Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অন্তেবাসী — চতুর্থ পর্ব

বাঘ ভল্লুক

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

তৃতীয় পর্বের পর

কতখানি ভয় পেলে মানুষ ঘুমিয়ে পড়তে পারে সে কথাই সেদিন ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। এ কথা অবশ্য আমার জানার কথা নয়, পরবর্তীতে জেনেছি। বাঘ তার শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসবে গভীর রাত্রি হলেই। তাই, রাত্রি গভীরতায় পৌঁছাবার আগেই সন্ধ্যারাত্রিতেই বাঘের দিকে পিছন ফিরে কাঠের বাংলোতে সাদা রঙের বার্নিশ দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ি।

এখন মনে হয় নিজে যেন হুইল চেয়ারে বসেই আছি। চেয়ারটিতে যার আমাকে বসিয়ে রাখবার দায়িত্ব সে আমাকে জানলা বা দরজার দিকে মুখ করে বসায় এবং তারপর ইচ্ছে করেই আমাকে সাদা দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিয়ে চলে যায়। এ কাজটি যে করে সে যেন ইচ্ছে করেই করে। মুখে কিছু না বলে বুঝিয়ে দেয়— তোমার বাইরের দৃশ্য দেখবার দিন শেষ, অনেক দেখেছ আর দেখতে হবে না।

ঘুমিয়ে পড়বার জন্য রাতে খাওয়াই হয়নি। মা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল ঘুমন্ত অবস্থা থেকে তুলে খাওয়ালে আমি নাকি ভীষণ ঝামেলা করি। আমরা তখন মেজমাসির পরিবারে একপ্রকারের আশ্রিত। মেজন্য ভেতরে ভেতরে একধরনের কুণ্ঠাবোধ তো ছিলই। কিন্তু মেজমাসি গলা তুলে মা’কে মনে করিয়ে দেয় আমার না খাওয়ার কথা। এবং তা শুনেই ঘুম ভেঙে যায়। মা কিন্তু সেই ডাক শুনতে পায়নি। নিবিষ্ট মনে কাঞ্চনজঙ্ঘার সূর্যোদয় দেখবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, যদিও তার জানা সোনাদা থেকে ঠিকঠাক সূর্যোদয় দেখা যায় না। তবে, সূর্যোদয়ের আলোর ছটা, জানলার পাশে বুনো সাদা গোলাপের ঝাড়— যাকে এখানকার লোকেরা বলে পাহাড়ি গোলাপ— তার রং পরিবর্তন দেখছিল। আমি যে কখন বাঘকে উপেক্ষা করে মা’র পাশে এসে দাঁড়িয়েছি জানি না। তবে রঙের খেলা বুঁদ হয়ে দেখছি— তখন কিন্তু সে বয়সে পৌঁছাইনি বলে এই রং পরিবর্তনের মধ্যে যে পাহাড়িয়া রাগের সুরের লয়কারি থাকে তা জানতাম না।

দ্বিতীয়বার মুখে কিছু না বলে মা ঘরে এসে ঝাঁঝিয়ে ওঠে। আর সাততাড়াতাড়ি আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে রান্নাঘরে এনে হাজির করে। শীতে কাঁপছিলাম ঠিকই, কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার সময় বাঘটাকে দেখে আসা হয়নি বলে অজানা শঙ্কার ভিতর গরম ভাত আর ডিমসেদ্ধ খাচ্ছিলাম আর বারবার ঘরের ভেতরে তাকাবার চেষ্টা করছিলাম। তা দেখে মেজমাসি বলে উঠল ‘অত তরাস খাচ্ছিস কেন রে? বাঘ তো আলমারিতে চিঁড়েচ্যাপ্টা… ঠিক করে খা… কাল তো না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লি!’

এই কথার সঙ্গে মা’কে হুকুম দিলেন সবটুকু যেন খাইয়ে দেওয়া হয়।

পরে জেনেছি আমার খাবার তৈরির জন্য মেজমাসি রাত থাকতে উঠে পড়েছিল। আর আমি সারারাত বাঘটাকে ঘুমের ভেতর আলমারি থেকে বেরিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে হাঁটতে দেখেছি।

এসব ভাবনার মধ্যেই মেজমাসি ও মা একই সঙ্গে বলে উঠল, ‘বেণুটা কাল সারারাত কেশেছে।’ তারপর দুজনেই নির্বাক, গরম জল দিয়ে আমার মুখ ধুইয়ে আমাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ঘরের দরজা বন্ধ। মা বুদ্ধি করে দরজাটা বন্ধ করে এসেছিল বলে একটু হাসলাম। কেননা স্বপ্নের বাঘটা বেরিয়ে এসে কার যে ঘাড় মটকাত তার তো ঠিকঠিকানা নেই। কিন্তু মেজমাসির কথাটা মনে পড়ে গেল— “বাঘ তো চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে আলমারিতে!” সেটা সত্যি কিনা আরও একবার দেখে নিলাম।

আড়চোখে চিঁড়েচ্যাপ্টা বাঘের দেহাংশ দেখে নিয়ে অনিচ্ছা সহ ঘুমোতে চলে যাই। মা ততক্ষণে লেপ কম্বলের ভেতর আমার ছোট বোনটার উত্তাপ মাপার চেষ্টা করছে। আমার কিছু করবার নেই এরপর, বাড়িটাই গভীর ভিতর। তারপর আছে বাঘের ভয়, স্বপ্নের ভিতর বাঘটার ঘরময় ঘুরে বেড়াবার দৃশ্যটা ভেসে উঠতে দেখেই স্বপ্নটা পাছে সত্যি হয়ে যায় এই ভেবে আমি আমার লেপের তলায়। ছেড়ে যাওয়া গরম বিছানা আবার ঠান্ডা বাইরের ঠান্ডার মতনই। এই ভাষাহীন শীতলতা কিছু একটা বলতে চায়। সেই মুহূর্তে শীতলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেয়ে আর বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না। তবে এ কথা সত্যি, ওঁৎ পেতে থাকা বাঘের খপ্পরে পড়তে চাইনি। সার্কাসে অবশ্য বাঘ দেখা হয়ে গেছে ততদিনে, তারা অবশ্য উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে। রিং মাস্টারের পোষ মানা বাঘ। সেদিনের মুখ্য ভাবনা একটাই ছিল— রিং মাস্টার যখন ঘুমিয়ে পড়ে, সে কি বাঘেরই স্বপ্ন দেখে? মা’ই সার্কাসের বাঘকে চিহ্নিত করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, “এ হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।” আর এটা যে চিতাবাঘ তাও মায়ের থেকেই জানা। কিন্তু স্বপ্নদৃশ্যের কথা বলতে এইরকম নিষেধবাক্য জানা থাকা সত্ত্বেও কেমন যেন জেদ চেপে যায় কেননা নীরবে স্বপ্নের ভেতরে কী করে বাঁচা যাবে!

সব শুনেটুনে মা বলে উঠল, ওটা বাঘ ছিল না, ভল্লুক। একসময় সোনাদাতে প্রচুর ভল্লুকের গুহা ছিল। তাদের কেউ একজন গত রাতে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিল।

–ভল্লুকে নাচে তো আমি জানি! ডুগডুগি বাজালেই নাচে।

এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মা এমনভাবে চুপ করে যায় দেখে মনে হবে কথা বলছে কিন্তু যার সঙ্গে কথা সে নেই। অদ্ভুত এক তন্ময়তা তাকে ঘিরে রয়েছে। জানি না নাচের ছন্দ খুঁজছে কিনা! তবে একটা কিছু যে খুঁজছে এ বিষয়ে নিশ্চিত। তা না হলে কেনই বা বলবে— ভল্লুকের পিঠে কেউ কি ছিল?

মা’র প্রশ্ন শুনে হতবাক। মা কীভাবে ধরে নিল ভল্লুকের পিঠে কেউ একজন ছিল? সেই যেন ভল্লুকটাকে আমার স্বপ্নের ভেতর নিয়ে এসেছে। আমার এই বিশ্বাস মা’র চুপ করে থাকাতে দৃঢ় হতে থাকে।

আসলে সপ্তর্ষি নক্ষত্র। এক থেকে সাতটি তারা যোগ করলে ঋকবেদে তার নাম ঋক্ষ। ঋক্ষ শব্দের অর্থ ভল্লুক। আর্যরা সপ্তর্ষি নক্ষত্রে এক শ্বেত ভল্লুককে দেখতে পেত। মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোর চারটের সময় সপ্তর্ষি নক্ষত্র মধ্যরেখায় আসে। তারপর ফাল্গুন মাসে রাত দুটোর সময়ে মধ্যরেখায় দেখা দেয়। যেহেতু গভীর রাতে স্বপ্নটি দেখা মা নিশ্চিত হয়ে বলে ওঠে, “তাহলে উনিই এসেছিলেন!”

বহুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মা’র এই কথার পিঠে বলে উঠেছিলাম— সে কে?

মা আবার তার চিন্তার জগতে ডুবে আছে দেখে চুপ করে ছিলাম।

মা কাউকে বলছে না, যেন কোনওদিন এ কথা বলা যায় না কখনও। যদি কোনও জীবনদেবতা থাকেন কোথাও না কোথাও, তাকেই বলা চলে— ভিন্ন স্বরে বলে যেতে থাকে জলের উপর হেঁটে চলা পূর্বপুরুষের কথা। যিনি মাটিতে পা রাখার পরই বলেছিলেন— তাঁকে যেন কোনওদিন নদীর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া না হয়। জলে তাঁর ভীষণ ভয় আর ভয় আগুনে। জল আর আগুন পরস্পর পরস্পরের শত্রু। এই শত্রুতা, বিদ্বেষের মধ্যে তিনি নেই। মৃত্যু ও নির্জনতাকে এমনভাবে অনুভবে এনেছিলেন যে, তাঁকে দেখলেই বোঝা যেত পরিচিত জগতের বাইরে অন্য জগতে পা রাখার রোমাঞ্চ তাঁকে সবসময় ঘিরে রয়েছে।

জল আর আগুনের বৈরিতার জন্য তিনি নির্জলা এবং ফলাহারী। তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘর থাকা সত্ত্বেও সেখানে রাত্রিবাস করতেন না। খোলা আকাশের নিচে নক্ষত্রর, তারার সরলরেখার যোগসূত্র খুঁজে চলতেন। এইভাবেই মাঘ ফাল্গুন জ্যৈষ্ঠ মাসে সপ্তর্ষি নক্ষত্রে ভল্লুক দেখতে পেয়ে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর একটাই কথা— বাঘ নরখাদক, ভল্লুক মধু সংগ্রাহক…

যা জাম্বুবান, ঋক্ষরাজ সে-ই ভল্লুক। মা তাদের উদ্দেশে প্রণাম করল, নাকি সেই পূর্বপুরুষের উদ্দেশে জানি না। তবে আমিও মা’র দেখাদেখি প্রণাম করেছিলাম। কার উদ্দেশে জানি না, তবুও তো প্রণাম। উদ্দেশ্য না থাকলে কী হবে, এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যেতে পারে নিজেরই জীবনদেবতার উদ্দেশে। তখনই আমার মামাবাড়ির নাম ধরে কে যেন ডেকে উঠল ‘বাচ্চু’।

এরপর আগামী সংখ্যায়