বাজেট ২০২৫: কৃষি-কর্মসংস্থান-কর-মুদ্রাস্ফীতি

দেবাশিস মিথিয়া

 


মোদি-৩ সরকারের এই বাজেট কৃষক, গরিব, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের কিছুই সুরাহা করবে না দেখাই গেল। তবে বাজেটে কি কিছুই নেই? আছে বৃহৎ পুঁজিপতি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ। যার জ্বলন্ত উদাহরণ, বিমায় ১০০ শতাংশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা। আর রয়েছে রাজনীতি। একদিকে সরকার বাঁচানো অন্যদিকে বিহারের আগামী নির্বাচনে ক্ষমতা দখল। যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য স্থির হয় ভোটরাজনীতির কথা মাথায় রেখে— সেই দেশে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যা দূর করে, কৃষি ও শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে দেশকে বিশ্বের অন্যতম উন্নত অর্থনীতি করে তোলা নিছক বাগাড়ম্বর

 

মোদি-৩ সরকারের দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ বাজেট ঘিরে আমজনতার প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। প্রচুর আশা-আশঙ্কার অঙ্কও কষেছেন দেশের মানুষ। কারণ গত বছর সরকার তৈরির পর যখন বাজেট পেশ হয় তখন আর্থিক বছরের ৪ মাস অতিক্রান্ত। ফলে খুব একটা কিছু হবে তেমন আশা জনগণের ছিল না। যাই হোক গতানুগতিক নিয়ম মেনেই ১ ফেব্রুয়ারি, সংসদে বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। এবারের ২০২৫ সালের বাজেটের ঘোষণায় কৃষি, করকাঠামো, নগরোন্নয়ন, বিদ্যুৎ-এর মতো ক্ষেত্রগুলিতে জোর দেওয়া হয়েছে। গত বাজেটেও কৃষিতে জোর ছিল। কিন্তু বাজেটের মজা হল— গত বাজেটে কী বলা হয়েছিল, তার কতটা পূরণ হয়েছে, সেসব নিয়ে মাথাব্যথা কম। বর্তমান বাজেটে কী পেলাম তা নিয়েই কাটাছেঁড়া চলে বেশি।

২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের জন্য কৃষি ও কৃষককল্যাণ মন্ত্রকের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ১.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। যার মধ্যে, ১.২৭ লক্ষ কোটি টাকা কৃষি ও কৃষককল্যাণ বিভাগে এবং ১০,৪৬৬ কোটি টাকা কৃষি গবেষণায় ব্যয় হবে। এবারের বাজেটের কৃষিসংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য ঘোষণা হল—

  • ‘প্রধানমন্ত্রী ধন-ধান্য কৃষি যোজনা’— এই প্রকল্পের লক্ষ্য কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, চাষে বৈচিত্র্য আনা এবং সুস্থায়ী কৃষিপদ্ধতি গ্রহণ করা। পঞ্চায়েত এবং ব্লকস্তরে সেচের উন্নতি-সহ ফসল কাটার পরে ফসল সংগ্রহের উন্নতি। চাষিকে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করা। এই প্রকল্পে ১.৭ কোটি কৃষক উপকৃত হবেন বলে ভাবা হচ্ছে।
  • তুলাচাষের উন্নতিতে ‘মিশন ফর কটন প্রোডাক্টিভিটি’ তৈরি হবে। পাঁচ বছরের মিশনটি তুলাচাষের উৎপাদনশীলতা বাড়াবে এবং উৎপাদনে স্থায়িত্ব ঘটাবে। তুলার মূল জাতগুলির উন্নতি করবে। কৃষকদের সর্বোত্তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া হবে— এতে তুলাচাষিদের আয় বাড়বে।
  • ছয় বছরের মধ্যে ডাল ও তৈলবীজ উৎপাদন বাড়িয়ে এই ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনা হবে। প্রথম চার বছর কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি (নাফেড এবং এনসিসিএফ) এই ডাল-তৈলবীজ উৎপাদনের সবটা সরকার নির্ধারিত এমএসপি-তে কিনবে।
  • কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ করা হয়েছে।
  • মহিলা কৃষকদের উন্নতির কথা বলা রয়েছে।

কৃষিসংক্রান্ত ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘এগ্রিকালচার ইজ অ্যান ইঞ্জিন অফ গ্রোথ’। তাই কৃষিতে এতটা জোর। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কৃষি ও কৃষকের জন্য সরকার অনেক কিছু করতে চাইছে। কিন্তু কৃষকের সমস্যা অনেক গভীরে। তার সমাধানের কোনও দিশা এই বাজেটে নেই। সেগুলির সমাধান করতে না-পারলে কৃষির উন্নতি সম্ভব নয়। দেশের প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর। তাদের আয় বাড়াতে না পারলে কৃষির হাত ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিছুতেই সম্ভব নয়। কৃষকদের দীর্ঘদিনের দাবি স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ এবং সেই দামে ফসল কেনার আইনি স্বীকৃতি— যা কৃষকদের আয় বাড়াবে। তা নিয়ে বাজেটে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। ফসলের উৎপাদন বাড়ানোয় জোর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু উৎপন্ন ফসল লাভজনক দামে বিক্রি করতে গেলে কৃষিবাজার সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। এছাড়াও কৃষি উপাদানের দাম কমলে ঘুরপথে (ব্যয় কমিয়ে) চাষির আয় বাড়ে। সেই দিকটিও বাজেটে অবহেলিত থেকেছে। অর্থাৎ সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতির দাম কমানোর কোনও উদ্যোগ নজরে পড়েনি। কৃষকের দীর্ঘদিনের দাবি কৃষিঋণ মকুব। সরকার সেদিকে দৃষ্টিই দেয়নি। কৃষক এমনিতেই ঋণে জর্জরিত, কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে তার ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর অর্থ তাকে আরও ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে দেওয়া। সরকার প্রথম চার বছর উৎপাদিত ডাল তৈলবীজ সবটা কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি সেই ডাল তৈলবীজ কিনে সরকার সংরক্ষণ করতে পারবে? দেশে মাত্র ৫ শতাংশ গ্রামে শস্য মজুত ভাণ্ডার রয়েছে। শস্য সংরক্ষণের অভাব আছে বলেই এতদিন পর্যন্ত সরকার ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে শুধু ধান গম কেনা হয়েছে। বাকি শস্য কেনা থেকে সরকার বিরত থেকেছে। মহিলা কৃষকদের উন্নতির ঘোষণা চমক ছাড়া কিছুই নয়। তাদের জন্য কী করা হবে বাজেটে নির্দিষ্ট করে বলা নেই। তবে ভারতে চাষের সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের বেশিরভাগই কৃষিশ্রমিক। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। মাত্র ১৩ শতাংশ মহিলার হাতে জমি রয়েছে, অর্থাৎ মহিলা কৃষকের সংখ্যা নামমাত্র। মহিলা কৃষকের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটাতে না পারলে কৃষির মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। তুলার উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে কিন্তু ১ কেজি তুলাচাষে প্রায় ২২৫০০ লিটার জল লাগে। প্রশ্ন হল, তুলাচাষে যে জল লাগবে তা কোথা থেকে আসবে! সেই কথা বাজেটে নেই। এমনিতেই ভূগর্ভস্থ জল বিপদসীমার নিচে নেমে রয়েছে। তুলাচাষ বাড়লে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে— সে-বিষয়েও সচেতনতা দরকার ছিল।

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সারা দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সাহায্য করার জন্য গৃহীত প্রকল্পে ২০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রাজ্যগুলির সঙ্গে যৌথভাবে একটি সামগ্রিক বহু-ক্ষেত্রিক গ্রামীণ সমৃদ্ধি এবং সহনশীল কর্মসূচি চালু করা হবে। যাতে কৃষিখাতে কর্মসংস্থানের সমস্যা দূর করা যায়। দক্ষতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমে গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। উদ্দেশ্য, গ্রামে পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ তৈরি করা। যাতে করে গ্রাম থেকে অন্যত্র কাজের খোঁজে যাওয়ার প্রয়োজন না পড়ে।

সরকার গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান বাড়িয়ে শহরে অভিবাসন বন্ধ করতে চাইছে, অথচ গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশের সবচেয়ে বড় সামাজিক প্রকল্প মহাত্মা গান্ধি ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট বা মনরেগা, যাকে চলতি কথায় আমরা ১০০ দিনের কাজ বলে থাকি— প্রকল্পটিকে এই বাজেটে অনেকটাই গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে। ২০২৫-২৬ আর্থিক বছরের জন্য এই খাতে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ৮৬,০০০ কোটি টাকা। গত বাজেটেও এটাই ছিল। অর্থাৎ বরাদ্দের পরিমাণ অপরিবর্তিত রইল। গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থান তৈরির ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পে পর পর দু-বছর একই পরিমান অর্থবরাদ্দের মানে সরকার প্রকল্পটিতে কম অর্থ বরাদ্দ করেছে। এই প্রকল্প গ্রামীণ অদক্ষ কর্মীদের প্রতি বছর ন্যূনতম ১০০ দিনের কাজ নিশ্চিত করে। ১০০ দিনের কাজে রাস্তা তৈরি, খাল কাটা এবং পুকুর খননের মতো স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টিতে বেশি জোর দেওয়া হয়। তাই এই প্রকল্প সম্পদ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে গ্রামের মানুষকে উপরের দিকে উঠে আসতে সাহায্য করে। উপরন্তু মনরেগা মহিলা, বৃদ্ধ এবং তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্তদের অর্থাৎ সামজের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের দারিদ্র্য এবং অনাহার থেকে বাঁচায়। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। প্রকল্পটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে একদিকে গ্রামীণ মানুষের বেকারত্ব ও অর্ধ-বেকারত্বের হার যেমন কমায়, তেমনই কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে কাজ পাওয়ার সুযোগও বাড়ায়। বছরের যে সময় চাষের কাজ থাকে না তখন মনরেগা গ্রামের মানুষের কাজের ব্যবস্থা করে শ্রমের বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। বাড়ির কাছাকাছি কাজ পাওয়া যায় বলে, শ্রমিকদের কাজের খোঁজে শহরে যাওয়ার প্রবণতা কমে। গ্রামীণ জনগণকে কাজের মাধ্যমে গ্রামে আটকে রাখার চলতি প্রকল্পে গুরুত্ব নেই, অথচ বাজেটে কাজ সৃষ্টির নতুন চমক! এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে এমন শ্রম-নিবিড় খাতগুলিতে জোর দেওয়া উচিত ছিল। চাকরির উপযোগী পাঠ্যক্রম তৈরি করে শিক্ষানবিশি প্রদানের জন্য শিল্প এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে মেলবন্ধনের কোনও চেষ্টা বাজেটে নেই। বাজারে প্রাপ্ত দক্ষ কর্মচারী ও প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মচারীর যে ফারাক তার বিস্তৃত ডেটাবেস অত্যন্ত প্রয়োজনীয়— সরকার সে-ব্যপারে নিশ্চুপ থেকেছে। সরকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর রুরাল ডেভেলপমেন্টের সমস্ত বরাদ্দ বন্ধ করে দিচ্ছে, বাজেটে এর জন্য কোনও টাকা বাড়তি নেই। এটা গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামীণ গরিবদের প্রতি সরকারের উদাসীনতারই প্রতিফলন।

তবে এটাও ঠিক অর্থমন্ত্রী বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে যে-ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে এখুনি যে কর্মসংস্থান বাড়বে না সে-ব্যপারে তিনি নিজেই নিশ্চিত। সেই কারণেই বাজেটে গিগ-কর্মীদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য সারা দেশে বিস্তৃত কাঠামো চালু করার প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রকল্পে ১ কোটিরও বেশি গিগ-কর্মীকে যুক্ত করার কথা বলেছেন।

এখন থেকে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপর কোনও আয়কর দিতে হবে না। সরকারি কর্মচারীদের অতিরিক্ত ছাড় ৭৫০০০ টাকা (স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন)। সবাই আহ্লাদে আটখানা। সরকার বলছে মানুষের হাতে বাড়তি অর্থ আসবে যা তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবে। বাজারে কার্যকরী চাহিদা সৃষ্টি হবে। যা অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। অর্থনীতিতে উন্নয়নের জোয়ার আসবে। প্রশ্ন হল দেশের মোট জনগণের মাত্র ৫.৮ শতাংশ আয়কর দাখিল করে। তার মধ্যে বাৎসরিক ১২ লাখ টাকা আয় করে সেই সংখ্যা হয়তো মোট জনসংখ্যার ২-৩ শতাংশ হবে। ১৪৪ কোটি জনগণের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই সামান্য। এরপরও যেটা বলার, মাসিক লাখ টাকা রোজগার করা মধ্যবিত্তকে আয়কর দিতে না হলে বাড়তি আয় তিনি হয় সঞ্চয় করবেন নচেৎ বাড়ি-গাড়ির মতন স্থায়ী সম্পদ কিনতে ব্যয় করবেন। সেই বাড়তি অর্থ বাজারের কার্যকরী চাহিদাকে খুব একটা প্রভাবিত করবে না। অর্থনীতির প্রাথমিক তত্ত্ব অনুযায়ী গরিব-নিম্নবিত্তের প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা মধ্যবিত্তের চেয়ে বেশি। ফলে অর্থনীতিতে সত্যিকারের কার্যকরী চাহিদা সৃষ্টি করতে চাইলে সরকারের উচিত ছিল গরিব-নিম্নবিত্তের হাতে অর্থের জোগান বাড়ানো।

ফেরা যাক মুদ্রাস্ফীতিতে। দেশে দীর্ঘ সময় ধরে মুদ্রাস্ফীতির হার খুব বেশি হয়ে রয়েছে। যা অর্থনীতির কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। ফলে গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনধারণ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষকে খাদ্যের জন্য ব্যয় করতে হয় তার আয়ের ৫০ শতাংশ। গরিব মানুষের সেই ব্যয় ৬০ শতাংশ। এই বাজেটে না আছে নিম্নবিত্তের আয়বৃদ্ধির ব্যবস্থা, না আছে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর চেষ্টা। মুদ্রাস্ফীতি না কমলে অন্য যে অসুবিধা তা হল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাবে না। সুদের হার না কমলে যতই এমএসএমই-তে ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হোক ঋণের চাহিদা বাড়বে না। এমএসএমই-র মাধ্যমে ভারতকে ‘গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ তৈরির স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জরুরি ছিল কৃষিমূল্য শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করা, উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহের খরচ কমাতে গ্রাম ও শহরের যোগাযোগের কাঠামোগত উন্নতি। খাদ্যদ্রব্যের হঠাৎ দাম বাড়া মোকাবিলা করতে এবং ফসল কাটার পরে ক্ষতি কমাতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। জেলা ও গ্রামপর্যায়ে কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা এবং গুদামগুলির একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা। যাতে সারা বছর ধরে একটি স্থির খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। ডিজিটাল মার্কেটের উন্নতি, যার মাধ্যমে কৃষকরা সরাসরি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং মধ্যস্থতাকারীদের উপর তাদের নির্ভরতা কমে। গণবণ্টন ব্যবস্থা জনগণের দরিদ্রতম অংশগুলিকে খাদ্য-মূল্যস্ফীতি থেকে বাঁচাতে পারে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলের মাধ্যমে সরবরাহ শৃঙ্খল পরিকাঠামোর আধুনিকীকরণ ঘটিয়ে কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ ঘটালে চাষি ফসলের দাম পেত, ক্রেতা সস্তায় খাদ্যদ্রব্য কিনতে পারত। বাজেটে এগুলি সব অবহেলিত থেকে গেল।

মোদি-৩ সরকারের এই বাজেট কৃষক, গরিব, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের কিছুই সুরাহা করবে না দেখাই গেল। তবে বাজেটে কি কিছুই নেই? আছে বৃহৎ পুঁজিপতি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ। যার জ্বলন্ত উদাহরণ, বিমায় ১০০ শতাংশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা। আর রয়েছে রাজনীতি। একদিকে সরকার বাঁচানো অন্যদিকে বিহারের আগামী নির্বাচনে ক্ষমতা দখল। এই বাজেট তাই বিহারের জন্য মাকানা বোর্ড, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফুড টেকনোলজি, পাটনা আইআইটি-র সম্প্রসারণ, পাটনা বিমানবন্দরের উন্নতি-সহ গ্রিন ফিল্ড এয়ারপোর্ট  তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে। ওয়েস্টার্ন কোশি ক্যানাল প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করেছে। যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য স্থির হয় ভোটরাজনীতির কথা মাথায় রেখে— সেই দেশে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যা দূর করে, কৃষি ও শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে দেশকে বিশ্বের অন্যতম উন্নত অর্থনীতি করে তোলা নিছক বাগাড়ম্বর।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...