বিদায় বাংলা সাহিত্যের মহান ভাষ্যকার

মোজাফ্‌ফর হোসেন

 


গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

গত ১৫ নভেম্বর প্রয়াত হলেন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখক হাসান আজিজুল হক। তাঁকে বাংলা ছোটগল্পের পালাবদলের অন্যতম প্রধান লেখক বলা হয়। ষাটের দশকের শুরুতে ‘শকুন’ গল্পটি লিখে তিনি দুই বাংলার লেখক ও সাহিত্যবোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এরপর ১৯৬৪ সালে ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ ও ১৯৬৮ সালে ‘আত্মজা ও একটি করবীগাছ’ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার। এ ‍দুটি বই লিখেই তিনি ১৯৭০ সালে পেয়ে যান বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা মোট ১০টি: সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, আমরা অপেক্ষা করছি, রোদে যাবো, মা-মেয়ের সংসার, বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প, রায় কুড়িয়ে বেল।

ছোটগল্পের পাশাপাশি তিনি তিনটি উপন্যাস লেখেন: শামুক, আগুনপাখি ও সাবিত্রী উপাখ্যান। শামুক লিখেছিলেন পঞ্চাশের দশকে, যদিও সেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। আগুনপাখি ২০০৬ ও সাবিত্রী উপাখ্যান ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। বিষয়বস্তুর দিক থেকে তাঁর উপন্যাস তাঁর ছোটগল্পেরই সম্প্রসারণ। হাসান আজিজুল হক আখ্যানপ্রধান কথাসাহিত্যিক। তাঁর কথাসাহিত্যের ধারাটি বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যগত এবং আগে-পরে জনপ্রিয়। কিন্তু তিনি সেই প্রচলিত গল্পের ধারাকে আরও সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করেছেন। নিজের একটি সিগনেচার তৈরি করেছেন ভাষা ও বিষয়বস্তুতে। বাংলাদেশের দেশভাগের সাহিত্যের স্বরূপ তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। এই বঙ্গের গণমানুষ ও প্রান্তিক মানুষ, দাঙ্গা, খরা, দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা, মুক্তিযুদ্ধ, রাঢ়বঙ্গের প্রকৃতি এসবই তাঁর ছোটগল্পে ফটোগ্রাফিকভাবে চিত্রিত হয়েছে। হাসান আজিজুল হক নিজেই দেশভাগের মর্মন্তুদ ইতিহাসের প্রোটাগনিস্ট, ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন দেশভাগপরবর্তী অখণ্ড বাংলা ও উপনিবেশ-উত্তর বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর। তাই তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের গল্পকাররা জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে তাঁর গল্প দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হন। সাহিত্যের ইতিহাসে এটা প্রমাণিত সত্য, আখ্যান বাদ দিয়ে কথাসাহিত্য খুব বেশি এগুতে পারবে না, ফলে নিরীক্ষা যতই হোক, হাসান আজিজুল হক পাঠ সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সাহিত্যের ঐতিহ্য এবং বাংলার ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য তাঁর গল্প-উপন্যাস তরুণ লেখকদের স্কুলিংয়ে কাজ করতে পারে। এইসব কারণে তাঁর কথাসাহিত্য বাদ দিয়ে আমাদের সাহিত্যের পাঠ হবে অসম্পূর্ণ, অপরিণত।

গল্প-উপন্যাসের বাইরে সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বিপুল মননশীল প্রবন্ধ ও চার খণ্ড স্মৃতিকথা লিখেছেন। স্মৃতি থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, ততই নির্মোহ থেকে, ততই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় নিজেকে। কাজেই বয়সকালই স্মৃতিকথা লেখবার উপযুক্ত সময়। আপাতদৃষ্টিতে, প্রসঙ্গটা আইরনিক্যাল মনে হলেও এর সঙ্গে সাইকোলজিক্যাল সম্বন্ধ জড়িয়ে আছে— জীবনসায়াহ্নে এসে কার না শিশু হতে ইচ্ছে করে! মৃত্যুভাবনা থেকে বের হওয়ার জন্য শিশুকালে নিজের শিকড় গাড়া মনের একটা স্কেপিজম অবস্থা থেকেই হয়ে থাকে। অনেক সময় স্মৃতিকাতরতা (হাসান আজিজুল হকের ক্ষেত্রে হোমসিকনেসও বলা যেতে পারে) একটা বয়সে গিয়ে রোগের মতো আচরণ করে। এজন্যে দেখা যায়, একজন আধাবয়সী তার শিশুকাল সম্পর্কে অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না, অথচ বয়সকালে এসে ঠিকই পাই পাই করে সব বলে দিতে পারেন! সময়ের অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বেলায়ও হয়ত একই ঘটনা ঘটেছে। তবে তাঁর ক্ষেত্রে মেজর ফ্যাক্টর ‘স্কেপিজম’ নয়, দায়িত্ববোধ। বলার কিছু বাকি ছিল বলেই তিনি সত্তর বছর বয়সে এসে আলাদা করে লিখতে শুরু করলেন তাঁর শৈশব-কৈশোর নিয়ে। এর আগে তিনি তাঁর রচনাসমগ্রে— গল্প ও উপন্যাসে— টুকরো টুকরো করে সেইসব দিনকালের কথা কিছু লিখেছেন। কিন্তু পাহাড়সমান স্মৃতির ভার যার মাথায়, তিনি কি আর অল্পতে খুশি হতে পারেন! এজন্যেই তিনি স্মৃতিচালিত হয়ে পড়লেন। গল্প লেখা প্রায় ছেড়ে দিয়ে লিখলেন চার খণ্ডে আত্মস্মৃতি ও স্মৃতিকথনমূলক গ্রন্থ— ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ (২০০৯, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ), ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ (২০১১, ঐ), ‘এই পুরাতন আখরগুলি’ (২০১৪, ঐ) ও ‘দুয়ার হতে দূরে’ (২০১৭, ঐ)। লিখলেন যে দুটি উপন্যাস— ‘আগুনপাখি’ (২০০৬, ঐ) ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ (২০১৩, ঐ) — তাও তাঁর স্মৃতিসিক্ত। স্মৃতিকথার প্রথম পর্ব ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ একালের হাসান গুরুত্বপূর্ণ এক কথা দিয়ে শুরু করেছেন—

স্মৃতিকে কতোটা পিছনে নেওয়া যায়, নিশ্চয়ই চেতনার পিছনে নয়। আমার ধারণা শুধুমাত্র চেতনাতেও স্মৃতি নেই, যদি থাকেও তা আধো অন্ধকারেই ডুবে থাকে। আত্মচেতনা থেকেই স্মৃতির শুরু। জন্মের পর থেকে চেতনা আছে, গূঢ় রহস্যময় চেতনা কিন্তু স্মৃতি নেই। চেতনা-আত্মচেতনার মাঝখানের সান্ধ্য জায়গায়টায় অনেকবার ফিরে ফিরে যেতে চেয়েছি। তাই ফিরে যাই, ফিরে আসি।

হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক পরিচয়ের মাঝে চাপা পড়ে গেছে তাঁর আরও এক সুকীর্তি। তিনি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ এক শিশুসাহিত্যিক। উপন্যাসের মতো এখানেও তাঁর সৃষ্টি বিপুল নয়। মাত্র দুটি বই লিখেছেন শিশুদের জন্য: ‘লাল ঘোড়া আমি’ ও ‘ফুটবল থেকে সাবধান’। ‘লাল ঘোড়া আমি’ একটি উপন্যাসিকা বা বড় গল্প। অন্যটি একটি গল্পগ্রন্থ, সাতটি ক্ষীণকায় গল্প আছে এখানে। হাসানের অন্য কোনও লেখায় যে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি ঘটেনি তা কিন্তু নয়। তাঁর বিখ্যাত ‘শকুন’ গল্পটির কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে—

কয়েকটি ছেলে বসে ছিল সন্ধ্যার পর। তেঁতুলগাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়লা হাফশার্টকে আসন করে। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল।

–‘শকুন’, ১৯৬০

কয়েকটি কৌতূহলী কিশোরের একটি শকুনকেন্দ্রিক সন্ধ্যা ও রাত্রিযাপনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় পুরো গল্প। শেষ অবধি সেখান থেকে যে সত্য বের হয়ে আসে, সে সত্যের নাগাল শিশু-কিশোররা পায় না। এছাড়াও, গল্পটিতে গদ্যের গাঁথুনি, শব্দের সংস্থাপন, উপমার উপস্থাপন কোনও কিছুই শিশু-কিশোর উপযোগী নয়। তাই শেষতক, গল্পটি হয়ে ওঠে একটি সিরিয়াস বড়দের গল্প। ‘শকুন’ গল্পের কিছুকাল পরেই রচনা করেন ‘একটি আত্মরক্ষার কাহিনী’ (১৯৬৩) গল্পটি। কিশোর রেজার বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক ও শারীরিক যে টানাপোড়েন তার উপস্থিতি ঘটেছে এই গল্পে। গল্পটি যথার্থ কিশোর-উপযোগী গল্প হয়ে উঠেছে। পরের বছর রচনা করেন আরও একটু গভীর জীবনবোধ সর্বস্ব ‘সারাদুপুর’ (১৯৬৪) গল্পটি। কাঁকন নামক নিঃসঙ্গ এক কিশোররের আত্মোপলব্ধির গল্প এটি। কাঁকন তার চারপাশ সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। সে অনুভব করে—

শীতে গাছের পাতাগুলোকে বিশ্রী দেখচ্ছে, পথের ওপর ছায়া ভয়ানক ঠান্ডা আর ঘাসের ভেতর রাস্তার রং দুধের মতো সাদা। ঘাস এখনও হলদে হয়নি— হবে হবে করছে। এই সব আধ-মরা ঘাসের ওপর শিশির আধাআধি শুকিয়েছে এতটা বেলা হয়েছে। রোদ কেবল এই সময়টায় একবার চড়াৎ করে উঠেছে, খেজুর গাছে ঘুঘু ডাকছে, অমনি মন কেমন করে উঠলো কাঁকনের। সব মরে যাচ্ছে গো— কাঁকন এই কথাটা শোনাবার মত লোক খুঁজে পেল না।

–‘সারাদুপুর’

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে তার হাহাকার, হতাশা ও জীবন সম্পর্কে কৌতূহল। গল্পটি হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এ অন্তর্ভুক্ত। অগ্রগণ্য আলোচকদের পাশাপাশি লেখক নিজেও হয়ত এটিকে বড়দের গল্প হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। আমি হলপ করে বলতে পারি, কিশোররাও এই গল্পের রস আস্বাদন করতে সক্ষম হবে, চমৎকার এই গল্পের চমৎকারিত্বে চমৎকৃত হবে তাদের জীবনবোধ। হাসান আজিজুল হক আত্মজীবনী লিখেছেন, সেখানেও একজন শিশু ও কিশোর হাসান আজিজুল হকের জীবনবৃত্তান্ত বিধৃত হলেও সেটা মূলত বড়দের জন্যেই লেখা, শিশু-কিশোরদের জন্যে তা মোটেও সুখপাঠ্য হবে না। সেই হিসেবে পরিকল্পনা করে শিশুদের জন্য লিখেছেন উল্লিখিত দুটি বই।

শিশু অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ‘লাল ঘোড়া আমি’ (১৯৮৪)। এটি একটি ঘোড়ার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এ ধরনের বইকে ইংরেজিতে ‘fictional pony book’ বলা হয়। ঘোড়াটি নিজেই বলে চলেছে তার আত্মকথা। হাসান আজিজুল হক এখানে একটি ঘোড়ার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন, অর্থাৎ তিনি এখানে ঘোড়ার চোখ দিয়ে পৃথিবীর প্রকৃতি ও প্রাণীজগৎ প্রত্যক্ষ করছেন। আর প্রত্যক্ষ করছেন মানুষ।

হাসান আজিজুল হক আজ আর আমাদের মাঝে সশরীরে নেই। কিন্তু তিনি আছেন তাঁর সৃষ্টি দিয়ে। বড়দের লেখক হিসেবে স্বীকৃত হাসান আজিজুল হক বর্তমান ও আগামী দিনের শিশুদের লেখকও হয়ে উঠুন, এটিই প্রত্যাশা করি। তাঁর মতো মহান লেখকের সঙ্গে আমাদের শিশুদের সাক্ষাৎ ঘটুক ‘লাল ঘোড়া আমি’ কিংবা ‘ফুটবল থেকে সাবধান’ বইয়ের মাধ্যমে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...