Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দীপংকর পাত্রের লেখা

দীপংকর পাত্র 

 

ক্রিকেটের কথাই যদি হয় তবে সেরা ক্রিকেটীয় শত্রুতা নিঃসন্দেহে আ্যসেজ সিরিজ। সেই টেস্ট ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকে ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটযুদ্ধ অনেক সাহিত্যের খোরাক হয়েছে, জন্ম দিয়েছে অনেক নায়কের এবং অবশ্যই অনেক বিতর্কের। তবে শেষ পর্যন্ত সব কিছু ছাপিয়ে ক্রিকেট জিতেছে। ১৮৭৬-৭৭ সালে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম সিরিজ কিন্তু “আ্যসেজ”-এর লড়াই ছিল না। ১৮৮২ সালের আগস্ট মাসে অস্ট্রেলিয়া আসে ইংল্যান্ডে। সিরিজের একমাত্র টেস্ট খেলা হয় ওভালে, ২৮শে আগস্ট। প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া ৮০ ওভারে ৭৭ রানে অলআউট। ভিজে আবহাওয়ায় ইংল্যান্ডের হয়ে বোলিং ওপেন করেন টেড পিট, সে যুগের সেরা স্লো-বোলার, মূলত লেগ স্পিন করতেন। মোট ৮০ ওভারের মধ্যে পিট একাই করেছিলেন ৩৮ ওভার। ৩৮-২৪-৩১-৪ ছিল পিটের পরিসংখ্যান। পিটের সঙ্গী ছিলেন অলরাউন্ডার ডিক বার্লো, ৩১-২২-১৯-৫। অস্ট্রেলিয়ার মাত্র তিন জন দুই অঙ্কে পৌছান। অধিনায়ক বিলি মার্ডক ১৩, উইকেটরক্ষক জ্যাক ব্ল্যাকহ্যাম ১৭, অলরাউন্ডার টম গ্যারেট ১০। মার্ডক ছিলেন সে কালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম দ্বিশত রানের অধিকারী।

প্রথম দিনের শেষ বেলায় ইংল্যান্ডের হয়ে ওপেন করতে নামলেন বার্লো এবং প্রবাদপ্রতিম ডব্লু জি গ্রেস। গ্রেসের তখন সবে চৌত্রিশ চলছে। পঞ্চাশ বছর বয়সেও যিনি ইংল্যান্ডের হয়ে ওপেন করতে নেমেছেন, চৌত্রিশে তো তিনি শিখরে। কিন্তু ওভালে সেদিন শেষ বেলায় ফ্রেড স্পফোর্থের একটি বল গ্রেসের মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে নিয়ে গেল। গ্রেস ২৩ বল খেলে ৪। ফ্রেডেরিক স্পফোর্থ। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ফাস্ট বোলার। স্পফোর্থের পথ বেয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে একের পর এক ফাস্ট বোলার উঠে এসেছে ক্রিকেটের ময়দানে। এবং এই সব ফাস্ট বোলারই আজও আ্যসেজ সিরিজ খেলতে নামেন একটা লক্ষ্য রেখে, কিভাবে ১৮৮২ সালের আগস্টে স্পফোর্থের রেকর্ড ছাপিয়ে যাওয়া যায়! কী সেই রেকর্ড সে কথায় পরে আসছি। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডকে একা হাতে শেষ করে দিয়েছিলেন স্পফোর্থ। শেষ ব্যাটসম্যান পিটকে যখন আউট করেন তখন তাঁর পরিসংখ্যান ৩৬.৩-১৮-৪৬-৭। তিন নম্বরে নেমে জর্জ উলিয়েট করলেন সর্বোচ্চ ২৬ রান। গ্রেসের পরেই উলিয়েট সে সময় ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাট।

দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া গুটিয়ে গেল ৬৩ ওভারেই ১২২ রান করে। বল ওপেন করে লেগ স্পিনার টেড পিট পেলেন ৪০ রানে ৪ উইকেট। আজকাল আমরা যখন ক্যাপ্টেন কোহলি অশ্বিনের হাতে ইনিংসের শুরুতেই বল তুলে দিলে চমৎকৃত হয়ে যাই কোহলির ক্রিকেট বুদ্ধিতে, তারা নিশ্চয় বুঝতে পারছি যে কোহলি নতুন কিছু করছেন না। মার্ডক ৫৫ বল খেলে পরিশ্রমী ২৯। তা, মার্ডক কোনও দিনই ইংল্যান্ডের এই ভেজা আবহাওয়া পছন্দ করতেন না। ঝকঝকে রৌদ্রকিরণোজ্জ্বল এই ওভালেই তিনি এর আগে ১৮৮০ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্টে করেছিলেন অপরাজিত ১৫৩। এবং এর পর, ১৮৮৪ সালে আবার এই ওভালেই টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম দ্বিশতরান, ২১১। এদিনের ওভালে বরং অখ্যাত হিউ ম্যাশি ওপেন করে একটি ঝোড়ো ইনিংস খেলে দিলেন, ৯টি বাউন্ডারি সমেত ৫৫ রান, মাত্র ৬০ বলে!

৮৫ রান করলে জিতবে। মাত্র দ্বিতীয় দিন। হাতে অগাধ সময়। অধিনায়ক আ্যলবার্ট হর্নবিকে সাথে নিয়ে নামলেন গ্রেস। হ্যাঁ, এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা যে গ্রেস দলে থাকা সত্ত্বেও হর্নবি ছিলেন এই টেস্টে অধিনায়ক। ভদ্রলোক জীবনে তিন খানা মাত্র টেস্ট খেলেছেন, ২১ রান, সর্বোচ্চ ৯। স্পফোর্থকে যমের মতো ভয় পেতেন। প্রথম ইনিংসে দশ নম্বরে নেমে স্পফোর্থকে ফেস করা প্রথম বলেই বোল্ড। দ্বিতীয় ইনিংসে বোধহয় পারিষদদের কাছে তোল্লাই খেয়ে ওপেন করতে নেমেছিলেন। ক্যারিয়ারের সেরা ৯ করে স্পফোর্থের বলে আবার উইকেট ছিটকে গেল। ইংল্যান্ড ১৫ রানে ১। নামলেন বার্লো, এবং গেলেন। স্পফোর্থ আগুন ছোটাচ্ছেন তখন। ওভাল ভর্তি ইংরেজ সমর্থকেরা বিস্ময় দৃষ্টিতে দেখে চলেছে সেই বিখ্যাত ফাস্ট বোলিং স্পেল যা এর একশ বছর পরেও যে কোনও ফাস্ট বোলারের স্বপ্নে আসবে। অন্যদিকে একা লড়ে যাচ্ছেন ক্রিকেটের পিতামহ এক ডাক্তার, ডব্লু জি। তিলে তিলে গ্রেস ইংল্যান্ডকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন জয়ের দোরগোড়ায়। মাত্র ৮৫ রান! কিন্তু স্পফোর্থের ভয়ংকর পেস বোলিং আর হ্যারি বয়েলের মাপা লেংথের বোলিং এইটুকু রানকেই দুর্লংঘ্য করে তুলেছে। ৫৪ বল খেলে ব্যক্তিগত ৩২ রানে, দলের রান তখন ৫৩, বয়েলের বল গ্রেসের ব্যাটকে প্রণাম করে ব্যানারম্যানের হাতে জমা পড়ল। ইংল্যান্ড ৫৪ রানে ৪। আর মাত্র ৩১ রান। কিন্তু স্পফোর্থ আর বয়েল ৭৭ রানে মুড়িয়ে দিলেন ইংল্যান্ডকে। স্পফোর্থ ২৮-১৫-৪৪-৭। ম্যাচে ৯০ রানে ১৪ উইকেট। যে কোনও ফাস্ট বোলারের এটি আজও রেকর্ড আ্যসেজ সিরিজে। পরে ১৯০৪ সালে উইল্ফ্রেড রোডস পাবেন ১২৪ রানে ১৫, ১৯৩৪ সালে হেডলি ভেরিটি পাবেন ১০৪ রানে ১৫, ১৯৫৬-তে জিম লেকার ৯০ রানে ১৯, অখ্যাত বব ম্যাশি ১৯৭২-এ ১৩৭ রানে ১৬। কিন্তু এর কেউই ফাস্ট বোলার নন। মিলার-লিন্ডওয়াল-ম্যাকেঞ্জি-লিলি-টমসন-ম্যাকগ্রাথ-লিরা আ্যসেজে বল করতে নেমেছেন সেদিনের স্পফোর্থকে ছাপিয়ে যেতে। লারউড-টাইসন-স্নো-উইলিস-বথাম-আন্ডারসনরাও তাই।

৩০শে আগস্ট ১৮৮২, The Sporting Times-এ একটি লেখা বেরোয়। তাতে ইংল্যান্ডের মাত্র দুইদিন খেলে এই হারকে বর্ণনা করা হয় ইংল্যান্ড ক্রিকেটের মৃত্যু হিসেবে। লেখা হয়, ইংল্যান্ড ক্রিকেটকে দাহ করে তার ছাই (Ashes) অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাচ্ছে। ১৮৮২-র ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ড টীমের অস্ট্রেলিয়া যাত্রার প্রাক-কালে অধিনায়ক ইভো ব্লাই কথা দেন যে অ্যাসেজ ফিরিয়ে আনবেন। ব্লাই কথা রেখেছিলেন। ১৮৯০ অবধি পর পর আটটি আ্যসেজ সিরিজ দখলে রাখে ইংল্যান্ড। ব্রাডম্যানের ম্যাজিক শুরু হয় ১৯৩০-এর ইংল্যান্ড সফরে। সে সময় দুই দলই রীতিমতো শক্তিশালী। ইংল্যান্ডের অধিনায়ক পার্সি চ্যাপম্যান, দলে আছেন হবস, হ্যামন্ড, সাটক্লিফ, দলীপ সিংহের মতো ব্যাটসম্যান, লারউড, টেট-এর মতো বোলার। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন উডফুল, সঙ্গে পন্সফোর্ড, ম্যাকেব এবং ব্রাডম্যান। বল হাতে ওয়াল, গ্রিমেট। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সেই সিরিজে শেষ টেস্ট জিতে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতে নেয় ২-১-এ। হার সহ্য হয়নি ইংল্যান্ডের। ১৯৩২-৩৩-এ অস্ট্রেলিয়া গিয়ে আ্যসেজ উদ্ধার করে আনবার জন্যে ক্রিকেটের বাইরে কিছু করতে হবে বুঝেছিলেন ডগলাস জার্ডিন। তিন ফাস্ট বোলার লারউড, ভোস এবং গাবি আ্যলেনকে অস্ত্র করে শুরু হয় কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজ। ৪-১-এ আ্যসেজ পুনরুদ্ধার হয় কিন্তু সমালোচনার ঝড় ওঠে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৫০ অবধি পরপর ছয়বার আ্যসেজ অস্ট্রেলিয়ার। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮– আবার পরপর ছয় আ্যসেজ সিরিজ জেতে অস্ট্রেলিয়া। ১৯৮৯ থেকে ২০০২-এ আ্যলান বর্ডার-মার্ক টেলর-স্টিভ ওয়াগরা জিতেছিলেন পরপর আটখানা আ্যসেজ। ১৮৮২-১৮৯০-এ ইংল্যান্ডের পরপর আট আ্যসেজ জেতার বদলা এল ১০০ বছর পার করে।

এখনও পর্যন্ত ৬৯টি আ্যসেজ সিরিজের মধ্যে দুই দল ভাগ করে নিয়েছে ৩২টি করে। ৫টি সিরিজ অমীমাংসিত থেকে গেছে। শেষ ২০১৫ সিরিজ ৩-২ জিতেছিল ইংল্যান্ড। ২০১৭ ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়াতে ৭০তম আ্যসেজ সিরিজ শুরু।

চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারত-পকিস্তান খেলা দেখতে বসে এত কিছু লিখে ফেললাম। বক্তব্য একটাই, দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা যত তীব্র হয় ততই ভাল ক্রিকেটের স্বার্থে। কিন্তু খেলার মাঠে সংকীর্ণ রাজনীতি টেনে এনে যারা রাজনৈতিক মুনাফা লোটার চেষ্টা করছে তারা নিপাত যাক। যুদ্ধ করতে হলে বড় বড় কথা না বলে সীমান্তে বসে থাকুক এই ধান্দাবাজের দল। আমরা ক্রিকেট খেলি।