যারা ক্রিকেট ভালবাসে না…

সৌমিত দেব

 

ক্রিকেট শব্দটা শুনলে আমার মনে পড়ে ১৯৯৪ সাল, বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল। ভারত হারিয়ে দিল পাকিস্তানকে। হ্যাঁ শচিনের দুশো, ভারতের ২০১১-র বিশ্বকাপ জয়, বিনোদ কাম্বলির ২০০২ সালে ‘অনর্থ’ নামক একটি হিন্দি ছবিতে ‘বান্ডিয়া’র চরিত্রে অভিনয়, ইত্যাদি আরও নানাবিধ মুহূর্ত থাকতেও, ভারতীয় ক্রিকেট বলতে ওই দিনটিই আমার স্মৃতিকোটায় অগ্রাধিকার পায়। কারণ পাঁচ বছর বয়সী আমি সেইদিনই প্রথম জেনে ফেলেছিলাম এমন তিনখানা জিনিস যা আজও আমার অন্তরে অ্যাংজাইটির ঠিক পাশেই পাকা জায়গা করে বসত করছে। প্রথমত, ভারত জিতে যাওয়ার বুবাইমামা উত্তেজনার আতিশায্যে উদ্বাহু হয়ে লাফিয়ে ওঠায় সকলে হাঁইহাঁই করে উঠেছিল ‘পাখা চলছে, পাখা চলছে!!!!’ পাখার মতো অমন একটা মিষ্টি জিনিসের যে হাত কেটে ফেলার গব্বুরে স্বভাব আছে সে কথা জেনে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম! দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের মতো বদমার্কা, ফালতু, আনগ্রেটফুল দেশ যে আর দুটো নেই সে কথা জেনে আশ্চর্য হয়ে উঠেছিলাম! তৃতীয়ত, সেইদিনই জীবনে প্রথমবারের জন্যে আমতেল ও সিঙ্গাড়া-ঘষা মুড়িমাখা খেয়ে আনন্দে আত্মহারা উঠে হয়েছিলাম। আতঙ্ক, আশ্চর্য এবং আনন্দ এই তিনটি ‘আ’ একাধারে অনুধাবন করেছিলাম বলেই পেশাদার তোতলা হিসেবে আমার এখনও বেশ নামডাক আছে।

ক্রিকেট শব্দটা শুনলে আমার মনে পড়ে ‘এমআরএফ’, ‘ক্যাস্ট্রল’, ‘ফেভিকুইক’ ইত্যাদি বিজ্ঞাপনের কথা। আমি মামাবাড়িতে মানুষ। দাদু ক্রিকেট বলতে অজ্ঞান। টেস্ট ক্রিকেট। টেস্টখেলার দিনগুলোয় একেবারে সকাল থেকে শুরু হত সাদাকালো টিভির ডিউটি। কী একঘেয়ে যে লাগত কী বলব! কিসুই হয় না! টুক, টাক, টুক, টাক। মাঝেমধ্যে কপাল ভাল থাকলে ‘আইগা’, ‘দাদি’, এসবও শোনা যেত কিন্তু সেও কালেভদ্রে! কারণ জেন্টলম্যান নাকি ওইরকমই হয়। বোরিং। সাপোর্টাররা অবশ্য সেরকম নয়। দাদাইয়ার মতো অমন একটা শান্ত, সৌম্যকান্তি ভদ্রলোকও একবার টেস্ট দেখার সময়, দিদান বেশ কয়েকবার শুক্তোর বড়িগুলো বেশি ভাজবে না কম জিজ্ঞাসা করায় তিনি ‘কাঁচা দাও, গিলে নিচ্ছি’ বলে উঠেছিলেন। তারপর অবশ্য দাদাইয়াকে হাইলাইটস দেখেই সন্তষ্ট হতে হয়েছিল। কারণ আমার দাদাইয়া যতটা জেন্টলম্যান, আমার দিদান ঠিক ততটাই আইপিএল।

আইপিএল মার্কেটে আসবার পর আমিও প্রথম প্রথম ফোমোতে খুবই গলা ফাটিয়েছিলেম। সবাই করছে, আমাকেও করতে হবে! অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ অনু্যায়ী পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে হাতে ‘করব লড়ব জিতব রে’ লেখা এবং সেই লেখা দেখে ইস্কুলে ধোলাই খাওয়াও হয়েছে। তবে বকুনি জুটেছিল বানানটা ভুল হয়েছিল বলে। আমার ক্রিকেট না-ভালবাসার পেছনে ও জিনিসের হাতও বেশ বড়সড়। না না বানানের নয়, বানান ভুলের পেছনের কারণটার। ডিজলেক্সিয়া। পরিষ্কার দেখছি বদল লিখলাম, কিন্তু খেলতে নামলেই সকলে আমাকে ল-টা, দ-এর আগে বলছে। যদিও পাড়ায় এক অত্যাশ্চর্য, দারুণ, অবাক করা প্রতিভা হিসেবে আমার বেশ নামডাক ছিল। কারণ ফিল্ডিং-এর সময়ে একটাও বল না ধরতে পারা, ব্যাট করতে গিয়ে আলোর গতিবেগে ফিরে আসা, প্রতি বলে চার ছয় খাওয়া, ইত্যাদি আমার কাছে ছিল জলভাত। শেষে উইকেটকিপারের পেছনেও দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু সেখানেও মিস করার ধারাবাহিকতা অব্যাহত। ফলে পাড়ার সমস্ত ধর্ম, গোত্র, শ্রেণি ও বর্ণের ছেলেরা যখন ক্রিকেটের জন্যে পাগলামো করত আমি তখন মনেপ্রাণে শীতকাল চাইতাম কারণ ভলিবল, গাদি, পিট্টু, র‍্যাকেট। ক্রিকেট, উঁহু দু-চোখের বিষ! নেহাত সৌরভ গাঙ্গুলি ছিল তাই, না হলে নাইন্টিজেই আমি ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় জানিয়ে শক্তিমানে মনোনিবেশ করতাম।

তারপর যা ক্রিকেট দেখেছি সে-সবই ওই মব-মেন্টালিটির ধারক ও বাহক হয়ে। ফলে তখনকার মতো একটা বিটকেল ভাললাগা কাজ করলেও ক্রিকেটের থেকে ইউএফসি আমার অনেক বেশি আপন।

কিন্তু বর্তমানে কাজ ও বন্ধুবান্ধব মিলে এমন কিছু মানুষ রোজনামচার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে গেছে যারা মোবাইলে ক্রিকেট চালিয়ে রাস্তা পার করে। ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করে। জ্ঞান দেয়। কেউ কেউ তো আবার বুম্বে যায় ক্রিকেটের কমেট্রি করতে। তবে এখন যা বয়স তাতে সবাই-করছে-তাই-আমাকেও-করতে-হবে-র জায়গায়াটা অ্যাংজাইটি নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কৌতূহল হয়। যে এরা দ্যাখেটা কী রে ভাই! সেই তো টুক, টাক, টুক, টাক! তাছাড়া এখন তো আবার না আইগা বলার লোক আছে, না দাদি ডাকার। সেই সব কৌতূহল নিবারণও হয়েছে বন্ধুরা থাকলে, আর থেকে খেলা দেখলে তবেই! একবার আইপিএল দেখবার সময় এক বন্ধুকে বলেছিলাম ‘ও আচ্ছা, ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে মাচা ফাংশনের ইংলিশ নাম আইপিএল?’ কথাটা শুনে প্রথমে এই মারে তো সেই মারে! তারপর ‘তুই তো আঁতেল! সবার যেটা ভাল লাগে তোকে তো সেটা খারাপ বলতেই হবে’ ইত্যাদি। শেষপাতে ক্রিকেট কীভাবে একটা গোটা দেশকে এক করে দিতে পারে, ইন্দিরা গান্ধি কেন দুরদর্শনে তিরাশির খেলা দেখিয়েছিলেন এসব বলে ক্ষান্ত হতেই যাচ্ছিল কিন্তু আমিও চেগে গিয়ে ‘খুব ভাল হয়েছে এবার খাবারটা বলে দে নাকি?’ বলায় ক্ষণিকের সম্পর্ক ত্যাগ করল। তবে পাঠক আপনি তো আর আমার মা নন তাই মিথ্যা বলব না, ওই খেলাগুলো দেখে যেটা আমি পেয়েছি সেটাকে ‘মস্তি’ ছাড়া আর কোনও শব্দ দিয়ে ঠিক ব্যাখ্যা করা যাবে না! যে মস্তিটা ডেভিড ধাওয়ানের সিনেমা দেখেও পাই। কিন্তু যাদের কথা বলে এই অংশের সূচনা হল, তাদের কথা শুনলে মনে হবে ক্রিকেট ছিল বলেই আজ তারা এরকম। অবাক কাণ্ড শাহরুখ খানের ব্যাপারেও তারা একই কথা বলে। তাহলে কোনটা সত্যি?

উত্তরটা হল ভালবাসাটা। নিখাদ ভালবাসাটা।

আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও শুরুর দিন থেকেও এদের সেই ভালবাসা জারি আছে। ভারতের প্রথম খেলা ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে। আমি জানতামও না। কিন্তু মোবাইল স্ক্রল করতে গিয়ে দেখলাম বাংলাদেশের ৩৫/৫, দেখে খুব কষ্ট হল ভারতীয় ব্যাটারদের জন্যে। আহা রে অ্যাদ্দূর গেছে ওরা একটু ব্যাট করবে না? তা সেই কষ্ট ভোলবার জন্যে মোবাইল স্ক্রল করতে গিয়ে দেখলাম বাংলাদেশের ১৮৯/৬! প্রথমে ভাবলাম ইলেকট্রল কিনে আনি। ডিহাইড্রেশন। চোখে ভুল দেখছি। ওমা তারপর দেখি না! ডিহাইড্রেশন হয়েছে বটে কিন্তু ভুল দেখছি না একেবারেই! কীভাবে এ জিনিস সম্ভব ভাবতে ভাবতে খেলাটা চালিয়ে দিলাম। যে ছেলে ওই অসাধ্য সাধন করেছে তার নাম হৃদয়। আক্সার পাটেলের ওপর সবিশেষ রাগও হচ্ছিল। পরে জানলাম ভদ্রলোক এর আগেই হ্যাটট্রিক করেছেন। এ কী হচ্ছে রে ভাই!! শেষমেশ গেল গেল গেল করতে করতে ২২৮ রানে বাংলাদেশ বান্ডিল হল। এই অল আউটকে যে বান্ডিল বলা হয় সেটাও আমার পাড়াতেই শেখা। আমি যে টিমে থাকতাম সেই টিমের বান্ডিলিকরণ অনিবার্য! তারপর ভারতের গোটা ব্যাটিংটাই কাজের ফাঁকে দেখলাম আর বিবিধ বন্ধুদের ‘শুভমন গিল কি সত্যিই ভাল প্লেয়ার?’, ‘বিরাট কোহলির কি অভিমান হয়েছে তাই ভাল খেলল না?’, ‘বাংলাদেশ কি ভালই খেলে আজকাল?’ ইত্যাদি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলাম আর এই সবকিছুর মধ্যেই শেষ ৬ উইকেট হাতে নিয়ে ভারত জিতে গেল। আর ঠিক তখনই আমার মনে হলো গোটা আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিটা জুড়ে অন্তত, ভারতের প্রতিটা ম্যাচ দেখব। বলা তো যায় না হয়তো আমিও রেসলম্যানিয়া ছেড়ে টেস্ট দেখতে বসে গেলাম। বাংলাদেশে ম্যাচটা নিয়ে যেমন বিশষ কিছু বলার নেই, সুন্দর সুন্দর মিম ছাড়া। ও ঠিক আছে, বাংলাদেশই তো। কিন্তু পরের ম্যাচটা আবার ডার্বি! পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা! আর পাকিস্তানকে যে আমাদের হারাতেই হত সেটুকু সানি দেওলের দিব্যি সবাই জানে।

পাকিস্তান ম্যাচের দিন খেলা দেখতে দেখতে শেষের দিকে আমাদের ইস্কুলের এক ছেলের কথা মনে পড়ছিল ভীষণ। বর্তমানে সে বিরাট একটা চাকরি করে। সে বিরাট মানে খুব্বিরাট। তো একবার ক্লাস ইলেভেনে পদার্থবিদ্যার স্যার এসে বলেছে আজ পদার্থবিদ্যার অঙ্কের সারপ্রাইজ টেস্ট হবে। এসব শুনলেই আমার গা পিত্তি জ্বলে যেত। একে অঙ্ক, তায় আবার ফিজিক্সের! কোনও মানেই নেই! তাছাড়া সারপ্রাইজ দিবি তো ছুটি দে, খাওয়াতে নিয়ে যা, নোটবন্দি কর, টেস্ট নেওয়ার কী আছে? কিন্তু সে ছেলে স্যারের মুখে ও কথা শুনে হাত মুঠো করে, যারপরনাই খুশি হয়ে বলেছিল ‘ইয়েস’! তারপর ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ায় দুঃখও পেয়েছিল যে আরও কটা অঙ্ক দিলে ভাল হত। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে ভারতের হয়েছিল ওই দশা! মনে হচ্ছিল ওরা আরও দু-চারটে রান বেশি করলে বিরাটের সেঞ্চুরিটা করতে এত অসুবিধে হত না! তবে বিরাট কোহলিকে নিয়ে চারপাশে এহেন মাতামাতির কারণটা সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। কমেন্ট্রিতে শুনছিলাম গোটা পৃথিবীতে হাতেগুণে তিনজনের আছে চোদ্দহাজার রান। তার মধ্যে বিরাট কোহলি একজন। তাও আবার নাকি ফাস্টেস্ট! একান্নটা ওয়ানডে সেঞ্চুরি, বিরাশিটা টোটাল। কিন্তু কী লাভ? পরে কোনও টুর্নামেন্টে খারাপ খেললেই তো বান্টি চার্জারে ফোন গুজে টাইপ করতে করতে প্রমাণ করে দেবে কোহলি আসলে ওভাররেটেড। তার ওপর কিছুর মধ্যে কিছু নেই আব্রার আহমেদ কেত মেরে শুভমান গিলকে গ্যালারি দেখাচ্ছে! আবারও আমার ছিয়ানব্বই সালের ওই দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। আহা গো ওই মুড়িমাখাটা ভাই! এতটা খেয়ে ফেলছিলাম যে বকুনি দিয়ে থামাতে হয়েছে। কিন্তু বিরাটকে থামানো গেল না, একদম বাউন্ডারি হাঁকিয়ে সেঞ্চুরি! সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেমিফাইনালে। আমেরিকান সিটকম বিগ ব্যাং থিওরির এক চরিত্র শেলডন কুপার একবার বলেছিল স্টার ওয়ার্সে যখন জেডাইরা এম্পায়ারকে হারিয়ে দেয় তখন তো আমরা বলি না যে আমরা জিতেছি, তাহলে খেলা দেখার সময় আমরা জিতেছি, আমরা হেরেছি এসব কেন করো? দ্যাখ ভাই শেলডন, সত্যিই জানি না। এই যেমন ধর বিরাট কোহলির টাকার তো কোনও হিসেব নেই। এদিকে আমি বাংলাবাজারে ‘রাইটার’ সেজেছি তাই আমার ইএমআই আছে। কিন্তু সেদিন যখন বিরাট সেঞ্চুরির দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়েছিল সেদিন আমার সত্যিই মনে হচ্ছিল যে ও জিতলে আমাদের জেতা হয়ে যাবে। মনোবিদদের ভাষা ব্যবহার করে এই বিষয়টা বেশ গুছিয়ে লেখা যায় নিশ্চয়ই কিন্তু কী দরকার? তার চাইতে মিম দেখলে কাজে দেবে ঢের বেশি। আর আমার দেখাটা সাজেও।

কারণ আমি সোশাল মিডিয়া সারা বছর মিলিয়ে বোধহয় দু-মাসমতো থাকি। কোনও কাজকর্ম বেরোলে সেটার নির্লজ্জ প্রচার করতে অথবা ক্রিকেট বা ফুটবল বিশ্বকাপের সময়গুলোতে। তাই এই সময়গুলোতে যতটা পারি ততটা কনটেন্ট শুষে নেওয়াই আমার কাজ। আসলে এই সময়গুলোতে অনেক কিছু জানা যায়, অনেক কিছু শেখা যায়। এই যেমন আইসিসি ট্রফি চলাকালীন জানলাম আসল খেলাটা হয় সোশাল মিডিয়াতেই। বাকিটা নিমিত্তমাত্র। আর এই খেলা হল নিজেকে মজারু প্রমাণ করার তাগিদের খেলা। একেকটা উত্তেজনা থরো থরো মুহূর্ত পেরোচ্ছে আর এক-একটা স্টেটাসে ঝলসে উঠছে কিবোর্ড। জানলাম অস্ট্রেলিয়া এবার আমাদের কাছে সেমিফাইনালে হেরেছে কারণ অতি অহঙ্কারই পতনের মূল কারণ। সেই যে বিশ্বকাপের ওপর পা তুলে ছবি দিয়েছিল! কাপ কারও পাপকে ছাড়ে না। কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম আমাদের দিককার লোক গিয়ে সেবার অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের বাপবাপান্ত করে এসেছিল, এমন সমস্ত কথা বলেছিল যে কথাগুলো বলা অপরাধের আওতায় পড়ে? যেগুলোকে হুমকি বলা চলে? তখন? আমাদের পাপ লাগেনি? কিন্তু এ-কথা জিজ্ঞাসা করবার আগেই দেখি কিছু বাংলাদেশি ভাই ভারতীয় ক্রিকেট দলকে কমিটির টিম বলে বসে আছে! ব্যস দেখামাত্রই মাথায় আগুন জ্বলে গেল। সঙ্গে শেলডনের প্রশ্নের উত্তরটাও ঝ্যাট করে পেয়ে গেলাম। আসলে আমরা সকলে ধর্মেন্দ্রর গলায় ‘জিঙ্গো’লালা হু গানটা শুনে বড় হয়েছি তো তাই নিজের পাড়ার ক্লাব হোক বা নিজের দেশের দল বেঁধে বেঁধে নিজেদের গলা আর অপরের পশ্চাদ্দেশ ফাটানো একেবারে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। কারণ আমরা এই দুটো জিনিস করবার জন্যেই প্রকাণ্ড প্রশংসিত হই, হয়েছি। এইসব নিয়ে লিখতে বসলে পাওয়ার প্লে নিয়ে লিখতে হয় তাই খেলায় ফিরি।

পাকিস্তানকে হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যাওয়ার পর নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে নিয়মরক্ষার খেলাটা দেখবার ইচ্ছে আর সুযোগ দুটোই হয়নি। ওতেও নাকি আমারই জিতেছি। তাই সরসরি চলে যাব নিউজিল্যান্ডের পাশের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। বরাবরের অপছন্দের দেশ। এত মাকড়সা পুষে রেখেছে যে মাকড়-সংক্রান্তি করলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তার ওপর আবার কুমির, সাপ, দামড়া সাইজের কাঁকড়া আর ২০০৩ সালেই সেই টিম! বাস রে! ক্লাস এইটে পড়ি বোধহয় তখন। মামাবাড়ির কোয়ার্টারে গালে গালে গণ-পতাকা আঁকাআঁকি চলছিল। তার ছাপ আমার দুই গালেও। বেশি হাসছি, কথাও বলছি না। যদি শুকোনোর পর পতাকা খুলে পড়ে যায় তখন? অস্ট্রেলীয় দল অবশ্যি সেই সুযোগটাও দেয়ওনি। শেহবাগ আউট হওয়ার পর পড়তে বসিয়েও দিয়েছিল বোধহয়। চাইল্ডট্রমা না হয় বাচ্চাটার এই খেলা দেখে। তার চেয়ে মেরে ধরে অন্য ঘরে বন্দি করে পড়তে বসিয়ে দি। ন্যাচারাল মধ্যবিত্ত বাবা-মা প্রোটোকল। তাছাড়া গেলবার ওই ওয়ান ডে বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন। বন্ধুদের আসর, বোতল বোতল আখের সরবত, ‘অ্যাই ওখান থেকে নড়িস না’ ইত্যাদি করেও শেষরক্ষা হয়নি। আমার খেলাটা বাদে বাকিগুলো নিয়ে উৎসাহ বেশি ছিল প্রথম প্রথম, কিন্তু আবারও সেই আমরা আমরা করতে গিয়ে হেরে যাওয়ার পর দস্তুরমতো মনখারাপ হল। তাই এইবার যখন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সেমিফাইনাল পড়ল তখন স্বভাবতই চিন্তায় পড়ারই কথা। শুরুও হয়েছিল সেভাবেই কিন্তু আবারও কোহলি। আবারও। সঙ্গে অবশ্যই হার্দিক পান্ডিয়া। কলকাতার প্রাচীন মাস্তানদের নিয়ে নানান গল্প কাম মিথ শুনতে পেতাম ছোটবেলায়। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গাড়ির চাকা আটকে গেছে কাদায়। মাস্তান গাড়ি থেকে নেমে, গাড়ি চাগিয়ে সেই চাকা তুলে দিল কাদা থেকে। হার্দিকের খেলায় সেইদিন ছিল সেই এক মাস্তানি। অবশ্য এই কদিনে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে যেভাবে দেখলাম ওই টাউটারিটা গোটা দলেই আছে। এক গজ যায়গা ছাড়ব না। স্লেজের বদলা স্লেজ। আউটের বদলা মার। বাউন্ডারি পার। ও জিনিসটাও বোধহয় দাদারই আমদামি করা যেটার লেগাসি রোহিত শর্মা এখনও কলার তুলে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

আহা রে রোহিত শর্মা!! আহা রে!

দলের ক্যাপ্টেন। আইসিসি ট্রফির ফাইনালে ওপেন করছে। কয়েকশো কোটি মানুষ তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রতিপক্ষ বেশ কঠিন। এই অবস্থায় কী করল, ক্যাজুয়ালি পেটাতে শুরু করল। ধাড়াদ্ধাড় মার! রোহিত ও জিনিস না করলে শেষের দিকে পান্ডিয়া বা রাহুল হাত চালিয়ে খেলার সুযোগ পেত না। এই আমার মতো যারা ক্রিকেটেও ক-ও বোঝে না, খ-নিয়ে ইন্টারেস্ট নেই, আর গ-এ গৌতম গম্ভীর যে ভারতের কোচ হয়েছে সেটা জানে কারণ মিম দেখেছে, তাদেরও ভাল লাগতে বাধ্য। ঠিক যে কারণে সিনেমা ভাল লাগে আপামর জনতার সেই একই কারণে। সিনেমায় ভালরা ভিলেন ক্যালায় আর এখানে ব্যাটাররা বোলারদের। আর আমাদের শামি, চক্রবর্তীমশাই, (শিলাদিত্য স্টাইলেই বললাম) জাদেজা, কুলদীপ যাদবরা করে উলটোটা। এক বন্ধু বলল বুমরার স্পেলগুলো দেখ! বুঝবি এক নম্বর বোলার কেন। তিনি আবার চোটের জন্যে খেলতেও পারেননি। তাতেই এই! সিনেমাতে তো তবু জানি গোটাটা নকল কিন্তু এখানে সত্যি সত্যিই ম্যাচশেষে হাতে ট্রফি ওঠে। রোহিত, বিরাট উইকেট হাতে নাচে জিতে যাওয়ার পর। পাড়ায় পাড়ায় লোক নেমে আসে রাস্তায়। এই যে এত উন্মাদনা, এত মাতামাতি, এত হইহুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে আসলে জিতে যায় মানুষ। খুচরো নেই বলে যে নিরীহ মানুষটাকে অপমান করেছে অটোওয়ালা, ন্যায্য ভাড়া চাওয়ায় যে রিকশাচালককে অপদস্থ করেছে বড়বাবু, যে মানুষটার কাজ নেই বলে চারপাশে ধার, যে লোকটাকে উঠতে বসতে কথা শোনায় বস, যে মানুষটার মাইনে হয়নি এ মাসে, যে মানুষটার কোনও বন্ধু নেই, যে মানুষটা বিয়ে হচ্ছে না বলে সারাদিন খোঁটা খায় বাড়িতে, যে মানুষটা কোনও অসুখে পড়ে আছে বহুদিন, যে মানুষটা মেনে নিয়েছে নিজের হার, যে মানুষটার পেছনে পাড়ার সবাই লাগে অকারণেই… তেমন আরও হাজার হাজর মানুষ জিতে যায় কারণ ভারত জিতে গেছে। আমরা জিতে গেছি। হ্যাঁ চাইলেই এ সবকটার বিপরীত স্পেকট্রামটা নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। অনেক কাটাছেঁড়া করা যায়। সে সব তো হতেই থাকবে। চলতেই থাকবে। কারণ বাস্তব অনস্বীকার্যভাবে খুব আলোকোজ্জ্বল নয়।

তবুও গুচ্ছের অন্ধকারের মধ্যে মাঝেমধ্যে নয় একটু ভাল কথা হোক না। ক্ষতি কী? আর এটুকু তো তারাও জানে আমারই মতো যারা ক্রিকেট ভালবাসে না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...