয়ে এগিয়ে কামরার কাছে আসত। এখন বোধহয় আর হুইলার স্টল বলে কিছু নেই। আমাদের বেশিরভাগ বেড়াতে যাওয়াতে মোগলসরাই জংশন স্টেশনের ভূমিকা খুব উল্লেখযোগ্য ছিল, উত্তর ভারতে যাওয়ার পথে। আর দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার পথে বিজয়ওয়াডা স্টেশন।

রাতের ট্রেনে যাওয়ার আনন্দটাই আলাদা। সেই যে অনেক রাত অবধি জেগে থাকা, ব্যাকগ্রাউন্ডে কু-ঝিক্‌ঝিক্‌, জানলার বাইরে অন্ধকারে অজানার দিকে অপলক তাকিয়ে দিগন্ত জোড়া মাঠ, সেই মাঠ পেরিয়ে দূরে ছোট ছোট আলো, কখনও কোনও ছোট সাঁকোর ওপর দিয়ে সাইকেল নিয়ে কারও যাওয়া, অথবা দূরের কোনও রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাওয়া এইসব দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম, হঠাৎই কোনও বড় স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়া, হকারদের চিৎকার সবই খুব মায়াচ্ছন্ন ছিল। সেই যে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন—

ঝক ঝকাঝক ট্রেন চলছে
রাতদুপুরে অই
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।…

এখন এই সেকেন্ড ক্লাসে চড়ার কথা ভাবাই যায় না। ট্রেনে চাপাই তো হয় না। উড়োজাহাজ খুবই সহজলভ্য হয়ে গেছে মধ্যবিত্তদের কাছে আজ। কিন্তু ট্রেনের সেই কু-ঝিক্‌ঝিক্‌, ‘চায়ে গরম’ হাঁক, সেই যে রাত্রিবেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে জানলা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অজানাকে চেনার চেষ্টা, অনেক দূরের ছোট ছোট আলোর দিকে তাকিয়ে ভাববার চেষ্টা সেই জায়গার কথা, সেখানকার মানুষের কথা, অথবা কোনও দোতলা ব্রিজের ওপর দিয়ে যেতে যেতে নিচে গাড়িচলাচলের শব্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়া! হারিয়ে গেছে। উড়েই গেছে সেসব জীবন থেকে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...