Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

খুল্‌ যা সিম্‌সিম্‌

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

 

বাড়ির কাছেই নদী। কিন্তু হাওয়া নেই। হাওয়া নেই মানে আছে, কিন্তু প্রবেশাধিকার নেই। সমস্ত দরজা জানলা এঁটে রাখা থাকে চব্বিশ ঘণ্টাই। নয়তো মশা। সকালের মশা মানেই নাকি আবার ডেঙ্গু। সকালের রোদ হাওয়ার সঙ্গে তেনারাও ঢুকে আসেন। তা নয়তো অন্য পোকামাকড়। নয়তো ধুলো। নয়তো পড়শির কৌতূহল। তাই সব বন্ধ। দমও বন্ধ হয়ে আসে পাল্লা দিয়ে। সারাদিনই এসি চলছে। ইয়াব্বড় বড় ঘর আর দেওয়াল আর আসবাব আর কার্পেট আর অয়েল-পেইন্টিং আর দেশবিদেশের নানান সংগ্রহ আর অজস্র শো-পিস — সবাই চুপচাপ ঠান্ডা মেরে থাকে দিনরাত্তির। মস্ত পুরনো বাড়িটা রেনোভেট করে দোতলাটার আধুনিকীকরণ হয়েছে দশ বছর আগে। নিচের তলায় দোকানঘর, শো-রুম। কয়েকপুরুষের পৈতৃক ব্যবসা। সারাদিন জনা বিশেক কর্মচারী কাজে আসে যায়। নানা ধরনের ক্রেতা স্টেশনারি কাম ফ্যান্সি শো-রুমে আর লাগোয়া জিমে। ওর সেসবে প্রবেশাধিকার নেই। ঠিক যেমন হাওয়াবাতাসের নেই দোতলায় এই বিরাট আড়াই হাজার স্কোয়ার ফুটের কোথাও। শুধু স্নানঘরের ছাদ লাগোয়া ফ্যানলাইট দিয়ে দু একটা মাকড়শা টিকিটিকি আর খড়কুটো ঢুকে পড়ে মাঝেমাঝেই। ফ্যানলাইট দিয়ে আকাশ দেখা যায় না। ওর খুব আকাশ দেখতে ইচ্ছে করে। ছাদে যাওয়ার সিঁড়িতে তালা। ওর মাথা ঘোরে। ডাক্তার বলেছে ছাদে না যেতে।

ও যায় না। ঘরের মধ্যে ঘর বানিয়ে খেলে। আবছা আবছা মনে পড়ে একটা উঠোন আর বারান্দাঘেরা বাগান। ঘুঘু পাখির বাসা। ঝড়ের দুপুরে বোগেনভেলিয়ার ডালে আটকে থাকা ভেজা ভেজা ছেঁড়া ছেঁড়া বেগুনি পাঁপড়ি। দু-জোড়া সোফা আর ছখানা বেতের চেয়ারের মাঝখানে লম্বালম্বি জায়গাটা একটা উঠোনমতো না? চুউউউউউ কিতকিতকিতকিতকিত — খেলতে খেলতে ততক্ষণ লাফানো যায় যতক্ষণ না ল্যান্ডফোনটা বেজে ওঠে — “কীসের এত আওয়াজ? আবার লাফালাফির শব্দ কেন?” হিস্‌হিস্‌ গলাটা চুপ করে শুনতে শুনতে খিলখিল হাসে ও। কীরকম হাওয়া আসছে বাতাবিলেবুপাতার নারকেলপাতার আমপাতার মধ্যে দিয়ে — আহ! শরীরটা জুড়িয়ে গেল। উনিশ ডিগ্রিতে উঠছে নামছে ব্লেড আর মিষ্টি লেবুফুলের গন্ধ! উম্মম্মম্মম!!! মৌমাছিগুলো যে কোথায় গেল। নাহ! ওদের তো ঢোকার অনুমতি নেই। দরজা বন্ধ, জানলা বন্ধ। সব বিলকুল বন্ধ্‌ হ্যায়!

জলে নামে ও। চুড়ো করে চুল বাঁধে। নিরাবরণ হওয়ার আগে মস্ত আয়নাটা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে দেয়। নিজের শিথিল শরীরটা দেখতে চায় না। ভয় পায়। জলের মধ্যে ছোট্টছোট্ট শাপলা। শরত এসে গেছে না? এটা তো আশ্বিন মাস বোধহয়! টিভিতে দেখতে হবে তো পুজোর শপিং শুরু হল নাকি শেষ সবার? ও টিভি দেখে না। মাথা ঘোরে। ডাক্তার বারণ করেছেন। মহালয়া যেন কবে! কী যেন একটা গান বাজত না — আলোর বেণু! বাবার কাছে শুনেছিল বেণু মানে বাঁশি। না বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা আমার বাঁশিটি — কে যে গাইত! আচ্ছা শরত এল কি? শাপলা ফুলে হাত রাখে ও। ফুলগুলো তুলে তুলে নিজের শরীরের ওপর রাখে — ডোবা জলে ভেসে থাকা শরীরে। নাভির ওপর নীল শাপলা একটা। এরকম তীব্র রঙের শাপলা ও কোথাও দেখেনি। এরকম রঙ কি হয় সত্যিই কোনও ফুলের? ও কেবল সাদা আর লালচে গোলাপী শালুকই দেখেছিল। বাড়ির পাশে ডোবাগুলোয়। বড় বড়  গাছের ঝিরিঝিরি পাতার ছায়ার নিচে। এই রবারের ফুলগুলোয় একটুও পেলবতা নেই। না থাকুক। বাথটাবের ঠিক উল্টোদিকে একটা মস্ত একোয়ারিয়াম। একটা হলুদ লাল ছোপছোপ মাছ ওকে দেখছে স্থির চোখে। মৎস্যকন্যার ভঙ্গিতে বাথটাবের ওপর উঠে বসে ও। পুচ্ছপাখনা নাড়ায়। চুল খুলে দেয়। জলজ তন্তুর মতো সারা শরীরে জড়িয়ে যায় খোলা চুল। শ্যাওলাগন্ধ — আহহহহ!! ও মাছগুলোকে দ্যাখে একোয়ারিয়ামের ওদিকে আর মাছগুলো ওকে দ্যাখে একোয়ারিয়ামের এদিকে। কাচের দেওয়ালটা লক্ষ্য করে সাবানটা ছোঁড়ে ও। মাছগুলো ঢেউ তোলে।

পাবলোর ফোন এসেছিল একটু আগে। ওর ওখানে এখন রাত তিনটে। — জানো মা খুব ইলিশ মাছ ভাজা খেতে ইচ্ছে করছে। কালই খাব দাঁড়াও! — শোন্‌ না পাবলো, আজ জানিস ঠাকুরঘরের জানলাটা একটু খুলেছিলাম। ওমনি একটা এইইইবড় হলুদ কালো প্রজাপতি ঢুকে পড়েছে ঘরে। ওটাকে আমি পুষব রে? এই দ্যাখ না আমার দিকে তাকিয়ে এখন আয়নার ওপর বসে ওটা। হাসছে ফিকফিক করে। আরে ওষুধ খাচ্ছি তো। খাব না কেন? হ্যাঁ হ্যাঁ ঘুমের ওষুধও খাই। অত ভাবিস না তো! না না, আমি একা একা রান্নাঘরে যাই না। গ্যাস ধরাই না। আমার মাথা ঘোরে। ডাক্তার বারণ করেছে। আচ্ছা শোন না রে। আমাদের বাথরুমের নদীটা কোনওভাবে সমুদ্রে যায় কি? এবার এসে তুই করে দিস তো ব্যবস্থা। দেখব কীরকম ইঞ্জিনিয়ার তুই। হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই হল, বাথটাব। রাগ করছিস কেন? এইইই, তুই এত মাছভাজা খেতে চাইছিস কেন? জানিস না নদী থেকে একবার সমুদ্রে এসে পড়লে মাছগুলো আর ফিরতে পারে না? ধরা পড়ে যায়? ছটফট করে? মরে যায়? হ্যালো, হ্যালো — পাবলো! শুনতে পাচ্ছিস??

ও ফোন কানে ধরে থাকে। ঘুমন্ত ছেলের নিশ্বাস আসে কি? ফোন হাতে বসে থাকে। কেমন সূর্য ডুবছে… আহা! একটা পাহাড়ী গ্রামে একদল ছায়ামানুষ মুখ নিচু করে পথ ভাঙছে। কতরকম রং আকাশে! বাদামী সবুজ একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। আঙুরলতায় ছাওয়া। মস্ত বড় পেইন্টিংটায় সূর্য ডুবছে। হাত দিয়ে আলোটা ধরে। মুঠি খোলে — নেই তো। কিচ্ছু নেই। হিজিবিজি দাগ কতগুলো। এই হাত দেখেই নাকি পাগলের লক্ষ্মণ চেনা যায়! ও চেনে তো। দ্যাখে সকলের হাতের পাতা। আর জানে কে কে এই বাড়িতে বদ্ধ পাগল। শুধু সকাল বিকেল এসে চলে যাওয়া সীতাদি ছাড়া আর কারও হাতেই এরকম ওর মতো শিরোরেখা আর হৃদয়রেখার বিন্যাস নেই। সবারই গোলমাল। যাকগে। কাউকে বলা যাবে না ও জেনে গেছে। আবার রোদ ধরার খেলাটা খেলে। থাবা দেয় দেওয়ালে লটকানো পেইন্টিংটায়। মুঠো করে, আবার মুঠি খোলে। ফাঁকা। হিহিহিহিহি!! বাহ! বেশ তো। টুউউউকিইইইই! ধপ্পা!

প্রজাপতিটা পাগলের মতো উড়ছে। এসি মেশিনটার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। এলোমেলো হাঁটাগুলো। ওই লোকটার মতো। যখন সেদিন রাতে গরম ঝোলটা ছুঁড়ে মারল ওকে — এরকম করেই হাঁটছিল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেছিল। কিন্তু প্রজাপতিটা কী করবে? প্রজাপতিটা কাঁদছে। ও স্পষ্ট দেখল টপ করে একফোঁটা জল ওর গাল থেকে হাতের ওপর পড়ল। কে কাঁদবে তবে? প্রজাপতিটাই তো এতক্ষণ ওর মাথার ওপর এসে এসে বসছিল, গালের ওপর, চোখের পাতার ওপর…! কী করবে বেচারি এখন? ও’ই বা কী করবে এখন? দরজা বন্ধ। জানলা বন্ধ। এমনকি ঘুলঘুলিও। এই বাড়িতে হাওয়াবাতাসপোকামাকড়ের প্রবেশাধিকার নেই। প্রজাপতিটা তো জানত না!

এবাড়িতে একবার ঢুকে পড়লে স্বেচ্ছায় বেরোনোর অধিকারও যে নেই, প্রজাপতিটা তো একথাও জানত না!!