সোহম দাস
ক্রিকেট বা ক্রিকেটের সমাজদর্শন নিয়ে কথা হবে, আর সেখানে ত্রিনিদাদ-জাতক সিরিল লায়নেল রবার্ট জেমসের কথা আসবে না— তা কী করে হয়! ক্রিকেট নিয়ে গভীর চর্চায় নিমগ্ন গবেষক থেকে শুরু করে নিজের ফেসবুক পেজে বিরাট কোহলির সেঞ্চুরি নিয়ে আবেগে গদগদ (কখনও, আদ্যোপান্ত ভুল বানানে) পোস্ট নামানো স্বঘোষিত ব্লগার-বিশেষজ্ঞ— প্রায় সকলেই, প্রসঙ্গ জেনে বা না-জেনে, কোনও না কোনও সময়ে সিএলআর-এর সেই অমোঘ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন। ১৯৬৩ সালে যখন তাঁর বহু আলোড়ন-তোলা Beyond a Boundary লন্ডনের হাচিনসন থেকে প্রকাশিত হয়, তখন এই মার্কসবাদী ঐতিহাসিক মুখবন্ধেই স্পষ্ট লিখে দেন—
This book is neither cricket reminiscences nor autobiography. It poses the question: What do they know of cricket who only cricket know? To answer involves ideas as well as facts.
সিএলআর জেমস ক্যারিবীয় অঞ্চলের মানুষ ছিলেন। ইউরোপীয় দখলদারির কদর্যতার যুগসাক্ষী তাঁর দেশ। সেখানে টুনাপুনার কালো পাড়াগুলো থেকে দ্বীপে দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ছে শ্বেতাঙ্গ রাজক্রীড়া, প্রাক-বিশ্বযুদ্ধ কালের জর্জ হেডলি থেকে উত্তর-ঔপনিবেশিক ক্রিকেট-জগতের ফ্র্যাঙ্ক ওরেল বা রয় গিলক্রিস্ট, কিংবা অতিমানব গারফিল্ড সোবার্স— ভূ-রাজনৈতিক চিন্তাবিশ্বে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের এই উত্থানকে মার্কসবাদী সিরিল সাহেব উপস্থাপন করেছিলেন সহজ, ব্যক্তিগত অনুভবের মোড়কে। যাই হোক, আপাতত যে বইটি নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি— যার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য, তার প্রকাশ এই প্রায়-মৃত বাংলা বাজারে— সেখানে এই স্বল্প গৌরচন্দ্রিকা প্রয়োজনীয় ছিল।
ব্ল্যাকলেটার্স থেকে মাস কয়েক আগে প্রকাশিত হয়েছে সাংবাদিক-লেখক প্রতীকের হিন্দুত্বের কবলে নতুন ভারতীয় ক্রিকেট। সিএলআর সাহেবদের প্রজন্ম যখন মোটামুটি অস্তমিত, তার ঠিক পরবর্তী যুগের ভারতীয় ক্রিকেট-মানসের বিবর্তন নিয়ে এই বই। চমকপ্রদভাবে, সিএলআর জেমস প্রয়াত হচ্ছেন যে-বছরে, সেই বছরেরই শেষদিকে পাকিস্তান সিরিজে ভারতের ব্যাটিং লাইন-আপে আত্মপ্রকাশ ঘটছে কোঁকড়াচুলো এক মারাঠি সদ্যযুবার— যিনি এক বছরের মধ্যেই বিলিতি ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে শতরান করে হয়ে উঠবেন আগামী দুই প্রজন্মের কাছে অবিসংবাদী দেবনায়ক। প্রতীকের বইয়ের প্রথমাংশ দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘটনার ভিতের ওপর— ‘দেবতার জন্ম’।
ভারতীয় ক্রিকেটে শচীন তেণ্ডুলকরের উত্থান, ততদিনে অবসরে চলে যাওয়া তাঁরই শহরের সুনীল গাভাস্করের মতো হয়নি। সানি তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলেছিলেন ১৯৭১ সালে, ওয়েস্ট ইন্ডিজে। পাঁচ টেস্টের সেই সিরিজে প্রথম টেস্ট খেলতে পারেননি নখে সংক্রমণের কারণে। কিন্তু পরের চার টেস্টে তিনি করেছিলেন চারটি শতরান (যার মধ্যে পোর্ট অব স্পেনের পঞ্চম টেস্টে দুই ইনিংসে যথাক্রমে ১২৪ ও ২২০ স্মরণীয়) এবং তিনটি অর্ধশতরান-সহ ১৫৪.৮০ গড়ে মোট ৭৭৪ রান করেন— অভিষেক সিরিজে করা সর্বাধিক রানের এই রেকর্ড এখনও অক্ষত। যদিও পরের কিছু সিরিজে তাঁর ব্যাটে সেই স্বাভাবিক নৈপুণ্য দেখা যায়নি।
শচীনের উত্থান ছিল সেখানে অনেক ধীরগতির, অথচ ধারাবাহিক। ১৯৯১-৯২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে সিডনিতে অপরাজিত ১৪৮ বা পারথের দ্রুতগতির পিচে করা ১১৪ দেখে শুধু গাভাস্কর কেন— তিনি যে অ্যালান বর্ডারকেও ছাপিয়ে যেতে পারেন, খোদ অজি ক্রিকেটারদের মধ্যেই তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই বছরের শেষের দিকেই সদ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে আসা দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে আরও একটি সেঞ্চুরি— সব মিলিয়ে জনপূজ্য হওয়ার বেদিটা একটু একটু করে তৈরি হচ্ছিলই।
এবার সময়টা একবার যদি দেখি— মগ্ন পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রতীকও যেভাবে দেখিয়েছেন— দেখা যাবে, ভারতের বুকে তখন একসঙ্গে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এক, সোভিয়েত পতনের পর বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের অর্থনীতি গভীর সংকটে। সমাজতান্ত্রিক সমাধানের পথ না পেয়ে নরসিমা সরকারের আমলে মনমোহন সিংয়ের অর্থনীতি মন্ত্রক খুলে দিলেন ঢালাও বিদেশি বিনিয়োগের দরজা। আর দুই, ভবিষ্যৎ রাজনীতির সম্মতি নির্মাণে যে ঘটনাটি আরও অনেক গভীর তাৎপর্য নিয়ে হাজির হল, তা হল নব্য-হিন্দুত্ববাদের উত্থান।
জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্সে অ্যালান ডোনাল্ড, ব্রায়ান ম্যাকমিলান, ক্রেগ ম্যাথুজদের সামলে একা কুম্ভের মতো শচীন যেদিন ১১১ (তাঁর পরে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল কপিলদেবের ২৫) করলেন, ঠিক তার ন-দিনের মাথাতেই করসেবকদের হামলায় ভেঙে পড়েছিল কয়েক শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ। নব্য হিন্দুত্বের ওই চারা-পর্বে ক্রিকেটও তার থাবা এড়াতে পারেনি। ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে, সুনীল-শচীনদের ছেলেবেলার মাঠ বোম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম হোক বা ১৯৯৯-তে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম (বর্তমানে অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম)— ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের বিরোধিতা করতে গিয়ে পিচ খুঁড়ে দিয়েছিল শিবসেনার স্বেচ্ছাসেবকরা। আর ওই দশকেরই মাঝামাঝি সময়ে, উপমহাদেশের ক্রিকেট-অর্থনীতিতে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছিলেন প্রায়-বিস্মৃত ওয়ার্ল্ডটেলের মার্ক মাসকারেনহাস। একসময়ে প্রবল নিন্দিত কেরি প্যাকার মডেলই তখন ‘নিউ নর্মাল’। ফুটবল-হকিতে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসা ভূখণ্ডে ততদিনে অবিসংবাদী ক্রীড়াতারকা হয়ে উঠেছেন ওপেনার শচীন। তাঁর ম্যানেজার হওয়ার দায়িত্ব নিলেন মার্ক— আসলে, ‘তারকা থেকে দেবতা’ করে তোলার নিখুঁত বাজারি ছক।
প্রতীকের নতুন বই এই সময়ের স্মৃতিকে প্রায় অতল থেকেই খুঁড়ে আনে।
বইয়ের নাম, মাঠজুড়ে ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার বিশাল পতাকা-সম্বলিত জাতীয়তাবাদী প্রচ্ছদ-চিত্রটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বইটির মূল ফোকাস অবশ্যই বর্তমান সময়ে স্থির। খুব সরাসরিভাবে বলতে গেলে, বিগত কয়েক বছরের ভারতীয় ক্রিকেটের হাঁ-মুখো চেহারার সঙ্গে ক্ষমতায় থাকা দলের উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সাযুজ্যপূর্ণ চরিত্রবিশ্লেষণই হল এই বইয়ের উপজীব্য। বিমুদ্রাকরণের মতো দেশের অর্থনীতি-পরিকাঠামোর কোমর ভেঙে দেওয়া নীতিকে সমর্থন দেওয়ার ঘটনা বা কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে হোলসেল বিবৃতি দেওয়ার বিষয়গুলো খুব নতুন কিছু নয়, গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া এ-দেশের ক্রীড়াব্যক্তিত্বরা বরাবরই ক্ষমতার অলিন্দের কাছাকাছি থাকতে ভালোবেসেছেন। কিন্তু, তা বাদ দিয়ে যে অনাবশ্যক ঔদ্ধত্য নিয়ে পুরুষ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাংবাদিকদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করেন, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট পছন্দ করার ‘অপরাধে’ জনৈক ক্রিকেটপ্রেমীকে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে থাকতে বলেন, কৌতূহলী সাংবাদিক ‘ভুলবশত’ তাঁর স্ত্রী-সহ আদরের কন্যার ছবি তুলে ফেললে ক্ষমতার বাহাদুরি দেখিয়ে ছবি তুলে নিতে বলেন— এই ঔদ্ধত্যকেও প্রতীক একই স্পর্ধায় প্রশ্ন করেন।
শিক্ষানবিশি থেকে নামী সংবাদমাধ্যমের অভিজ্ঞ সাংবাদিক হয়ে ওঠা, দেড় দশকের ক্রীড়া সাংবাদিকতার জীবনে এবং তার পরবর্তী পাঁচ বছরে প্রতীক যা কিছু প্রত্যক্ষ করেছেন, এই সময়কালে ভারতীয় ক্রিকেটে ‘দেবতা-পরিবর্তনের’ চাকাটি ঘুরেছে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে— একদিকে ইঁদুরদৌড়, অন্যদিকে ভুলিয়ে দেওয়ার গতি— দুইয়ের যুগল ধাক্কায়। ২০০৫ সালে প্রতীক সাংবাদিকতা শুরু করেছেন। সেই বছরই গ্রেগ চ্যাপেল কোচ হয়ে আসার পর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে যখন অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, পরে দল থেকেও অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়া হল, তখন শ্রেণিনির্বিশেষে গোটা বাঙালি সমাজই গুরু গ্রেগ আর সদ্য-নিযুক্ত অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়কে যে কায়দায় জাতীয় খলনায়ক বানিয়ে ফেলেছিল— সেই সময় থেকেই মোটামুটি দেবতা-নির্মাণের নগ্নতাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
বঞ্চনার বাংলা থেকে বিশ্বমানের উইকেটরক্ষক হিসেবে উঠে আসা শিলিগুড়ির চাকচিক্যহীন, ‘কালোকোলো বেঁটেখাটো রোগাসোগা’ ঋদ্ধিমান সাহার প্রতি কলকাত্তাইয়া বোদ্ধা বাঙালির যে অসহ্য শীতলতা, তা নিয়ে বলতে গিয়ে প্রতীক দ্বিধাহীন। তিনি লিখেছেন, ২০০৫-এর নভেম্বরে ইডেনে সৌরভ-হীন ভারতীয় দল দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে লেজে-গোবরে হয়ে যাওয়া দেখে কলকাতার দর্শকের তুমুল আনন্দ-উচ্ছ্বাসের যে জাতীয়তাবোধ ইডেনের বুকে ঝরে পড়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও ঋদ্ধির বেলায় দেখা গেল না। বর্তমান আলোচক তখন নেহাতই প্রাক-বয়ঃসন্ধির কিশোর। তবু তারও দিব্যি মনে আছে— আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ইংরেজি দৈনিক The Telegraph প্রথম পাতায় শিরোনাম করেছিল: “189 ALL OUT, 159 ONE OUT.” প্রসঙ্গত, সেদিন পিচের চরিত্র বুঝতে না পেরে ভারতীয় দলের ইনিংস ১৮৯ রানে গুটিয়ে যায়, আর সেদিনই পুনেতে রঞ্জি ম্যাচে মহারাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সৌরভ করেন ১৫৯।
আসলে, ২০০০ সালে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর যে সাহস, দূরদৃষ্টি আর দক্ষতায় গড়াপেটা-জর্জর কুখ্যাতি আর দলের সামগ্রিক অনভিজ্ঞতা সামলে সৌরভ ভারতীয় দলকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, বাংলার মিডিয়া-শার্দূলরা তা নিয়ে ক্রিকেটীয় বিচার-বিশ্লেষণের রাস্তায় না হেঁটে আবেগে গদগদ গদ্য লিখে খেলার পাতা ভরাতেন। সৌরভকে বাঙালির মসিহা বানিয়ে, এঁরা মোটামুটি ক্ষমতার গুডবুকে নিজেদের নাম পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন। ফলে সৌরভকে বাদ দেওয়ার পরে যেটা করা হচ্ছিল, সেটাও যে অন্যায়ই, তা নিয়ে একটা কথা খরচ করতেও তাঁদের আগ্রহ ছিল না। বরং বারবার বলা হচ্ছিল, দল সৌরভ ছাড়া কতটা খারাপ করছে— যদিও শুরুতে ফলাফল বিপরীতই হচ্ছিল— বলে-টলে পালে হাওয়া দিয়েছিলেন।
পেশাসূত্রে প্রতীক দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন এই বাস্তুতন্ত্রের অভ্যন্তরে। উচ্চপদে থাকার সুবাদে ক্ষমতার আঁচও বুঝেছেন দিব্যি। ২০০৮ সালে যখন আইপিএল শুরু হয়, তখন তিনি হায়দরাবাদের সংবাদ সংস্থা ডেকান ক্রনিক্যাল-এর বেতনভুক সাংবাদিক— যে ডেকান ক্রনিক্যাল-এর মালিকানাধীন দল ছিল লক্ষ্মণ, গিলক্রিস্ট, গিবস, চামিন্ডা ভাসদের ডেকান চার্জার্স। ফলে ‘আইপিএল-নাস্তিক’ হতেও যেমন তাঁর অসুবিধা হয় না, সৌরভের ভারতীয় ক্রিকেটে অবদান ও নৈতিক অধঃপতন নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও দ্বিধা হয় না; আবার ঠিক তেমনই দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই আক্রমণ শানাতে পারেন তাঁর ফ্র্যাটার্নিটির প্রতিও—
আসলে ভারতীয় ক্রিকেট কোনোদিনই পুরোপুরি ক্রিকেটীয় যুক্তি মেনে চলে না, আর ভারতীয় সাংবাদিকতা বহুদিন হল সাংবাদিকতার যুক্তি মেনে চলে না।… ক্রিকেট সাংবাদিকতাকে সফলভাবে গসিপ সাংবাদিকতায় পরিণত করা হয়েছে গত শতকের শেষ থেকেই।
বইজুড়ে প্রতীক একাধিক বিষয়ে কথা বলেছেন। সাংবাদিকতার মহৎ শর্ত মেনে পাশে দাঁড়িয়েছেন একাধিক ক্রিকেটারের, যাঁরা এই দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্রে খাপ খাননি, আজগুবি গপ্পো ফেঁদে যাঁদের একঘরে করেছে অবতার-শাসিত ভারতীয় ক্রিকেট। সেই তালিকায় যেমন আছেন ঋদ্ধিমান সাহা ও রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটার, তেমনই আছেন মহম্মদ শামি ও ওয়াসিম জাফরের মতো সংখ্যালঘু ক্রিকেটাররাও— সঙ্গত কারণেই।
৭৬৫ খানা আন্তর্জাতিক উইকেট পাওয়া রবি অশ্বিনকে অবসরের পর মাইক আথারটন ও নাসের হুসেনের সামনে বলতে হয়— “Don’t think this corporate or office felt I was good enough for leadership, and that doesn’t mean I am not good enough for leadership.” ভারতীয় ক্রিকেট দল যে আদৌ বহুত্বময় দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে না— বরং তা হয়ে উঠেছে বিসিসিআই নামক এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের একটি শাখামাত্র— এ সত্যি স্বীকার করার সাহস আজ হয়তো অশ্বিনের মতো হাতে-গোনা দু-একজনেরই আছে।
দেশের হয়ে খান দুয়েক দ্বিশতরান করা ওয়াসিম জাফরের বিরুদ্ধে যখন ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ তোলে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতায় ধুয়ো দেওয়া ক্রিকেট-প্রশাসকরাই, তখনও দেখা যায়, হাতে-গোনা কয়েকজন ক্রিকেটার বাদে বাকিরা সকলেই চুপ। এমনকি আহমেদাবাদের স্টেডিয়ামে মহম্মদ শামির দিকে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ছুড়ে দেওয়ার পরও দলের তরফে বা বোর্ডের পক্ষ থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হেড কোচ রাহুল দ্রাবিড় তো চিরকাল এমনই মাটিতে-পা রেখে চলেন যে কোনও অন্যায়ই তাঁর জল-স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে স্পর্শ-টর্শ করে না। মাস্টারমশাই তিনি কোনওদিনই কিছু দেখতে পান না। আর বিরাট কোহলি সোশাল মিডিয়ায় শামিকে উদ্দেশ করে আক্রমণকারীদের জবাব দিচ্ছেন— বাস্তবে তাঁকে সেই অবতারে পাওয়া দুষ্কর।
বইটা পড়তে গিয়ে জায়গায়-জায়গায় প্রতীকের উপর রাগ হতে পারে। ব্যক্তিসর্বস্বতার এই যুগে কেউ যদি লেখেন—
এখন মুশকিল হল— চেতেশ্বর পূজারা, অজিঙ্ক, ঋদ্ধিমানের মতো লোকেরা ক্রিকেট খেলতে শিখেছেন। আক্রমণাত্মক ইংরিজি বলতে শেখেননি; বলিউডি নায়িকার সঙ্গে প্রেম করতে পারেননি; মাঠে নেমে স্রেফ ক্যাচ ধরে, স্টাম্পিং করে আর রান করে চলে আসা যে কর্তব্য নয়, তা-ও বোঝেননি।
তাতে রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক বৈকি।
বাংলার বাইরের কথা ছেড়ে দিলাম, সোশাল মিডিয়ার আসার পরে বাংলা থেকে যে হারে ক্রিকেট-লিখিয়ে বা ক্রীড়া-লিখিয়ে গজিয়েছে (ওই সংখ্যক খেলোয়াড় গজালে নিঃসন্দেহে লাভই হত, যাকগে), তাঁদের মধ্যে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ বা উগ্রতা-বিরোধীদের কাছেও বিরাটের আগ্রাসন বা ক্ষমতাদম্ভী আচরণ দিব্যি মান্যতা পেয়ে যায়। তাঁদের সকলেরই এ-বই পড়লে খেপে ওঠার সম্ভাবনা আছে। অতএব, সাবধান।
প্রতীকের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি ঠিককে ‘ঠিক’ বলেন, আর ভুলকে ‘ভুল’। বড় ক্রিকেটারদের নিয়ে বলতে গিয়ে কেবল প্রশংসা বা নিছক নিন্দার কোনও অযৌক্তিক মেরুকরণ তাঁর লেখায় নেই। আবার, তিনি যে কবিও, সে পরিচয়ও পাঠক পেয়ে যেতে পারেন মাঝেমধ্যে। যেমন, প্রথম অধ্যায়েই কী সহজসুন্দর একটা বাক্যের দেখা পেলাম—
ক্রিকেট খেলায় একমাত্র বোলিংটাই ক্রিয়া; ব্যাটিং আর ফিল্ডিং হল প্রতিক্রিয়া।
নয়ের দশকের একদম শুরুতেই রামমন্দির আন্দোলন ও লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রার মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদের যে দুর্গ গড়ার প্রকল্প শুরু হয়েছিল, সাড়ে তিন দশক পেরিয়ে এসে তা মোটামুটি সফল বলাই যায়। তবে সভ্যতার নিয়মে, প্রতিরোধের ধারাবাহিকতায় সে-দুর্গে অল্প হলেও ফাটল ধরেছে, ২০২৪-এর নির্বাচনের ফলাফল সেই ইঙ্গিত পেয়েছি আমরা। নব্য ভারতের মুসোলিনি-সম আদবানিকেও আজ ফিকে মনে হয় তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে, যদিও, ক্রিকেটকে গিলে খাওয়ার রাজনীতিতে সকলেই আস্থা রেখেছেন। কেবল আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনই নয়, আয়োজক দেশ হিসেবে সর্বোত্তম সাফল্য লাভ করে নিজেদের সর্ব-বিদ্বেষী রাজনীতি প্রচারের সুবিদিত হাতিয়ারটিরও সাফল্যের বেদি প্রায় প্রস্তুতই হয়ে গিয়েছিল। বেনিতো মুসোলিনির ১৯৩৪-এর ইতালি ফুটবল বিশ্বকাপ, অ্যাডলফ হিটলারের ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিক্স, কিংবা হোরগে রাফায়েল ভিদেলার ১৯৭৮-এর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ আয়োজনের ছাঁচেই ২০২৩-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপটি আয়োজিত হয়েছিল। সর্দার প্যাটেল স্টেডিয়াম ভেঙে তৈরি করা নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ফেলা, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দিন ভারতীয় দলকে গেরুয়া জার্সি পরে খেলার অনুরোধ— সবই একটি পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের অনুসরণ।
কিন্তু সেই চিত্রনাট্যে ছাই দিয়ে গেল প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালের পরে, বিজয়ী অধিনায়কের হাতে ট্রফি তুলে দিয়ে তাঁকে মঞ্চে একলাটি দাঁড় করিয়ে রেখে প্রধানমন্ত্রী যতই ভারতীয় সাজঘরে গিয়ে ক্রিকেটারদের সঙ্গে ‘বিরিঞ্চিবাবা’-র গণেশ মামা-স্টাইলে ‘হেঁ-হেঁ’ করতে ছুটুন, কি ফাইনালে দুরন্ত ক্যাচ নিয়ে রোহিত শর্মাকে ফেরানো এবং পরে ১৩৭ করা ট্র্যাভিস হেডের কন্যাকে যতই ধর্ষণের হুমকি দিক নব্য ভারতের পোস্টারবয় দর্শকরা, যাবতীয় স্বপ্নের বেলুন ফুটো হয়ে গিয়েছিল হেড-লাবুশানের পার্টনারশিপেই। প্রতীকের বইয়ের শেষ লেখাটি— ‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের হাতে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বিষক্রিয়ার সাক্ষীর জবানবন্দি’— এই গোটা সাড়ে তিন দশকের রাজনীতি-ক্রিকেটের প্রেম-পরিণয়ের আশ্চর্য ব্যক্তিগত ধারাবিবরণী।
প্রতীক জানেন, এ বই থেকে তাঁর প্রাপ্তির বেশিরভাগটা জুড়েই থাকবে উগ্র বিরোধিতা। কারণ, সৎ ও যুক্তিবাদী সাংবাদিক এবং ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ হিসেবে তিনি সেই কথাগুলোই লিখেছেন, এমনকি বইয়ের ভূমিকায় স্বীকারও করেছেন, ঠিক যে কথাগুলো সিরিল সাহেবের বইয়ের সুবর্ণজয়ন্তী সংস্করণের প্রাককথনে রবার্ট লিপসাইট লিখেছিলেন:
Lurking beyond the boundaries of every game are the controlling interests, the forces of oppression: the economics of the owners, the politics of the government, even the passions of the fans. Sports is no sanctuary from the real world because sport is part of the real world, and the liberation and the oppression are inextricably bound.
এমন একটি বইয়ের— যার উৎসর্গ (“আমার যে বন্ধুদের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দিন অন্য বন্ধুরা আড়চোখে দেখত”) থেকে শেষ পৃষ্ঠার শেষ বাক্য পর্যন্ত পথ্যি-তেতো বক্তব্যে ঠাসা— তার নির্মাণ নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়।
প্রকাশকের তরফে স্পষ্ট স্বীকার করা হয়েছে, এই বই প্রকাশ করা তাঁদের রাজনৈতিক দায়। নিঃসন্দেহে, এমন স্বীকারোক্তি কুর্নিশযোগ্য। কিন্তু, নির্মাণের দিক থেকে সেই দায়ের সমান পেশাদারিত্ব দেখা যায় না। লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে কী ধরনের পেশাদারি বা ব্যবসায়িক আলোচনা হয়েছে, তা এখানে বিবেচ্য নয়, আমাদের জানার কথাও নয়— বিচার্য হল পাঠকের হাতে পৌঁছনো বইটি কীভাবে উপস্থাপিত। সেই জায়গায় অন্তত দুটি স্পষ্ট খামতি চোখে পড়ে।
প্রথমত, গঠনের দিক থেকে বইটি দুটি বিভাগে বিভক্ত— দুটি বিভাগের অধীনে আলাদা কয়েকটি প্রবন্ধ— অথচ কোনও সূচিপত্র নেই। এতে, কোনও কোনও পাঠকের বইটি পড়ে দেখার উৎসাহ চলে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, বইয়ের জ্যাকেটের সামনের ফ্ল্যাপে এবং ইনসাইড ফ্রন্ট কভারে, দুটোতেই বই-পরিচিতি, আবার পিছনের ফ্ল্যাপ এবং ইনসাইড ব্যাক কভার, দু-জায়গাতেই লেখক-পরিচিতি। মজা করে বলা যায়, জ্যাকেটটি হারিয়ে গেলেও পাঠকের যাতে কিনতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে-কথা মাথায় রেখেই হয়তো এমন পরিকল্পনা! কিন্তু ব্যাপারটা সামগ্রিকভাবে চূড়ান্ত দৃষ্টিকটু।
পরবর্তী সংস্করণ হলে প্রকাশক এগুলি শুধরে নিলেই বোধহয় ভালো।

