Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লেডিস কামরা

অলি চক্রবর্তী

 

ধনীর দুলালী হওয়ার সৌভাগ্য আমার কোনোদিনই হয়নি, তবুও অটো এবং রিক্সা ছাড়া যাতায়াত খুব একটা করতাম না| একটা সময় শখ চাপল, বিদেশী ভাষা শিখব, কাজেই উঠল বাই তো গোলপার্কে যাই|
নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংসারে এ হেন শখপূরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ালো রোজকার গাড়িভাড়া| তাই যাওয়ার সময় অফিসটাইমে বাসেই বেশী নিরাপদ হলেও ফেরার সময় নামমাত্র খরচে ভরসা ছিল ট্রেন| জনৈক বন্ধুর সহযোগিতায় দু-একবার জেনারেলে চড়েছি, কিন্তু ভরদুপুরে একা নারী, সাহসে কুলোত না ব’লে কপাল ঠুকে উঠতাম লেডিসে|
“লেডিস”, গোদা বাংলায় যে ‘মহিলা কামরা’ শব্দদুটির অস্তিত্ব আছে কেবল প্ল্যাটফর্মের বোর্ডে| প্রথম দর্শনে যাকে বলে “হট্টমেলার দেশ”, সেইরকম এই বিচিত্র বাক্সে চড়ে পাড়ি দিতাম ছয়টি স্টেশন| এর মধ্যে সিটে বসার সৌভাগ্য হয়েছে দু-তিনবার, নয়ত ঐ ক’মাসের বেশীটাই দাঁড়িয়ে যাওয়া| সবথেকে বিরক্ত লাগত প্রকান্ড সাইজের সব ঝুড়ি ও বস্তাসমেত ‘মাসি’দের জায়গা দখল ক’রে থাকা|
ওরা মূলত ভোরবেলার ঝি-গাড়ির প্যাসেঞ্জার, দুপুরের ট্রেনটা ওদের বাড়ি ফেরার একমাত্র উপায়| রাগ হত, কান জ্বালা করত, খিস্তি আর নোংরা কথা শুনে, অশ্লীল কথোপকথনে ওরা প্রাণ খুলে হাসত| একদিন শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিল, সিটগুলো সব ভদ্র মহিলাদের দখলে, তাই একপাশে দাঁড়িয়ে ভাবছি কতক্ষণে নামব| একজন ‘মাসি’, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশের কোঠায়, এক প্যাকেট টমেটো নিয়ে “দশটাকা” ব’লে হাঁকছে| ওইটাই বোধহয় তার সেদিনের শেষ পসরা, তাই সিটে বসা মহিলাদের বারবার জিগ্যেস করছে কেনার জন্য| কিন্তু তাদের হেডফোন বিদীর্ণ ক’রে সেই ডাক মর্মে পৌঁছল না দেখে আমি ঐ দশটাকার বদলে টমেটো কিনেই নিলাম| যদিও আমার কাছে বাজার করা আর কেমিষ্ট্রি পড়া একইরকম কঠিন|
তো সেই ‘মাসি’ ভাঙা দাঁতের ফাঁকে ফিক্ করে হাসি দিয়ে দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়ালো| গন্তব্যের আগের স্টেশনে যখন, শরীরটা বেশ খারাপ করছে বুঝতে পারলাম| এদিকে দরজার সামনে ভিড়ের চাপ বেড়েই চলেছে আর পাল্লা দিয়ে ঝগড়া| আমি তখন প্রাণপণে এগোতে চাইছি, কিন্তু রোগাপটকা চেহারায় গুঁতো খেয়ে নিজেই পিষে যাচ্ছি| স্টেশনে গাড়ি থামতেই হুড়মুড় ক’রে স্রোত নামতে লাগল, কিন্তু আমি ব্যাগসুদ্ধ আটকে গিয়ে একরকম ঝুলতে থাকলুম| হঠাৎ একটা শীর্ণ অথচ শক্ত হাত আমাকে কোনো আশ্চর্য কায়দায় টেনে, কার্যত তুলে এনে মাটিতে নামালো| আমার তখন জিভ বেরিয়ে গেছে, সিমেন্টের বেঞ্চিতে ব’সে হাঁফাতে-হাঁফাতে চোখ তুলে দেখলাম- ভাঙা দাঁতের ফাঁকে ফিক্ ক’রে হেসে হাঁটতে লাগল “দশটাকা” হেঁকে যাওয়া ‘মাসি’||