যে বই পড়বই— অষ্টম বর্ষ, পঞ্চম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

এমনটা ভাবা বোকামো যে আমরা যতগুলি বই কিনেছি, সবগুলোই আমাদের পড়ে ফেলতে হবে। একইভাবে যাঁরা নিজের পড়ার সামর্থ্যের অতিরিক্ত বই কিনে ফেলেন, তাঁদের সমালোচনা করাটা ঠিক নয়। বিষয়টা এরকম দাঁড়াল যেন নতুন কোনও ছুরি-চামচ, গেলাস, স্ক্রু ড্রাইভার বা ড্রিল বিট কেনার আগে এসবের সবকটি পুরনো সেট আমাদের ব্যবহার করে ফেলতেই হবে!

—উমবের্তো একো (১৯৩২-২০১৬)

চিন্তক উমবের্তো একোর মুখেই এমন কথা সাজে, অথবা এইভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করা ছাড়া তাঁর কাছে সম্ভবত অন্য কোনও রাস্তা ছিল না। কারণ শোনা যায়, একোর নিজস্ব গ্রন্থাগারে ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশি বই। এবং এইসব বইয়ের মধ্যে একটা বড় সংখ্যার বই-ই নিশ্চয়ই না-পড়া। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে না-পড়া বইয়ের সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়ে, অপঠিত বইগুলি তাক থেকে বইপ্রেমী ক্রেতা বা তখনও হয়ে না-ওঠা অসহায় পাঠকের প্রতি তীব্রদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সুরসিক একো তখনও না-পড়া তাঁর এই বই সংগ্রহের নাম দিয়েছিলেন অ্যান্টি-লাইব্রেরি।

বইয়ের মরসুমে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর বসন্ত সংখ্যাটি আমরা দাঁড় করাতে চেয়েছি এমন একটি চাবি-ভাবনায়, যা অ্যান্টি লাইব্রেরি-র সম্পূর্ণ বিপরীত! যে বই পড়বই। আমরা এই সংখ্যার লেখকদের লিখতে অনুরোধ করেছি এমন সব বই নিয়ে যা পড়ার ইচ্ছে তাঁরা পোষণ করছেন বেশ কিছুদিন, যে-বইগুলি প্রকাশ পেলেই তাঁরা কিনবেন এবং পড়বেন। হয়তো এর মধ্যে কিছু বই প্রকাশ পেয়েছে, বইগুলি সম্বন্ধে ভাল ভাল কথা শোনা গেছে, কিন্তু এখনও বইগুলি সংগ্রহ করা হয়ে ওঠেনি, পঠিতব্যের তালিকায় রয়ে গেছে তারা। আবার হয়তো এখনও লেখাই শেষ হয়নি কোনও কোনও বইয়ের, কোনও বেস্ট সেলিং লেখক আগাম জানিয়ে রেখেছেন অমুক মাসে প্রকাশিতব্য তমুক বইটির কথা। অথবা হয়তো কোনও সাময়িক পত্রে পর্বে পর্বে প্রকাশিত হয়ে চলেছে কোনও নির্জন লেখকের প্রথম কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাস। হতে পারে, নানা প্রকাশিতব্য বইয়ের আগাম খবর প্রকাশিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমে, কর্পোরেট মিডিয়ায়, ফেসবুকে, বইসম্বন্ধীয় খবরাখবরে অথবা মফস্বল থেকে প্রকাশিত অনামা লিটল ম্যাগাজিনের পাতার এককোণে। কোনও এক নির্জনতর পাঠক অধীর আগ্রহ নিয়ে বইগুলির জন্য অপেক্ষা করে আছেন। সকালে কাঁচাবাজার করার সময় অথবা সন্ধেবেলা কাজ থেকে ফেরার পথে অথবা রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বিছানায় শুয়ে থাকা পাঠকের মস্তিষ্কে ঘন হয়ে আসছে বইগুলির জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা ও আমেজ।

পাশাপাশি উঠে এসেছে এমন সব বইয়ের খবর যা সচরাচর আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণিপরিসরে ভেসে ওঠে না৷ শ্রমজীবী মানুষজনের লেখা ও তাঁদের খবরে ঠাসা, সস্তা কাগজে ছাপা নানা পত্র-পত্রিকা-পুস্তিকা বইমেলার মাঠে বেচেন বা বিলি করে বেড়ান কেউ কেউ, কিছু কপি ঠাঁই পায় লিটল ম্যাগাজিন মঞ্চের কোনও টেবিলে, যা থেকে ধরা পড়ে বাংলার নানা জেলায় নানা ক্ষেত্রে কর্মরত প্রান্তিক মানুষজনের আর্থসামাজিক হাল-হকিকৎ। বইমেলার মাঠ ছাড়া অন্য সময় শহর কলকাতায় বসে সেসব বইয়ের নাগাল পাওয়া মুশকিল। ঝকঝকে, সুবাসিত, এলিট সাহিত্যচর্চার তলপেটে থাকা সেইসব প্রান্তিক বইয়ের কথাও উঠে এসেছে এই সংখ্যার কোনও কোনও লেখায়।

আবার কোনও কোনও লেখক নিজ কল্পনার রঙে রাঙিয়ে এই অপেক্ষাকে নিয়ে গেছেন অন্য স্তরে। তিনি অপেক্ষা করছেন এমন বইয়ের যা কোনওদিন কেউ লিখবেন কিনা জানা নেই। অথচ বইয়ের বিষয়টি এমনই অভিনব, যদি কোনওদিন সেই বই লেখা হয়, আমাদের নিবন্ধলেখকই হবেন ওই বইয়ের প্রথম ক্রেতা ও পাঠক। সেইসব না-লেখা কাল্পনিক বইয়ের কথা উঠে এসেছে সে-লেখায়। ভবদুলালবাবু পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এই বই সংখ্যাটির কথা শুনে নিলে নির্ঘাত বলে উঠতেন— আমার ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরি’ বইখানা আপনাদের লাইব্রেরিতে রাখেন না কেন?

যে বই পড়বই-সংখ্যায় লিখে যেসব লেখক আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন তাঁরা হলেন— আশীষ লাহিড়ী, অনিতা অগ্নিহোত্রী, পরিমল ভট্টাচার্য, স্বাতী ভট্টাচার্য, দেবাশিস ভট্টাচার্য, অচিরাংশু আচার্য, রামানুজ মুখোপাধ্যায়, প্রতীক, স্বাতী মৈত্র, শুভ মৈত্র এবং অভিষেক ঝা।

বলাই বাহুল্য, প্রচ্ছদ নিবন্ধগুলি ছাড়াও যথারীতি এই সংখ্যায় রইল অন্যান্য সবকটি নিয়মিত বিভাগ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4998 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...