Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পরিবেশ শোষণ ও বিশ্বায়ন

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

 

ছোটনাগপুর মালভূমির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, লাল মাটির দেশ, ঝাড়খণ্ডের লাগোয়া পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড়, মধ্যবিত্ত বাঙালির ছোট্ট ছুটিতে বেড়ানর জায়গা। পর্বত-আরোহীদের “রক-ক্লাইম্বিং” শেখার সবচেয়ে পছন্দের স্থান, মাঠাবুরু, গোজাবুরু এই অঞ্চলেই রয়েছে। আদিবাসী গান, সহজ-লভ্য “বাংলা” সপ্তাহান্তিক বিশ্রাম-সন্ধানীদের মৃগয়াক্ষেত্র হল এই অযোধ্যা পাহাড় আর তার সন্নিহিত অঞ্চল। এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা এই অঞ্চলের অরণ্য সম্পদের ওপর ভিত্তি করে বেঁচে আছে বেশ কয়েক শতাব্দী। এই আদি জনগোষ্ঠীর সরব উপস্থিতি পুরাতাত্ত্বিকদের ভাবিয়েছে নানা দিক থেকে, তাঁরা সন্ধানে ফিরেছেন পুরাতাত্ত্বিক অবশেষের এবং উদ্ধার করেছেন বিপুল পরিমাণে “মাইক্রোলিথ” বা ছোট ছোট একলপ্তের পাথরের খণ্ড, একটা দুটো নয়, বেশ কিছু শ’য়ে। উন্মোচিত হয়েছে এই রুক্ষ বাংলার প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগের সেই চিত্তাকর্ষক ইতিহাস, যা প্রকৃতির নিশ্চিন্ত কোলে আশ্রয় নিয়ে টিকে ছিল এই সুদীর্ঘ বছর।

কিন্তু বিশ্বায়ন-পরবর্তী প্রায় একমেরু বিশ্বে এই তত্ত্বের প্রবক্তারা উন্নয়নের স্থান-কাল-পাত্রর মধ্যে বাছ-বিচারের প্রশ্নে সাম্যে বিশ্বাসী, তা সে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবাংলা, দেশ হিসেবে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, অব-সাহারা আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলো, সর্বত্রই উন্নয়নের বিজয়-রথ গড়গড়িয়ে চলবে এই আদিবাসী-মূলবাসী মানুষগুলোর জীবন-জীবিকার মাতৃসূত্র, তাদের কৌমর অধীনে থাকা জল-জঙ্গল-জমির ওপর, যার অবধারিত ফল– উচ্ছেদ, বিপুল পরিমাণে, পরিব্যাপ্ত যার পরিসর। তাই এই রাজ্যের প্রত্যন্ত প্রান্তে থাকা এই অযোধ্যা পাহাড়ও “ভূমিলক্ষ্মীর বিত্তহরণের” দস্যুতার হাত থেকে নিস্তার পায়নি।

ফিরে যাই ঠিক এক দশক– ২০০৮ সাল। সেই সময়ের “উন্নয়ন-পন্থী” সরকার “আর্থিক লগ্নি” টানার উদগ্র আগ্রহে জাপানের তাইসেই কম্পানির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে, উন্নয়নের আবশ্যিক উপাদান, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অযোধ্যা অঞ্চলে বড়সড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রূপায়ণের আয়োজন করেন। “পরিবর্তনের ঝড়” সামলানোর তাৎক্ষণিকতায় তাঁদের রাজত্ব্বের শেষ তিন বছরে এই সব “উন্নয়নে” নজর দেওয়ার অবকাশ মেলেনি হয়ত।

পরিবর্তনের জমানায় সেই পরম আরাধ্য “উন্নয়ন”-এর কাজটি আবার বিপুল উদ্যোগে শুরু হয়েছে। আগের সরকারের চুক্তি অনুসারে এই প্রকল্পে লগ্নির পরিমাণ যেমন-তেমন নয়, কম-বেশি তিন হাজার কোটি টাকা! অযোধ্যা পাহাড়ের গোটা-দুই নদী, বামনি আর থুগরা, যারা অযোধ্যা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বাঘমুন্ডি এলাকায় নেমে এসেছে সেই অঞ্চলে গোটা চারেক “পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প” তৈরি করে (মানে পাহাড়ের নিচে জল জমা করে সেই জল আবার পাম্পের সাহায্যে পাহাড়ের মাথায় তুলে দিয়ে) জলস্রোত ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। অতি সম্প্রতি এই থুগরা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু… সমগ্র প্রকল্পটি রূপায়ণের জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস করতে হবে, প্রায় সাত হাজার গাছ কাটা পড়বে এই “উন্নয়ন যজ্ঞে” এবং এই মর্মে বর্তমান পশ্চিমবাংলা সরকার বৃক্ষনিধনের জন্য ভারতের বন দপ্তরের কাছে আবেদন জানিয়েছে। সরকারের নিজের মতেই এই অঞ্চল বুনো হাতি, শেয়াল, হায়েনা, নেকড়ে প্রভৃতি বিশেষ প্রাণীদের আবাসস্থল, এরা যদি উচ্ছেদ হয়ে যায়, তবে এদেরকে অন্য কোনও অঞ্চলে “পুনর্বাসন” দেওয়া অসম্ভব।

প্রযুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রকল্পের অবাস্তবতা (বামনি প্রকল্প ২০০২ থেকে শুরু হয়ে জলের অভাবে ২০০৮-এ বন্ধ করে দেওয়া হয়) নিয়ে কথা না বাড়িয়ে বিশ্বায়ন নির্ধারিত উন্নয়ন-ভাবনা মানুষ-পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর কেমন নৃশংস অত্যাচার করছে সেই কাহিনী বলা যাক। যে পরিমাণ জমির ওপর থাকা সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হতে চলেছে, তার দ্বিগুণ পরিমাণ কৃষিজমি এই প্রকল্পের “অন্যান্য” কাজে বরবাদ হয়ে যাবে। যে দুটি নদীর উল্লেখ করলাম, সেগুলি সারা বছরের নদী নয়, মরসুমি নদী– এই নদীগুলোর ওপর ঘন ঘন বাঁধ আর জলাধার তৈরি করলে নদীগুলোর শুকিয়ে যাবার সম্ভাবনা বাড়বে, আর এগুলো  শুখা মরসুমে স্থানীয় স্তরে জলের প্রায় একমাত্র উৎস হওয়ায় পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে কৌম সমাজও বিপদের মুখে পড়বে বা হয়ত এখনি সেই বিপদ সংকেত বেজে উঠেছে। উন্নয়নের জন্য অরণ্য-নিধন এবং এর ফলে বনাঞ্চল কমে আসা পুরুলিয়ার মতো শুখা অঞ্চলে যে কী ভয়ানক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনবে তার কোনও আগাম সমীক্ষা নেই, নেই সেই আসন্ন বিপর্যয় প্রতিহত করার রূপায়ণ-যোগ্য আগাম পরিকল্পনা এবং বিপর্যয়-মোকাবেলা প্রস্তুতি। ঐ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক’ঘর মানুষই বা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন! ফলে তাঁদের দিকে নজর দেওয়ার অবকাশ নেই কোনও সরকারেরই। ঘরের পাশের প্রিয় অঞ্চলে প্রকৃতির ওপর হিংস্র আক্রমণ সংঘটিত হয়েছে, হতেই থাকবে, সেটিকে নির্দেশ করে বিশ্বায়নের কাঁটাওয়ালা রথের চাকা কেমনভাবে মাটি, মাটির তলার সম্পদ এবং সর্বোপরি, মানুষের সমাজকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিচ্ছে, তা নাপাম বোমা ফেলে যে ধ্বংসলীলা আমরা এই সেদিন ভিয়েতনামে প্রত্যক্ষ করেছি, তার চেয়ে কম কিছু নয়।

আমরা ফিরে যাই সেই ২০০৭-এ আর গিয়ে হাজির হই ব্রিটিশ ভারত থেকেই ভারতের আর্থিক রাজধানী, মুম্বাই শহর যে রাজ্যে অবস্থিত, সে মহারাষ্ট্র রাজ্যে। এই বছর ভারতের বন ও পরিবেশ মন্ত্রক মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর ও তার সংলগ্ন অঞ্চলকে বাঘের সংরক্ষণের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঞ্চল বলে ঘোষণা করে পুরো অঞ্চলটিকে বাঘের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চল বলে নির্দেশিকা জারি করে এবং এই অঞ্চলে কোনও ধরনের “উন্নয়নমূলক কাজ” নিষিদ্ধ বলে জানিয়ে দেয়। কিন্তু তখন ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন হয়নি, শ্রী গৌতম আদানি মহাশয়কে বর্তমানের প্রধানমন্ত্রীর পার্শ্বচর হিসেবে দেখা যায়নি। এইবার এগিয়ে আসি ২০১৫-য়। মহারাষ্ট্রর চন্দ্রপুরে কয়লাখনির থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য গৌতম আদানির কোম্পানি দাবি তোলে যে তাদের ৩,৩৫০ হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছেড়ে দিতে হবে! কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি খনির সংস্থাকে এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কয়লা উত্তোলনের অধিকার দিয়েছে, যার মধ্যে আদানির কোম্পানি, আদানি এন্টারপ্রাইজ অন্যতম। এই সংস্থাটিকে মোট ১৬০০ হেক্টর বনাঞ্চল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এখানে তারা “খোলামুখ” খনি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লা বার করবে। এই কাজের ফলে লোহারা গ্রামটির সর্বনাশ হবে।

“উন্নয়ন প্রকল্প”গুলির কাছে মানুষ, প্রকৃতি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ এক আবশ্যিক উৎপাত। প্রকল্প রূপায়ণে এই সব “অপ্রয়োজনীয়” বিষয়কে হিসেবে আনার দরকার পড়ে না। আদানি এই খনি প্রকল্পের জন্য লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে ১ কোটি ৪০ লক্ষ টন কয়লা তোলা। এত বড় এক খনি প্রকল্পের জন্য পরিবেশের ওপর এই প্রকল্পের প্রভাব নিরূপণের রিপোর্ট তৈরি করা দেশের আইন মতে বাধ্যতামূলক। এই রিপোর্ট বিচার-বিবেচনা করে তবেই এইসব প্রকল্পের জন্য ছাড়পত্র মেলে। মজার বিষয় হল আদানি প্রদত্ত রিপোর্টে তাডোবা-আন্ধারি বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের উল্লেখই নেই, অথচ এই প্রকল্পের জন্যই এই অঞ্চলকে কঠোরভাবে সংরক্ষিত বলে ২০০৭-এ ঘোষণা করা হয়েছিল!

এই রিপোর্টে আরও অনেক কিছুই নেই। নেই-এর তালিকা বিরাট। খনির কাজের জন্য যে বর্জ্য পদার্থ ফেলতে হবে, তার জন্য জায়গা ধরা নেই, ধরা নেই অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় স্থানও। প্রকল্পের মধ্যে এই সব লুকোনো জায়গার হিসেব এক করলে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজে জমির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর!

পুনর্বাসনের কথা যে এই রিপোর্টে একদম নেই, এমনটা নয়। তবে এখানে যে কৌশলটির আশ্রয় নিয়েছে কোম্পানি, তার থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা কী চোখে মানুষ, প্রকৃতি এবং প্রাণকে দেখে থাকে। প্রথমত তারা লোহারা গ্রামটিকে দুভাগে ভাগ করে দেখিয়ে এক অংশে উচ্ছেদ হচ্ছে এবং অন্য অংশে হচ্ছে না এমন দেখিয়ে পুনর্বাসন পাওয়ার যোগ্য মানুষের সংখ্যা কমিয়ে দেখাচ্ছে। আরও যে ১১টি গ্রামের মানুষের উচ্ছেদ হওয়ার কথা তারা এই রিপোর্টে কোথাও নেই! গাছ কাটার হিসেব নেই, বাধ্যতামূলক বনসৃজনের কথাও নেই কোথাও।

লোহারা গ্রামের যে অংশটি তারা ব্যবহার করবে না বলে ঘোষণা করেছে, সেখানের একটি ১০ হেক্টর দীঘির জল তারা খনির কাজে ব্যবহার করবে আর সবাই জানে যে খনির কাজে কী পরিমাণ জল লাগে। দীঘির জল দূষিত হওয়া ছাড়াও জলের ভাণ্ডারে টান পড়া অবধারিত। এই খনির কিছুটা দূরে ওয়েস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেড নামে একটি খনি চালু আছে, এবং এই খনিটির জন্য স্থানীয় জলস্তর নেমে গেছে শোচনীয় মাত্রায়। আদানির খনি চালু হলে সেই সমস্যা সংকটের আকার নেবে। এই সব সমস্যার খুব সরল সমাধান রয়েছে আদানির হাতে। তাদের বক্তব্য : আমরা মানুষকেই তো হাটিয়ে দিচ্ছি, তাহলে জলদূষণে কার কী এসে যায়! গাছ, প্রাণী, সবাইকে আলাদা আলাদা করে বিভিন্ন প্রান্তে “পুনর্বাসন” দিচ্ছি, ৫০০ কিমি দূরে কিছু গাছ লাগিয়ে দেব আর প্রাণীরা, যারা লোকবসতি পেরিয়ে ঐ কৃত্রিম বনাঞ্চলে গিয়ে পৌঁছতে পারবে তারা বেঁচে যাবে! দারুণ সমাধান, সন্দেহ নেই।

যাঁরা উচ্ছেদ হবেন না, প্রকল্প এলাকা থেকে ৫ কিমি দূরত্বে থেকে যাবেন, তাঁদের চাষের খেত-খামার খোলামুখ খনির ধুলোয় ভরে যাবে, জমি তার চাষযোগ্যতা হারাবে। উন্নয়ন চলবে।

ভারতে খনি থেকে প্রায় ৮৯টি খনিজ পদার্থ পাওয়া যায় আর তাই দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো সেই সম্পদে ভাগ বসানোর জন্য হামলে পড়েছে। অন্যদিকে, আমাদের দেশ খনি দুর্ঘটনায় পৃথিবীর বহু দেশকেই টেক্কা দিয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া খনিগুলোর ব্যবস্থাপনা আমরা এখনও ঠিকমত করতেই পারি না। ঝরিয়া, রানিগঞ্জ অঞ্চলের প্রায় ৫০০ খনি আছে, যেগুলো থেকে এখন আর খনিজ উত্তোলন করা হয় না। এই খনিগুলোর বিপুল পরিমাণ জমি এখনও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, ফলে এমন পরিত্যক্ত খনির আশপাশের জমি বসে যাচ্ছে, দুর্ঘটনা বাড়ছে।

ভারত দেশটি প্রাচীন গন্ডোয়ানা স্থলভাগের অংশ ছিল সুদূর অতীতে, তাই অঞ্চলটি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। বিদেশি দস্যু খনিজ সংস্থাগুলি এই তথ্য সংগ্রহ করতে পারার পর আমাদের দেশের খনিজ সম্পদের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেওয়া শুরু করেছে। খনি ক্ষেত্রে ভারত সরকার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত নিয়মের বড় রকমের পরিবর্তন করার পর সেই বিনিয়োগ এখন অনেক বেশি “বিনিয়োগ-বান্ধব”– আর তাই এই “লুক ইস্ট” বলে বিনিয়োগকারী ডাকার এই হুক্কাহুয়া। এই বিনিয়োগ টানতে গিয়ে পাপুয়া নিউ গিনি দেশটি তার নিজের দেশের পরিবেশ সংক্রান্ত আইনে প্রচুর পরিবর্তন করে সেই দেশটিকে জাপানি বিনিয়োগকারীদের হাতে “পলিউসান হেভেন” করে তুলেছে। আমাদের দেশও দ্রুত সেই পথে অগ্রসর হচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে গোয়ার কথা বলা যায়। গোয়ার লোহার খনিগুলি গোয়ার পাহাড়ের চূড়াগুলো বাটির মতো করে দিয়েছে, ফলে অরণ্য-শামিয়ানা ধ্বংস হচ্ছে দ্রুত। এত বড় মাপের খনি চালাতে গেলে যন্ত্রপাতি আনা-নেওয়া করা, খনিজ পদার্থ খনিমুখ থেকে রেলস্টেসনে নিয়ে যাওয়া, সড়কপথে পাশের রাজ্যে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে সড়কপথ বাড়ানো অবশ্যম্ভাবী, আর গোয়াতে ঠিক এটাই ঘটছে। ফলে গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ হয়ে সড়কপথ বাড়ছে, গোয়া সংযুক্ত হচ্ছে জাতীয় হাইওয়ের চক্রর সঙ্গে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ।

১৯৮৭ সালে ভারতে অরণ্য-শামিয়ানা ছিল প্রায় ২০ শতাংশ। আর ২০১৫ সালে, বিশ্বায়নের দু দশক পর সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ! বিশ্বায়নের ফলে উপকার হল, তাই না? কিন্তু এই হিসেবে প্রচুর জল মেশানো আছে। এর মধ্যে সামাজিক এবং বাণিজ্যিক বনসৃজনের অংশটিও ধরা আছে, যা কিনা ঠিক বনাঞ্চল বলে কখনওই গণ্য করা যায় না। বস্তুত, ঠিকঠাক বনাঞ্চল কমেছে এই সময়সীমায়, কমার হার বছরে ০.২৩ শতাংশ হারে, যা গত দু বছরে বাড়তির দিকে। কারণটা দ্বিবিধ– এক, বনাঞ্চলের ভৌগোলিক পরিমাণ ক্রমাগত কমে আসছে, দুই বনসৃজনের নামে স্রেফ জোচ্চুরি চলছে। কত গাছ লাগানো হচ্ছে, তার হিসেবটাই গাছের আসল সংখ্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কত গাছ মরে যাচ্ছে, সেই হিসেবটা চেপে যাওয়া হচ্ছে। গত তিন দশকে আমাদের দেশে প্রায় ১৪ হাজার বর্গ কিমি পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে, যার মধ্যে যার খনির জন্য গেছে ৪৯৪৭ বর্গ কিমি, “প্রতিরক্ষা খাতে” ১৫৪৯ বর্গ কিমি এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প খাতে ১৩৫১ বর্গ কিমি জমি। এই তিরিশ বছরে হরিয়ানা রাজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ জমি, বা প্রায় ৩৯ হাজার বর্গ কিমি জমি গিলে খেয়েছে বিশ্বায়ন-তাড়িত বিভিন্ন “উন্নয়ন প্রকল্প”। সরকারও সম্প্রতি স্বীকার করে নিয়েছে যে সামাজিক বনসৃজনকে বনাঞ্চল সৃষ্টি বলে ধরা ঠিক হচ্ছে না! একদা বনাঞ্চল সমৃদ্ধ অঞ্চলে লোকালয়ে খাদক প্রাণীর অত্যাচার বাড়ার কারণ এই বনাঞ্চল কমে আসা। উত্তরাখন্ডে চিতার আক্রমণে মানুষের মৃত্যু ক্রমাগত বাড়ছে। সুন্দরবন অঞ্চলে এই সমস্যার কথা আজকাল প্রায়ই খবর হিসেবে উঠে আসছে। ফল দাঁড়িয়েছে আমাদের দেশ প্রতিদিন গড়ে ১৩৫ হেক্টর বনাঞ্চল হারাচ্ছে।

জল-জঙ্গল-আলো-বাতাস-কৌম জমি, সামগ্রিকভাবে পরিবেশ, এর মালিকানা সমাজের সকলের, কোনও ব্যক্তিবিশেষের নয়। বিশ্বায়ন চায় এই কৌম মালিকানার আওতায় থাকা যৌথ সম্পত্তি কোম্পানির সম্পত্তিতে পরিণত করতে, যাতে তাকে তার উৎপাদনের জন্য কাঁচা মাল সংগ্রহ করতে গাঁটের কড়ি খরচা না করতে হয়। সেই সঙ্গে যদি তাকে শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা না মেটাতে হয়, যদি শ্রমিকের পেশাগত সুরক্ষার জন্য টাকা খরচা না করতে হয়, তবে সবাই বুঝবে যে মালিকের কাছে এই খাতগুলি খরচার ঘরে না গিয়ে লাভের ঘরে যাবে আর সব সময়েই দাম না চুকিয়ে সংগ্রহ করা জিনিসকেই মুনাফা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বায়ন প্রথমে শ্রম ও শ্রমিক সংক্রান্ত নীতি শিথিল করিয়েছে, তারপর সরকারগুলোর সঙ্গে ষড় করে কর কমানোর কল খুলেছে, ধার নিয়ে সেই টাকা মেরে দিয়ে দেশের বাইরে পগার পার হয়েছে, আর এগুলো সবই তার মুনাফার ঘরে জমা পড়েছে। এখন তারা জোট বেঁধেছে সরকারগুলোর সঙ্গে, পরিবেশ শোষণ করার কুঅভিপ্রায়ে। এ চক্রান্তের অংশীদার ভারত-সরকারও। মাতা বসুমতী অতঃপর বিশ্বায়নের হিংস্র দাঁত-নখের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকবে, যতদিন না মুনাফার লোলুপ ক্ষুধা খান্ডব-দহনের পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে।