অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
অবাক করার মতো বিষয় হল, এতদসত্ত্বেও বাঙালির সংগঠিত প্রতিবাদ লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিক্ষিপ্ত কিছু রাজনৈতিক/সামাজিক সংগঠন বিচ্ছিন্ন কিছু কর্মসূচি নিলেও, ভাষা তথা সামাজিক অস্তিত্বের পরিসরে এই সুদূরপ্রসারী সংকটের বিষয়ে বাঙালি কি আদৌ ভাবিত আজ?
ইংরেজি শব্দ ‘fearmongering’। সার্থক বাংলা প্রতিশব্দ জানা নেই আমার। তবু আজকের এই নিবন্ধকে অনেকেই ‘fearmongering’ বলে ভেবে নিতে পারেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে আমার কোনও যুক্তি নেই। পরিস্থিতি কেবলই আশঙ্কার জন্ম দেয়। মাতৃভাষাকে বাঙালি যেভাবে এতকাল অবহেলা করে এসেছে, এতদিন যাবৎ তা কেবল পরিহাস ও তাচ্ছিল্যের আলোচনা-বস্তু হয়ে থাকলেও— বর্তমান অবস্থায় এই ভাষাগত আত্মঘাতের কারণে কেবল ভাষা নয়, বাঙালির সার্বিক জাতিগত অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আগ্রাসী, উগ্রপন্থী, ভাষা-কেন্দ্রিক প্রাদেশিক আন্দোলনের মাধ্যমেই কেবল যে সেই সংকট থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। কারণ এই বিদ্বেষের শিকড় বহুদিন ধরে, বহুমাত্রিক গভীরতায় ছড়িয়েছে। সেই কারণেই ‘fearmongering’।
এ যেন বাংলা ও বাঙালির বিপরীতে ১৯৪৫-এর ইহুদি-গণহত্যার সমতুল এক ঘৃণার পরিবেশ! অনেকদিনের প্রচেষ্টায়, অতি সন্তর্পণে গড়ে তুলতে চাওয়া এক জঘন্য প্রয়াস; যা আজ প্রায় এক প্রাথমিক সাফল্যের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এতদসত্ত্বেও বিষয়টিকে নিয়ে বৃহত্তর জনমানসে ততটাও সামাজিক প্রতিক্রিয়া অথবা প্রতিবাদ লক্ষ করা যাচ্ছে না। নিছক নির্বাচনমুখী রাজনীতির বাইরেও এই পরিস্থিতির যে এক দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অভিঘাত রয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলি তো বটেই— সামাজিক অন্যান্য সংগঠন অথবা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, তাদের কারও তরফেই এই বিষয়টির সম্পূর্ণ গুরুত্ব অনুধাবন করে সেই মোতাবেক জোরালো ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ব্যক্ত করার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ আরও একবার নিজেদের সম্পর্কে বহুল-ব্যবহৃত এই বিশেষণটিকেই সার্থক প্রয়োগ হিসেবে প্রমাণের পথে অগ্রসর হচ্ছে।
সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ওড়িশায় ৪০০ জনেরও বেশি বাঙালি অভিবাসী শ্রমিককে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে হেনস্থা, ও তার পাশাপাশি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার তরফে দেওয়া এক সরাসরি হুমকি, যে হুমকির মাধ্যমে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, “জনগণনার সময়ে অসমের যে সমস্ত মানুষ কথ্যভাষা হিসেবে বাংলাকে বেছে নেবে, তারাই আখেরে ‘বিদেশি’-চিহ্নিতকরণের কাজ আপনা থেকেই সহজ করে দেবে।” অর্থাৎ ‘বাংলাভাষী = বাংলাদেশি = রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী ও মুসলমান’, এই অতিসরলীকরণের সূত্রেই যে কার্যত অঘোষিত সরকারি সিলমোহর পড়তে চলেছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্গত একটি অঙ্গরাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান প্রকাশ্য জনসভায় তা ঘোষণা করতেও কোনওরকম অস্বস্তি বোধ করছেন না। ২০১৪-পরবর্তীতে এই অতিসরলীরণের সূত্রই গোয়েবলসীয় দক্ষতায় গো-বলয়ের ভারতে ক্রমশ বিকশিত হয়ে আজ প্রায় গোটা দেশেই মারণ-ক্যানসারের সমতুল এক চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে। রাজধানী দিল্লিতেও এমন অতিসরলীকরণের প্রভাব দেখা গেছে। পাশাপাশি এই সময়েই নীতি আয়োগের সরকারি রিপোর্টে নির্দেশক মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তে বিহার রাজ্যের মানচিত্রের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এ কি কেবলই গয়ংগচ্ছতা, নাকি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বাংলাকে সম্পূর্ণ এক আলাদা, ‘অপর’ সত্তা হিসেবে উল্লেখ ও অনুধাবনের সুপ্ত বাসনাই ক্রমশ অবচেতনে সংক্রামিত হয়ে এখন তা ক্রমশ প্রকাশ্য ক্রিয়াকর্মেও নির্লজ্জভাবে প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে?
২০১৪-পরবর্তীতে সামাজিক মাধ্যম দৈত্যদের (social media troll) দাপাদাপির কারণে প্রথম শুরু হয়েছিল মেধার অবমাননা। বাংলা তথা বাঙালির বিরুদ্ধে সেই অস্ত্রেই গো-বলয়ের অনগ্রসর অন্ধ-ভক্তেরা আক্রমণ শানিয়েছিল। সামাজিক মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ‘বাক’-স্বাধীনতার দাপটে ক্রমশ মেধার পরিসরই সঙ্কুচিত হয়েছে। মেধার প্রতি স্বাভাবিক সম্মান অপসৃত হয়েছে। সেই জায়গা নিয়েছে, অল্প-সংখ্যক মেধাবী জনসংখ্যার বিপরীতে অযুত-সংখ্যক মধ্য তথা নিম্ন-মেধার মানুষের ‘গণতান্ত্রিক’, প্রায় অশালীন এক ‘স্বাধীনতা’র উদযাপন। বাঙালিদের বিরুদ্ধে অবাঙালি (বিশেষত হিন্দিভাষী) মানুষের যে বিদ্বেষ, কারণ খুঁজলে দেখা যাবে সেই ঘৃণার উৎসেরও অনেকটাই সেই মেধাগত পরিসরেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে। অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই, আজও, এখনও, মেধার পরিসরে সারা পৃথিবীর বিচারে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যগুলির তুলনায় বাংলার স্থানই সর্বাগ্রে। একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুসারে এই তথ্যকে মান্যতা দেওয়া চলে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অধিকাংশ হিন্দিভাষী ‘ভক্তেরই’ মনোভাব এমন, “বাঙালি তো খেটে পয়সা কামায় না, তাই দুধ-পানির জ্ঞান নেই তাদের। তারা আদর্শের গজদন্তমিনারে বসবাস করে অভ্যস্ত।” এই অনায়াস তাচ্ছিল্যই ক্রমশ কেন্দ্রীয় শাসকদলের আইটি-দৈত্যদের প্রচারের কল্যাণে এক বিকৃত বাংলা-বিদ্বেষের রূপ পরিগ্রহ করেছে। যার কারণেই তৈরি হয়েছে ‘বাংলাভাষী = বাংলাদেশি = রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী ও মুসলমান’ তত্ত্বের সরলীকরণ। ‘মেধাজীবী’র পরিচয়ে ব্যক্তি-পরিসরে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ঘটনার, ক্রমশ বিবর্তন ঘটেছে ভাষাগত বিদ্বেষের চরম সামাজিক অভ্যাসের ঘটনায়। এই সামাজিক অভ্যাসই একদিন যে ইহুদি-বিদ্বেষের সমতুল বাঙালি-বিদ্বেষের জন্ম দেবে না, এই আশঙ্কাকেও আজ আর উড়িয়ে দেওয়া চলে না কোনওভাবেই।
অবাক করার মতো বিষয় হল, এতদসত্ত্বেও বাঙালির সংগঠিত প্রতিবাদ লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিক্ষিপ্ত কিছু রাজনৈতিক/সামাজিক সংগঠন বিচ্ছিন্ন কিছু কর্মসূচি নিলেও, ভাষা তথা সামাজিক অস্তিত্বের পরিসরে এই সুদূরপ্রসারী সংকটের বিষয়ে বাঙালি কি আদৌ ভাবিত আজ? মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালি বহুকাল যাবৎ যে চূড়ান্ত অনীহা, কেবল অনীহাই নয় বোধহয়— প্রায় ‘অশ্রদ্ধা’র মনোভাব দেখিয়ে এসেছে, সেই বাঙালি কি আদৌ কোনওদিন নিজেদের সামাজিক অস্তিত্ব/পরিচয় ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা অনুভব করবে? কিছুদিন আগেই ‘জাতীয়’(!) মঞ্চে বাংলার এক জনপ্রিয় অভিনেতা (যাঁর বাংলা উচ্চারণ নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো বোধহয়), বাংলা ভাষা কানে শুনে যে ভয়াবহ গা-গুলুনি প্রতিক্রিয়ায় নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন, সেই নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে কিঞ্চিৎ তোলপাড় হয়েছিল বটে— কিন্তু অনেকেই এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিনেতার ক্ষমা চাওয়ার পরে পরেই তাঁর সমর্থনে আবেগমথিত স্মৃতিচারণে গা ভাসাতে দেরি করেননি। সিঙ্গল-স্ক্রিন বাঁচিয়ে রাখতে সেই অভিনেতার একের পর এক হিট সিনেমার কথা অনেকেই উল্লেখ করেন বটে, অনেকে এ যুক্তিও দেন— সাধারণ গ্রামবাংলার দর্শক নাকি ‘ওই ধরনের ছবি’ দেখতেই অভ্যস্ত, অথচ এর বিপরীতে কেউ কিন্তু এ-কথা উল্লেখের চেষ্টা অবধি করেন না— গ্রামবাংলার মানুষের রুচি আমরা শহরের বোদ্ধারাই কি কেবল ‘ওই ধরনের ছবি’তে সীমাবদ্ধ রেখেছি, নাকি গত বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ বছরে আমাদের ‘ওই ধরনের ছবি’র ঊর্ধ্বে আর কিছু করা সম্ভব হয়নি বলেই আমরা ‘গ্রামবাংলা’কে সামনে রেখে নিজেদের মধ্যমেধার বেসাতি চালিয়ে গিয়েছি?
নিজেদের দিকে আঙুল তোলার সময় কি আমাদের এখনও আসেনি? ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ হয়ে আর কত প্রজন্মই বা আমাদের বেঁচে চলতে হবে, আজ কেউ কি সে প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারেন?

