সৌমিত্র ঘোষ
রাজনৈতিক কর্মী, পরিবেশকর্মী ও গবেষক
দিল্লি শহরের বাইরে ভারতবর্ষের কৃষকেরা এখনও বসে আছেন। তাঁদের আন্দোলন তিন মাস পেরুতে চলল, সিন্ধু গাজিপুর টিকরি সীমান্তে ভিড় পাতলা হচ্ছে বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে রাষ্ট্রের নির্বিকার অবহেলা, ঔদ্ধত্য, আগ্রাসন। অন্যদিকে, যে আন্দোলনের সে অর্থে কোনও মুখ ছিল না, অনেকের সিদ্ধান্তে কাজ হচ্ছিল, সেখানে ক্রমশই প্রধান হয়ে উঠছেন উত্তরপ্রদেশের রাকেশ টিকায়েত, সংযুক্ত কিসান মোর্চার বেষ্টনী ছাড়িয়ে আন্দোলন ঢুকে পড়ছে হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের গ্রামসমাজের ভিতরঘরে, একের পর এক মহাপঞ্চায়েতে উপচে পড়ছে ভিড়। সেই ভিড়ে মিশে যাচ্ছে প্রায় মরেহেজে যাওয়া বিরোধীপক্ষ, আন্দোলনের জনরোষ থেকে পুষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্ৰদখলের ভোটের লড়াই।
এসব সবাইয়ের জানা। বিশেষ করে আমরা যারা বিজেপি-আর এস এস এর ক্রমবর্ধমান দখলদারি ও হামলায় বিব্রত, সন্ত্রস্ত, শ্বাসরুদ্ধ, হাঁ করে কৃষক আন্দোলনের ছবি খবর দেখছি। ২০১৪য় বিজেপি রাষ্ট্ৰক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের সরকারকে এমন সঙ্ঘবদ্ধ সংগঠিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি, স্বাধীনতার পর থেকে দেশ এই মাপের কৃষক আন্দোলন দেখেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ফলে আন্দোলন ঘিরে প্রত্যাশাও বেশি। নতুন কৃষি আইনের অভিঘাতে যে অর্থনৈতিক সামাজিক সঙ্কট তৈরি হবে, তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই প্রশ্ন: কৃষকরা পারবেন তো? শেষ পর্যন্ত দৌড়োবে কি লড়াইয়ের ঘোড়া? ফ্যাসিবাদের বিজয়পথ থমকে দাঁড়াবে? কৃষক আন্দোলনের মধ্যে আমরা দেখতে চাইছি ক্রমশই ফ্যাসিস্ট চরিত্রের রাষ্ট্রযন্ত্র ও ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা ও জয়। যে লড়াই আমরা তৈরি করতে পারিনি, তা করে দেখাচ্ছেন উত্তর ভারতের কৃষকেরা, আমরা তাদের দিকে সঘন আবেগ ও আশা নিয়ে তাকিয়ে।
সিংঘু গাজীপুর টিকরিতে যাওয়ার হয়নি, আন্দোলন কীভাবে চলছে তা প্রত্যক্ষ করারও সুযোগ ঘটেনি। আন্দোলনে কারা আছেন, কারা নেতৃত্বে, আন্দোলনের সাংগঠনিক শক্তি দুর্বলতা রণকৌশল ইত্যাদি নিয়ে বিশদ চর্চায় যাওয়া সম্ভব নয়। এই সংক্ষিপ্ত লেখাটায় বরং কিছু অন্য, প্রয়োজনীয় প্রশ্ন তোলা যাক। প্রশ্ন অর্থনীতির, সেকারণে রাজনীতিরও। কোনও আন্দোলনই আকাশ থেকে পড়ে না, যে কোনও বড় গণসংগ্রামের দীর্ঘ বিচিত্র প্রেক্ষাপট থাকে, যা একইসঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। সমাজের গভীরে প্রোথিত বহুবিধ ক্ষমতাসম্পর্কের যে বহুস্তর বিন্যাস (এক্ষেত্রে উৎপাদন সম্পর্ক ও ভূমি সম্পর্ক, জাতি (কাস্ট ও এথনিসিটি), ধর্ম) তা পড়ার চেষ্টা না করলে সংগ্রামের চরিত্র ও ক্ষমতা বা potency বিষয়ে ধারণাও জন্মায় না। কৃষকদের লড়াই নিয়ে চারপাশে যে সব প্রতিক্রিয়া দেখছি, বিশেষত বাংলায়, তার বেশিরভাগই আবেগতাড়িত প্রত্যাশামুখর, ঘটনাবহুল বর্তমানের যে বাইটদুনিয়ার মধ্যে আমরা ইদানিং আপদশির নিমগ্ন, সেই ছবিশব্দময় আপাতপ্রত্যক্ষতার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা বড় একটা নজরে পড়ে না। অথচ এই কাজটা করতেই হয়। অন্তত যাঁরা কৃষক আন্দোলনের সহমর্মী সহযাত্রী, যাঁরা আন্দোলনের রাজনৈতিক সম্ভাবনা বুঝতে চাইছেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন খোঁজার প্রক্রিয়াটি প্রয়োজনীয় ঠেকতে পারে, এই বিবেচনায় দু চারটি প্রশ্নপ্রসঙ্গের কথা বলা যাক।
সবুজ বিপ্লব ও চাষে পুঁজির প্রবেশ
মোটামুটি যে কথাটা সবার জানা, হালের কৃষক আন্দোলন কৃষিতে কর্পোরেট পুঁজির রাষ্ট্ৰদাক্ষিণ্যপুষ্ট প্রবেশের বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ। কথাটা অর্ধসত্য। ভারতের কৃষিতে কর্পোরেট অর্থাৎ বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটেছে ষাটের দশকে, মানে নিদেনপক্ষে অর্ধশতাব্দীকাল আগে। কৃষি উৎপাদনের যে যে উপকরণগুলি সামাজিক অথবা পারিবারিক মালিকানাধীন ছিল, একটা একটা করে তার প্রায় সবকটিতে সংগঠিত বড় পুঁজি ঢুকতে শুরু করে। তথাকথিত স্বনির্ভর গ্রামঅর্থনীতি এবং জাতিব্যবস্থায় ওতপ্রোত সামন্তসমাজ পুঁজিবাজারের চৌহদ্দির মধ্যে চলে আসতে বাধ্য হয়। উৎপাদনবৃদ্ধির কথা বলে প্রাক-পুঁজি উপকরণগুলিকে একে একে উচ্ছেদ করা হয়— পরিবারে ও গ্রামে যে বীজ সঞ্চিত হত তার জায়গায় কোম্পানির উচ্চফলনশীল বীজ ঢোকে। বীজ বদলায় বলে কৃষিবাস্তুতন্ত্রও আমূল বদলায়। বিশেষ বীজ থেকে যে নতুন চাষ শুরু হয়, তার জন্য আলাদাভাবে জমি তৈরি করতে হয়, তার জন্য কোম্পানির যন্ত্র (যথা ট্র্যাক্টর) লাগে, গাছ বাঁচিয়ে রাখতে গেলে নির্দিষ্ট পরিমাণ জল লাগে, নতুন গাছে যে নতুন পোকা ও ব্যাধি লাগে তা দূর করতে গেলে কোম্পানির কীটনাশক লাগে, ওষুধ দেওয়ার যন্ত্র লাগে। জমি তৈরি করতে গেলে সার লাগে, যা বানায় ও বিক্রি করে কোম্পানি। নতুন চাষে যে নতুন ফসল ওঠে তা কাটা, ঝাড়া, বাছা এসব কিছুর জন্যই আলাদা আলাদা যন্ত্রের প্রয়োজন হয়, যে সব যন্ত্র বানায় কোম্পানি।
উৎপাদনের প্রত্যেক স্তরে সচেতনভাবে পুঁজির প্রবেশ ঘটিয়ে কৃষিউৎপাদনকে পুঁজিনির্ভর করে তোলার এই প্রক্রিয়ার পোশাকি নাম সবুজ বিপ্লব। ভারতবর্ষে এই ‘বিপ্লব’ শুরু হয়েছিল পাঞ্জাব হরিয়ানা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষিঅঞ্চলে। বাংলার বর্ধমান ও হুগলির কিছু এলাকা সবুজ বিপ্লবের আওতায় আসে। এগুলো জানা কথা, তবু মনে করার দরকার। যে কৃষক আন্দোলনের কথা আমরা বলছি, তার মূল অংশিদার সবুজ বিপ্লব এলাকার কৃষক, কৃষিজীবী। তাঁদের অনেকেই সবুজ বিপ্লবের ফলে আর্থিক লাভবান হয়েছেন, ভারতের অন্যান্য বহু এলাকার তুলনায় তাঁরা পুঁজি ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক চাষে রপ্ত হয়েছেন অনেক তাড়াতাড়ি। এমনকি, পুঁজিতন্ত্র বিশ্বজুড়ে যে পরিবেশ সঙ্কট তৈরি করেছে, যে বিশ্ব উষ্ণায়ন বা জলবায়ু বদলের ফলে কৃষিব্যবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ছে প্রতিদিন, তার উত্তরে আরও যে সব তথাকথিত পরিবেশবান্ধব আধুনিকতর প্রযুক্তি আমদানি করা হচ্ছে, যা কিনা মোটের ওপর জলবায়ুচালাক কৃষি বা ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার নামে জ্ঞাত, তার প্রথম ও ব্যাপক প্রয়োগও ঘটছে পুরনো সবুজ বিপ্লব অঞ্চলে। একটা গোদা হিসেবে দেখছিলাম, এই নতুন কৃষিতে যন্ত্রের ও পুঁজির ব্যবহার আরও বাড়ছে। ঝড়বৃষ্টিবন্যাখরা নতুন পোকামাকড় অসুখ এসব থেকে বাঁচতে হলে নতুন জিন বদলানো বীজ নিয়ে আসছে বহুজাতিক কোম্পানিরা। জমি না চষে নতুন ধরনের চাষ শুরু হয়েছে, যার জন্য ক্ষেতকে সাফসুতরো সমতল বানিয়ে ফেলতে হয়, তার জন্য ল্যান্ড লেভেলার নামের যন্ত্র লাগে। বীজ ছেটানোর জন্য লাগে টার্বো সিডার। আবহাওয়ার ফেরবদলে চাষি যাতে মার না খান, সেজন্য আবহাওয়া বিমা, সে বিমার কিস্তি। পুরনো নতুন মিলিয়ে শুধু যন্ত্রের পিছনেই মাঝারি বা বড় চাষিদের ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা খরচ করতে হচ্ছে আজকাল। যাঁরা এত টাকা জোগাড় করতে পারছেন না তাঁদের যন্ত্র ভাড়া করতে হচ্ছে।
লড়াই কার বিরুদ্ধে? রাষ্ট্ৰ, চাষ ও পুঁজিবাজার
চাষব্যবস্থার বিন্দুতে বিন্দুতে পুঁজি ঢুকে আছে যে অঞ্চলের কৃষিতে, সেখানকার কৃষকদের আন্দোলন পুঁজির বা পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে এরকম বলাটা আদৌ ঠিক হবে না। পুরনো ধরনের চাষে প্রকৃতিনির্ভরতা বেশি থাকত, বীজ, সার, জল, মাটি তৈরি, ফসল তোলা, অর্থাৎ চাষের সমগ্র প্রক্রিয়া নির্ধারিত ও সম্পন্ন হত প্রাকৃতিক নিয়মে। সেই ব্যবস্থা থেকে প্রকৃতিকে বলে বলে উচ্ছেদ করা হয়েছে, প্রকৃতির অংশ হিসেবে শ্রমকেও। শ্রমের জায়গা নিয়েছে পুঁজি। বিশ্বব্যাঙ্ক ও ওই জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো (যথা, এফএও) একসময় বলত শ্রমনিবিড় নয়, পুঁজিনিবিড় চাষ চাই, লেবার-ইন্টেন্সিভ নয় ক্যাপিটাল-ইন্টেন্সিভ। পুঁজিনিবিড় চাষে রীতিমতো উপকৃত ও অভ্যস্ত কৃষকদের লড়াইটা তাহলে কিসের, কাদের বিরুদ্ধে?
এইখানে খানিক থমকাতে, ভাবতে হয়। ভারতবর্ষের চাষে সবুজ বিপ্লব মারফত পুঁজি ও প্রযুক্তির যুগপৎ আনুষ্ঠানিক প্রবেশ ঘটছে রাষ্ট্রের হাত ধরে। কোম্পানির বীজ সার কীটনাশক যন্ত্র ইত্যাদি নিজে নিজে, বাজারের অমোঘ নিয়মে, চাষির কাছে পৌঁছোয়নি। কেন্দ্রের কৃষিমন্ত্রক, রাজ্যের কৃষিবিভাগ পরিকল্পনামাফিক দেশের চাষচিত্র বদলেছে। সরকারি কৃষিবিদ ও আধিকারিকরা পুরনো দেশজ চাষের জায়গায় পুঁজিনির্ভর নতুন চাষ শুরু করিয়েছেন, এচওয়াইভি (হাই ইলডিং ভ্যারাইটি) চাষের যুগ এসেছে। সবুজ বিপ্লবের আদিকাল থেকে রাষ্ট্ৰ স্বয়ং নির্বাধ পুঁজিবাজার ও চাষির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকেছে, সার, বীজ, কীটনাশক, যন্ত্র, এসব কেনার জন্য অনুদান, কৃষিঋণ ও ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছে। একইসঙ্গে, একফসলা জমি যাতে দুই কি তিনফসলা হয়ে ওঠে, উৎপাদন যাতে বাড়ে, তার জন্য নদীতে বড় ছোট বাঁধ দিয়ে, খাল কেটে, সেচ এলাকা বাড়ানো হয়েছে, যেখানে সেচ ব্যবস্থা নেই, সেখানে চাষিরা পাম্প বসিয়ে মাটির নিচের জল তুলছেন। পাম্প ও ট্রাক্টর ইত্যাদি অন্যান্য যন্ত্র চালানোর জন্য যে জ্বালানি, তার জন্যও রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ব্যবস্থা হয়েছে।
রাষ্ট্রের ভূমিকা এক্ষেত্রে যতটা না বাজারের হিংস্র ঝড়ঝাপটা থেকে চাষিকে বাঁচানোর, বা রক্ষকের, তার চাইতে অনেক বেশি পুরনো চাষে অভ্যস্ত চাষিদের নতুন চাষে নামানোর ক্ষেত্রে মূল অনুঘটকের, উৎসাহদাতার। অর্থাৎ কৃষিকে কেন্দ্র করে যে পুঁজিবাজার গড়ে উঠছিল, তাকে রাষ্ট্ৰ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা দিচ্ছিল, নতুন ক্রেতা তৈরি করে, ক্রেতার আর্থিক ক্ষমতা বাড়িয়ে। এক্ষেত্রে ক্রেতা চাষি, বড় ও মাঝারি চাষি তো বটেই, ছোট চাষিও। শুধু বাজার থেকে নতুন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান কেনার খরচা জুগিয়ে তাদের টিঁকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, যা চাষ হচ্ছে সেই ফসল যাতে মোটামুটি ঠিকঠাক দামে বিক্রি হয়, সে ব্যবস্থাও করল রাষ্ট্ৰ। ফলে কৃষিপণ্যের নিয়ন্ত্রিত বাজার, মান্ডি, কিছু প্রধান ফসলের (যথা খাদ্যশস্য) ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি, এসবের প্রচলন হল। অর্থাৎ, কৃষিক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সক্রিয় মধ্যস্থতার অর্থ দাঁড়াল যে চাষি একাধারে ক্রেতা ও বিক্রেতা হিসাবে ‘উপযুক্ত’ হয়ে উঠলেন, পুঁজিতান্ত্রিক কৃষি অর্থনীতির গোড়াপত্তন হল।
উৎপাদন নয় পুনরুৎপাদন? বিপন্ন কৃষি
ঠিক এইখানটায়, সমস্যাও তৈরি হল। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল কথা, যে কোনও উপায়ে হোক পুঁজিবৃদ্ধি, উৎপাদন নয়, পুনরুৎপাদন। রাষ্ট্ৰ মূলত পুঁজিবান্ধব, তার কাজ চাষিকে সুরক্ষা দেওয়া নয়, পুঁজিবৃদ্ধির পথ সুগম করা। মিশ্র অর্থনীতি, ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি, কেইনসীয় অর্থনীতি নামে যে অর্থনৈতিক মডেল ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পর থেকে সরকারিভাবে অনুসৃত, সেখানে সামাজিক সুরক্ষা, জনকল্যাণ ইত্যাদির বার্তা ছিল, ফলে রাষ্ট্রের পক্ষে খোলাখুলি পুঁজির পক্ষ নেওয়া সব সময় একভাবে সম্ভব হয়নি। আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে যে নিওলিবরল বা তথাকথিত মুক্ত অর্থনীতির অনুশীলন রাষ্ট্রীয় মদতে শুরু হল, তার মোদ্দা কথা, রাষ্ট্ৰ অর্থনৈতিক ক্ষমতাসম্পর্কের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক-নির্ধারক ভূমিকা নেবে না, যা হবে পুঁজির, বাজারের নিয়মে। যথা, আমরা দেখছি, নতুন কৃষি আইনের ফল, রাষ্ট্ৰ সরে যাচ্ছে, কৃষককে অরক্ষিত রেখে। কেন সরছে? যেহেতু পুঁজি উৎপাদন থেকে পুনরুৎপাদনে সরে যাচ্ছে, যেখানে লাভ বেশি, দ্রুত সেখানে যাচ্ছে। সরকারি তথ্য নির্ভরযোগ্য নয়, তবু কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক। সবুজ বিপ্লব এলাকার অন্যতম, পাঞ্জাবে, মোট চাষ এলাকা কমছে। ১৯৯৮-৯৯তে, সে রাজ্যে মোট চাষ এলাকা (net down) ছিল ৪২৬৩৮৯৭ হেক্টর, মোট জমির ৮৪ শতাংশ। ২০০৬-৭এ, চাষ এলাকা কমে দাঁড়াচ্ছে ৪১৮৪২২৫ হেক্টরে, মোট জমির ৮৩.১৪ শতাংশ। ২০১৭-১৮য় আরও কমে, চাষ এলাকা ৪১২৩৫৯১ হেক্টর, ৮১.৯৩ শতাংশ। অন্যদিকে, ওই সময়কালের মধ্যেই, অ-চাষ এলাকা বাড়ছে। ১৯৯৮-৯৯এ, পাঞ্জাবে মোট অ-চাষ এলাকা ৩২৬৫২৪ হেক্টর, মোট জমির ৬.৪৮ শতাংশ। ১৯১৭-১৮য় তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৪৯৭৭০৫ হেক্টরে, মোট জমির ৯.৮৮ শতাংশ। উত্তরপ্রদেশ, সবুজ বিপ্লবের আর একটি এলাকা, সেখানেও এক ছবি। ২০০৬-৭এ, অ-চাষ এলাকা রাজ্যের মোট জমির ১১.২৯ শতাংশ। ২০১৭-১৮য় তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৩.০৮ শতাংশে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে লাগাতার চাষ এলাকা কমছে, অ-চাষ এলাকা বাড়ছে। ১৯৯৯-২০০০ নাগাদ, মোট চাষ এলাকা রাজ্যের মোট জমির ৬২.৯৭ শতাংশ, অ-চাষ এলাকা ১৮.৭৭ শতাংশ। ২০১৮-১৯এ, চাষ এলাকা কমে ৬০.৪০ শতাংশ, অন্যদিকে অ-চাষ এলাকা বেড়ে ২১.৬৮ শতাংশ।
একদিকে চাষজমির পরিমাণ কমছে, অন্যদিকে উৎপাদন বাড়ানোর চাপ। ফলে কম জমিতে বেশি ফসল ফলাতে হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন রাসায়নিক সার, নতুন প্রজাতির বীজ, আরও বেশি কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবহারে জমির দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনশীলতা তো কমছেই, দেখা দিচ্ছে বহুবিধ পরিবেশ সমস্যা। রাষ্ট্রের নতুন কৃষি আইনের পিছনে অবশ্য কাজ করছে মূলত পুঁজিবাজারের অর্থনীতি। দেশের মোট উৎপাদন থেকে যে মূল্য সংযোজিত হয়, তাকে বলা হয় জিভিএ বা গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড। হালের কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, স্বাধীনতার পরপর, কৃষি ও সংযুক্ত ক্ষেত্র (তার ভিতর খনি, বন সব ঢোকানো আছে, কেন জানা নেই) থেকে দেশের মোট জিভিএ-র ৫৩.১৭ শতাংশ আসত। এই পরিমাণটা ক্রমশ কমতে থাকে। সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার প্রায় দু দশক পরে, ১৯৮২-৮৩ নাগাদ, সমস্ত ক্ষেত্রের মোট পরিমাণের সাপেক্ষে কৃষিক্ষেত্রের জিভিএ এসে দাঁড়িয়েছে ৩৭.৩০ শতাংশে। আরও কুড়ি বছর পর, পরিমাণটা আরও কমে ২৩.১১ শতাংশ। কমতে কমতে, ২০১৪-১৫ নাগাদ, ১৯.৫০ শতাংশ। এই সময়ে প্রত্যক্ষ চাষের, অর্থাৎ সমস্ত উৎপাদিত ফসলের মোট জিভিএ-র পরিমাণ মাত্র ১১.২ শতাংশ, ২০১৮-৯ নাগাদ আরও কমে তা ৯.৪। অর্থাৎ, মূল্য সংযোজন বা পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির নিরিখে, দেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব ক্রমশ কমছে, কমতে কমতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা জানা নেই। কৃষিক্ষেত্রে পুঁজির জোগান ও লগ্নি সুনিশ্চিত করার উপায়ও নেই। যেখানে লাভ বেশি ও দ্রুততর, পুঁজি সেদিকে গড়াতে বাধ্য। যথা, দেশের মোট জিভিএ-র সাপেক্ষে পরিষেবা ক্ষেত্র বা সার্ভিসেস সেক্টরের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বর্তমানে ৫৪ শতাংশ, যার ভিতর ২২ শতাংশ আসছে অর্থক্ষেত্র বা ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর থেকে। এ আলোচনায় এখানে ঢোকার অবকাশ নেই, শুধু বলে রাখা ভালো, শিল্প উৎপাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিং-এর হাল কৃষির তুলনায় বিশেষ ভালো নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ২০১১-১২ নাগাদ, শিল্প উৎপাদনের জিভিএ-র মোট পরিমাণ ১৭.৪ শতাংশ, ২০১৯-২০তে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫.১ শতাংশে। এ বছরের, অর্থাৎ করোনাকালের হিসেব পাওয়া গেলে তা আরও কমতে বাধ্য। লক্ষ্যণীয়, করোনাপর্বেও কৃষিক্ষেত্রের আয় বেড়েছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় সাতকাহন করে বলা হচ্ছে, ২০২০-২১এ, কৃষিক্ষেত্র বাড়ছে ৩.৪ শতাংশ, অন্য সব ক্ষেত্র যেখানে সঙ্কুচিত হয়েছে।
পুঁজির শেষ ধাক্কা
অর্থাৎ চাষবাস থেকে পুঁজিবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, চাষে পুঁজি হইহই করে ঢুকে পড়লেও, কৃষিউৎপাদনের মূল উপকরণ যা, জমি, আটকে আছে খণ্ড ব্যক্তিমালিকানায়, বহুক্ষেত্রেই পুরোনো সামন্তসম্পর্কে। কৃষিতে পুঁজি লগ্নি বাড়াতে হলে, জমি পরিবার ও ব্যক্তির হাত থেকে বার করে নিয়ে আসতে হবে। বাজারে আনতে হবে। উৎপাদিত ফসলের পুরোটাই বাজারে আনতে হবে, তার বৃহদংশ রাষ্ট্ৰ সমাজকল্যাণের দোহাই দিয়ে এফসিআই-এর গুদাম ও রেশনদোকানে পাঠাবে, তা চলবে না। প্রয়োজনমতো ফসল বদলাবে, চাষও। ধানগম চাষে লাভ না হলে, পাম অয়েল, সয়াবিন, ভ্যারেন্ডা (বায়ো ডিজেলের জন্য)। অথবা, নতুন যে আবহাওয়া বাজার তৈরি হচ্ছে, সেখানে বিক্রির জন্য বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত কার্বন টেনে নিতে পারে এমন গাছ, যথা ইউক্যালিপটাস, তার চাষ, অর্থাৎ কার্বনচাষ।
রাষ্ট্ৰ কী করবে?
আন্দোলনরত কৃষকরা চাইছেন, স্থিতাবস্থা। তাঁরা ভয় পাচ্ছেন, মাঝখান থেকে রাষ্ট্ৰ সরে গেলে বড় পুঁজি ও বড় কোম্পানির হাত থেকে জমি, চাষ কিছুই বাঁচানো যাবে না। যাবে যে না, পৃথিবীর সর্বত্র সে উদাহরণ ছড়িয়ে। প্রশ্নটা সেখানে নয়। খটকাটা এই, রাষ্ট্ৰ কেন কৃষকের পক্ষে দাঁড়াবে? রাষ্ট্রের সঙ্গে পুঁজির সম্পর্ককে বোঝা দরকার। নিওলিবরল, ফ্যাসিবাদী চরিত্রের রাষ্ট্ৰ পুরনো নিয়মে চলতে পারবে না, চাইবেও না, এক না যদি রাষ্ট্রের ভিতরকার ফাঁকফোকরগুলোকে যথেষ্ট বাড়ানো যায়। কৃষক আন্দোলনে ইতিমধ্যেই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, সংসদীয় গণতন্ত্র, হিন্দু জাতীয়তার বিরুদ্ধে শিখ জাতিসত্তা, জাঠ অস্মিতা ইত্যাদি দ্বন্দ্বমুখ সম্পৃক্ত, অন্যদিকে আন্দোলনের নেতারা ফিরে যাচ্ছেন সামন্তপ্রথার সামাজিকতায়, খাপপঞ্চায়েতে। যা ছিল তা কোথাও থাকে না, বিশেষ করে পুঁজিতন্ত্রে সমস্ত উৎপাদন ও ক্ষমতাসম্পর্ক নিরন্তর দ্রুত বদলাতে থাকে। বদলটা কেমন হবে, কিভাবে হবে, তা সবসময় পুঁজির হাতধরা থাকে না, সামাজিক আন্দোলনের চাপেও চালু অবস্থা বদলায়। এই মুহূর্তের চালু অবস্থা দ্বন্দ্বের, অনিশ্চয়তার।
নিওলিবরল পুঁজির বিরুদ্ধে রাষ্ট্ৰ সামন্তপ্রথার সামাজিকতায় সম্পৃক্ত কৃষকসমাজের পক্ষে দাঁড়াবে কি? না দাঁড়ালে কী হবে? এখনও অবধি যা চলছে, রাষ্ট্রের আচরণই বর্তমান আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, এমন মনে হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রচৌহদ্দির বাইরে এই আন্দোলন ইতিমধ্যেই এক ভিন্ন স্বয়ংশাসিত সামাজিক পরিসর নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে, নাহলে এতবড় একটা লড়াই এতদিন ধরে চালানো যেত না। সেই নির্মাণকে বাড়িয়ে, শক্তিশালী করে, ফ্যাসিবাদ ও নিওলিবরল পুঁজির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। উঠবেই যে, এক্ষুণি নিশ্চিতভাবে তা বলা যাচ্ছে না।