
অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
সকালটা আজকাল বমির উদ্রেক করে। মাসখানেক আগেও করত না।
যে দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর জন্য চাতকের মতো উৎসুক হয়ে থাকতাম এতদিন, সেই খবরের কাগজের প্রথম পাতা দেখতে ভয় হয়। কাগজও আসার আগে ঘুম ভাঙায় খবরের অ্যাপের নোটিফিকেশন। দিন শুরু হওয়ার আগেই মৃত্যু আসে নয়া রূপে। পালিয়ে যেতে চাই সেই পাতা থেকে। মুখে তখনও টুথপেস্টের গন্ধ। বিজ্ঞাপনের ভাষায় ফ্রেশ সকাল। দ্রুত উল্টে ফেলি। প্রথম পাতায় যে খবর দেখে চোখ সরিয়ে নিতে চেয়েছি, পড়ামাত্র অসুস্থ বোধ করেছি, ভিতরের পাতাগুলো জুড়ে থাকে সেই খবরেরই বিস্তারিত রূপ। কোথায় পালাব আমি? বিরক্ত হয়ে মোবাইলের কাছে ফিরে যাই ফের। স্ক্রিনের উপর থেকে যে নোটিফিকেশনগুলো ঝুলে থাকে, সেগুলোর মধ্যেও তো জড়িয়ে আছে মৃত্যু। মৃত্যু সরাতে সরাতে আঙুল ব্যথা করে। সরিয়ে দেওয়ার সামান্য সময়ে নতুন মৃত্যু স্ক্রিনের উপর থেকে ঝরে পড়ে ফের। আমার বমি পায়। অফিস যাওয়ার তাড়া থাকে। খাবার সাজিয়ে রাখা থাকে টেবিলে। আমি তাকিয়ে থাকি চুপচাপ। যন্ত্রের মতো চিবোই। প্রিয়জনেরা শরীরের খোঁজ নেন। “মুখে কি একেবারেই রুচি নেই?” আমি চুপ করে থাকি। হুডমুড়িয়ে বেরিয়ে যাই কিছু ভাল লাগে না বলে।
হচ্ছেটা কী চারদিকে? সেদিন মেট্রোতে একজনকে বলতে শুলনাম, “শহর জুড়ে যেন মরার মরসুম।” তাঁর শুকিয়ে যাওয়া, বিষণ্ণ শরীর থেকেও ছড়িয়ে পড়ছিল অসুস্থতা, ভাল না-থাকা। অন্য একজন বিড়বিড় করে বললেন, “বাঁচতে ভয় হয়। মনে হয় ঝপ করে শেষ করে দিই নিজেকে। এই লোকগুলো পারলে আমি পারব না কেন?” ওঁর হাতে ছিল সেদিনের খবরের কাগজ। চারদিকে যা ঘটছে তা নিয়ে যাঁরা মোটামুটি ওয়াকিবহাল আছেন, তাঁরা জানেন, গত দু-তিন সপ্তাহের প্রায় প্রতিটি দিন আমাদের মৃত্যুর গল্প শোনাচ্ছে, মৃত্যুকে নিয়ে কাঁটাছেড়া করছে, নানা বর্ণে, নানা রূপে। কেউ হত্যা করছেন। কেউ আত্মহত্যা করছেন। একা। সপিরবারে। কেউ হত্যা করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকে আত্মহত্যা না-করতে পারার যন্ত্রণায় অন্যকে হত্যা করেছেন। এগুলো দুই বিরুদ্ধ দলের মধ্যে খুনোখুনি নয়। এই হত্যা এবং আত্মহননের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছেন প্রিয়জন। রক্তের সম্পর্ক। একটি গোটা সংসার, পরিবার তলিয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে। নিজে শেষ হয়ে যাওয়ার সময় চারপাশের মানুষদের কথা ভাবছেন না অনেকে। অন্যদিকে, জড়িয়ে থাকা মানুষদের কথা ভেবে, তাঁদেরই স্বার্থে পুরো পরিবারকে শেষ করে দিচ্ছেন আমাদেরই কিছু সহনাগরিক। এর শেষ কোথায় জানি না। এই দুঃসময়ে মৃত্যুমিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ঘটে যাওয়া হত্যা এবং আত্মহননের খতিয়ান দেওয়া যাক। জানি, এটা আংশিক। জানি, যতটুকু খবরে পড়েছি, তারও বাইরে থাকে অনেক না-হওয়া খবর। মানুষের মনের মধ্যে নিহিত ইচ্ছের কথা কজনই বা জানে? বাড়ির তিনজনকে চিরতরে শেষ করে দিয়ে, রাতের অন্ধকারে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে, পিলারে ধাক্কা মেরে নিজেদের জীবনে দাঁড়ি টানার জন্য রওয়ানা দিয়েছিলেন দু-ভাই। শুনেছি, ঋণের ভারে জর্জরিত ছিলেন তাঁরা। দশ মিনিটে ডেলিভারির মতো হয়তো মৃত্যু চেয়েছিলেন। সফল হননি। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরেও এক ভাইয়ের মুখ থেকে ক্রমাগত বেরিয়ে আসছে আর বাঁচতে না-চাওয়ার ইচ্ছের কথা। মানুষের মুখে মুখে ঘটছে ঘটনার পুনর্নিমাণ। বাড়ির দুই মহিলার শিরা কেটে মুখে বালিশ চাপা হয়েছিল নাকি বালিশ চাপা দেওয়ার পরে শিরা কাটা হয়েছিল, অভিযুক্তের কোন বয়ান সত্যি, কতটা সত্যি, তা নিয়ে তৈরি হচ্ছে খবরের কাগজের নিত্যদিনের হেডলাইন। তৈরি হচ্ছে তাকে কেন্দ্র করে শহরজোড়া ফিসফিস। ক্রমাগত জেরার ফলে এক ভাই নাকি দাবি করেছেন, মেয়ের মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলার সময় তাঁর স্ত্রী মেয়ের পা চেপে ধরেছিলেন সজোরে। মেয়ে শেষ হল। এবারে স্ত্রী নিজেই হাতের শিরা কেটে ফেললেন। মরণ এল না। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন স্বামী। স্ত্রীয়ের গলা কেটে দিলেন। কেটে দিলেন হাত। রক্তের সঙ্গে মিশল আরও রক্ত। একই পদ্ধতিতে খুন হলেন বৌদিও। বিশেষভাবে সক্ষম মেয়ের আগামী দিনের কথা ভেবে নিজেই ভবিষ্যৎ লিখে দিলেন পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া এক বাবা। একই দড়ির দুদিকে ঝুলছিলেন বাবা ও মেয়ে। তাঁদের অবর্তমানে মেয়েটির কি হবে তা নিয়ে হয়তো তাঁর কেটেছিল অজস্র বিনিদ্র রাত। জীবন জাপ্টে যে সমস্যা জড়িয়েছিল তাঁর, তার কোনও সুরাহা পাননি তিনি। বছর পাঁচেকের একরত্তি মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে নিজেও বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হলেন এক মা। শহরের অন্য প্রান্তে আড়াই বছরের পুত্রসন্তানকে হত্যা করে আত্মহননের পথে হাঁটলেন এক দম্পতি।
কিছু কিছু জ্ঞানার্জন গা গুলিয়ে দেয়। একটি কথা প্রথমবারের জন্য শুনলাম জীবনে। কপিক্যাট সুইসাইড। একটি আত্মহত্যার ঘটনা যদি বৃহত্তর সমাজে অন্য কাউকে একইরকমভাবে জীবন শেষ করে দিতে ইন্ধন জোগায় তা হলে দ্বিতীয় আত্মহত্যার ঘটনাটিকে কপিক্যাট সুইসাইড বলা যেতে পারে। আরও সোজা করে বলা যায়, অন্য কারও মারা যাওয়ার ঘটনা শুনে কিংবা পড়ে নিজেও নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা। খুব কম সময়ে পরপর এমন ঘটনা ঘটতে দেখে বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের মুখ দিয়ে ক্রমাগত বেরিয়ে আসছে এই শব্দদুটি। কে কার ঘটনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজে এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা এ প্রসঙ্গে অবান্তর। সবার প্রথমে আলোড়ন তুলেছিল যে ঘটনাটি, তাঁরাই বা কী দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন? জানি না। জানার চেষ্টা করতে ইচ্ছে করে না। তবে অনেকের মতোই আমারও তুমুল রাগ ও অভিমান হয় দিনের পর দিন এমন ঘটনার ধারাবিবরণী পড়তে। একটি জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্রের অন্দরমহলের এক সিদ্ধান্তের কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের ফল বেরোনোর পরেই রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে উঠে আসত পরীক্ষায় বিফল হয়ে কিংবা আশানুরূপ ফল করতে না পেরে ছাত্রছাত্রীদের জীবন শেষ করে দেওয়ার ঘটনা। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এমন আত্মহত্যার ঘটনা তাঁরা প্রকাশ করবেন না। কারণ, এটি অন্যদের প্ররোচিত করতে পারে। একই সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল আরও একটি সিদ্ধান্ত। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের সেরা ছাত্রছাত্রীদের খবর এবং সাফল্যের নেপথ্যকাহিনি ফলাও করে ছাপার বিষয়টি তাঁরা বন্ধ করেছিলেন। বুঝেছিলেন, ব্যর্থ হওয়া, মন খারাপ করা পড়ুয়া এবং তাঁদের বাড়ির লোকদের এই প্রবল সাফল্যের কাহিনি পড়তে ভাল লাগবে না। তা অনেক সময় ছাত্রছাত্রীদের হঠকারী সিদ্ধান্তের মুখে ঠেলে দিতে পারে। এর ফলে সমাজ কতটা বদলেছিল জানি না। এমন জটিল সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষা করা সহজ নয়। সমাজের ভালমন্দ নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁরা ইদানীং বারবার বলছেন মৃত্যুর এমন ধারাবিবরণী বন্ধ করার কথা। যে মানুষগুলি চলে গেলেন, তাঁরা কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে মৃত্যুকে আঁকড়ে ধরলেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। এমন সংবাদ আর্ত পরিবারগুলির কাছে কোনও ‘গুড সামারিটান’ পাঠায় না। দিনের শেষে যা তৈরি করে, তা হল অহেতুক গুজব। যে মানুষদের কাছে জীবনের সংগ্রাম প্রবলভাবে হার মেনে যায় জীবন উদযাপনের কাছে, বেঁচে থাকাটা যাঁদের কাছে যুদ্ধসম, তাঁদের জন্য এমন খবর আলকাতরা মাখা ক্যাটালিস্টের কাজ করে। কালকের মুখোমুখি হতে চান না যাঁরা, প্রতিদিন রাতে শুয়ে এক অনন্ত ঘুমের জন্য কাতর প্রার্থনা করেন যাঁরা, সকালবেলার সংবাদপত্রের পাতাজোড়া হত্যা-আত্মহত্যার খুঁটিনাটি খবর, মৃত্যুবরণের উপকরণের সুলুকসন্ধানের প্রতিবেদন তাঁদের বাঁচার ইচ্ছে আরও কমিয়ে দেয়, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। খুব ভাল থাকা মানুষরা এ নিয়ে চর্চার পর চর্চা করতে পারেন অফিসের কফিমেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে। চর্চা করতে পারেন বাড়ি ফেরার সময় পাড়ার মোড়ের চা-বিস্কুট-চাট-মদের সান্ধ্য ঠেকে। অনেকের উইকেন্ড আড্ডায় এটাই হয়তো হট টপিক আজকাল। কিন্তু মন ভাল না রাখতে না পারা মানুষরা এমন সংবাদে দমে যান। হ্যামলিনের বাঁশির মতো তাঁদের ডাক দেয় মরণ।
এই খবরগুলোর সঙ্গে লেপ্টে থাকা, কালচে লাল রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার পরে, যা পড়ে থাকে তা হল নিঃসঙ্গতা। ফনা তুলে ছোবল মারে একাকিত্ব। মনে হয়, কয়েকশো কোটির এই তুমুল ব্যস্ত দুনিয়ায় আমার সঙ্গে কথা বলার কোনও লোকই নেই। আমার মতোই ভেবেছিল অন্য কেউ, অন্য কোনও দিন। আসলে কারও সঙ্গেই কেউ কথা বলে না আর। অন্যের খোঁজ নিতে গেলে দু-দণ্ড থামতে হয়। আর থামলেই পিছিয়ে পড়তে হয়। সমাজ আমাদের পিঠে চাবুক মারে প্রতিদিন। থামতে দেয় না।
আর কয়েকজন লোক পুরোপুরি থেমে যান। আমরা ধারাবিবরণী শুনি। আর মাত্র কয়েকদিন। হয়তো লিফলেটের মতো বিলি হবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।
আমার লেখা শেষ, আপনারও পড়া। চলুন, দৌড় শুরু করি ফের।
পিইইপ।