বাজেটে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি

বিশ্বনাথ উদিত

 

মানবসম্পদ উন্নয়ন, কারিগরী দক্ষতা বৃদ্ধি— এসব কথার ফুলঝুরি ছুটছে, অথচ এই ক্ষেত্রে উন্নয়নে গভীরতা আনতে গেলে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সমস্ত স্তরের শিক্ষাতেই গভীর নজর দেওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র কয়েকটা আইআইটি, আইআইএম আর আইসার এত বড় দেশের প্রয়োজন মেটাতে পারে না, আর তাদের ছাত্র-শিক্ষকের মানও শেষপর্যন্ত নিচের স্তরে শিক্ষার মানের উপর নির্ভর করে। গত তিন দশকে আমাদের দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক দূর এগোলেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দরিদ্র মানুষের বাস এখানেই। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্কলহ শুরু হওয়ার আগে গত বছরই সে দেশ মাথাপিছু আয়ে আমাদের ছাড়িয়ে গেছে। এই তথ্যই দেখিয়ে দেয় আমাদের দেশের উন্নয়নের ভিত কত সঙ্কীর্ণ। বিভিন্ন সমীক্ষা দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান অত্যন্ত হতাশাজনক; তা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ কোথায়? বিদ্যালয়শিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দ (টাকার স্থির মূল্যে) গত বছরের প্রায় সমান যদিও জাতীয় আয় বেড়েছে, জনসংখ্যাও বেড়েছে। উচ্চতর শিক্ষাতেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ টাকার ক্রয়ক্ষমতার বিচারে বরাদ্দ বাড়েনি। রাজকোষ ঘাটতিকে বাগে রাখার যুক্তি দিয়ে এই কার্পণ্যের ব্যাখ্যা হয় না।

 

কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট হল পরিকল্পিত বার্ষিক আয়-ব্যয়ের রূপরেখা। সরকার নিজের আয়কে বেশ খানিকটা নির্ধারণ করতে পারে, এ-ব্যাপারে বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ববোধ একটা ভূমিকা পালন করে। জরুরি অবস্থায় তো বটেই, স্বাভাবিক অবস্থাতেও সামাজিক প্রকল্পগুলির তাৎক্ষণিক গুরুত্ববোধ অনুযায়ী ব্যয় বেশি-কম হতে পারে। অবশ্যই আয় বাড়ানোর উপায় হল করের বোঝা চাপানো যা করদাতার কাছে অস্বস্তিকর ও অপ্রিয়। স্বাভাবিকভাবেই জনপ্রিয়তাকামী সরকার এই ব্যাপারে সতর্ক থাকে। করের বোঝা যেহেতু অপ্রিয়, রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা তাই কোনও-না-কোনও গোষ্ঠীকে অখুশি করে। অথচ যদি না আপন গতিতে রাজস্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে— যেমন জাতীয় আয় যখন দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে করের হার না বাড়িয়েই ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আদায় হতে থাকে— সরকারকে অনেক সময়ই অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার, মুদ্রার অপর পিঠের মতো, কোনও গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য করের ভার কমানো যেতে পারে। পার্লামেন্টে সুস্থ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ না থাকলে সরকার খেয়ালখুশিমতো এসব কাজ করতে পারে।

ব্যয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যয় বিশেষ গোষ্ঠীকে খুশি করে। তাই সাধারণত সরকার সব গোষ্ঠীকে একই সঙ্গে খুশি করতে পারে না, যদিও দ্রুত-বর্ধমান রাজস্বের ভাণ্ডার থাকলে একসঙ্গে অনেক গোষ্ঠীকেই খুশি করা যায়। এ-কথাও মনে রাখতে হবে যে ইচ্ছা থাকলেই, এমনকি টাকা থাকলেও, নির্ধারিত পরিমাণ ব্যয় করা সম্ভব নাও হতে পারে। যেমন রাস্তা তৈরি করার জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে হয়; ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কাজটা কঠিন। তাছাড়া সমস্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রেই বিভিন্ন অংশের কাজের মধ্যে সমন্বয় করতে হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই নির্ধারিত পরিমাণ টাকা খরচ করা যায় না, বাজেটে পূর্ববর্তী বছরের সংশোধিত ব্যয়ের হিসাব দেখলেই তা নজরে আসে। সঠিক উদ্দেশ্যে নির্ধারিত টাকা খরচ করতে না-পারা তাই সবসময় টাকার জোগানের অভাবই বোঝায় না, বহুক্ষেত্রেই তা সদিচ্ছা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার অভাব নির্দেশ করে।

তাহলে এই বছরের বাজেটকে আমরা কীভাবে বিচার করব? সরকার কোন গোষ্ঠীকে খুশি করবে, কোন খাতে কত ব্যয়বরাদ্দ করবে তা তার রাজনৈতিক ও আর্থিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। সেটা বুঝতে হলে দেখা যাক আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি কী, কী করা সম্ভব ছিল আর কী করা হল।

প্রাক-বাজেট অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে গত সাত বছর ধরে (কোভিডের দু-বছর বাদ দিয়ে) আমাদের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের একটু ওপরে স্থির আছে। এটা হতাশাজনক নাকি উৎসাহব্যঞ্জক তা নির্ভর করে আমরা কী চাই তার উপরে। যে উঁচু পাহাড়ে উঠতে চায় সে বেস-ক্যাম্পে পৌঁছে সাফল্যে আত্মহারা হয় না। আমরা নাকি সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধিশীল দেশ! একজন শিশুর যেভাবে প্রতি বছর ওজন বাড়ে তা তো প্রাপ্তবয়স্কের হয় না। সেরকমই উন্নত দেশ অনুন্নত দেশের মতো দ্রুত বাড়ে না। আমাদের নিজেদের তুলনা করার সবথেকে উপযুক্ত দেশ হল চিন। সে-দেশ আমাদের প্রতিবেশী, মাত্র চার দশক আগেও আমাদের সমতুল্য ছিল, এখন বহুদূর এগিয়ে গেছে শিক্ষায়, সামরিক ও আর্থিক শক্তিতে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তার আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল আমাদের বর্তমান হারের প্রায় দেড়গুণ। তাই এখন তার জাতীয় আয় (মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার সমতার বিচারে) আমাদের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ। চিন যদি এখনকার মতোই এগোতে থাকে তাহলে আগামী দুই দশকে চিনের আর্থিক ক্ষমতার ধারে-কাছে পৌঁছতে হলে আমাদের বৃদ্ধির হার অনেকটা বাড়াতে হবে। এখন থেকে দুই দশক আগে আমরা সেভাবেই বাড়তে শুরু করেছিলাম, কিন্তু সে-বৃদ্ধির হার আমরা ধরে রাখতে পারিনি, এটা হতাশাব্যঞ্জক।

সেই উন্নতির পথে ফিরে যেতে হলে চাই পরিকাঠামোয় ব্যাপক বিনিয়োগ, মানবসম্পদের প্রতি যত্নবান হয়ে তার উন্নয়ন এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে সযত্নে প্রতিযোগিতার পরিবেশে পালন করা। গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে দেশে সামগ্রিক বিনিয়োগ, এমনকি পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ একটা মাঝারি মাপে স্থিতিশীল যখন আমাদের দেশে এই বিনিয়োগের সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা অফুরন্ত। আগামী বছরের বাজেটেও পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় বাস্তবিক পক্ষে (real terms) বাড়ানোর লক্ষ্য রাখা হয়নি। অথচ জাতীয় আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অন্তত সেই হারে তা বাড়ানো স্বাভাবিক ছিল, মোট রাজস্ব আদায় যেমন জাতীয় আয়ের হারেই (টাকার অঙ্কে শতকরা দশ ভাগ, আনুমানিক মুদ্রাস্ফীতি হিসাবে নিলে বাস্তবিক বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ছয় শতাংশের কাছেই) বাড়বে ধরা হয়েছে।

মানবসম্পদ উন্নয়ন, কারিগরী দক্ষতা বৃদ্ধি— এসব কথার ফুলঝুরি ছুটছে, অথচ এই ক্ষেত্রে উন্নয়নে গভীরতা আনতে গেলে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সমস্ত স্তরের শিক্ষাতেই গভীর নজর দেওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র কয়েকটা আইআইটি, আইআইএম আর আইসার এত বড় দেশের প্রয়োজন মেটাতে পারে না, আর তাদের ছাত্র-শিক্ষকের মানও শেষপর্যন্ত নিচের স্তরে শিক্ষার মানের উপর নির্ভর করে।

গত তিন দশকে আমাদের দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে, তা সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দরিদ্র মানুষের বাস এখানেই। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্কলহ শুরু হওয়ার আগে গত বছরই সে দেশ মাথাপিছু আয়ে আমাদের ছাড়িয়ে গেছে। এই তথ্যই দেখিয়ে দেয় আমাদের দেশের উন্নয়নের ভিত কত সঙ্কীর্ণ। কারিগরী দক্ষতা বৃদ্ধিতে উৎসাহ দান অত্যন্ত জরুরি কিন্তু তার সঙ্গে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাও মানবসম্পদের বিকাশকে ধরে রাখার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। বিভিন্ন সমীক্ষা দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান অত্যন্ত হতাশাজনক; তা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ কোথায়? বিদ্যালয়শিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দ (টাকার স্থির মূল্যে) গত বছরের প্রায় সমান যদিও জাতীয় আয় বেড়েছে, জনসংখ্যাও বেড়েছে। উচ্চতর শিক্ষাতেও একই কথা প্রযোজ্য। দুই ক্ষেত্র মিলে আগামী আর্থিক বছরের বাজেটে বরাদ্দ কোটি টাকায় ১২০ হাজার থেকে বেড়ে ১২৮ হাজার। অর্থাৎ টাকার ক্রয়ক্ষমতার বিচারে বরাদ্দ বাড়েনি। রাজকোষ ঘাটতিকে বাগে রাখার যুক্তি দিয়ে এই কার্পণ্যের ব্যাখ্যা হয় না।

সরকার বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ দিচ্ছে, এতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণায় ছাঁট-কাট করে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহদান একটা একপেশে মনোভাব প্রকাশ করে। কর্পোরেট সংস্থার গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার পরিপূরক হবে এটাই কাম্য, না হলে উন্নয়ন হবে সঙ্কীর্ণ। আবার বিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যার পাশাপাশি কলা ও মানববিদ্যাকে গুরুত্ব না দিলে মানুষের স্বাভাবিক আগ্রহ ও উদ্যমের বিকাশ স্বাভাবিক গতি হারাবে। বাজেট-বরাদ্দের বহর দেখে এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে কারণ তা সরকারের মনোভাবের প্রকাশ।

এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি দেশবাসীর প্রতিও। আমাদের দেশটা যেন দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা ছোট ভাগ আয় ও সম্পদে দ্রুত বর্ধমান, প্রায় একটা উন্নত দেশের মানে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলিতে লাভের হার অবিশ্বাস্য রকমে বেড়ে চলেছে, অথচ সেখানে সাধারণ কর্মীদের বেতন বস্তুত স্থির হয়ে রয়েছে, তারা আয়করের আওতায় পড়ে না। উঁচু আর নিচুতলার কর্মীদের বেতনে ফারাক বিরাট। আয়করদাতারা বর্তমানে দেশের ভোটদাতাদের মোটামুটি দুই শতাংশ। এদের সকলকেই অবশ্য বড়লোক বলা যায় না, তবুও বলা যায় এ-দেশের অপর অংশের মানুষের তুলনায় তারা ভাগ্যবান।

অপরভাগের মানুষের একটা বড় অংশ দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও অপুষ্টিতে ক্লিষ্ট। অসংগঠিত ক্ষেত্রের চিত্রটা অনুন্নয়নের বাস্তবতাকে প্রকট করে। সেখানে মানুষ কোনওভাবে ছোটখাটো যে-কোনও কাজ করে বাঁচার চেষ্টা করছে। প্রাকনির্বাচনী সমীক্ষা জানাচ্ছে স্বনিযুক্ত কর্মীদের গড় মাসিক আয় তেরো হাজারের সামান্য বেশি, অর্থাৎ বছরে এক লক্ষ ষাট হাজারের মতো। চাকরিরতদের ক্ষেত্রে তা মাসে একুশ হাজার বা বছরে আড়াই লাখের মতো। বিরাট সংখ্যক ক্যাজুয়াল কর্মীদের দৈনিক মজুরি গড়ে ৪১৮ টাকা, তাদের বার্ষিক আয়ের হিসাব নেই কারণ কতদিন তারা কাজ করে জানা নেই। এইসব মানুষের সন্তানেরা সরকারি বিদ্যালয়ে যায় যেখানে মিড-ডে মিলের জন্য বরাদ্দ অতি সামান্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে যাদের মাসিক করযোগ্য আয় এক লক্ষ (বার্ষিক ১২ লক্ষ) টাকারও বেশি তাদের করের আওতার বাইরে রাখার যুক্তিটা কী হতে পারে? যখন বেশি সংখ্যক মানুষকে করের আওতায় আনাটাই লক্ষ্য হওয়ার কথা, এবং এই লক্ষ্যে কিছুদূর অগ্রগতি হয়েছিল গত কয়েক বছরে, তখন সে সুফল ঝেড়ে ফেলে এক লক্ষ কোটি টাকার রাজস্বহরা করপ্রস্তাবকে অদূরদর্শিতা বললে কম বলা হয়, এটা ভোটের রাজনীতি।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...