আশরাফ আহমেদ
মাস কয়েক আগে, ফেসবুকে আমার বা অন্য কারও পোস্টে দেওয়া মন্তব্য দেখে হামীম কামরুল হকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। খোঁজ নিতে এক সাহিত্যিক বন্ধু জানিয়েছিলেন, জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক একজন ভাল লেখক। তা শুনে তাঁর ফেসবুক পেইজের একদম শুরুতে ‘শূন্যপরান ও অন্যান্য গল্প’ দেখে সেটিই ঢাকা থেকে আনিয়ে পড়লাম। লেখক সম্পর্কে আমার বন্ধুটি মোটেই অত্যুক্তি করেননি।
ভিন্ন ভিন্ন তেরোটি গল্প থাকলেও পুরো বইটিকে দুটি বিশেষত্বের আলোকে আলোচনা করা যায়। প্রথমত, আধুনিক মানুষ প্রতিনিয়ত সমাজ-সৃষ্ট নানাবিধ বস্তুগত, তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক টানাপোড়েন এবং সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। একদিকে বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের কল্পিত সুফলের হাতছানি, অন্যদিকে বুর্জোয়া অর্থনীতির দৃশ্যমান ও জৌলুসপূর্ণ ভোগ-জীবন, সত্য-মিথ্যার বিভাজনহীন ধূসর জগৎ, প্রাচীন ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিক জীবনযাত্রার অসামঞ্জস্য, এবং জনসেবার নামে সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রবণতা— এই সবকটি সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আমরা প্রতিদিনই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি। এই বইয়ের গল্পগুলোতে— কখনও কাহিনি-নির্ভর, কখনও ঘটনাবিহীন— এসব সমস্যাই সফলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
যদিও কোনও কোনও গল্পে কাহিনি অনুপস্থিত, তথাপি সেগুলো পাঠককে আশাহত করে না; ভাষা ও পাণ্ডিত্যে পাঠককে ধরে রাখে বিরামহীন। ঘটনাবিহীন, দর্শননির্ভর ও ইঙ্গিতপূর্ণ গল্পগুলিতে শিক্ষিত ও মননশীল সূক্ষ্মানুভূতির খোরাক থাকলেও শুধুমাত্র শেষ গল্প— ‘চক্কর’— থেকেই লেখককে এক শক্তিশালী সাহিত্যিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
বইয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল যৌনতা। প্রথমটি বাদে, বাকি সব গল্পেই যৌনতা কখনও মূল উপজীব্য হিসেবে, কখনও প্রাসঙ্গিকভাবে, আবার কখনও উদাহরণ হিসেবে এসেছে। একটি মাত্র বইয়ের প্রায় সব গল্পে যৌনতার এমন সরব উপস্থিতি আমি আর কোনও বাংলা বইয়ে দেখিনি।
মানুষ-সহ জীবজগতের সবার তিনটি প্রাকৃতিক ধর্ম হল খাওয়া, সঙ্গম করা এবং ঘুমানো। সঙ্গম প্রক্রিয়াটি মূলত সন্তান উৎপাদনের জন্য হলেও মানুষের ক্ষেত্রে কালক্রমে তা হয়ে ওঠে এক নিবিড় ও চরম আনন্দের অনুভূতি— সুস্থ জীবনযাপনের এক অত্যাবশ্যকীয় মাধ্যম। শিল্পরূপে এই বিষয়টি সাহিত্যে যেভাবে প্রকাশ পায়, পাশ্চাত্যে তা ‘ইরোটিক’ নামে এবং ভারতবর্ষে তা ‘কাম’ বা ‘যৌনতা’ নামে পরিচিত। সাধারণ অনুসন্ধান থেকে যেটুকু ধারণা পাওয়া যায়, তা অনেকটা এইরকম: জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো ইরোটিক সাহিত্যেরও সমাদর ছিল প্রাচীন এলিট তথা শিক্ষিত সমাজে, যদিও সংখ্যায় তারা ছিল সীমিত। পঞ্চদশ শতকে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে বইপুস্তক সাধারণ মানুষের নাগালে আসতে শুরু করে, ফলে বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে যৌনসাহিত্য রচনা, চর্চা ও প্রচার বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। ইউরোপের হাত ধরে ভারতীয় সাহিত্যেও যৌনতা ‘অসামাজিক’ তকমা পেয়ে সাহিত্যের মূল ধারায় স্থান পায়নি। তা সত্ত্বেও আধুনিক লাইব্রেরিগুলিতে যৌনসাহিত্য গুরুত্বের সঙ্গেই সংরক্ষিত হয়। ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বিশাল ও প্রখ্যাত কংগ্রেসনাল লাইব্রেরির সিলিং জুড়ে প্রতিটি আর্চে জ্ঞানের একেকটি শাখা— ‘Physics’, ‘Chemistry’, ‘Geography’, ‘Literature’, ‘History’ ইত্যাদির মতোই স্পষ্টভাবে ‘Erotic’ শব্দটিও লেখা আছে একটি আর্চে।
ডিএইচ লরেন্সের Lady Chatterley’s Lover উপন্যাস প্রকাশের মধ্যে দিয়ে যৌনসাহিত্যের পুনরাবির্ভাব শুরু হয়। বর্তমানে ইংরেজি ও ইউরোপীয় সাহিত্যে যৌনতা ও যৌনাচারভিত্তিক লেখালেখি নতুন কিছু নয়। সেই তুলনায় বাংলায় এ-ধরনের লেখালেখি এখনও খুব বেশি নেই। বাংলা ভাষায় জীবন ও কাম সম্পর্কিত সাহিত্যের ধারায় শূন্যপরান ও অন্যান্য গল্প ভবিষ্যতেও উল্লেখযোগ্য বলে চিহ্নিত হতে পারে।
গল্পগুলোর পৃথক পৃথক পরিচিতি দেওয়ার আগে, সেগুলোর সামগ্রিক পর্যালোচনা করলে বইটির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রথমত, প্রথম গল্পটি বাদ দিলে, বাকি সব গল্পেই সেক্স বা যৌনতা— কখনও মুখ্যভাবে, কখনও ইঙ্গিতময় হয়ে উপস্থিত হয়েছে। প্রথম গল্পটিকে পিউরিটান বলা গেলেও, সেখানেও নারী চরিত্রটি পাকিস্তান আর্মির হাতে বন্দি হয়েছিল বলে যৌনতার একটি দুর্বল ইঙ্গিত রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে কোনও কোনও গল্পে যৌনতার উপস্থিতি দেখা যায়, কিন্তু একটি বইয়ের প্রতিটি গল্প যৌনতা ঘিরে আবর্তিত— এমন উদাহরণ বিরল। পাশ্চাত্য সাহিত্যে এ ধরনের বিষয়বস্তুকে হয়তো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মনে না-ও হতে পারে, তবে বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গে একে কেবল ‘যৌনতা’ বললে হয়তো কিছুটা খাটো করে দেখা হবে। অনেক ক্ষেত্রেই শব্দচয়ন ও ঘটনার বর্ণনা এমন যে, সেগুলিকে ‘ইরোটিক’ বললে অত্যুক্তি হয় না। একই সঙ্গে এটাও সত্য, লেখক কোথাও যৌনতা বা ইরোটিক প্রকাশকে জোর করে বসিয়ে দেননি; বরং গল্পের প্রয়োজনে বা চরিত্রচিত্রণের স্বাভাবিক ধারাতেই সেগুলো উপস্থিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, প্রায় প্রতিটি গল্পেই নারীচরিত্রগুলো সংস্কারমুক্ত, কামাসক্ত এবং বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত— যা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি দেখা যায় না। দুটি গল্পে শক্ত দেহের, বহুনারীসঙ্গমে পারঙ্গম পুরুষচরিত্র প্রশংসাসূচকভাবে চিত্রিত হলেও, তারা কখনও মূল চরিত্র নয়।
কিন্তু নারী ও পুরুষ— উভয়ের জবানিতেই আমরা আধুনিক সমাজ ও জীবনের বস্তুগত, তাত্ত্বিক এবং আধ্যাত্মিক টানাপোড়েনের আলোচনা পাই বেশ জোরালোভাবে। প্রথম বা দ্বিতীয় পুরুষে কথিত পুরুষ চরিত্রদের মুখেও যে-সব বচন বেরিয়ে আসে তাতেও থাকে পরিচিত মেয়েলি ধাঁচ। যেমন, ‘সে এবং তোমার গল্প’-এ পুরুষ চরিত্রটি সম্পর্কে বলা হয়েছে— “সে ওপরেই পুরুষ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মেয়েদের মতো। তাই সে অন্য পুরুষমানুষের মতো নয়।” অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ চরিত্রকে হীনভাবে দেখানো হলেও নারীদের ক্ষেত্রে তা কখনও হয়নি। পুরুষ চরিত্রদের মুখে মেয়েলি ভাষার ব্যবহার যদি লেখকের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে থাকে, তবে তার কারণ বইতে স্পষ্ট নয়। এর তুলনায় শিল্পী এসএম সুলতান তাঁর বিশাল ম্যুরালে বাঙালিকে অস্বাভাবিক পেশিবহুল রূপে উপস্থাপন করেছিলেন— কারণ তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী বিজয়ী বীরদের শরীর তেমনই হওয়া উচিত।
অধিকাংশ গল্পেই পুরুষ চরিত্রগুলি প্রধান না হলেও প্রায় সর্বত্র তাঁরা দীর্ঘদেহী, নারীচিত্তহরণকারী সুপুরুষ রূপে উপস্থিত। অন্যদিকে, এই বইয়ে নারী-সৌন্দর্যের বর্ণনায় লেখক ফর্সা গায়ের রং, নাক, গাল, ঠোঁট, চোখ বা ভুরু নয়— তাঁদের অপূর্ব দেহবল্লরী, এবং বিশেষ করে নিতম্বকে সৌন্দর্যের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করেছেন।
তৃতীয়ত, আমাদের দেশে অনেকেরই প্রাচ্য— অর্থাৎ বাংলা ও ভারতবর্ষীয়— এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্যক পরিচয় আছে। তথাপি, এই বইয়ের লেখক প্রয়োজনে ও প্রাসঙ্গিকতায় সেগুলোর যে সুচারু প্রয়োগ করেছেন, তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। প্রচারমূলক না হয়েও, লেখকের পাঠাভ্যাস, মনস্তত্ত্ব, দর্শন ও অন্যান্য বিষয়ে তাঁর সম্যক জ্ঞানের পরিচয় গল্পের বুনোটে নিঃশব্দে মিশে আছে।
লেখকের অন্য কোনও বই আমি পড়িনি, এবং শূন্যপরান ও অন্যান্য গল্প ছাড়া তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানি না। তবে সবগুলো গল্প পড়ে লেখক সম্পর্কে আমার মনে কয়েকটি ধারণা তৈরি হয়েছে।
বিত্তশালী না হলেও, তিনি বাংলাদেশের কোনও উচ্চমধ্যবিত্ত ও রুচিশীল পরিবেশে লালিত হয়েছেন— এমন অনুমান করা যায়। কয়েকটি গল্পের ভাষা ও মেজাজ দেখে মনে হয়, তিনি একাধিক জ্যেষ্ঠ বোন বা তেমন সম্পর্কিত মহিলা সদস্যের পরিবারে বড় হয়েছেন— অর্থাৎ, তাঁর পরিবারে ভাইয়ের চেয়ে বোনের সংখ্যা বেশি ছিল। যদিও এই ধারণার সরাসরি কোনও ইঙ্গিত গল্পে নেই। আরও একটি, যদিও খুব দুর্বল, কিন্তু আমার ধারণা— আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ কিংবা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে লেখকের কোনও নিকটাত্মীয় প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছিলেন।
আমার এসব ধারণা সত্য না-ও হতে পারে। কিন্তু সেসব ভ্রান্ত হলেও, লেখক যে আমাদের সময়ের একজন শক্তিশালী সাহিত্যিক— এই মূল্যায়ন বদলাবে না।
শূন্যপরান ও অন্যান্য গল্প
হামীম কামরুল হক
রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা
২০১৩
বইয়ের প্রথম গল্প শূন্যপরান— এক সাধুসন্তসুলভ, কর্মক্ষম ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী অশীতিপর ভারতীয় শিক্ষাবিদের জীবনাবসানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে খ্যাতিমান এই ব্যক্তি ঢাকায় এক বাঙালি শিক্ষাবিদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার থেকে শুরু করে ‘কাদেরপুর ইউনিয়ন পুরস্কার’— তেমনই অসংখ্য রুচিহীন সম্মান ও পার্থিব জৌলুসে মগ্ন আমন্ত্রণকারী শিক্ষাবিদের আত্মসমর্পণের দৃশ্যগুলি তাঁকে নিদারুণভাবে পীড়া দিতে থাকে। ফলে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সেই স্থান ত্যাগ করেন, এবং শয্যাগ্রহণের আধঘণ্টার মধ্যেই মাত্র দেখা বৈভবের কুরুচিপূর্ণ প্রতিচ্ছবির পাশাপাশি নিজের দেশে ফেলে আসা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্পিত কলকাকলি শুনতে শুনতেই তাঁর পরানটি দেহধাম ত্যাগ করে।
গল্পের দুই চরিত্রের নাম কাল্পনিক হলেও, পাঠকের মনে যদি নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন ও মুহাম্মদ ইউনুসের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, তবে দোষ দেওয়া চলে না।
প্রতিটি দুঃখের দাম দশ হাজার টাকা গল্পে দীর্ঘদেহী, সুশ্রী এক চিত্রকর নীলাভ্র গ্রামের এক কালো, কিন্তু অবিশ্বাস্য রকমের আকর্ষণীয় দেহবল্লরীর অধিকারী নারীর মাঝে এক মডেলকে খুঁজে পান। দুজনের মধ্যে একটি দেহজ ও প্রেমমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠলেও, শিল্পীর পরামর্শে মেয়েটি একসময় অন্য একজনের সঙ্গে থাকতে শুরু করে এবং শেষে বিয়ে করে তৃতীয় একজনকে। বহু বছর পর, যখন শিল্পী একাডেমি পুরস্কার পেতে চলেছেন, মেয়েটি টিভিপর্দার সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে— সে শুনতে চায়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, শিল্পীর মুখে তার প্রতি কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি। কিন্তু অন্য এক নারীর নাম উচ্চারিত হলে সে আশাহত হয়। একই সঙ্গে সে সন্দিহান হয়ে ওঠে, শিল্পীর চূড়ান্ত সাফল্য ও স্বীকৃতির সেই মাহেন্দ্রক্ষণ হয়তো এখনও উপস্থিত হয়নি।
শেষে, নিজের ব্যর্থ ভালোবাসার প্রতি একরকম করুণা জন্ম নেয় তার মনে।
পাখি ও জোনাকি গল্পে, লিজির প্রচণ্ড কামনায় বন্দি হয়ে পড়া ছেলেটি যুক্তরাষ্ট্রে বসে ব্রহ্মপুত্রের কাশবনে খেলার সাথী ডোরিনকে হারিয়ে তার সন্ত্রাসী বনে যাওয়া জীবনের স্মৃতিচারণ করছে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ছেলেটি উপলব্ধি করে: “অন্যকে খুন করা আর নিজে খুন হয়ে যাওয়া ঘুরেফিরে তো একই।” একই সঙ্গে সে ভাবতে থাকে— ডোরিনের সান্নিধ্যে মেলে যে হৃদয়ের আরাম, আর লিজির দেহভোগের আনন্দ— তার কোনটি বেশি কাম্য?
অন্যদিকে, ছেলেটিকে নিবিড়ভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আনন্দভ্রমণে এসেও লিজি স্বপ্নে দেখছে তার পুরনো প্রেমিক জনকে। ডোরিন এখানে পাখি, আর জন থেকে জোনাকি।
এই গল্প দিয়েই বইটিতে সরাসরি যৌনসম্পৃক্ততার আবির্ভাব ঘটে।
মনের মতো ‘পুরুষ’ না-পাওয়ার হতাশা এক বিবাহিতা নারীর বয়ানে ব্যক্ত হয়েছে সে এবং তোমার গল্প-তে।
আরও কিছুক্ষণ জেগে থাকার দরকার ছিল গল্পে প্রায় শতবর্ষী এক পাবলিক ফিগারের দীর্ঘায়ুর কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে। সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তি কখনও কিছু লেখেননি, কারণ “লিখতে গেলে সত্য লিখতে হয়। আর সত্য লিখতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয়।”
তাঁর দীর্ঘজীবনের নানা কারণের মাঝে, বাড়িতে এক যুবতী মেয়ের সান্নিধ্য কামনা করে তিনি যে রাত জাগতে চাইতেন— লেখক সেটি অত্যন্ত সহজ অথচ সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন বলে মনে হয়।
ইন্দ্রিয়গ্রামের দূরত্ব বেশ বড় একটি গল্প। পরকীয়ায় আসক্ত এক যুবকের আত্মোপলব্ধির বয়ান— যিনি প্রতারণার শিকার হয়ে নিজের গোপন যৌনাচারের ভিডিও হাতে পান। ‘পাপ’ আর ‘অপরাধবোধ’-এর পার্থক্য, মার্কস ও ফ্রয়েড থেকে পাওয়া শিক্ষা, এবং ‘দেহমুক্তির শ্রমবিপ্লব আর শ্রমমুক্তির দেহবিপ্লব’কে করতে না-পারা— এইসব তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক বোঝাপড়া যুবকটির ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
অসময়াপেক্ষ গল্পে, ডাক্তারি পাশ করা হতাশাগ্রস্ত এক যুবক এক বন্ধু, অথবা তারই এক দ্বৈতরূপের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে নিজেকে আলো-বাতাসহীন ঘরে বন্দি রাখার যুক্তিগুলি তুলে ধরে। তেমন কয়েকটি হচ্ছে:
“ঘরের বাইরের পৃথিবীটা একটা ভাঁড়ামোর জায়গা।”
“যা তথাকথিত পপুলার, মানে ব্যাপক সংখ্যক লোক, মানে ধরো কয়েক বিলিয়ন মানুষ যেটাকে সত্য বলে জানে তার ভেতরেই আসল মিথ্যা।”
“লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার নামে প্রায় মরা একটা লোককে কয়েক মিনিট বাঁচিয়ে মিনিট হিসেবে হাজার হাজার টাকা কামাব?”
স্যাটেলাইট টিভিতে দেখানো “এন্টারটেইনমেন্ট যে ধর্মের মতোই আরেক আফিম হয়ে উঠেছে…”
“আগে বলা হত ধর্ম জনগণের আফিম। এখন ধর্মের জায়গা নিয়েছে এন্টারটেইনমেন্ট।” ইত্যাদি।
আর্থার কোয়েসলার-এর উপন্যাস Darkness at Noon মনে পড়তে বাধ্য।
আলোকলতার মূল গল্পটি এক গৃহবধূকে ঘিরে, যিনি বহু প্রতীক্ষার পরও নিষ্ফল এক তীব্র যৌনাকাঙ্ক্ষা বয়ে বেড়ান। তাঁর সামনে হঠাৎই “এক দরজা বহু দরজা হয়ে” যায়— গন্তব্যে পৌঁছনোর এক নতুন পথ খুলে যায় যেন।
কাছিমের কামড় বা একটি প্রেমকাহিনি বইয়ের অন্যতম দীর্ঘ গল্প। এতে উঠে এসেছে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব, যুক্তিবাদী-নাস্তিক-কমিউনিস্টের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার সংঘাত, দেহনির্ভর প্রেম তথা সন্তান-উৎপাদনের প্রবৃত্তির বিপরীতে পিউরিটান ভালোবাসার বিতর্কে জর্জরিত একজোড়া যুবক-যুবতীর ভাবনা। ইরোটিক ও পর্নোগ্রাফিক সাহিত্যকে কেন মূলধারার সাহিত্য থেকে আলাদা করা হয়— সে-প্রসঙ্গ এসেছে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে, শারীরিক উত্তেজনা সৃষ্টি না করেই।
এই আলোচনার সূত্র ধরেই শুনতে পাই— “পৃথিবীতে মার্কসবাদ ছাড়া আর কোনও আধুনিকতাই নেই,” মর্মে বিশ্বাসী আমাদের নেতারাও সংস্কার ও সামাজিকতার বাস্তবতা থেকে মুক্ত নন। আরও শুনতে পাই— “মানবতাবাদ হল পুঁজিবাদের নোংরা যোনি থেকে জন্মানো এক সুন্দর কাপুরুষ সন্তান। শুনতে ভালো, কিন্তু ফাঁপা অর্থহীন।”
নিপাতনে সিদ্ধ গল্পটি অপেক্ষাকৃত হালকা মেজাজের। শিক্ষাগত, সামাজিক ও ভৌগোলিক দূরত্বে বাস করেও— সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন দুজন ব্যক্তি কীভাবে এক অভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন, সেই বিস্ময় নিয়েই গল্পটি এগোয়। ‘ভোগে নয়, ত্যাগেই আনন্দ’— এই প্রচলিত দর্শনের বিপরীতে তাঁদের সিদ্ধান্তটি হল: “ভোগে সুখ নাই, কিন্তু টেস্ট আছে।” একজন তাঁর উপলব্ধি ব্যক্ত করেন মৃতের স্মরণে আয়োজিত মিলাদের তোবারক খেতে খেতে; অন্যজন জীবনে নতুন নতুন নারী ভোগ করে। এইসব কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকেই উঠে আসে কামরসের উপকরণ।
ভালোবাসা একটি চার অক্ষুরে শব্দ-ও হালকা মেজাজের একটি গল্প। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির অপেরা হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে স্বামীর কোমর জড়িয়ে এক সুখী দম্পতির ভঙ্গিতে ক্যামেরার সামনে পোজ দিতে দিতে এক মহিলা দেশে ফেলে আসা দুই সত্যিকারের প্রেমিকের কথা মনে করেন। একজনের সঙ্গে ছিল নিঃসংশয় দৈহিক সম্পর্ক; অপরজনের সঙ্গে শরীর ছাড়িয়ে তৈরি হয়েছিল গভীর মানসিক সংযোগ। দ্বিতীয়জনের লেখা আবেগময় প্রেমপত্রগুলো ছিল খুবই সুন্দর।
জীবন গল্পে, জীবন ও বেঁচে থাকার মধ্যেকার গূঢ় ও জটিল সম্পর্কটি আবিষ্কার করার প্রয়াস করা হয়েছে। পার্থিব প্রাপ্তি ও সামাজিক সফলতা সত্ত্বেও মানুষ যৌন অতৃপ্তির কারণে কেন আত্মহননের পথে এগিয়ে যায়, কোনও সমাধান দেওয়ার চেষ্টা না করেই, লেখক দুটি আলাদা চরিত্রের জীবনচিত্রের মাধ্যমে এই প্রশ্নকে পাঠকের সামনে মেলে ধরেছেন।
বইয়ের প্রথম গল্পটির মতোই, সর্বশেষ গল্প চক্কর-ও একটি কাহিনি-নির্ভর সনাতনী ছোটগল্প। অন্যদিকে, মাঝের গল্পগুলিকে ভাবনা-নির্ভর বা কথোপকথননির্ভর আধুনিক ছোটগল্প হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
চক্কর গল্পে দেখা যায়— সন্তান কামনায় এক শ্রমজীবী বিবাহিতা রমণী এক পরপুরুষে নিজের যৌনসুখ আবিষ্কার করে। এভাবে জীবন উপভোগে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা এই অভিজ্ঞতাকে লেখক এক ঘোরলাগা অথচ মানবিক বর্ণনায় উপস্থাপন করেছেন। জীবনকে উপভোগ ও মাতৃত্ববোধের মানসিক দোলাচল— এই দ্বৈত অনুভবই এই গল্পের মূল সুর।
লেখক পরিচিতি থেকে তাঁকে মধ্যবিত্ত সমাজের সুবিধাভোগী বলেই ধরে নেওয়া যায়। সেই কারণেই বইয়ের প্রথম বারোটি গল্পের পাত্রপাত্রী ও পারিপার্শ্বিকতা মূলত মধ্য ও উচ্চমধ্যবিত্তকে ঘিরে আবর্তিত হওয়াটা অস্বাভাবিক ঠেকে না— বরং লেখক সেই জগৎ অত্যন্ত দক্ষতা ও স্বাচ্ছন্দ্যে এঁকেছেন। কিন্তু মোটামুটি বড় কলেবরের সর্বশেষ গল্প চক্কর-এ দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে যায়। এখানে প্রায় সব পাত্রপাত্রীই নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী নারী ও পুরুষ। বাংলাভাষার খুব কম লেখকই এই সমাজের ভাষা, সংস্কৃতি ও মনস্তাত্ত্বিক সীমানায় প্রবেশ করতে পেরেছেন। সেই দিক থেকে হামীম কামরুল হক, সমাজগতভাবে এই সমাজের বাইরের একজন হয়েও, অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে সেই কাজটি করতে পেরেছেন— এটি নিঃসন্দেহে এক অসামান্য কৃতিত্ব। এই গল্পে প্রায় অশিক্ষিত ও অবহেলিত এক কাষ্ঠশিল্পীর মুখে লেখক বিশ্বখ্যাত ভাস্কর মাইকেলেঞ্জেলোর একটি উক্তি, কিছুটা হেরফের করে, ব্যবহার করেছেন। তবে তা উদ্ধৃতিচিহ্নে (‘ ’) সংরক্ষিত রেখে তিনি নিজের লেখকীয় সততাও বজায় রেখেছেন।

