পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণ

সাবিনা ইয়াসমিন

 

হঠাৎ ঠিক হলো পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় বেরাতে যাবো। মার্চ মাসের শুরুর দিকে অযোধ্যা যাওয়ার একটাই কারণ – পলাশ ফুল। আমরা শহরে কোনো থাকার জায়গা ঠিক করিনি। পাহাড়ের ওপরেই West Bengal Development Comprehensive Area Development Corporation এর নীহারিকা নামে একটি গেষ্ট হাউসে ছিলাম। শহর থেকে বাসে করে পাহাড়ি রাস্তা ধরে যখন অযোধ্যা যাচ্ছি, দেখি চারিদিকে পলাশ ফুলের গাছ। যেন গোটা জঙ্গলে আগুন লেগেছে। সেদিন আমরা হোটেলে পৌঁছলাম বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে। ঠিক হলো দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকেলের দিক করে ঘুরতে বেরোবো। সেই মতো হোটেল থেকে একটা গাড়িরও বন্দবস্ত করা গেলো। আমাদের হাতে সময় বেশি ছিলো না। পরদিন রাত ৮ টায় ফেরার ট্রেন।
প্রথম গেলাম ময়ূড় পাহাড়। আমার এই প্রথম পাহাড় দেখা। তাই আর পাঁচটা মানুষের কাছে হয়তো এটা আহামরি কিছু না; কিন্তু আমার কাছে যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। পাহাড়ে ওঠা মাত্রই চঞ্চলা কিশোরীর মতো এদিক-সেদিক ছুটে বেরাতে লাগলাম। ময়ূর পাহাড় থেকে নেমে আসছি, দেখি ২টো বাচ্চা মেয়ে পলাশ ফুলের মালা গাঁথছে বিক্রির জন্যে। আমরাও কিনলাম।
গাড়িতে উঠলে ড্রাইভার বললো এবার সুইসাইড পয়েন্টে নিয়ে যাবে। শুনেই মনে হলো কেমন একটা গা ছমছমে ব্যাপার; বোধহয় অনেক আত্মহ্যার সাক্ষ্মী এই পাহাড়। ওখানে গিয়ে দেখি – কোথায় কি? এত সুন্দর জায়গা আমি আগে কখনও দেখি নি। উঁচু পাহাড় থেকে নীচের দৃশ্য দেখার মজাটাই আলাদা। পাহাড়ের একদিকে তাকাতেই দেখি নীচে বিশাল জলাধার – মুরুগুমা ড্যাম। এর পরে আমাদের এখানেই যাওয়ার কথা। চরে ঘাসের গালিচা পাতা; তাতে গরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। স্থানীয় ছোট-ছোট ছেলেমেয়রা সব খেলা করছে। কিছু আদিবাসী মহিলা কাঠ-কুটো নিয়ে ঘরে ফিরছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। আমার আবেগী মনকে বেশ খানিকটা প্রশ্রয় দিলাম। ঠিক করলাম পাহাড়ের খাঁজে পা দিয়ে নীচে নামবো ওই সবুজ প্রান্তরটাই। তারপর পায়ে হাঁটা পথ ধরে পাকা রাস্তায়। আমি তখন যেন বিরোহিণী রাধা। যখন জলাধারের চরে পৌঁছলাম, তখন মনে হলো গোধূলী বেলায় আকাশে সিঁদূর খেলা চলছে। পারে বসেই ডুবন্ত সূর্য দেখলাম। আহা, কি কোমল সেই দৃশ্য। জলাধারটাকে মনে হচ্ছিলো প্রকাণ্ড একটা সুরাপাত্র যেন। এখান থেকে সুরা পান করে প্রকৃতি একটু একটু ঝিমোচ্ছে। একটা আবেশে নিমগ্ন হয়ে গেলাম। খানিক্ষণ সেই লালপানীর রঙিন হাওয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকার পর পায়ে হেঁটে পাকা রাস্তায় উঠলাম। গাড়িতে যখন উঠছি তখন সন্ধ্যে নেমেছে। সেদিনের মতো আমাদের ঘোরা শেষ। ক্লান্ত শরীর, কিন্তু মন তখনো ঝলমলে। জানালা দিয়ে মিষ্টি বাতাস আসছে গাড়ীর ভিতরে। সে কি শিহরণ জাগানো পরিবেশ। হোটেলে ফিরে চা আর সব্জির পকোড়া খেলাম। বেশ ভালোই বানিয়েছিলো। হোটেলের পরিবেশটাও খুব ভালো। অনেক গাছপালা দিয়ে সাজানো বিশাল একটা বাগান রয়েছে তাতে। প্রত্যেকটা ঘরও যথেষ্ট সাজানো-গোছানো।

পরের দিন খুব সকালে উঠে ছিলাম। সকাল ৬টা নাগাদ গাড়িতে উঠে দ্বিতীয় দিনের যাত্রা আরম্ভ হলো। আর এটায় তো শেষ দিন। সকাল সকাল এ-দিকটায় বেশ ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু বেলা হতেই গরম শুরু। প্রথমেই গেলাম মার্বেল হ্রদ। এত সকালে লেকের জল ধীর-শান্ত, যেন ঘুম ভাঙে নি এখনও। লেকটা দেখতে এত সুন্দর তা ভাষায় বোঝানো খুব কঠিন। লেকের সামনে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো লেকটা যেন একটা পবিত্র নারী; হাল্কা নীল রঙের শাড়ী পড়ে ধ্যান করছে। সমস্ত প্রকৃতি তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার নিশ্চল মূর্তি সমস্ত চরাচরকে এক মুহূর্তের জন্য থামিয়ে দিয়েছে। তার সেই ধ্যানের গভীরতায় বারবার ডুবে যাচ্ছিলাম। সেই ঘোর লাগানো জায়গা ছেড়ে আসতে কিছুতেই মন চাইছিলো না। কিন্তু যেতেই হোত। এই লেকের ধার ঘেঁসেই একটা পাহাড় ছিলো। পাহাড়টা গাছ দিয়ে সাজানো। নরম রোদের আলোয় তাকে লাগছিলো একেবারে নতুন বধূর মতো। লেকের জলে সে বারবার নিজের রূপ দেখতে চাইছে।

এরপর গেলাম বামনী ঝর্ণা। ছোট একটা ঝরণা আপন মনে বয়ে চলেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে জলে। একটা টিলার ওপর বসে সেই জলে পা ভেজালাম। প্রকৃতির কত রূপ, কত রঙ, কত সৌন্দর্য। তবুও সে কোথাও নিজেকে জাহির করে না। আপন ছন্দে নিজেতেই মেতে থাকতে ভালোবাসে।

এরপর গেলাম খয়রাবেড়ি হ্রদ। হ্রদের ওপর দিয়ে একটা সেতু আছে। পাড়ে কিছু সাদা বক বসে ছিলো। সারাক্ষণ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। দুপুরের সময় তখন। সূর্য এক্কেবারে মাথার ওপরে। তবুও, প্রকৃতির আন্তরিকতায় মনটা জুড়িয়ে গেলো।

এবার আমাদের গাড়ীর চালক বললো পাখী পাহাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। নামটা শুনে মনে হলো বোধহয় এখানে হরেক রকমের পাখী থাকে। গিয়ে দেখি অন্য ব্যাপার। পাহাড়টাকে কাছ থেকে দেখলে কেউ এর নামকরণের আসল কারন ঠাউর করতে পারবে না। একে দেখতে হবে দূর থেকে। অনেকটা jigsaw puzzle এর মতো। তাহলে দেখা যাবে সাদা রঙ দিয়ে কেউ তার গায়ে পাখী এঁকে দিয়েছে। শোনা যায় কোনো এক পর্যটক এখানে বেড়াতে এসে কাজটি করে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ঠিক স্লেটের ওপর পেনশিল দিয়ে আঁকা। মনে মনে শিল্পীর সৃজনশীলতাকে তারিফ না করে পারলাম না।

এরপর রওনা দিলাম লোয়ার ড্যামের দিকে। এর ঠিক ওপরেই আছে আপার ড্যাম। খুব সুন্দর জায়গা। আসে-পাশে ছোট-খাটো দোকানও গড়ে উঠেছে। তাতে নানা রকমের খেলনা, বেলুন, খাবার-দাবার বিক্রি হচ্ছে। একটা ছোট মেলা বসেছে মনে হল। এই পরিবেশটা আবার আগের গুলোর থেকে সম্পূর্ন আলাদা। একদম আমার ছোটবেলার কথা মনে করে যাচ্ছিল। কিন্তু আমরা এই জায়গাটার সৌন্দর্য ঠিকমতো উপভোগ করতে পারি নি কারন তখন ভরদুপুর; তাই গরমে কাহিল অবস্থা। ওখান থেকে চটপট বেড়িয়ে পড়লাম আপার ড্যামের দিকে। ওখানেই একই অবস্থা; কোথাও এতটুকু ছায়া নেই। এবার ঘরে ফেরার পালা।

বিকেলের দিকে হোটেলের বিল মিটিয়ে আমরা পুরুলিয়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আসার সময় গাড়ীর জানলার কাচ দিয়ে শেষ দেখা পুরুলিয়ার মাটিকে। সত্যি মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। এই সবুজের সমারোহ, পাহাড়, পাখির কিচিরমিচির, নির্মল বাতাস, গ্রামের মানুষের সরল মুখগুলো, রাঙা মাটির পথ – এগুলোর মধ্যে একটা আশ্চর্য মায়া আছে যেটা খুব টানে। প্রকৃতি যেন সব ক্লান্তি গুলোকে তার ঝুলিতে ভরে একদম গায়েব করে দিল; আর ফেরার সময় উপহার হিসেবে দিল একরাশ ভাললাগার মুহূর্ত, যেগুলো সারা জীবন এই স্মৃতিবাক্সে জমা থাকবে। কে না জানে – যার সঞ্চয়ে যত বেশি মধুর স্মৃতি, এই বিশ্বে সেই তো ততবেশি ধনী।

 

1 Comment

  1. খুব সুন্দর লাগলো। মনে হলো চোখের সামনে পুরুলিয়া দেখতে পাচ্ছি।

    পাখি পাহাড় সম্বন্ধে দু-চার কথা বলতে চাই। এই পাহাড়ের এক আশ্চর্য ইতিহাস আছে, যা হয়তো অনেকেরই অজানা। কলকাতা গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টের এক শিল্পীর উদ্যোগে এই পাহাড়ে পাথর খোদাই করে ‘ইন-সিটু রক স্কাল্পচার’ সৃষ্টি করা হয়। শিল্পী চিত্ত দে চেয়েছিলেন বিপন্ন প্রজাতির পশুপাখিকে চিরকালের জন্য এই পাহাড়ের চিত্রে ধরে রাখতে। প্রকান্ড পাহাড় খোদাই করার জন্য তিনি স্থানীয় আদিবাসীদের ছেনি হাতুড়ি ইত্যাদি দিয়ে শিল্প সৃষ্টির কৌশল শেখান। ২০০৭ সাল থেকে আলিপুর করেকশনাল হোমে চিত্রকলার ওয়ার্কশপ করতেন চিত্ত দে। একদিন তিনি দেখেন যে হোমের বাসিন্দাদের একজন অনেক ছবি এঁকেছেন কিন্তু কোন ছবিতেই আকাশ নেই। যিনি এঁকেছেন তিনি শিল্পীকে বলেন যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পনেরো বছর শাস্তি পাওয়ার পর তাঁর মনে হয় যে তিনি চিরকালের জন্য খোলা আকাশ হারিয়ে ফেলেছেন। পাখি পাহাড় খোদাই করার কাজে করেকশনাল হোমের অনেকজনকে নিযুক্ত করেন চিত্ত দে। কয়েকদিনের জন্য হলেও তাদের নিয়ে আসেন পুরুলিয়ার খোলা আকাশের নিচে। এই পাহাড়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই পাহাড়ের প্রতিটি পাখি মানুষের চিরকালের মুক্তির আশার প্রতিবিম্ব। এই পাহাড়ের শিল্প প্রমাণ করে যে আমাদের বিধান যাদের মানবসমাজের থেকে বিযুক্ত করেছে, যাদের জীবনের সকল সুযোগ কেড়ে নিয়েছে, তারাও মানুষ। তাদের মনেও পৃথিবীর সৌন্দর্যের খেলা দেখা যায়।

    তথ্যসূত্র:
    https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/pakhi-pahar-in-purulia

    https://www.telegraphindia.com/7-days/a-chisel-for-some-sky/cid/1315623

আপনার মতামত...