Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রামের নামে নয়, চাষির নামে ভোট

অভীক ভট্টাচার্য

 

চিত্তরঞ্জন পার্কের সন্ধেগুলো খুব ইন্টারেস্টিং। হরিয়ানভি, জাঠ আর দিল্লিওয়ালাদের সঙ্গে সারাদিন মেঠো হিন্দিতে কথা বলতে বাধ্য হওয়ার পর সেখানে মোচার চপ আর লেবু চা সহযোগে নিজের লুপ্তপ্রায় বাঙালিত্ব পুনরুদ্ধার করার একটা সুযোগ জোটে। উপরি পাওনা হিসেবে প্রায়ই জুটে যায় নানা পেশার বেশ কিছু বাঙালি যাঁরা বহু বছর ধরে রাজধানী শহরে থিতু হয়ে প্রায় শিকড়বাকড় গজিয়ে ফেলেছেন, কথায়-কথায় হিন্দি বলে ফেলেন কিন্তু লেবু চায়ের পর পতাকা বিড়ির মৌতাতটা এখনও ছাড়তে পারেননি। দু’নম্বর মার্কেটের সামনের চত্বরে সপ্তাহদুয়েক আগে সন্ধেবেলা কথা হচ্ছিল তেমনই কয়েকজনের সঙ্গে। প্রত্যেকেই পেশায় সাংবাদিক। তাঁদের মধ্যে সর্বভারতীয় ইংরেজি কাগজের জাঁদরেল ব্যুরো চিফ যেমন ছিলেন, তেমনই ছিল কলকাতা থেকে গিয়ে সদ্য কাজে যোগ দেওয়া কানে-দুল জুনিয়র রিপোর্টারও। চা খেতে-খেতে এ-কথা সে-কথা হচ্ছিল, সিআর পার্কের বাজারে ভাল পাবদা উঠেছে শুনে যারপরনাই সন্তোষ প্রকাশ করছিলেন ব্যুরো চিফ।

কিন্তু রাত পোহালেই পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ফলপ্রকাশ, আর তার আগের সন্ধেয় সাংবাদিকদের আড্ডায় সে-প্রসঙ্গ উঠবে না, হয়? ফলে, অবধারিতভাবে উঠে আসে হাওয়া কেমন বুঝছেন। দুঁদে সাংবাদিকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় সচরাচর স্পেকুলেশনের পথ মাড়ান না। শুরুতে প্রায় সকলেই কাটেঁ কা টক্কর হবে গোছের গোল-গোল কথা বলছিলেন যার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়, ওসব এগজিট পোল-টোল সব বকওয়াস, টাফ লড়াই হলেও শেষ পর্যন্ত গোবলয়ের তিন রাজ্যে বিজেপি আরামসে বহুমত হাসিল করে নেবে। মোদি-শাহ-যোগী গত দু’মাসে প্রচারের যা ঝড় তুলেছেন, তাতেই কেল্লা ফতে হয়ে গিয়েছে। তার ওপর বিজেপি ইভিএম-এ কোথায় কী বিজ্ঞান করে রেখেছে কেউ জানে না। ফলে, যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে, এখন কেবল মেশিন খোলার অপেক্ষা। একইসঙ্গে প্রায় সকলেই রায় দিয়ে দিলেন, রাহুলের কপালে আবারও একবার ‘পাপ্পু কান্ট ডান্স সালা’-র শিরোপা নাচছে, এবং এবারের ভোটের ফলাফলই নাকি আনুষ্ঠানিকভাবে হতে চলেছে – অমিত শাহ যেমন বলেছেন – কংগ্রেস-মুক্ত ভারতে পৌঁছনোর আট লেনের সুপারহাইওয়ে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, এ-কথা মেনে নিয়েও সকলেই যখন বিজেপি ও তার জোটশরিকদের প্রায় জিতিয়েই দিয়েছেন, তখন একটু অন্যরকম কথা শোনা গেল কেবল দু’জনের মুখে। একজন বললেন, “ভাই, রেজাল্ট যা-ই হোক, একটা কথা কিন্তু খুব পরিষ্কার। উন্নয়নের তাস ডাহা ফেল মেরে গিয়েছে, অতএব বিজেপি-কে এবার প্রকাশ্যেই তাদের হিন্দুত্বের রাজনীতিতে ফিরতে হবে। ফলে আগামী কয়েকমাস আরও গোরু, আরও মন্দির, আরও নামবদলের জন্য তৈরি থাকুন। সেইসঙ্গে আরও বুলন্দশহর, আরও টিএম কৃষ্ণ, কাশ্মির উপত্যকায় আরও জঙ্গিনিধন, নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে আরও সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। আমাদের কাজ বেড়ে যাবে।” দ্বিতীয়জন ওঁর বক্তব্যকে পুরোপুরি খণ্ডন না-করেও জানালেন, “মুম্বইদিল্লিতে কৃষকদের লং মার্চ কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে একচেটিয়া হিন্দুত্বের লাইন ভবিষ্যতে আর ততটা কার্যকর না-ও হতে পারে। অনেকদিন পর এবার একটা পালটা রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী জিগিরকে কাউন্টার করতে আদ্যন্ত রাজনৈতিক একটা ভাষ্য যে দানা বাঁধছে, আমার তো মনে হয় সেটাই আগামী দিনগুলোতে বড় খবর হয়ে উঠতে চলেছে।”

ভোটের ফল বেরনোর দিনই কলকাতায় ফিরে আসার টিকিট ছিল, ফলে ওঁদের সঙ্গে পরবর্তী দফার আড্ডাটা আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। অধিকাংশ এগজিট পোলের পূর্বাভাসকে আরও একবার অন্তঃসারশূন্য প্রমাণ করে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিসগঢ়ে বিজেপি হেরেছে। প্রাপ্ত আসনসংখ্যা ও ভোট-শেয়ারের হিসেবে তিন রাজ্যেই গত লোকসভা ভোটের ফলাফলের সাপেক্ষে বিজেপি-র অধোগতি খুব স্পষ্ট। যে বিজেপি দিনকয়েক আগে পর্যন্তও সমস্ত গণমাধ্যমে কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের টেমপ্লেট ছড়িয়ে দিচ্ছিল, এবং টিকিবাঁধা মিডিয়ার মাইনে-করা সাংবাদিকেরা যা দেশবাসীকে সফলভাবে গিলিয়েও যাচ্ছিলেন, আচমকাই দেখা যাচ্ছে সেই টেমপ্লেট প্রায় অপ্রাসঙ্গিক, এমনকী অস্তিত্বহীনও – এতটাই যে, কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত গোটা পথটা কোনও বিজেপি-শাসিত রাজ্যে পা না-রেখেও দিব্যি পাড়ি দিয়ে ফেলা যাচ্ছে। জনাদেশ মেনে দার্শনিকসুলভ টুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কিন্তু শরিকেরা এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয় – ফলপ্রকাশের পর কংগ্রেসের চেয়েও বেশি কংগ্রেসি হয়ে উঠে রাহুল গান্ধীর ভূয়সী প্রশংসা করেছে শিবসেনা। ফলপ্রকাশের আগের দিনও মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসকে সমর্থনের বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখে, হাওয়া বুঝে উপযাচক হয়ে থুতু গিলেছেন মায়াবতী। বিহারে এনডিএ-র মধ্যে দরকষাকষির টানাপড়েনে নতুন করে অক্সিজেন পেয়েছেন নীতিশ কুমার, পাঁচিলে বসে পা দোলানোর খেলা আরও সুচারুভাবে শুরু করার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন আর এক শরিক রামবিলাস পাসওয়ান। অমিত শাহ বা যোগী আদিত্যনাথেরা অবশ্য এখনও প্রকাশ্যে এমন কোনও মন্তব্য করেননি যা থেকে বোঝা যায় দেওয়ালের অদৃশ্য লিখন তাঁরা পড়তে পেরেছেন। বিজেপি-র ভিতরেও অসন্তোষ ক্রমধূমায়মান, মোদি-শাহ-যোগীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন, এখনও প্রকাশ্যে না-হলেও, ঘনিষ্ঠ মহলে চোরাগোপ্তা উঠতে শুরু করেছে। কেমন হয় যদি দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন গডকড়ি – এ-জাতীয় কথাবার্তাও হাওয়ায় হালকা ভাসছে, যার মধ্যে নাগপুরের কুশলী জল মাপার ইঙ্গিত স্পষ্ট পড়ে নিতে পারছেন কেউ কেউ। এমনকী অসম-ত্রিপুরাতেও এনআরসি নিয়ে উলটো সুর গাইতে শুরু করেছেন সর্বানন্দ-বিপ্লবেরা। বোঝা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি প্রান্তিক সেনাপতিদের ভরসা আর ততদূর নিটোল নয়।

কী হলে কী হতে পারে-র চর্চা না হয় চিত্তরঞ্জন পার্কের পরেরবারের আড্ডার জন্য তোলা থাক। কিন্তু রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ-ছত্তিসগঢ়ের বিধানসভা ভোট ইতোমধ্যেই কয়েকটা নতুন সম্ভাবনার রাস্তা খুলে দিয়েছে। প্রথম এবং সবচেয়ে বড় কথাটা হল এই যে, গত সাড়ে চার বছর ধরে মোদি-শাহর নির্বিকল্প নেতৃত্বের যে মডেলে প্রায় চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায় বলে দেশবাসীর একটা বড় অংশকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিল বিজেপি, সেই মডেলটা আচমকাই আর ততটা জমাট দেখাচ্ছে না। ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি সত্যিই অপরাজেয় কি না, তা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মানুষ বিজেপির হাতেই আরও একবার দেশের রথের রশি তুলে দেবেন নাকি বিকল্পের সন্ধানে নামবেন, তা নিয়ে আলোচনার জন্য এখনও অনেক সময় পড়ে আছে। কিন্তু তিন রাজ্যের ভোট যে লড়াইয়ের মাঠটা পুরো খুলে দিতে পেরেছে সে কথা মানতেই হবে।

এই প্রসঙ্গে একটি তত্ত্ব গত দু’সপ্তাহে খুব আলোচিত হতে দেখা যাচ্ছে। তত্ত্বটি অবশ্য পেশ করা হচ্ছে একটি প্রশ্নের আকারে। সেটি এরকম, তিনরাজ্যের ভোটে বিজেপি হেরেছে ঠিকই, কিন্তু কংগ্রেস কি জিতেছে? এবং এরই লেজ ধরে পরের যে প্রশ্নটি উঠে আসছে, বিধানসভার ভোটের ফল দিয়ে কি লোকসভার ভোটের গতিপ্রকৃতি মাপা উচিত? যদিও প্রশ্নকর্তাদের মনে করিয়ে দেওয়া চলে যে এই তিন রাজ্য কার্যত গোবলয়ের অন্যতম তিন হিন্দুপ্রধান রাজ্য তথা উত্তরভারতে বিজেপির সবচেয়ে বিশ্বস্ত ভোটব্যাঙ্ক, তথাপি দ্বিতীয় প্রশ্নটি অতীব চর্চিত, ফলত তা নিয়ে চর্চা আপাতত নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু প্রথম প্রশ্নটি, শুনতে একটু বরঠকানো গোছের লাগলেও, আদতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি মনেও রাখা যায় যে, প্রায় প্রতি পাঁচ বছরেই সরকার পালটে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে রাজস্থানিদের, এবং মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিসগঢ়ে বিজেপি-র বিরুদ্ধে কাজ করেছে দীর্ঘদিন ধরে একই সরকারের শাসনে থাকার ফলে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তথা অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি, তবে তা দিয়েও কিন্তু এবারের বিধানসভা ভোটের ফল পুরোটা ব্যাখ্যা করা যায় না। পক্ষান্তরে স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যেকার কোন্দল সামাল দিয়ে তাঁদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে রাহুল গান্ধী যেভাবে রাজ্যস্তরে কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন, তার জন্য তাঁকে প্রাপ্য নম্বর দিতেই হবে। মনে রাখতে হবে, এই তিন রাজ্যে বিজেপির প্রধান মুখ কিন্তু ছিলেন না শিবরাজ সিং চৌহান বা রমন সিং বা বসুন্ধরার রাজে। বরং স্থানীয় নেতৃত্বের চেয়েও অনেক বেশি করে তারা ভরসা করেছিল মোদি-শাহ-যোগীর ক্যারিসমার ওপরে। ভোটের আগের মাসে এই তিন নেতা কার্যত চরকিপাক খেয়েছেন তিন রাজ্যে। তার মধ্যে রাজস্থান নিয়ে বিজেপি গোড়া থেকেই বেকায়দায় ছিল বলে সম্ভাব্য হারের দায় যাতে মোদির ঘাড়ে না-পড়ে তা নিশ্চিত করতে তাঁকে সে রাজ্যে খুব বেশি প্রচার করানো হয়নি। বরং যোগী ও অমিত শাহকে বেশি করে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল সেখানে। আর মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিসগঢ়ে এই তিন জনেই পালা করে একের পর এক জনসভায় প্রচার করে গিয়েছেন। ফল প্রকাশের পরে দেখা গিয়েছে যেসব জায়গায় সভা করেছেন এই ত্রিমূর্তি, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোটের বাক্সে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। যার সোজাসুজি অর্থ, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ। ফলে, যদি কেউ বলেন এই পরাজয় আসলে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরাজয়, সে যুক্তিকে ফেলে দেওয়া যাবে না। উলটোদিকে কংগ্রেস কিন্তু কোনও রাজ্যেই স্থানীয় নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে এগোয়নি। উলটে ফলপ্রকাশের পর সচিন পায়লট বা জ্যোতিরাদিত্যর মতো রাহুল-অনুগামী নবীনদের যথোচিত মর্যাদা দিয়েও ক্ষমতা রেখেছে তথাকথিত প্রবীণদের হাতেই। সেদিক থেকে বলাই যায়, ভোটে যদি বিজেপি হেরে থাকে, কংগ্রেস আসলে লড়াইটা জিতেছে ভোটের পরের সপ্তাহে। যাঁরা রাহুল গান্ধীকে পাপ্পু ছাড়া আর কোনও নামে ডাকার কথা কল্পনাই করতে পারতেন না, তাঁরা তাঁর এই পরিণতমনস্ক সিদ্ধান্তে কিছুটা অবাক হয়েছেন বই কী!

কিন্তু এই তিন রাজ্যের ভোটে তার চেয়েও বড় প্রাপ্তি অন্যত্র। সেটা হল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রধান যে ভাষ্যটি, সেটিকেই এবার পিছনের সারিতে পাঠিয়ে দিতে পেরেছেন সাধারণ মানুষ। রামের নামে, মন্দিরের জয়গানে, ধর্মীয় মেরুকরণের সূত্রে যে ভোটের চিড়ে আর ভিজছে না – এই সত্যটি অবশেষে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। যাঁরা বলছেন বিজেপি-আরএসএসের উগ্র হিন্দুত্বের সঙ্গে লড়াইয়ে জিতেছে কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্ব, তাঁরা পুরোপুরি ঠিক বলছেন না। এই তিন রাজ্যের কোথাওই কংগ্রেসের প্রধান উপপাদ্য হিসেবে নরম হিন্দুত্বের ওপর বাজি রাখেননি রাহুল। হ্যাঁ, তিনি মন্দিরে গিয়েছেন, নিজেকে হিন্দু তথা কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ বলেও ঘোষণা করেছেন, কিন্তু সেটা করেছেন অত্যন্ত কৌশলে, বিজেপির পাল থেকে হিন্দুত্বের হাওয়া কেড়ে নেওয়ার জন্য। ভোটের প্রচারে তিনি কিন্তু বরাবর সামনে রেখেছেন কৃষকদের দুর্দশার প্রসঙ্গই। খেয়াল করবেন, রাফাল দুর্নীতির প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি বেশি কথা বলেছেন শহর ও শহর-লাগোয়া এলাকার জনসভাগুলিতে, কিন্তু দেহাতে পৌঁছে রাফালের কথা প্রায় তোলেনইনি। উলটে সামনে এনেছেন গরিবদরদি, কৃষিদরদি মুখ। বারবার ছুঁয়ে গিয়েছেন কৃষকদের আত্মহত্যার প্রসঙ্গ। বলেছেন ক্ষমতায় এলে প্রথমেই কৃষিঋণ মকুব করবে কংগ্রেস। অথচ দিল্লিতে প্রতিদিন নিয়ম করে রাফাল নিয়ে তোপ দেগে গিয়েছেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল খুব সহজ, চাকুরিজীবী শহুরে মধ্যবিত্তকে বিজেপির দুর্নীতিগ্রস্ততার বিষয়টি বোঝানো, ও গ্রামীণ মানুষদের কাছে গিয়ে সেই কথা বলা যা তাঁরা বোঝেন, যা তাঁরা শুনতে চান। বলা বাহুল্য, রাহুলের এই দ্বিমুখী কৌশলের কোনও জবাব জাতবক্তা নরেন্দ্র মোদি বা মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট অমিত শাহর হাতে ছিল না।

এবং সর্বোপরি, মানুন চাই না-ই মানুন, স্মরণাতীতকালের মধ্যে এবারই প্রথম কৃষকের দাবিদাওয়া চাহিদা-প্রত্যাশা ভোটের বাজারে প্রায় নির্ণায়ক অ্যাজেন্ডার ভূমিকা পালন করেছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আদ্যন্ত রাজনৈতিক ইস্যুতে ভোট হয়েছে। রাহুলের নির্বাচনী প্রচারে বারবারই সামনে এসেছে কৃষিঋণ মকুবের কথা, এবং ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কাজ হিসেবে তিন রাজ্যেই তা করে দেখিয়ে মানুষের আস্থাভাজন হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে কংগ্রেস। শ্রেণিগত ও দার্শনিক অবস্থানে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই এ-কথা মেনে নিলেও, কৌশলগত দিক থেকে কংগ্রেস যে এখানেও বিজেপিকে দশ গোল দিয়েছে তা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। ভোটের অ্যাজেন্ডা ও ন্যারেটিভকে কল্পিত হিন্দুত্ব ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাম্প্রদায়িকতার ঘেরাটোপ থেকে বের করে মানুষের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারাই এবারের ভোটের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

চিত্তরঞ্জন পার্কের আড্ডার ওই মাঝবয়সি সাংবাদিক বন্ধুটি ঠিকই বলেছিলেন। সাম্প্রতিক বিধানসভার ভোট দেখিয়ে দিয়েছে রাম বা মন্দির বা গোরুর ধ্বজাবাহী একচেটিয়া হিন্দুত্বের লাইন ভবিষ্যতে আর ততটা কার্যকর না-ও হতে পারে। উলটে অনেকদিন পর এবার পালটা একটা রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। এমন একটা ন্যারেটিভ যা তার নিজস্ব প্রাসঙ্গিকতার জোরে চাপিয়ে দেওয়া হিন্দুত্ববাদী জিগিরকে অনায়াসে কাউন্টার করতে পারে।

রামের নামে নয়, এবারের ভোট হয়েছে চাষির নামে।