গোঁফ

এস হরিশ

 

শুরু হল নতুন ধারাবাহিক এস হরিশ রচিত মালয়ালম উপন্যাস ‘মিসা’-র বঙ্গানুবাদ। মূল মালয়ালম থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জয়শ্রী কালাথিল। ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষান্তর ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্যের। উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ Moustache ২০২০ সালে সাহিত্যের জন্য JCB পুরস্কার পায়। মূল উপন্যাসটি ২০১৯ সালের কেরল সাহিত্য অ্যাকাডেমি (উপন্যাস) পুরস্কারে ভূষিত। অনুবাদ করার এবং প্রকাশের সহৃদয় অনুমতি দেওয়ার জন্য লেখকের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

 

লেখকের কথা (সম্পাদিত)

‘গোঁফ’ কাহিনির ঘটনাস্থল কুট্টানাড। ভারতের দক্ষিণে যে কেরল রাজ্য, তারই তিনটে জেলা নিয়ে এই কুট্টানাড অঞ্চলের বিস্তার। এই অঞ্চল প্রকৃতপক্ষে একটা ব-দ্বীপ। পশ্চিমঘাট পাহাড়ের থেকে বয়ে আসা পাঁচটা নদী আর তাদের সঙ্গে বয়ে চলা শয়ে-শয়ে উপনদীগুলো এই ব-দ্বীপ তৈরি করে কালক্রমে ভারতের দীর্ঘতম হ্রদ ভেম্বানাড কায়লে গিয়ে মিশেছে, আর এই ভেম্বানাড কায়ল তারপর গিয়ে মিশেছে আরব সাগরে, কোচি বন্দরের কাছাকাছি একটা জায়গায়। উপকূলের সাগরফেরত জমা জল, অত নদী আর খালের তৈরি ঠাসবুনোট নকশা, বিস্তীর্ণ অঞ্চলজোড়া ধানক্ষেত, জলাভূমি, পুকুর, আর সোঁদা গন্ধ-ওঠা কালো মাটি— এই নিয়ে কুট্টানাড যেন একটা আস্ত জলছবি। মানুষের বাস শুধু ক্ষেতের পাড় আর তার সঙ্গে জুড়ে-থাকা উঠোনের ধারে-ধারে। এখানে চাষ হয় সমুদ্রতলের থেকে নিচে। চাষের জন্য জমি তৈরি হয় হ্রদগর্ভের মাটি কেটে, আর চাষ করা হয় সকলে মিলে, কারণ তার জন্য পরিশ্রম লাগে প্রচুর। আলাদা আলাদা মালিকের জমি এক করে তৈরি হয় ‘পাডশেখরম’। একটি পাডশেখরম বা জমিমণ্ডলের মধ্যেকার প্রতিটি জমির সীমানা আল বেঁধে নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। এরকমভাবে তৈরি প্রতিটা জমিমণ্ডলের আলাদা আলাদা নাম রাখা হয়।

ফি বছর দক্ষিণ-পশ্চিমের বর্ষার পর তিনবার করে বন্যায় ডুবে যাওয়া এই অঞ্চলে অতি মামুলি ঘটনা। আবার, গ্রীষ্মে ভেম্বানাড কায়লের পথ ধরে আরব সাগরের নোনাজল এই অঞ্চলের জমি, জলা আর জলপথগুলোকে প্লাবিত করে। এখানে জমির চাষ করে রোজকার জীবিকানির্বাহ করা মানে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যাওয়া। জলজ গাছপালা আর পশুপাখি এখানে প্রচুর। সাইবেরিয়া ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে পরিযায়ী পাখিরা প্রতি বছরই এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। চাষ করা ছাড়াও মাছ ধরা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে জীবিকা উপার্জনের আরেকটা রাস্তা।

এই কাহিনির প্রধান ঘটনাগুলোর সময়কাল বিশ শতকের প্রথমার্ধ। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা আর পাঁচটা জায়গার মতো লেগেছিল কুট্টানাডেও। যেখানকার মানুষ মালয়ালম ভাষায় কথা বলেন, সেই কেরল রাজ্য তখন ছিল তিনটে অঞ্চলে বিভক্ত: উত্তরে মালাবার, মধ্যে কোচি (বা কোচিন) আর দক্ষিণে তিরুভিথমকুর (বা ত্রিবাঙ্কুর)। মালাবার ছিল বৃটিশশাসিত, আর কোচি ও তিরুভিথমকুরের শাসকেরা ছিল স্থানীয় রাজারাজড়ারা— যারা বৃটিশদের প্রভুত্ব স্বীকার করে তাদের অধীনে নিজের নিজের রাজ্য পরিচালনা করত। কুট্টানাড ছিল তিরুভিথমকুরের একেবারে উত্তরপ্রান্তে, আর ভেম্বানাড কায়ল কোচি থেকে তিরুভিথমকুর পর্যন্ত ছড়ানো। এই কাহিনি যখনকার, তখন ইংরেজি শিক্ষার ক্রমবিস্তার, ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিদের আনাগোনা আর স্থানীয়ভাবে ঘটে চলা ছোটখাটো সামাজিক সংস্কারের ফলে বৃহত্তর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটে নানান রদবদলের সূচনা হয়ে গিয়েছে।

শুচি-অশুচির চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী সামাজিক জাতিভেদ দেশের অন্যান্য জায়গার মতো এই কেরলেও ছিল। বস্তুত, কেরলে এখনও সামাজিক মর্যাদা, কদর আর অবস্থানের মূল নির্ণায়ক জাতই। যে-সময়ের কথা এই গল্পে বলা হচ্ছে, তখন দৈনন্দিন জীবনে জাতপাতের প্রভাব আজকের চেয়ে বেশি বই কম ছিল না। মানুষ কোন কাজ করবে, কেমন জামাকাপড় পরবে, কী খাবার খাবে, কার সঙ্গে খাবে বা মেলামেশা করবে, কাকে ছোঁবে, কাকে বিয়ে করবে বা কার সঙ্গে শোবে, বিয়ে, জন্ম বা মৃত্যুর সময় কোন কোন নিয়মকানুন পালন করবে, কার পুজো করবে এবং কেমনভাবে করবে, কেমন ঘরে থাকবে— এর সবটাই ঠিক হত সে কোন জাত তার ভিত্তিতে। নিচু জাতের মানুষ যেন উঁচু জাতের চোখের সুমুখে এসে না পড়ে, বা কোন জাতের মানুষকে অন্য জাতের থেকে কতটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে এ-সবই ঠিক করে দিত জাতপাতের নিয়মাবলি। এক জাতের মানুষ অন্য জাতের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবে, তা-ও ঠিক করে দিত ওই নিয়ম। ওই নিয়মে মানুষকে ডাকা হত তার জাতনামে, নিজের নামে নয়। অনেক জাতের আবার ছিল নানান উপজাত, এবং এক-একটি উপজাতের জন্যেও নির্দিষ্ট ছিল উচিত-অনুচিত আর শুচিতা-অশুচিতার নানা বিধান। উচ্চতর জাতের কেউ ছোটজাতের মেয়েমানুষের সঙ্গে শুলে এবং তার ফলে বাচ্চাকাচ্চা এলে সেই বাচ্চাকে বাপের বংশধর বলে মানা হত না। শাসক বা রাজারা যাতে জাতব্যবস্থার সবচেয়ে উপরে থাকা মানুষজনের কল্যাণ বা হিতসাধন সুনিশ্চিত করতে পারেন— আইনকানুনের প্রণয়ন হত এমন করেই। একই অপরাধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন জাতের জন্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির নিয়ম।

নারী ও পুরুষের ভূমিকা এবং নারীত্ব ও পুরুষত্বের ধারণার নির্ধারকও ছিল এই জাতব্যবস্থা। নারীর জীবন, বিশেষ করে যৌনজীবনের নিয়ন্ত্রণও ছিল এই ব্যবস্থার হাতে। উনিশ আর বিশ শতকে বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা ভিক্টোরীয় নৈতিকতার ধারণা মহিলাদের উপর বিধিনিষেধের পাহাড় আরও বাড়িয়ে তুলল। জাতের নিয়ম বলে দিল, স্তন ঢাকার অধিকার পাবে একমাত্র নাম্বুথিরি মেয়েরা। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের নিয়ম এমনই হল, যে মেয়েদের একমাত্র গতি হল তাদের জাতের পুরুষদের— যাদের অনেকেই বয়সে এই মেয়েদের থেকে অনেকটা বড়— শিশু কনে হয়ে থেকে যাওয়া, এবং অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিধবা হওয়া। নায়ার মেয়েদের আবার কর্তব্য ছিল উচ্চতর জাতের পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া। তারা অবশ্য এই মেয়েদের পুরোপুরি মানুষ হিসেবে গণ্যই করত না। সঙ্গী নির্বাচন ও নিজেদের যৌনজীবন নিজেদের শর্তে বাঁচার ক্ষেত্রে বরং স্বাধীনতা ছিল নিচুজাতের মেয়েদের, যদিও শোষণ আর ক্রীতদাসের মতো খাটুনি ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী।

যাকে, বা যার গোঁফ নিয়ে এই কাহিনি, সেই বাবচন জাতিতে পুলয়ন, কিন্তু খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত। এই পুলয়ন সম্প্রদায় ছিল কুট্টানাডের অন্যতম বৃহত্তম সম্প্রদায়। এরা মূলত ছিল ধানের ক্ষেতে কাজ করা কৃষিজীবী, যদিও কিছু লোকের জীবিকা ছিল মাছ ধরা। এরা থাকত ধানের ক্ষেত-সংলগ্ন কুটিরে। আঠারো শতকের শেষ পর্যায় পর্যন্ত উঁচুজাতের জমিদারেরা এই পুলয়নদের নিজেদের সম্পত্তির মতো ব্যবহার করত। প্রয়োজনমতো জমির সঙ্গে বিনিময় করে নিত। কেরালায় মিশনারিদের ক্রিয়াকলাপ বাড়ার সঙ্গে এদের অনেকেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিতে থাকে। বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক ও জাতিবিরোধী নেতা আইয়নকালি, যাঁর কথা এই কাহিনিতে বলা হয়েছে, একজন পুলয়ন হয়েই জন্মেছিলেন।

অন্যান্য জাতির অনেক চরিত্রের কথাও এই গল্পে এসেছে। জাতিতন্ত্রের সবথেকে উঁচুতে স্থান নাম্বুথিরি (কেরল-ব্রাহ্মণ)-ইত্যাদি ব্রাহ্মণের। এদের কাজ মন্দির পরিচালনা করা, সামাজিক রীতি ও আচারপালন সুনিশ্চিত করা, ভূমিসম্পদের অধিকাংশের দেখাশোনা করা, রাজাদের ও রাজনীতির উপর প্রভাব খাটানো, আর পাট্টন/পাট্টর ও আইয়রদের (তামিলনাডু থেকে আসা ব্রাহ্মণ)— যাদের দখলে পেশকার ও তহশিলদারদের মতো বেশিরভাগ প্রশাসনিক আর বিভিন্ন অঞ্চল ও জেলার কর আদায়ের ভার— কব্জায় রাখা। রাজপরিবারের লোকেরা ক্ষত্রিয়, অব্রাহ্মণ হলেও উচ্চবর্ণ। এদের অধিকাংশের জন্ম নাম্বুথিরিদের সঙ্গে যৌনমিলনের ফলে। এরা মেনে চলত মাতৃকুলভিত্তিক উত্তরাধিকারের নিয়ম। এই গল্পের অনেক চরিত্র নায়ার জাতির ও পিল্লা, মেনন, কুরুপ্পু-আদি জনজাতির যারা মোট জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ। এরাও মাতৃকুলভিত্তিক উত্তরাধিকারের নিয়ম মেনে চলত। নায়ারদের হাতে ছিল, এখনও আছে, সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ। বৃটিশ রাজের আগে রাজপরিবার মানেই ছিল নায়ারেরা। এদের কেউ কেউ চাষ-আবাদও করত, আবার ব্রাহ্মণদের ভৃত্য হিসাবেও কাজ করত।

চোভন (এড়ভা) জাতের কথাও এই কাহিনিতে অনেকবার এসেছে। এরা জনসংখ্যার একটা বড় অংশ হলেই ছিল মোটের উপর নিচুজাত। এদের প্রধান জীবিকা ছিল চাষবাস আর নারকেলের তাড়ি তৈরি করা। শ্রী নারায়ণ গুরু বা গুরুস্বামী, যিনি ছিলেন কেরলের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা, ছিলেন এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব এই কাহিনিতে আবির্ভূত হয়েছেন।

আর ছিল দক্ষিণ তিরুভিথমকুরের নাদরেরা। এরা ছিল ঐতিহ্যগতভাবে তালগাছ-সংক্রান্ত কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। এই কাহিনিতে রাজপরিবারের সঙ্গে সখ্যের ফলে এদের যথেষ্ট সামাজিক প্রতিপত্তি পেতে দেখা যাবে। অন্যান্য যেসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ওই সময় কুট্টানাডের সমাজ গঠন করেছিল, জীবিকাসহ তাদের একটা তালিকা এখানে পেশ করা গেল: মারর (উচ্চবর্ণ যারা মন্দিরের ছোটখাটো কাজকর্ম করত), আসরি (ছুতোর ও কাঠখোদাই), কোল্লন (কর্মকার), থাট্টন (স্যাকরা), ভানিয়ান (কলু), ভেলাক্কিঠলা নায়ার (উচ্চবর্ণের জন্য নাপিত), ভাঠি (নিম্নবর্ণের জন্য নাপিত), ভেলন (ধোপা), পারয়ন (কৃষিজীবী ও চর্মকার), ভালন আর আরয়ন (জেলে), উল্লাদন (যাযাবর) ইত্যাদি।

এই গল্পে বর্ণিত আরও এক গোষ্ঠী হল ক্রিশ্চানেরা। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে কেরল-ক্রিশ্চানদের— যাদের সিরিয়ান ক্রিশ্চান বা নাসরানি ক্রিশ্চানও বলা হয়ে থাকে— শুরুওয়াতকে সেন্ট টমাস দ্য অ্যাপস্টলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। এই গল্পে মাপ্পিলা নামের জাতির মানুষেরা ক্রিশ্চান, যাদের প্রধান জীবিকা চাষবাস আর বাণিজ্য। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল ভূস্বামী। এদের অনেকে নিজেদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত উচ্চবর্ণের হিন্দু বলে গর্ববোধ করত।

মালাবারের এড়ুথাচান এই কাহিনির একজন অন্যতম প্রধান চরিত্র। এড়ুথাচানেরা ঐতিহ্যগতভাবে ছিল শিক্ষক। তা ছাড়া কুট্টানাডে এই জাতির লোকেদের খুব একটা পাওয়াও যায় না। এর বাইরে কুট্টানাডে ছিল অল্প সংখ্যায় মুসলমান আর গোয়া থেকে আগত কোঙ্কনি ভাষাভাষী কিছু মানুষজন।

বাবাচনের কাহিনির সময়ে কুট্টানাডে ধানক্ষেতের বেশিরভাগটারই মালিকানা ছিল মন্দির আর ব্রাহ্মণদের কাছে। বাকিটা ছিল সিরিয়ান ক্রিশ্চান আর নায়ারদের হাতে। ধানচাষই কুট্টানাডে সামন্তব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছিল এমন বললে অত্যুক্তি হয় না। মূলত ক্রিশ্চান আর নায়ারেরা ভাগচাষের ব্যবস্থা করত, আর ওই জমি চাষের জন্য কায়িক মেহনতটা করত পুলয়নেরা, কিছুটা চোভনেরাও। প্রদেয় মজুরির জন্য কোনও সুস্পষ্ট নিয়ম ছিল না। চাষ করলে ফসলের ভাগ দেওয়াই ছিল দস্তুর, যদিও সে ভাগ ঠিক করত ভূস্বামী বা ভাগচাষের আয়োজকেরা। এর ফলে, বলাই বাহুল্য, প্রকৃত মেহনতকারীরা শিকার হত চূড়ান্ত বঞ্চনার। এই কাহিনিতে ধরা সময়টাতে সামাজিক রীতিনীতি ও আধিপত্যপরম্পরায় ক্রমে ক্রমে বদল আসতে দেখা যাচ্ছে। এই সময়ে কুট্টানাডবাসীদের মনে মানবাধিকারের ধারণাও ছাপ ফেলতে শুরু করে।

এই ভূমি, যেখানে আমি এখন পর্যন্ত আমার সমস্ত জীবন কাটালাম, আমায় মুগ্ধ করে রাখে। যেদিন থেকে আমার লেখালেখির শুরু, সেইদিন থেকে আমি আমার এই জন্ম ও কর্মভূমিকে আমার কাহিনিতে আনতে চেয়েছি। বাবচন চরিত্রটি এমন একজন বড় গোঁফওয়ালা মানুষকে দেখে লেখা যাঁকে আমি ছোটবেলা থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের পাড়ায় তাঁর উপস্থিতি ছিল একেবারে অনন্যসাধারণ। মানুষটি ছিলেন নরম স্বভাবের, আর সকলে বেশ একটু ভয়মিশ্রিত সম্ভ্রম নিয়েই তাঁর সঙ্গে কথা বলত। তাঁর ওই নজরকাড়া গোঁফজোড়া যে একটি নাটকে অভিনয়ের পর থেকেই তিনি রাখতে শুরু করেন এবং কখনও না কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন, সে-কথা আমি জেনেছি অনেক পরে। ওই ভদ্রলোক ছিলেন আর পাঁচটা সাধারণ, পরিচিত মানুষের থেকে একেবারে আলাদা। আমার মনে হয়, ওঁর গল্পই আমার মাথার মধ্যে একটা বড় গল্পের বীজ রেখে যায়, যে বীজ পরবর্তী অনেকটা সময় নিয়ে অঙ্কুরিত ও প্রসারিত হতে থাকে। তবে ওঁর জীবনকথা লেখার কোনও উদ্দেশ্যই আমার ছিল না। বাবচনের কাহিনি সম্পূর্ণত কাল্পনিক।

জাতিগোষ্ঠীর রাজনীতি নিয়েও আমি গল্প লিখতে বসিনি। তবে এই কাহিনির খাতিরে যেটুকু গবেষণা আমাকে করতে হয়েছে ও তার জন্যে যে যাত্রাপথ আমি অতিক্রম করেছি, তার ফলে আমার নিজস্ব ধ্যানধারণা ও বোধের ক্ষেত্রে একটা গভীর পরিবর্তন আমি লক্ষ করেছি। এই কাহিনির প্রস্তুতিকালে আমি শিখেছি কীভাবে ও কতটা অনুধ্যান নিয়ে শুনতে হয় দলিত ইতিহাস আর সেই ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁদের নিজেদের জ্ঞান কতটা গভীর। অধ্যয়ন করেছি সমগ্র কুট্টানাডের জাতিগোষ্ঠীর রাজনীতি। এই কাহিনিতে এমন অনেক চরিত্র আছে যারা নারীবিরোধী বা মানবতাবিরোধী কথাবার্তা বলে। এই নিয়ে প্রতিবাদও হয়েছে। এ-কথা মানতে আমার বাধা নেই যে এই চরিত্রগুলো এইসব বিষয়ে আরও অনেক যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে পারত। কিন্তু উপন্যাস তো স্বাধীন দেশের মতো। তাই সেই দেশের চরিত্রেরা কোন কাজ কেমন করে করবে সে বিষয়ে লেখকের খুব বেশি কিছু করার থাকে না।

আঠালো কাদা, ক্ষয়িষ্ণু ম্যানগ্রোভ, নদ-নদী-খালের গ্রন্থিময় নকশা আর ধানক্ষেতের অনন্ত, অসীম বিস্তার— এর থেকে গল্পের মাছ তুলে আনার জন্য যোগ্যতর শিকারি ছিলেন অনেক। এই জলছবির গভীরতা থেকে কাভলম বিশ্বনাথ কুরুপ আর থাকাড়ি শিবশঙ্কর পিল্লার মতো লেখকেরা তুলে আনতেন নধর ওয়ালাগো, সাপমাথা আর মাগুরের মতো মাছ। কুট্টানাডের জল ছেনে নানান সম্পদ তুলেও এনেছেন অনেকেই। কিন্তু আমি তো মাছ ধরায় ভাল ছিলাম না কোনওকালেই। ছোটবেলায় বন্ধুরা মাছ ধরতে গেলে আমি তাদের সঙ্গী হতাম একটা পাত্র নিয়ে, যাতে রাখা হবে তুলে আনা মাছ। এখানকার মাছ ধরা খুব সহজ কর্ম নয়। জল থেকে তুলে আনলেও তারা কাঁটা বেঁধায়, বোকা বানায়। এই কাহিনিতে লিখতে গিয়ে অমন কাঁটার খোঁচা আমি খেয়েছি অনেক। বোকাও বনেছি অনেকবার।

এই উপন্যাস লিখতে বসে সাহায্য পেয়েছি অনেকেরই। কিছু বর্ণের বিশেষাধিকার ও জাতিগরিমা এবং প্রায় রোগের মতো নীতিপুলিশি যে দেশে সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমন একটি দেশে এই উপন্যাস প্রকাশ পেতেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে প্রচুর। এমতাবস্থায় পাশে পেয়েছি অনেককেই। এঁদের সকলকেই আমি ধন্যবাদ জানাই।

এস হরিশ
নিন্দুর

 

[মূল কাহিনি শুরু আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4853 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. গোঁফ — ১ম পর্ব – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...