মোদি কৃষকদের দিল্লি ঢুকতে দিচ্ছেন না, কিন্তু তাঁরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছেন

অমিত ভাদুড়ি

 



জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক। লেখাটি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি গ্লোবাল ইন্ডিয়ান টাইমস-এ ইংরাজিতে প্রকাশিত

 

 

 

 

আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন সম্মাননীয় ব্যক্তি। তিনি যা বলেন, তাই করেন। মানুষই তাঁকে বুঝতে পারে না।

মোদি কথা রাখেন। তিনি বলেছিলেন ভারতীয় অর্থনীতি থেকে কালো টাকা উধাও করে দেবেন। ২০১৬-তে তিনি তাঁর এই কথাটা রাখলেন একটা ধামাকা দিয়ে। সেই ধামাকার নাম নোটবন্দি। আমরা দেখলাম রাতারাতি বড় বড় পুঁজিপতিরা তাদের কালো টাকাকে সাদা করে ফেলল, আর অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির নন-পারফর্মিং অ্যাসেটের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে উঠল। ফলাফল সবাই দেখতে পাচ্ছে। না সবাই না! অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনেক মানুষই দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ তাঁদের ব্যবসা এই ধামাকার আঘাত সহ্য করতে পারেনি।

মোদিজির আরেকটা ধামাকা এল গত বছরের মার্চ মাসে, যখন মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে তিনি গোটা দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করলেন। দেশবাসীকে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তিনি দুটো মূল্যবান উপদেশ দিলেন। বাসন বাজাতে হবে আর বারান্দায় প্রদীপ জ্বালাতে হবে। অভিবাসী শ্রমিকরা, তাদের কাছে তখন টাকাও নেই কাজও নেই, তাদের বাড়ির পথে লং মার্চ শুরু করল। যেহেতু তাদের কাছে বাসনপত্র বা বারান্দা কিছুই ছিল না, ফলে তারা মোদিজির কথামতো ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে না পেরে বাড়ি পৌঁছানোর আগেই অনেকে মরে গেল।

তারপরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি দিলেন যে দু বছরের মধ্যে তিনি কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ করে দেবেন। তিনি সেটা করেও ফেললেন— কিন্তু একটি অকস্মাৎ এবং ভয়ঙ্কর লকডাউনের পর্দার আড়ালে। আমরা জানি মোদিজি একজন মার্জিত ভদ্রলোক। তিনি মোটেই নিজের সাফল্য ঢাক পিটিয়ে প্রচার করতে পছন্দ করেন না। কিন্তু দেশের তো এটা জানা উচিত যে ঠিক ২২৭ দিনের মধ্যে কৃষকদের সম্পদ দ্বিগুণ হয়ে গেছে!

আমরা একটি সাম্প্রতিক অক্সফ্যাম রিপোর্ট থেকে জানতে পারছি— “১৮ মার্চ থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের— যাদের মূল ব্যবসা পেট্রোল, রিটেইল এবং টেলিকমিউনিকেশনস— ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সবচেয়ে বেশি শেয়ারের মালিক, মুকেশ আম্বানি, নিজের সম্পদ দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে ৩৬.২ বিলিয়ন ডলার থেকে ৭৮.৩ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছেন। ভারতের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানির চেয়ে আম্বানির সম্পত্তি তিনগুণেরও বেশি। কিন্তু আদানিও এই লকডাউনের সময়কালে তাঁর সামগ্রিক সম্পদমূল্যের বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। কোভিড-১৯-এর লকডাউনের যে সময়ে ভারতের অর্থনীতি এক মারাত্মক সঙ্কোচন প্রত্যক্ষ করল, সেই সময়ে এই ধরনের সম্পদ বিস্ফোরণ মাধ্যাকর্ষণ সূত্রকেও হার মানায়।

এই কোটিপতিযুগল আম্বানি ও আদানি তো সম্মানীয় কৃষক! কারণ তাঁদের খুচরা ব্যবসা এবং মজুতে ব্যাপক বিনিয়োগ এবং ব্যাপক স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু যেহেতু আমাদের প্রধানমন্ত্রী খুবই ভদ্র এবং মার্জিত তাই তিনি এই কৃষকযুগলের নাম করলেন না। ভেবে দেখুন এই দুই কৃষকের আয় যদি ভারতের বাকি কৃষকদের সঙ্গে যোগ করা যায় তাহলে সমস্ত কৃষকদের আয় কিরকম এক লাফে দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়!

কর্পোরেট-পন্থী বাজার-সর্বস্বতায় বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদরা ইতিমধ্যেই কৃষকদের এই সম্পদবৃদ্ধির অঙ্কটা কিন্তু কষে ফেলেছেন। এঁদের কেউ কেউ আমাদের দেশেই কাজ করেন, আবার কেউ কেউ বসে রয়েছেন আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাঙ্কে। সেইজন্যই বোধহয় তাঁরা মোদির এই নয়া কৃষি নীতির পক্ষে মিডিয়ার সামনে এতখানি সরব।

আর সেই নীতিতে প্রথমেই সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য। এতদিন এর মাধ্যমেই কৃষকদের আয়ের কিছুটা নিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু মোদিজির চোখে এই এমএসপি কৃষকদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির পথের কাঁটা। তিনি মনে করেন খোলা বাজারের দামেই কৃষকরা ফুলেফেঁপে উঠতে পারে। তাঁর এই তিনটি কৃষি আইন সেই খোলা বাজার তৈরিরই নকশা।

এই যে এরকম একটা সরল পাটিগণিত কীভাবে তাদের গড় আয় বাড়িয়ে দিতে পারে দিল্লিতে প্রতিবাদরত কৃষকদের সেটা বোঝা উচিত। এবং বুঝে এই দুই নতুন কর্পোরেট সদস্যকে নিজেদের মধ্যে স্বাগত জানানো উচিত। আমরা জানি প্রধানমন্ত্রী তাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন। কারণ তিনি আগে যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন থেকেই এঁদের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম। সেই দহরম-মহরম বর্তমানে আরও বেড়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আম্বানি এবং আদানিকে বিমানবন্দর উপহার দেওয়া হচ্ছে, আরও বিভিন্ন বড় বড় সরকারি কাজের বরাত দেওয়া হচ্ছে।

ভারতের যে সমস্ত অভিজাতরা শেয়ার মার্কেটে টাকা খাটান তাঁরাও অবাক হচ্ছেন যে কৃষকরা এই লাভের সহজ অঙ্কটা কেন বুঝতে চাইছে না। এটা তো সত্যিই, বিশেষ করে আম্বানি এবং আদানিদের কোম্পানির শেয়ারের দাম যত বাড়ে এই সমস্ত অভিজাতদের অর্থাগমও ততই বাড়ে। ভারত তথা বিদেশের স্টক ব্রোকারদের দিকে তাকালেই এই জিনিসটা পরিষ্কার বোঝা যায়। শুধু এই একগুঁয়ে কৃষকরাই শেয়ার কিনতে চাইছে না! তাদের জমিতে হালচাষ করেই বেশি সুখ যেন!

বর্তমানে কোভিড-১৯-এর মতই বিপজ্জনক ভাইরাস হল সন্ত্রাসবাদীরা, খলিস্তানিরা, আরবান নকশালরা এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। আমাদের গোয়েন্দা দপ্তর এগুলো খুব ভাল জানে এবং তারা বলেছে যে এরা সবাই ভারতকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এরা যদি দেশবিরোধী নাও হয় তাহলে অন্তত সরকারবিরোধী, যদি সরকারবিরোধীও না হয় তাহলে অন্তত সরকারের নীতির বিরোধী তো হবেই! এরা সবাই কৃষকদের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে, আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার যেটা কৃষকরাও আস্তে আস্তে এদের মতন হয়ে যচ্ছে।

আর মিডিয়া ভাইরাসও যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সে সম্পর্কেও মোদিজি প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই ওয়াকিবহাল। ভারতের জেলবন্দি তথাকথিত মাওবাদীদের কম্পিউটারে কীরকমভাবে এভিডেন্স প্লান্ট করা হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট তা নিয়ে কিছুদিন আগেই খবর করেছে। এই ওয়াশিংটন পোস্টই প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস করে তাঁকে গদিচ্যুত করতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ফলে নিঃসন্দেহে এটি আরেকটি ‘বিদেশি ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা’র অঙ্গ— মোদিজি আমাদের সঠিকভাবেই সতর্ক করেছেন!

মোটের ওপর আমরা নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেতেই পারি। কারণ আমাদের সুরক্ষার দায়িত্বে আছেন ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতিওয়ালা একজন বলিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী, যিনি কখনওই নিজের আদর্শের সঙ্গে আপস করেন না।

এদিকে কৃষকরা বাজে স্কুলের একদল অবাধ্য ছাত্রের মতো আচরণ শুরু করল, যারা নাকি কিছুতেই শিখতে চায় না। মোদিজি তখন কী করলেন? তিনি তাদের আটক করে শেখাতে চাইলেন। অনেক কৃষককেই সামান্যতম সন্দেহের কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমনকি কোনওরকম সন্দেহ ছিল না তাও গ্রেপ্তার করা হয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।

সেইসঙ্গে লোহার গজল কাঁটাতার সিমেন্টের চাঙড় দিয়ে ঘিরে এবং পরিখা কেটে সিংঘু সহ দিল্লির অন্য যে সীমান্তগুলিতে কৃষকরা জড়ো হয়েছেন সেখানে সেখানে তাদেরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে অজস্র পুলিশ বাহিনি। ফলে তাদের শারীরিকভাবে নড়াচড়ার উপায় কার্যত বন্ধ। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় শক্তির বলে বলীয়ান আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কৃষকদের দিল্লি অভিযান সহ যেকোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।

অন্যদিকে প্রতিবাদরত কৃষক পুরুষ মহিলা এবং শিশুরা— তারা কিন্তু শান্তিপূর্ণ মানুষ! তাদের কাছে ট্রাক্টর ছাড়া আর কোনও অস্ত্রই নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই অসম লড়াই তারা জিততে পারবে না।

কিন্তু তা সত্ত্বেও, কী অদ্ভুত, যুদ্ধ যতই এগোচ্ছে, মোদিজির পাল্লা দেখছি ততই হাল্কা হচ্ছে। শুধু কৃষকরা জেদী এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই নন, তাঁরা লড়াইয়েরও একটা আপাত-বিপরীত রাস্তা বের করেছেন।

কৃষকরা দিল্লি ঢুকতে আগ্রহী নন। সরকার যতক্ষণ না প্রকৃত সদিচ্ছা দেখাচ্ছে ততক্ষণ তাঁরা আর সরকারের সঙ্গে আলোচনাতেও আগ্রহী নন। মোদিজি যে সংসদে মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সমর্থন করেন, কৃষকরা তাতেও ভুলছেন না। তাঁরা শুধু চাইছেন সংসদে আইন পাশ হোক যাতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত হয়।

মোদিজিকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে যে দিল্লি সীমান্তে বসে থাকা কৃষকদের কোনও তাড়া নেই। তাঁরা আশেপাশের পাঞ্জাব হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ এবং শিখদের মধ্যে নিজেদের গণভিত্তি সংহত করছেন। এর মধ্যেই কিসান মহা পঞ্চায়েতগুলি যারা অন্তত দশ বারোটা গ্রামের কৃষকদের পরিচালনা করছে, তারা বিহার মহারাষ্ট্র রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশে ব্যাপক সংখ্যায় কৃষকদের সংগঠিত করতে শুরু করেছে।

ওদিকে অন্ধ্র তেলেঙ্গানা কর্নাটক তামিলনাড়ু কেরলের মত দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে দিল্লির এই কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বিরাট বিরাট কৃষক মিছিল হচ্ছে।

এরপরে কৃষক আন্দোলন পশ্চিমবাংলা, ওডিশার মতো পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে সমর্থন বাড়ালেই মোদিজির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি আরেক দফা ধাক্কা খাবে।

ভারতবর্ষ এর আগে কৃষকদের এরকম ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ কখনও দেখেনি। যেগুলি দ্বারা তাঁরা সাধারণত বিভাজিত হয়ে থাকেন সেই জাত ধর্ম বা শ্রেণির সমস্ত ব্যবধান তাঁরা ভেঙে ফেলেছেন।

এখন বিরোধী দলগুলির কর্তব্য কৃষকদের পেছনে নিজেদের সংহত করা। এবং সংহত হয়ে তাদের কাজ শুধু এই তিনটি কৃষি আইনকেই বানচাল করে দেওয়া নয়, বরং মোদি সরকারকেই বানচাল করে দেওয়া, যাতে তারা আর এই সমস্ত আইন পাশ করার সুযোগ না পায়।

প্রধানমন্ত্রী মোদিজি কৃষকদের ঘিরে ফেলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কৃষকরা এখন তাঁর সরকারকেই ঘিরে ফেলেছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...