ব্যয়সঙ্কোচন এবং অবহেলার বাজেট

প্রসেনজিৎ বসু ও সৌম্যদীপ বিশ্বাস

 


এই বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে ভারতে মোট ৮৮.২ শতাংশই অদক্ষ বা স্বল্প-দক্ষতার পেশায় নিযুক্ত। তথ্য অনুযায়ী কোভিড অতিমারি-পরবর্তী পাঁচ বছরে মোট শ্রমজীবীদের মধ্যে সংগঠিত শিল্প বা পরিষেবা ক্ষেত্রে নিযুক্ত নিয়মিত বেতনভুক কর্মীদের ভাগ কমে গিয়ে কৃষিক্ষেত্র এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে স্বনিযুক্ত কর্মীদের ভাগ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ সংগঠিত শিল্প থেকে কৃষি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অভিবাসন ঘটছে; অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা উল্টো দিকে ঘুরছে। সমীক্ষা এটাও দেখাচ্ছে যে স্বনিযুক্ত ক্ষেত্রে কর্মরত পুরুষ কর্মীদের গড় প্রকৃত আয় ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪-এ অনেকটাই কমে গেছে। শ্রমজীবীদের প্রকৃত আয়ের সঙ্কোচনের প্রেক্ষিতে বাজেটের সরকারি ব্যয়সঙ্কোচন পরিস্থিতিকে আরও প্রতিকূল করে তুলবে।

 

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের পর জুলাই মাসে মোদি সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত একটি বিশেষ প্যাকেজের অন্তর্গত পাঁচটি স্কিমে পাঁচ বছরে চার কোটি নতুন কর্মসংস্থান এবং ইন্টার্নশিপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুই লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দও ঘোষণা করা হয় গত বাজেটে। অথচ এই বছরের বাজেট-বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এই কর্মসংস্থান এবং দক্ষতাবৃদ্ধির প্যাকেজের বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়ে সদিচ্ছা এবং আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।

 

নতুন আয়কর কাঠামো

২০২৫-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে দেশের আয়করের কাঠামোয় বড়সড় পরিবর্তন। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে আগামী অর্থবর্ষ, অর্থাৎ ২০২৫-২৬ থেকে বছরে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত উপার্জনকারীদের কোনও আয়কর দিতে হবে না। আয়করের এই সীমা বর্তমানে আছে বার্ষিক ৭ লক্ষ টাকা আয় পর্যন্ত, যেটা বাড়িয়ে ১২ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বার্ষিক আয়ের বিভিন্ন স্ল্যাবের মধ্যেও আয়করের রেটে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার ফলে বার্ষিক ১৬ লক্ষ টাকা উপার্জনকারী একজন ব্যক্তির বর্তমান আয়কর ১.৭ লক্ষ টাকা থেকে কমে হবে ১.২ লক্ষ টাকা; বার্ষিক ২০ লক্ষ টাকা আয়ের উপর আয়কর ২.৯ লক্ষ থেকে কমে হবে ২ লক্ষ টাকা; বার্ষিক ৫০ লক্ষ টাকা আয়ের উপর বর্তমান আয়কর ১১.৯ লক্ষ টাকা থেকে কমে হবে ১০.৮ লক্ষ টাকা।

২০২৪ সালে প্রকাশিত ভারতে আয় এবং সম্পদের অসাম্যের উপর ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব-এর গবেষণা রিপোর্টে অর্থনীতিবিদ নীতিন কুমার ভারতি, টমাস পিকেটি, লুকাস চ্যানসেল ও আনমল সোমাঞ্চির দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ২০২২-২৩ সালে ভারতের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ছিল ৯২.২ কোটি, এবং এই জনসংখ্যার মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল ২.৩ লক্ষ টাকা। এই প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে সর্বনিম্ন আয়ের ৫০ শতাংশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৭১ হাজার টাকা, তার উপরের ৪০ শতাংশের মাথাপিছু আয় ছিল ১.৬৫ লক্ষ টাকা আর তার উপরের ১০ শতাংশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল ১৩.৫২ লক্ষ টাকা। প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার একেবারে শীর্ষের ১ শতাংশ, অর্থাৎ ৯২ লক্ষ ব্যক্তির গড় বার্ষিক আয় ছিল ৫৩ লক্ষ টাকা।

এই তথ্য অনুযায়ী ভারতের মতন দেশে আয়করদাতাদের ‘মধ্যবিত্ত’ বলে চিহ্নিত করা একেবারেই অনুচিত। আয়করদাতারা আসলে ভারতের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ, এবং তারা সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই পড়ে। আয়কর বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে রিটার্ন দাখিল করা ৭.৫ কোটি ব্যক্তিগত আয়করদাতাদের মধ্যে ৪.৭ কোটি আদতে শূন্য কর দিয়েছেন। অর্থাৎ, আয়করদাতাদের আসল  সংখ্যা বর্তমানে মাত্র ২.৮ কোটি, যা ভারতের সমগ্র বেতনভুক কর্মীদের ২৩ শতাংশেরও কম।

এই ২.৮ কোটি ব্যক্তিগত আয়করদাতাদের সামনের অর্থবর্ষে যে ছাড় দেওয়া হবে, অর্থমন্ত্রীর হিসেব অনুযায়ী তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্বের ক্ষতি হবে ১ লক্ষ কোটি টাকা। এই উচ্চবিত্তশ্রেণির হাতে সামনের বছর বাড়তি ১ লক্ষ কোটি টাকা আসা মানেই কিন্তু সেই টাকার পুরোটা বাজারে খরচা হয়ে নতুন চাহিদা সৃষ্টি করবে, তা একেবারেই নয়। উচ্চবিত্তশ্রেণির বাড়তি আয় থেকে সঞ্চয়ের প্রবণতা ভোগব্যয়ের তুলনায় বেশি থাকার কারণে বাজারে সামগ্রিক ভোগব্যয় বৃদ্ধি ১ লক্ষ কোটি টাকার অনেক কম হবে। বরং নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের মজুরিবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ১ লক্ষ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়বরাদ্দ করলে তাতে বাজারে ভোগব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ অনেক বেশি হতে পারত। এতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিও সুনিশ্চিত হত। উদাহরণস্বরূপ, মহাত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের অন্তর্গত ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প।

মোদি সরকার এই প্রকল্পে লাগাতার ব্যয়বরাদ্দ ছাঁটাই করে চলেছে। কোভিড অতিমারির সময়, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজে ব্যয় করেছিল প্রায় ১.১০ লক্ষ কোটি টাকা, যার মধ্যে মজুরি-খাতে খরচ হয়েছিল ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মাধ্যমে সারা দেশে ১১.১৯ কোটি গ্রামীণ শ্রমিক গড়ে ২০০ টাকা দৈনিক বেতনে মাথাপিছু ৫১ দিন করে কাজের সুযোগ পেয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট ব্যয় নেমে এসেছিল ৮৯ হাজার কোটি টাকায়, মজুরি-খাতে খরচও নেমে এসেছিল ৭৪ হাজার কোটি টাকায়। গড় দৈনিক মজুরি সামান্য বেড়ে ২৩৫ টাকা হলেও সারা দেশে মোট কাজ পাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা তিন বছরে প্রায় ২.৮৫ কোটি কমে হয় ৮.৩৪ কোটি।

এই বছরের কেন্দ্রীয় বাজেট চলতি এবং আগামী  অর্থবর্ষের জন্য ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের মোট ব্যয়বরাদ্দ আরও কাটছাঁট করে ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছে। চলতি অর্থবর্ষে, ২০২৪-এর এপ্রিল থেকে ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই প্রকল্পে কাজ পাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭.২৯ কোটি, মজুরি খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ ৬২ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে এখন পর্যন্ত গড় দৈনিক মজুরি ২৫০ টাকা, শ্রমিকরা মাথাপিছু কাজের সুযোগ পাচ্ছে গড়ে মাত্র ৪৫ দিন। এদিকে কেন্দ্রীয় সরকারেরই নির্ধারিত কৃষিকাজে অদক্ষ শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরির হার এখন ৪৫২ টাকা।

বাজেটে ১০০ দিনের কাজে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে গ্রামীণ শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এবং কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারলে অন্তত ৮ থেকে ৯ কোটি মানুষের প্রকৃত আয়ের বৃদ্ধি হত, এবং তাদের ভোগব্যয় বৃদ্ধির ফলে বাজারে অনেক বেশি পরিমাণে চাহিদা সৃষ্টি হত। সেই পথে না হেঁটে কেন্দ্রীয় বাজেটে যেভাবে উচ্চবিত্তদের আয়করের ছাড় দেওয়া হয়েছে, সেটা জাতীয় অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধির জন্য নয় বরং দিল্লি বিধানসভা ভোটে রাজধানীর উচ্চবিত্ত ভোটারদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে বলেই মনে হচ্ছে।

 

ব্যয়বরাদ্দে কাটছাঁট

ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর প্রকাশিত সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী ভারতের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রকৃত বৃদ্ধির হার ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ৮.২ শতাংশ থেকে কমে গিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ৬.৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন এবং আয় বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ার ফলে চলতি অর্থবর্ষে রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত বাজেটে নির্ধারিত ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অন্তত ৪১ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হতে চলেছে। এর উপর অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবর্ষের বাজেট ঘাটতি কমানোকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় মোট ব্যয়বরাদ্দ গত বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ছাঁটা হয়েছে। মূলধনী খাতে প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকার ব্যয়বরাদ্দ ছাঁটা হয়েছে।

মূলধনী খাতে ব্যয় কমানোর ফলে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বেশ কিছু প্রকল্পের বাস্তবায়ন এখন প্রশ্নের মুখে পড়বে। কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, কৃষি, শিক্ষা, খাদ্য, শক্তি, পরিবহন এবং স্বাস্থ্য দপ্তরের ২০২৪-২৫-এর বাজেটবরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে জল জীবন মিশন-এর চলতি বছরের বরাদ্দে ছাঁটা হয়েছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ছাঁটা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবর্ষে মূলধনী বিনিয়োগ এবং জনকল্যাণ খাতে এই ব্যয়সঙ্কোচনের নেতিবাচক প্রভাব বেসরকারি বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের উপর পড়তে বাধ্য, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। বিনিয়োগ এবং ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির গতি হ্রাস পেলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার আরও নেমে যেতে পারে।

গত বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা (ইকনমিক সার্ভে) ভারতের ক্রমবর্ধমান কর্মক্ষম যুবসমাজের কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করতে ২০২৪ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত অ-কৃষিক্ষেত্রে প্রতি বছর ৭৮.৫ লক্ষ কাজের সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে বা পিএলএফএস-এর তথ্য অনুযায়ী ভারতে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুবসমাজে বেকারত্বের হার ২০২৪-এর জুন মাসে ১০.২ শতাংশে পৌঁছেছে। স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে, যা খুবই উদ্বেগজনক।

এই বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে ভারতে মোট শ্রমজীবীদের ৯০ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক স্তর বা তার চেয়েও কম। ফলত শ্রমজীবীদের ৮৮.২ শতাংশই অদক্ষ বা স্বল্প-দক্ষতার পেশায় নিযুক্ত। পিএলএফএস-এর তথ্য অনুযায়ী কোভিড অতিমারি-পরবর্তী পাঁচ বছরে মোট শ্রমজীবীদের মধ্যে সংগঠিত শিল্প বা পরিষেবা ক্ষেত্রে নিযুক্ত নিয়মিত বেতনভুক কর্মীদের ভাগ কমে গিয়ে কৃষিক্ষেত্র এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে স্বনিযুক্ত কর্মীদের ভাগ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ সংগঠিত শিল্প থেকে কৃষি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অভিবাসন ঘটছে; অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা উল্টো দিকে ঘুরছে।

সর্বশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষা এটাও দেখাচ্ছে যে স্বনিযুক্ত ক্ষেত্রে কর্মরত পুরুষ কর্মীদের গড় প্রকৃত আয় ২০১৭-১৮-তে মাসিক ৯৪৫৪ টাকা থেকে ২০২৩-২৪-এ মাসিক ৮৫৯১ টাকায় নেমে এসেছে। নিয়মিত বেতনভুক পুরুষ কর্মীদের গড় প্রকৃত মজুরি ২০১৭-১৮-তে মাসিক ১২৬৬৫ টাকা থেকে কমে ২০২৩-২৪-এ হয়েছে ১১৮৫৮ টাকা। অর্থাৎ চাকরির বাজারে উদ্বৃত্ত শ্রমের প্লাবন এবং খাদ্যদ্রব্যের চড়া মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভারতের আনুমানিক ৫৫ কোটি শ্রমজীবী জনগণের বহুলাংশেরই প্রকৃত আয় বা মজুরি হ্রাস পেয়েছে। শ্রমজীবীদের প্রকৃত আয়ের সঙ্কোচনের প্রেক্ষিতে বাজেটের সরকারি ব্যয়সঙ্কোচন পরিস্থিতিকে আরও প্রতিকূল করে তুলবে।

 

মুনাফার বৃদ্ধি নয়, চাহিদার বৃদ্ধি প্রয়োজন

এই বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণাকে উদ্ধৃত করে দেখানো হয়েছে কীভাবে শেয়ারবাজার নিফটি-তে তালিকাভুক্ত শীর্ষের ৫০০ কোম্পানির কর-পরবর্তী মোট মুনাফা ২০১৯-২০-তে ৪.৩২ লক্ষ কোটি টাকা (দেশের জিডিপি-র ২.১ শতাংশ) থেকে চার বছরে তিনগুণ বেড়ে ২০২৩-২৪-এ হয়েছে ১৪.১২ লক্ষ কোটি টাকা (দেশের জিডিপি-র ৪.৮ শতাংশ)। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী কর্পোরেট করের হার এক ধাক্কায় কমিয়ে দেওয়াতেই বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলি এই বিপুল মুনাফা করতে পেরেছে। অথচ পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে কর্পোরেট ক্ষেত্রে কর্মীদের মাইনে বৃদ্ধির হার মুনাফা বৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম থেকেছে।

গত চার-পাঁচ বছরে মুনাফার এই ধারালো বৃদ্ধি কিন্তু কর্পোরেট বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে পরিণত হয়নি। বরং এই কর্পোরেট মুনাফা বৃদ্ধির প্রতিফলন দেখা গেছে শেয়ারবাজারের সূচকগুলির অভূতপূর্ব ঊর্ধ্বগতিতে। অথচ এই অভিজ্ঞতা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও শিক্ষাই নেয়নি। ২০২৫-এর কেন্দ্রীয় বাজেট একদিকে মূলধনী বিনিয়োগ এবং জনকল্যাণ খাতের ব্যয়সঙ্কোচ করে বাজেট ঘাটতি কমাতে চাইছে, আর অন্যদিকে আয়কর কাটছাঁটের মাধ্যমে অর্থনীতিতে ভোগব্যয়ের চাহিদা বাড়াতে চাইছে। এই বিপরীতধর্মী নীতিগুলির ফলে দেশের বাজারে সার্বিক চাহিদা বৃদ্ধির পরিবর্তে দেশে আয়ের অসাম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই যেভাবে যত্রতত্র আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করছেন, তাতে বিশ্ব-অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়বে। এই অনিশ্চিত পরিবেশে ভারতের পক্ষে রপ্তানি বাড়িয়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বাড়ানো খুবই কঠিন। তদুপরি, ভারতের ঘরোয়া বাজারেও যদি চাহিদা বৃদ্ধি না ঘটে সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী হবে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শ্রমজীবী জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন অধরাই থেকে যাবে। ২০২৫-এর কেন্দ্রীয় বাজেট মোদি সরকারের অর্থনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানের অভাবকেই আরও প্রকট করে তুলেছে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...