![debashis](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/03/debashis.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
দেবাশিস মোহন্ত
কবি, গদ্যকার
যাবতীয় উত্তেজনা থেকে, উত্তাপ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে যখন একজন অতি সাধারণ আশাকর্মী বলেন যে, মানুষ তাদের শিকড়কে ভুলে যায়নি। আমরা শ্রমিক, আমরা কৃষক। কিছু ঘটলে আমরাই প্রথমে কষ্ট সহ্য করি। সুতরাং এই বিপদে একজন শ্রমিক একজন কৃষকের পাশে দাঁড়াবে এটাই তো স্বাভাবিক।
আর এইসব কথা যখন উচ্চারিত হয় তখন খোঁজ নিতে হয় বইকী? কী ঘটছে চরাচরে।
২০২০ সালের ২৬ নভেম্বরে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ঐতিহাসিক ধর্মঘটের ডাকে কৃষক আর শ্রমিকেরা এক হতে শুরু করে। শ্রমিকেরা বলে যে, আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায় আর নিপীড়নে কৃষকরা যেভাবে সামিল হয়েছে আমরাও তেমনই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের হাত ধরেছি। সত্যিই এই মিলন— মহামিলন। এই একতা ঐতিহাসিক।
এই সেদিন, অর্থাৎ শনিবার ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, আন্দোলনরত কৃষকরা রাজধানীর প্রবেশদ্বারে একত্রিত হয়ে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পালন করলেন ‘কিসান-মজদুর একতা দিবস’। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে হাজার হাজার মানুষ সীমান্তে একখানে হয়েছিলেন সংহতি প্রকাশের জন্য।
এই সংহতি একদিনে আসেনি। এর ইতিহাসও দীর্ঘ। ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে এই অটুট বন্ধন। সমাজ সংস্কারক এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি রবিদাসের জন্মদিনে এবং কিংবদন্তি মহান যোদ্ধা চন্দ্রশেখর আজাদ-এর শহিদ দিবসে কৃষক ও শ্রমিকদের মেলবন্ধন উদযাপনের ডাক দেয়— সংযুক্ত কিসান মোর্চা। এই ঐক্যের নগরকীর্তনে রবিদাসের মন্ত্র এবং স্লোগান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আসলে স্রোতে মিশে যায় দুটি ধারা। শ্রমিক-কৃষক।
এই মিলন সত্যিই উদযাপনের। মানুষের সঙ্গে মানুষের পাশে থাকার উদযাপন। সুখ-দুঃখের সাথী হবার উদযাপন। সূত্র বলছে যে, হাজার হাজার মানুষ; বিশেষ করে রবিদাসের অনুগামীরা আগের রাতে এসে তাদের নগরকীর্তনের মধ্য দিয়ে এই বার্তা ছড়াতে থাকে।
প্রচণ্ড-প্রখর রোদের তাপ উপেক্ষা করে প্রতিবাদী কৃষকরা তাদের আন্দোলন বজায় রেখেছে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে পালা করে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে কৃষকরা। অনেকে আন্দোলনস্থলে লাগিয়ে নিচ্ছেন ওয়াটার-কুলার। সিংঘু সীমান্তের এই আন্দোলন কর্মসূচিতে শিল্প ও সামাজিক ক্ষেত্রের কর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ করার মতো।
এই যে শ্রমিক-কৃষক আজ পাশাপাশি, এ যেন নিউটনের চতুর্থ সূত্র। কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত রাখার সূত্র। আর এই সূত্র সংগঠিত হয়েছে খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা এবং বেসরকারিকরণ থেকে। এই যন্ত্রণা সম্মিলিত সবার যন্ত্রণা যা আজ প্রতিফলিত হচ্ছে। কারণ, যুগে যুগে সরকার-প্রশাসনের প্রথম শিকার হয়েছেন এই শ্রমিক-কৃষকরা।
শনিবারের ঐ জমায়েতে একজন বলেছেন যে, কৃষি আইন বাস্তবায়ন না হলেও কৃষকরা সরকারের অতিরিক্ত আয়ের সহায়তা না পেলে টিকতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন যে, ভারতীয় কৃষকরা ইউরোপীয় কৃষিভিত্তিক ও ডেয়ারি সংস্থাগুলির সঙ্গে কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, যেখানে ইউরোপের কৃষকরা আয়ের ক্ষেত্রে ভর্তুকি এবং সহায়তা পেয়ে থাকে।
রবিদাস বলেছেন যে, জাতি-বর্ণ এগুলো ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়, বরাবর মানুষ তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই বিভেদ তৈরি করেছে। তিনি এমন এক সমাজ কল্পনা করেছিলেন যেখানে কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না। তার এই ঐক্যের সুরে সুর মিলিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক-কৃষক আজ দিল্লির সীমান্তে রাতের পর রাত নগরকীর্তন আর স্লোগান তুলে বেঁচে আছেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস সরকার একদিন তাঁদের কথা শুনবেন।
এ জেগে থাকা ন্যায়বিচারের জন্য…
এ জেগে থাকা নতুন সংহতির…
এ জাগরণ কৃষকের সঙ্গে শ্রমিকের…জাগতে রহো… জাগতে রহো… জাগতে রহো…