প্রকৃত ভারতবর্ষকে জেগে উঠতে দেখছি

সৌমিত্র দস্তিদার

 



গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, তথ্যচিত্রনির্মাতা

 

 

গত ২৪ তারিখ থেকে আমি সিংঘু বর্ডারে আছি। কৃষকদের প্রতিবাদস্থলের লাগোয়া একটা হোটেলেই মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করেছি। সিংঘু জায়গাটা পানিপথের কাছে। এখানে এসে দেখছি ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপরেই একটা বিশাল এলাকা জুড়ে তাঁবু খাটানো আছে। প্রায় আঠারো-কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে তাঁবুতে তাঁবুতে একটা অস্থায়ী টাউনশিপ তৈরি হয়েছে বলা যেতে পারে। একদিকে যেমন থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, অন্যদিকে গাড়ি-ট্রাক্টর রাখার জায়গা করা হয়েছে। অনেকেই রাতে নিজেদের ট্রাক্টরের মধ্যেই কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। আগুন জ্বালিয়ে নিজেদের উষ্ণ রাখছেন। রাতে প্রচণ্ড শীত। ২৪ তারিখ থেকেই দেখছি প্রচুর ট্রাক্টর প্রতিবাদস্থলে ঢুকছে, গাড়ি ঢুকছে, মোটরসাইকেল ঢুকছে৷ প্রচুর মানুষ পায়ে হেঁটেও আসছেন। প্রায় মেলার মতো পরিবেশ। এক পা চলার জায়গা নেই, তবে কিছুই বিশৃঙ্খল নয়। আন্দোলনের পাশাপাশি একদিকে বক্তৃতা হচ্ছে, একদিকে গান বাজছে, একদিকে নানা পোস্টার তৈরি হচ্ছে, কোনও তাঁবুতে আবার অস্থায়ী লাইব্রেরি তৈরি করা হয়েছে, কৃষকরা সময় কাটাতে সেখান থেকে বই নিয়ে পড়ছেন। এছাড়াও অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প আছে। লুধিয়ানা থেকে শীতবস্ত্র এসেছে। খুব অল্প দামে সেগুলো কৃষকদের বিক্রি করা হচ্ছে। এক পা অন্তর লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। মানুষ সেখানে লাইন দিয়ে বিনামূল্যে খাবার সংগ্রহ করছেন। আমি কালকে সেরকমই একটা লঙ্গরে লাইন দিয়ে রুটি আর ডাল খেলাম। গরম চা খেলাম। সব মিলিয়ে গোটা এলাকা জুড়ে একটা উৎসবের পরিবেশ। তা সত্ত্বেও এটা বুঝতে পারছি যে আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটা তীব্র জেদ আছে। তাঁরা ইতিমধ্যে প্রায় দেড়শো জন সহযোদ্ধাকে হারিয়েছেন। তাও তাঁরা মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, কারণ তাঁদের মতে তাঁদের আর কিছু হারাবার কিছু নেই। অনেক কৃষকের সঙ্গেই কথা বলেছি, তাঁরা বলছেন যে তাঁরা খালি হাতে আর নিজের গ্রামে ফিরে যেতে পারবেন না। দেওয়ালে ওঁদের পিঠ ঠেকে গেছে। মোদি সরকার এই কৃষি আইন ফিরিয়ে না নেওয়া অবধি এই জায়গা ছেড়ে তাঁরা যাবেন না৷

এবার আসি আজ সকালের ঘটনায়। আগেই বলেছি গত দুদিন ধরে এখানে মানুষ ও ট্রাক্টরের সংখ্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। থেকে থেকেই আওয়াজ উঠেছে— মোদি সরকার নিপাত যাক। কৃষক-মজদুর ঐক্যের সপক্ষে স্লোগান উঠছে। নিশ্চিতভাবেই নানা বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোকজন এখানে আছেন। তবে প্রতিবাদস্থলে সামগ্রিকভাবে একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে, একটা কোয়ালিশন, যেখানে এককভাবে কেউই এই আন্দোলনের নেতা নন। আজ সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটা থেকেই দেখছি প্রতিবাদস্থলে যে কেন্দ্রীয় মঞ্চ আছে সেখানে নানা কর্মসূচি চলছে। বক্তৃতার পাশাপাশি গান, কবিতাপাঠ হয়েই চলেছে। বিহার থেকে আইপিটিএ-র নাট্যকর্মীরা এসেছিলেন আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে ও পাশাপাশি কিছু পারফর্ম করতে। এইসব নানা অনুষ্ঠানের পর আজ সকাল বারোটা নাগাদ কৃষকদের র‍্যালি বেরোয়। সিংঘু বর্ডারের খুব কাছেই একটা পুলিশ ফাঁড়ি। র‍্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স সেখানে ব্যারিকেড করে রেখেছিল। কিন্তু এই ফোর্স বা পুলিস কর্মীরা কৃষকদের সঙ্গে কোনও সংঘাতে যাননি। কৃষকদের ট্র্যাক্টর নিজেরাই ব্যারিকেড সরিয়ে এগিয়েছে। আমি নিজেও একটা ট্রাক্টরে ছিলাম। পুলিশকর্মীরা চুপচাপ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে দেখেছেন৷ প্রায় সতেরো কিলোমিটার পথ ট্র্যাক্টরের সঙ্গে গিয়ে আমি দেখলাম পুলিশের মধ্যে সেই বিরক্তি বা বাধা দেওয়ার ইচ্ছা কোনওটাই তেমন নেই। বরং প্রচুর প্রাক্তন পুলিশকর্মী ও মিলিটারি অফিসাররা যেমন মেজর র‍্যাঙ্কের অফিসার নিজের ব্যাচ পরেই প্রতিবাদস্থলে এসেছেন ও আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছেন। যে পুলিশকর্মীরা ব্যারিকেড রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন, তারা কেউ পাঞ্জাবি নন, তবে অনেকেই হয়তো উত্তরপ্রদেশের মানুষ, কেউ কেউ হয়তো কৃষক পরিবার থেকেই এসেছেন। তাই আজ তাঁরা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হলেও কৃষকদের প্রতি তাঁদের চোখেমুখে সম্ভ্রমই দেখেছি।

অন্য বর্ডার অঞ্চল থেকে কিছু বিক্ষিপ্ত হিংসার খবর আসছে, লালকেল্লায় নিশান উড়িয়েছে একটি গোষ্ঠী, কিন্তু সিংঘু বর্ডারে বা দিল্লি শহরে ঢোকার আগে অবধি রাস্তায় আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কৃষকরা ব্যারিকেড সরিয়ে এগিয়ে গেছেন। পুলিশ বাধা দেয়নি। বাধা দিয়েও অবশ্য কিছু করা সম্ভব ছিল না কারণ কাল থেকে প্রতি আট সেকেন্ডে একটি করে ট্র্যাক্টর প্রতিবাদস্থলে এসেছে। ফলে কৃষকদের নিজেদেরই প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে প্রায় দুই-তিন লক্ষ ট্রাকটরের বিশাল বাহিনী আজ কুচকাওয়াজে নেমেছে। প্রতি ট্র্যাক্টরে তিনজন করে লোক ধরা হলে র‍্যালিতে লোকসংখ্যা প্রায় ছ লাখ। মোদি সরকার যতই নানাভাবে ছলেবলে কৃষকদের নিরস্ত করার চেষ্টা করুন না কেন, তা কৃষক ও তাঁর পরিবারের ক্রোধে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। এঁদের মধ্যে একটা জেদ বা আত্ম-অভিমান কাজ করছে যে এ জায়গা তাঁরা কখনওই এই জায়গা ছাড়বেন না। এবার সিংঘু ছাড়াও টিকরি ও গাজিপুরের সীমান্তেও এত বড় আকারে না হলেও অন্যান্য কৃষকরা ট্র্যাক্টর র‍্যালি করেছেন। টিকরি সীমান্তের ওখান থেকে অবশ্য কিছু সংঘর্ষের খবর এসেছে। একটি ছেলে আজ মারা গেছে। লালকেল্লার মাথায় নাকি কেউ ধর্মীয় নিশান লাগিয়েছেন। এইসব খবর আসছে। কিন্তু এত বড় একটা গণআন্দোলনের সমস্ত এলিমেন্ট নেতৃত্বের কথামতো চলবেন, এটা হয় না। বরং এখন এই ঘটনাগুলিকে সামনে রেখে মোদি সরকার কৃষক আন্দোলন রুখে দেওয়ার একটা মরিয়া চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যে সিংঘু ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, অমিত শাহ নাকি জরুরি মিটিং-এ বসেছেন। আজ রাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ ইন্টারনেট বন্ধ করার লক্ষণটা খুব একটা ভালো নয়। কাল থেকে কার্ফু জারি হলেও হতে পারে। একটা আঘাত আসতে পারে এটা কৃষকরাও বুঝছেন বলে মনে হয়। তারা নিজেরাও জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট ব্যারিকেড তৈরি করছেন। অবশ্য এই সতর্কতার জায়গাটা আগেও ছিল। কিছু মুসলিম গোষ্ঠী এই মঞ্চে এসে কৃষকদের আন্দোলনকে সমর্থন করে গেছেন। তাঁদের স্বাগত জানিয়েও ইচ্ছে করেই তাঁদেরকে মূল মঞ্চে খুব বেশি জায়গা দেওয়া যায়নি, কারণ এমন সম্ভাবনা ছিল যে সরকারপক্ষ এই আন্দোলনের সঙ্গে আইএসআই ও পাকিস্তানের যোগ খুঁজে বের করে ফেলবে। যাই হোক, আমি এখন অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি রাত আটটার সময় সিংঘু বর্ডার থেকেই কথা বলছি, যদিও জানি না আগামীকাল সকালে পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে৷ জানি না একটু পরে আমার ফোনটাই অফ হয়ে যাবে কিনা। অথবা এখানে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবে কিনা। র‍্যাফ বা মিলিটারি নামবে কিনা। আজ কৃষক র‍্যালির পর সরকারের তরফ থেকে একটা পালটা অবরোধ যে শুরু হয়ে গেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

আজকের এই র‍্যালিতে থেকে যেটা সবচেয়ে বেশি করে মনে হচ্ছে যে এতদিন আমরা শুনতাম ব্যবস্থার শিকার হয়ে এতজন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, আজ দেখছি কৃষকরাও সরকারকে পালটা লড়াই দিতে জানেন। এবং এটাও বলার যে আজকে তাঁরা এই লড়াইয়ে আম-জনতার প্রতিনিধিত্ব করছেন। আজকের লড়াইটা কর্পোরেট বনাম আম-জনতার, রাষ্ট্র বনাম আম-জনতার। এ এমনই এক গণআন্দোলন যা যেকোনও সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আমি তেভাগা দেখিনি, তেলেঙ্গানা দেখিনি, নকশালবাড়ির সময়েও আমি খুব ছোট। কিন্তু আজ এই সিংঘু সীমান্তে দাঁড়িয়ে আমি অতীতে ভারতবর্ষের সমস্ত কৃষক আন্দোলনের আঁচ টের পাচ্ছি। এমনকি এই আন্দোলন প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক কারণ তা আবার কৃষক-শ্রমিকের এক হওয়ার বার্তা দিচ্ছে। ইউরোপ, কানাডা ও লাতিন আমেরিকার নানা দেশ থেকে এই আন্দোলনের পক্ষে সমর্থনের খবর আসছে। কারণ কর্পোরেটের হাতে তাদের মার খাওয়াটা আর আমাদের দেশের কৃষকদের মার খাওয়াটা আলাদা নয়। এই আন্দোলন আধুনিক কারণ এই কৃষকেরা কর্পোরেট ও দালাল রাষ্ট্রের গ্রাস থেকে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার কথা বলছেন। এ লড়াই প্রকৃত অর্থেই মাটির লড়াই। পঞ্জাবের কৃষক যারা একসময় সবুজ বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন, তারা আজ বুঝতে পারছেন যে তা তাঁদের জমি, সার, বীজধান ও দেশীয় প্রযুক্তিকে নষ্ট করে দিয়ে আজকের পরিস্থিতিতে এনে ফেলেছে। অতএব আজ দিল্লি সীমান্তের এই কৃষক আন্দোলন নানা দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। পুঁজির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের আন্তর্জাতিকতাকে এই আন্দোলন ছুঁয়ে ফেলেছে। অতএব এই কৃষক আন্দোলন কোনও বিচ্ছিন্ন লড়াই নয়। আজ আমার এই লেখা যদি অনুবাদ হয়ে কানাডার কোনও কৃষকের কাছে বা শ্রমিকের কাছে পৌঁছয়, তাহলে সে কিন্তু এই আন্দোলনের পাশে থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, আজ এই কৃষক আন্দোলন আমার সমস্ত বিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তিগত পাওয়া না পাওয়ার বোধ, সবকিছুকে ধুয়েমুছে এক বড় কিছুর সামনে আমায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আজ প্রকৃত ভারতবর্ষকে চোখের সামবে জেগে উঠতে দেখলাম।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...