Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পুষ্টির ডাল এত মহার্ঘ্য কেন?

দেবাশিস মিথিয়া

 


ডাল এত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এতদিন দেশের সরকার ডাল উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করেনি। নিজের দেশের চাহিদা মেটাতে তাই এখন হিমসিম খাচ্ছে। ভারতে উৎপাদিত ডালে বড়জোর আট মাস চলে, বাকি চার মাসের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় বিদেশের দিকে। দেশের চাহিদার তুলনায় ডাল উৎপাদনের এই ঘাটতির কারণেই মূলত ডালের দাম আকাশছোঁয়া

 

বিশ্ববাসীর কাছে ডালের অপরিসীম গুরুত্ব তুলে ধরতে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব ডাল দিবস’ পালন করে আসছে। ২০২৫ সালের বিশ্ব ডাল দিবসের থিম— “ডাল: কৃষিখাদ্য ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনা (পালসেস: ব্রিঙ্গিং ডাইভার্সিটি টু অ্যাগ্রিফুড সিস্টেম্‌স)।” ডাল কেবল আমাদের খাদ্যতালিকায় নতুনত্ব আনে না, বরং এটি সুষম পুষ্টিরও জোগান দেয়। সুষম পুষ্টির সাহায্যে একটি সুস্থায়ী ও পুষ্টিকর ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হলে কৃষিক্ষেত্রে ডালের উৎপাদন বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। এই পরিপ্রেক্ষিতে, ভারতের মতো কৃষিপ্রধান দেশে ডালচাষের গুরুত্ব যে কতখানি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এক সময় ডাল ছিল প্রান্তিক মানুষদের ভাতের সঙ্গী, স্বল্প খরচে পুষ্টির উৎস। অভাবের সংসারে মাছ-মাংসের বিকল্প ছিল এই ডাল। আজ সেই ডালই দরিদ্রের হেঁশেলে মহার্ঘ্য বস্তু। অথচ স্বাস্থ্যসুরক্ষায় এর ভূমিকা অপরিসীম। ভারতের বিভিন্নপ্রকার ডালে প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মতো জরুরি পুষ্টি উপাদান পরিপূর্ণ। মুগডাল হজমে সাহায্য করে, হৃদরোগ প্রতিরোধে রাজমা, তুর (অড়হর) ডাল খনিজ পদার্থের যোগানদাতা, মুসুর ও উরদ (মাসকলাই) ডাল প্রোটিনে সমৃদ্ধ, আর চানা (ছোলার ডাল) রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা নেয়। আজকের দিনে যখন ঘরে ঘরে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যসমস্যার প্রকোপ বাড়ছে, তখন ডাল-জাতীয় খাবার সুস্থ জীবনের সহায়ক হতে পারে।

শুধু স্বাস্থ্যই নয়, পরিবেশরক্ষাতেও ডালের চাষ অন্যান্য কৃষিপণ্যের তুলনায় অনেক এগিয়ে। ডালের নাইট্রোজেন-ফিক্সিং বৈশিষ্ট্য মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, ফলে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন কম হয়। এতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমে, পরিবেশ দূষণ অনেকটা কমানো যায়। ডাল, ধান ও গমের মতো জল-নিবিড় নয় তাই ডালচাষে অনেক কম জলের প্রয়োজন হয়, যা ভূগর্ভস্থ জলের অপচয় রোধে সাহায্য করে। মধ্যপ্রদেশের ডাল-চাষি বালচন্দ্র আহিরওয়ার এক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি দেখিয়েছেন, গমে যেখানে ৩ থেকে ৪টি সেচ লাগে, সেখানে ডালে একটি সেচই যথেষ্ট। তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন যে ডালচাষ শুধু অর্থনৈতিকভাবেই লাভজনক নয়, পরিবেশের জন্যেও কতটা উপকারী, বিশেষ করে জল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। এছাড়াও, আন্তঃফসল ও কভার ফসল হিসেবে ডালের ব্যবহার ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ ও রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করে, কীটনাশকের ব্যবহার কমায়। এতে কৃষি ও মাটির স্থায়িত্ব বাড়ে। শস্য আবর্তনে (ক্রপ রোটেশন) ডাল যোগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়। যা সামগ্রিকভাবে একটি টেকসই এবং পরিবেশ-বান্ধব কৃষিব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য।

ডাল এত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এতদিন দেশের সরকার ডাল উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করেনি। নিজের দেশের চাহিদা মেটাতে তাই এখন হিমসিম খাচ্ছে। ভারতে উৎপাদিত ডালে বড়জোর আট মাস চলে, বাকি চার মাসের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় বিদেশের দিকে। দেশের চাহিদার তুলনায় ডাল উৎপাদনের এই ঘাটতির কারণেই মূলত ডালের দাম আকাশছোঁয়া।

 

ডালের দামের গতিপ্রকৃতি

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশীয় উৎপাদন কম হওয়ায়, ২০১৪-২০১৬ সালে দামের বড়সড় বৃদ্ধি দেখা যায়। এরপর উৎপাদন বাড়লে ২০১৬-২০১৯ সালে দাম কিছুটা স্থিতিশীল হলেও, কিছু ডালের দাম বাড়তেই থাকে। ২০১৯ থেকে ফের দাম বাড়তে শুরু করে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম থাকায়। অন্যদিকে, ২০২৩ সালের শেষদিক থেকে চলতি বছরের শুরু পর্যন্ত দামের ক্ষেত্রে মিশ্র ছবি দেখা গেছে। খরিফ ডালের উৎপাদন এবং আমদানির ফলে কয়েকটি ডালের দাম কিছুটা কমলেও, সামগ্রিকভাবে দাম নিয়ন্ত্রণে নেই।

ডালের দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার আমদানির পথ বেছে নেয়। এর ফলে ২০২৪ সালে ডাল আমদানির পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় এক লাফে অনেকখানি বৃদ্ধি পায়, যা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে ভারত ৬.৬৩ মিলিয়ন টন ডাল আমদানি করেছে, যেখানে ২০২৩ সালে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ৩.৩১ মিলিয়ন টন। সরকার ডালের আমদানি শুল্ক তুলে নেওয়ার পর এই আমদানি আরও বাড়ে। আমদানিকৃত ডালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল হলুদ মটর, প্রায় ৪৫ শতাংশ। এছাড়াও, ছোলার ডালের আমদানি বেড়েছে চারগুণেরও বেশি, উরদের ২৮ শতাংশ এবং মুসুরের ৫৩ শতাংশ।

 

আমদানি নিয়ে বিতর্ক

ডালের এই আমদানি বৃদ্ধি নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। ইন্ডিয়ান পালসেস অ্যান্ড গ্রেইনস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিমল কোঠারি স্পষ্ট ভাষায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, “ভারতে হলুদ মটরের এই বিপুল আমদানি দেশীয় ডালচাষের জন্য অশনিসঙ্কেত। প্রোটিনসমৃদ্ধ হলুদ মটর আজ গমের চেয়েও সস্তা হয়ে গেছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।”

অপরদিকে, সরকারের যুক্তি, দাম নিয়ন্ত্রণ করতেই এই আমদানি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে হলুদ মটর তুলনায় সস্তা। সরকার যাই যুক্তি দেখাক, অত্যধিক আমদানির ফলে পাইকারি বাজারে হলুদ মটরের দাম কমে গেছে। এর ফলে মটরচাষিরা তার ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন না এবং ভবিষ্যতে চাষে উৎসাহ হারাতে পারেন। দীর্ঘমেয়াদি দাম স্থিতিশীলতার জন্য দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং একটি সুচিন্তিত আমদানি নীতি তাই অপরিহার্য।

 

ডালচাষে রাজ্যভিত্তিক সমস্যা

যুক্তি-পাল্টা যুক্তি চলতেই থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, দাম নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে আমদানির চেয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো অনেক বেশি জরুরি নয় কি? দেশের ডাল উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই কম। এর মূলে উৎপাদনশীলতার অভাব নাকি ডালচাষের অলাভজনকতা? নাকি অন্য কোনও সমস্যা?

অন্যদিকে, উত্তর প্রদেশের হামিরপুর অঞ্চলে সেচের সুবিধা থাকায় সুশীল রাজপুতের মতো কৃষকরা উন্নত জাতের অড়হর চাষ করে বেশি লাভবান হয়েছেন। তামিলনাড়ুর ভিলুপুরমের কৃষকরা বীজ হাবের মাধ্যমে উন্নত মানের বীজ তৈরি করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অন্যদের কাছে সেই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় করছেন। এছাড়াও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে কিছু অংশে কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভালো ফলন পাচ্ছেন। দেশের যেসব অঞ্চলে কৃষক সমবায় সমিতিগুলি শক্তিশালী, সেখানকার কৃষকরা সরাসরি বাজারে ডাল বিক্রি করে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন।

 

ডালচাষের সার্বিক প্রতিকূলতা

জলবায়ু পরিবর্তনের খামখেয়ালিপনা, বাজারের সঙ্গে চাষিদের যোগাযোগের ঘাটতি এবং সরকারি সাহায্যের অভাব অনেক কৃষকের কাছেই ডালচাষকে এক ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় পরিণত করেছে। আর একটু খোলসা করে বললে অপ্রত্যাশিত খরা বা বন্যায় ফসল হারালে অধিকাংশ ছোট ও প্রান্তিক কৃষক সর্বস্বান্ত হন। বাজারের সঙ্গে ভালো সংযোগ না থাকায় অনেক কৃষক তাদের কষ্টার্জিত ফসল স্থানীয় ফড়েদের কাছে জলের দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। পরিবহন খরচ ও সংরক্ষণের অভাব তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা কেড়ে নেয়। সরকারি সাহায্য ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) সুবিধা অনেক সময় প্রান্তিক চাষিদের কাছে পৌঁছায় না। ক্রয়কেন্দ্রের অভাব ও দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তাদের হতাশ করে তোলে। রোগ ও পোকার আক্রমণ এবং উন্নত কীটনাশকের দুষ্প্রাপ্যতা অনেক কৃষকের ফলনকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়। দেশের ডালের জোগানে ঘাটতির কারণ তাই স্পষ্ট। কৃষিপ্রধান ভারতের ডালচাষে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে না পারা সত্যিই বিস্ময়কর।

 

আত্মনির্ভরতার জন্য সরকারি উদ্যোগ

এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করে ডালের উৎপাদন ও স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। ডাল উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে সরকার গবেষণা ও উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, পরিকাঠামো উন্নয়ন ও নীতিগত সহায়তার ওপর জোর দিয়েছে। আইসিএআর (ইন্ডিয়ান কউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ) ও অন্যান্য কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জলবায়ুসহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল ডালের নতুন জাত উদ্ভাবনের নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এনএফএসএম (ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি মিশন)-এর অধীনে কৃষকদের আধুনিক চাষপদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বীজ হাব স্থাপন ও কৃষি পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজও দ্রুতগতিতে চলছে। এমএসপি বৃদ্ধি ও সরকারি ক্রয়কে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। চলতি আর্থিক বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে ডালের উৎপাদন বৃদ্ধি ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য ছয় বছরের একটি নতুন মিশন ঘোষণা করা হয়েছে। এই মিশনের অধীনে তুর, উরদ ও মুসুরের ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হবে। ২০২৫-২৬ বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি আগামী চার বছরে এই তিনটি ডাল কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করার জন্য প্রস্তুত থাকবে।

 

শস্য বৈচিত্র্যকরণই ভরসা

পরিশেষে বলা যায়, ডালচাষের উৎপাদন বৃদ্ধি, মাটির স্বাস্থ্যসুরক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং কৃষকদের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য শস্য বৈচিত্র্যকরণ ঘটিয়ে ভারতীয় কৃষিতে ডালচাষকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন শস্যের সঙ্গে এর আবর্তনকে উৎসাহিত করা উচিত। সরকারের সঠিক নীতি ও কৃষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই ডাল উৎপাদনে ভারতকে স্বনির্ভর করতে পারে, যার মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে দেশবাসীকে ডাল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।