অন্তেবাসী — ১৯তম পর্ব

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

দরজার কড়া নাড়বার শব্দটাকে মনে হয়েছিল অতিমানুষিক গর্জন। সেই শব্দ লেপের ভিতরে আছড়ে পড়তেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসি। মা অবশ্য ততক্ষণে দরজা খুলে দিয়েছে। ঘরে ঢুকেই নানমাসি বলে ওঠেন, “খুব আস্তে কড়া নেড়েছিলাম তোমার মেয়ের যাতে ঘুম ভেঙে না যায়!”

মা কিন্তু সামান্য হেসে নিজে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেয়— অর্থাৎ শীতের জামাকাপড় যা আছে তা শরীরে চাপিয়ে আমাকে নিয়ে পড়ে। কিন্তু তখনও আমার মধ্যে ক্রিয়াশীল সেই অতিমানুষিক শব্দ! বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের আওয়াজ কি উঠে এসেছিল পাহাড়ের ফাটল থেকে? এখন তো গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠবার কথা নয়। তবে কি পাহাড়ের ফাটলের খাঁজে গুটিয়ে রেখেছিল শব্দ নিজেকে? বোধগম্যের বাইরে শব্দটা যখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে যাচ্ছিল তখনই মা হনুমানের টুপি ছুড়ে দিয়ে বলে— এটা পরে নে। কেননা ততক্ষণে সোয়েটার পরা হয়ে গেছে। কিন্তু বাবলুর ঘুম ভাঙছেই না অনেক ডাকাডাকির পরেও। ঘুম ভাঙার যখন কোনও লক্ষণ নেই, তখনই ওর মধ্যেই বাবলু বলে ওঠে— টাইগার হিল ছাড়া সানরাইজ দেখাই যায় না।

বাবলুকে ছেড়ে যেতে মা ইতস্তত করছিল। তা দেখে নানমাসি বলে ওঠে, “গার্ডকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।” এবং সঙ্গে সঙ্গে গার্ডের কাছ থেকে নেওয়া পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা জ্বালিয়ে দেয়। সেই উজ্জ্বল আলোর ভিতরে রাখা মা ঘরে রাখা বাতিটির শিখা একটু উসকে দেয়। যেন হঠাৎ করে বাবলুর ঘুম ভেঙে গেলে ভয় না পায়। কিন্তু গার্ড দরজার বাইরে থেকেই নানমাসির এক ডাকে ঘরে এসে ঢোকে। নানমাসি গার্ডের মাতৃভাষায় বুঝিয়ে দেয় তাকে এখন কী করতে হবে।

প্রথমত তাকে ঘড়িঘরের চাবিটা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত তাকে এ ঘরে থাকতে হবে। বাবলুর যদি ঘুম ভেঙে যায় তবে যেন বুঝতে পারে সে একা নয়। তার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে— অথবা তার ঘুমকে যেন গার্ড করছে সে ব্যক্তি। দুটোর মধ্যে যেকোনও একটি হতে পারে— এরকমই ধারণা এখন।

ঘড়িঘরের দরজা খুলতেই দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সমান ঘরটির পরিচ্ছন্ন অবয়ব টর্চের আলোতে কিছুটা পিছলে গিয়ে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেই বুঝলাম এই সিঁড়িপথেই গম্বুজের মতন কোনও এক জায়গায় আমাদের থামতে হবে। সেখানে পৌছে যেন মনে হয় পাহাড়ের শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি, আর তবেই সানরাইজ দেখতে পাব। পুরো গির্জাটা পাহাড়ের কোলে তবুও তার শৃঙ্গ ছিল একদিন। নানমাসির বর্ণনায় যে মহাপ্রলয়ের কথা আছে তার মধ্যে শৃঙ্গ চূড়ার কথা নেই। কোনওরকম ধ্বংসের কথা যাতে উল্লেখ করতে না হয় সেজন্য গম্বুজের সৃষ্টি।

আবার সিঁড়িটি এমনই একজন মাত্রই উঠতে পারবে। তবে ন্যাড়া নয়, রেলিঙের ব্যবস্থা আছে। এইসব সিঁড়ির ক্ষেত্রে যা হয়— প্রথম ধাপটাই বেখাপ্পা। মাকে উঠতে সাহায্য করেছিলেন নানমাসি স্বয়ং। নিজেকে তো উঠতে হয়েছিল রীতিমতন হামাগুড়ি দিয়ে— কিন্তু তারপরেই স্বাভাবিক। ঘড়ির পেন্ডুলামের দোলক এড়িয়ে সোজা উঠে যাচ্ছিলাম কেননা সূর্যোদয়ের সময় হয়ে গেছে। বাবলু বেশ কিছু সময় খেয়ে ফেলেছে— উগলে দিলেও কিছু করার নেই এখন। কিন্তু নানমাসি একটা নির্দিষ্ট ফোঁকরের সামনে দাঁড়িয়ে হেসে ওঠেন— হাঁপ ধরা অবস্থায় বলেন— এখনও তিনি ওঠেননি।

এক সময় দেখা যায় ঘন কুয়াশার পর্দার ভেতর থেকে লাল রঙের একটা গোলাকার বস্তু কুয়াশার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত— ক্ষরণ যা হচ্ছে তা চিত্রিত সাত রঙের বর্ণচ্ছটা। এক্ষেত্রে কুয়াশা যেন ব্লটিং পেপার, সবকিছু শুষে নিচ্ছে নিমেষে। তবে পরমুহূর্তেই সূর্য একবারের জন্য নিজেকে প্রকট করেই উধাও। মা তৎক্ষণাৎ উচ্চারণ করে, “ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং।” মার সঙ্গে নিজেও এই মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলাম কিনা সে কথা মনে নেই। তবে, নানমাসি জবাকুসুমকে জপাকুসুম বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন জবা তো হিবিস্কাস বা চাইনিজ গোলাপ। জবাফুল এদেশে এসেছে বৌদ্ধতন্ত্রের হাত ধরে।

সূর্যোদয় দেখবার সময় তাড়াহুড়োতে ঘন্টাটির দিকে নজর যায়নি। কিন্তু নিচে নামবার সময় নানমাসি থমকে দাঁড়িয়ে ‘এ যে তোমার ঘন্টা’ বলে টর্চের আলো ফেলতেই অন্ধকারের মধ্যে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা ঘন্টাটিকে দেখলাম। মাকে ঘন্টা থেকে কিছুটা নিচে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বললেন, “এখানে এখন হিমেল হাওয়া বইবে। বাচ্চাটার ঠান্ডা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।” কথাও শেষ, ঘন্টার দুদিকে দুটো বড় বড় স্কাইলাইটের পাল্লার দড়িতে টান মেরে খুলে দিলেন।

–এখান দিয়েই ঘন্টাধ্বনি বাইরে বেরিয়ে যায়।

হঠাৎ টর্চ নিভিয়ে দিতেই নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে যায় ঘন্টা। যদিও বাইরে সূর্য উঠছে— সেই আলোক এই অব্দি পৌঁছাচ্ছে না অবশ্য। এইসব অভিজ্ঞতা নিমেষের জন্য ভুলে গিয়ে একাকী ঘন্টা মুক হয়ে স্থির। যেন যে ধ্বনি সে তুলতে সক্ষম ছিল সেই সব অভিজ্ঞতা উধাও। পরমুহূর্তে আলো জ্বালিয়ে দিতেই মনে হল সবাক। কিন্তু কিছুই না হওয়ার ফলে আমি রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম কতক্ষণ জানি না। তবে কি ভাবছিলাম ঘন্টার ধ্বনির ঢং শব্দের সঙ্গে বাইরের আকাশে সূর্যও লাফিয়ে উঠছে?

না, এসব কিছুই নয়, এখন শুধু সিঁড়ির উঁচু ধাপগুলো লাফিয়ে নামবার জন্য অখণ্ড মনোযোগ এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যে অন্ধকারপ্রায় ঘরের ভিতর ঘড়ির কাঁটার সময়ের দোলক নজর এড়িয়ে যায়। বাইরে তখনও আলো ফোটেনি। যে সূর্যোদয় আমরা দেখেছি তা হয়তো বহুদূরের। তাই কিরণ এখনও এসে পৌঁছয়নি। কুয়াশার স্তর ভেদ করে রোদ আসতে আসতে ঘন্টাখানেক। নানমাসি তীব্র টর্চের আলোর দিকে তাকিয়ে কথাটা চলার মধ্যেই বলেন এবং শেষ করেন এইভাবে— “তোমাকে তো সকালে মন্দিরে যেতে হবে, এখন একটু ঘুমিয়ে নাও।”

বাবলু অবশ্য ঘুমাচ্ছেই। গার্ডও যথারীতি জেগে। এই তালগোল পাকানো সময়ের মধ্যে মা একবার বাবলুকে দেখে নিয়ে বলে— ওকে একবার টাইগার হিলে নিয়ে যাওয়া যায় না? চেষ্টা করব? সে তো কালকের কথা। তার পরপরই মার চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠেন নানমাসি। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করে ওঠেন— কেমন দেখলি?

কী বলব ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না। বরফের পাহাড়ের মাথাতে রক্তিম টিপের মতন। না, ঠিক হল না, টিপ তো লাফিয়ে ওপরে উঠে গেল শরীরে কম্পন তুলে, তাহলে ডিমের কুসুমের মতন, সামান্য কেঁপে স্থির। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলি কুসুমের কথা। নানমাসি বিস্ময়ে আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন— একদম ঠিক। সবকিছুর জন্মের সময় আলোড়ন হয়। একটা দিন শুরু হচ্ছে, জন্ম হচ্ছে, যিনি জন্ম দিচ্ছেন তিনি একটু আলোড়িত হবেন না! কুসুমের ভিতরেই আরেকটি প্রাণ।

মা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই নানমাসি মাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন— অনুভূতির কথা সবসময় ভেবে বলা যায় না— এইভাবেই প্রকাশ পায়…

‘ব্রেকফাস্ট’ (যেহেতু নানমাসি বলেছিলেন তাই নিজেও সেই শব্দটি ব্যবহার করলাম। কেননা সেদিনই সকালের জলখাবারকে ব্রেকফাস্ট বলা হয় জানতে পেরেছিলাম।) হয়ে যাওয়ার পর বাবলু জানতে পারল মা মহাকালের মন্দিরে যাবে। তখনই সে চিৎকার করে বলে ওঠে সেও যাবে। কেননা বেলুদির মঙ্গলের জন্য পুজো দেওয়া হচ্ছে, আর সে যাবে না এটা হতেই পারে না। কেননা বেলুদি তার দিদি। এবারে মা ধমকে ওঠে— “তুই যাবি ঠিক আছে, তাই বলে এত চিৎকার করতে হবে?”

গির্জার চারপাশ ঘিরে যে শান্ত পরিবেশ তার যেন ছন্দপতন ঘটিয়ে এই চিৎকার এবং সত্যতা প্রমাণিত হয় যখন প্রতিধ্বনি ফিরে আসে। মা কথা না বাড়িয়ে নানমাসির কাছে একটু গরমজল চায় কেননা নিজেকে শুদ্ধ করে তুলতে হবে পূজার জন্য। একসময় নানমাসিকে জিজ্ঞেস করে বাগানে সাদা ফুল আছে কিনা?

–তোমাদের পুজোর ফুল কুন্দ, আকন্দ এখানে পাবে না। এখানে হিন্দু দেবদেবীর পুজো চাইনিজ রোজ-গোলাপফুলেই হয়। তুমি সাদা গোলাপ পাবে।

মা কিন্তু সাদা গোলাপের সঙ্গে জবা অর্থাৎ চাইনিজ রোজ, কিছু অন্যান্য ফুল, লালপেড়ে গরদের শাড়ি পরে পুজো দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়ালে আমি না হেসে থাকতে পারি না। কেননা এই শাড়িটা দুর্গাপুজোর অষ্টমী আর কালীপুজোতেই মা পরে। বাদবাকি সময়ে যত্নে তোলা থাকে। কিন্তু মা ‘বোনকে দেখে রাখিস’ বলে রওনা হয়ে যায়। পেছন পেছন অবশ্যই বাবলু, কিন্তু মা একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকায় না।

এই গির্জাতে এসে এক ধরনের শান্তি খুঁজে পেয়েছিল মা। তার সুর কেটে গিয়েছে বাবলুর চিৎকারে। বাবলু বাড়িতে এসব চিৎকার-চেঁচামেচি হামেশাই করে— এটা মার তো জানা— তবে মা এতই বা রেগে যাবে কেন? তার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বোনের উপর নজরদারি বাড়িয়ে দেই। যাতে করে বোন কোনও কারণে চিৎকার করে কেঁদে না ওঠে। উঠলেই ভেঙে যাবে নৈঃশব্দের সৌন্দর্য। যা আমার মার ভীষণ প্রিয়।

আশীর্বাদী ফুল মাথা ঠেকিয়ে প্রসাদ দিতেই আমি বোনের মাথাটা এগিয়ে দিলাম। মা ফুল ছোঁয়ানোর সঙ্গে সাবধান করে দিলেন ওর মুখে যেন প্রসাদ না দেওয়া হয়। কেননা অন্নপ্রাশন এখনও হয়নি। অবশ্য এরপর গম্ভীর হয়ে যায়। তখন বুঝতাম না এখন বুঝি, কবে অন্নপ্রাশন হবে এবং আদৌ হবে কিনা জানা না থাকায় মা ভাবতেই পারে আমার মেয়েটা একদিন নিজে নিজে ভাত খাওয়া শিখে যাবে কোনও শুভদিন ছাড়াই। এর মধ্যে মা বাবলুকে সাবধান করে দেয়— তোর আশীর্বাদী ফুল কিন্তু ঠাকুরমশাই বাবার থান থেকে দিয়েছেন, যত্নে রাখিস।

–ওকে প্রসাদ দিলে না?

“সারাটা রাস্তা তো প্রসাদ খেতে খেতেই এসেছে।” বলে হেসে ওঠে। তারপর আপন মনে বলে এদের মন্দিরগুলো বিচিত্র। শুধু রংচঙে পতাকার ছড়াছড়ি। একেকটা পতাকা নাকি টাঙানো হয় ভক্তের বিশেষ মনস্কামনায়। তারপরই উদাস হয়ে পড়ে মা। এরই মধ্যে নানমাসি ঘরে এলে মা কিন্তু ওঁকে প্রসাদ দেয় না। কিছু কথাবার্তার পর চলে গেলে মাকে জিজ্ঞেস করি— নানমাসিকে প্রসাদ দিলে না কেন? উত্তরে মা যা বলল শুনে অবাক। কথাটা ছিল— ওরা আমাদের প্রসাদ খায় না।

দুপুরে নানমাসি সমেত আমরা সকলেই চকবাজারে গিয়ে কয়েক পাউন্ড উল কেনা হল। বোনের জন্য একরকম রং, আমার জন্য অন্য রং— এটা নানমাসির উপহার। মা কিনল আমার জন্য যে হনুমানের টুপি বরাদ্দ ছিল, তাকে বাতিল করে কানঢাকা টুপি। বোনেরও তাই, তবে সেটা ফিতে দিয়ে বাঁধা। কিন্তু বাবলু নেপালি কুর্কি কিনবেই। প্রয়োজনে রহস্যময় বোয়েমের খুচরো পয়সা খরচ করতেও রাজি। একথা শুনেই নানমাসি ধমকে ওঠেন— ওরকম ডেঞ্জারাস অস্ত্র নিয়ে তুমি খেলা করবে?

বাবলুকে কেউ ধমকাতে পারে তা ছিল তার চিন্তার বাইরে। সে কিছুটা হতবাক হয়ে নানমাসির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার জন্য টুপিই কেনা হয়— তা নেপালি টুপি, টুপির মাথাতে জ্বলজ্বল করছে মিনিয়েচার ফর্মে দুটি কুর্কি আড়াআড়িভাবে। বাবলু খুবই দ্রুততায় টুপিটি পরে নেয় যাতে দ্বিতীয় ধমক খেতে না হয়।

রাতে বৃষ্টি নামতেই বাবলু বুঝে যায় এ বৃষ্টি থামবার নয়, টাইগার হিলে আর যাওয়া হবে না। ও হয়তো বৃষ্টি মাথায় করেও সূর্যোদয় আগামীকাল কীভাবে হবে— এই চিন্তার ভিতর ঘুমিয়ে পড়ে। নিজে অবশ্য জেগেই ছিলাম। কেননা গির্জার ক্রশ চিহ্নের ওপর একটা পাখি যে ঠায় ভিজছে তার জন্য।

 

(ক্রমশ)


অন্তেবাসী-র সমস্ত পর্বের জন্য ক্লিক করুন: অন্তেবাসী – পীযূষ ভট্টাচার্য

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...