
সাধন দাস
মাঘ মাস। রাত এগারোটা। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছি পূর্বপাড়ায়, আমার শ্বশুরবাড়ি। লোকে লোকারণ্য। যত দূর থেকেই আসি না কেন, এত মানুষ মাত্র দুজনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। ঠান্ডায় কাঁপছে। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে এল। চার বছরের নাতি তার নতুন দাদাইকে খেলনা পিস্তল উঁচিয়ে বলেছিল— দাদাই, তুমি মরে গেলে বুলেট হবে, যে তোমাকে মারবে এই পিস্তল দিয়ে তাকে ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা মেরে দেব। দুঃখে শোকে মাথা নিচু করে বাড়ি ঢুকলাম। উঠোনে শোয়ানো নাতির নতুন দাদাই, আমার ছোট শ্যালক রণ, রণজিৎ বৈরাগী। মারা গেছে। ভুল বললাম। আমার চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট, এই বয়সে স্বাভাবিকভাবে কেউ মারা যেতে পারে না। আমার নাতির কথাই ঠিক, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
ফুল-চন্দনে ঢাকা মৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। এই সেই রণ, প্রাইভেট পড়তে এসেছিল আমার কাছে, ক্লাস ওয়ানে। সূর্যোদয়ে গোলাপি আভার মতো ফুটফুটে বালক। হাসলেই ফোকলা দাঁতের ফাঁক গলিয়ে কথা হাসি সরলতা গড়িয়ে পড়তো। ফুলের মতো মুখখানায় চোখদুটো ছিল ডাগর। সকালে আলোর মতো ঝকঝকে উজ্জ্বল। মণি দুটো গভীর কালো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালেই মনে হতো স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে আছে। চারপাশের পথঘাট গাছপালা মানুষজন আপন করে নিচ্ছে। মা, বাবু পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছিলেন তার স্বপ্নে। রুটিন মাফিক ভোরে ঘুম থেকে ডেকে দিতেন। বাসি বিছানায় বসে হাত জোড় করে দিদি দাদার সাথে তাকেও শপথ নিতে হতো, সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেনো ভালো হয়ে চলি। এভাবেই শুরু হতো তার দিন। শুরু হয় শৈশব। আমি গৃহ শিক্ষক। শৈশবের সেই স্বপ্নকে রঙীন করার রঙ তুলি মাত্র এগিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
বাবুর ছিল যশোর রোডের ধারে রেডিমেড কাপড়ের ছোট্ট দোকান, বালকটির স্বপ্নের ভরণপোষণ। রাষ্ট্রের উন্নতিকল্পে রাস্তা চওড়া হলো। রাস্তা চওড়া হতেই পারে। কিন্তু উন্নতির অত্যাচারে ভাঙা পড়ে গেল দোকানখানা। এক লহমায় বালকের স্বপ্ন গুটিয়ে বাবুর সাইকেলের পিছনে কাপড়ের পুটুলি হয়ে গেল। শুরু হলো দাঁতে দাঁত চেপে বেঁচে থাকার লড়াই। অন্যদিকে রাস্তা রাজপথ হলো। লম্বা চওড়া ব্রিজ হলো নদীর উপরে। বড়ো বড়ো মাল ভর্তি ষোলো চাকা, আঠারো চাকার লরি ভর্তি মাল, মাইলের পর মাইল লম্বা সারি দিয়ে যাত্রা শুরু করলো বাংলাদেশে। দেশের সে উন্নতির হৈ হৈ হিসেব পাওয়া গেল দেশ বিদেশের কাগজে, টিভিতে। আড়ালে হারিয়ে গেল একটা সংসার আর বালকটির স্বপ্নের ডুবন্ত আর্তনাদ।
রাষ্ট্রের উন্নতির বিনিময়ে স্বপ্নময় বালকটি বাবার সাথে ফুটপাথে পেঁপে, নারকেল বিক্রি করতে বসে পড়লো। পেট ভরা ভাত, মাঠ ভরা খেলা, ঘুমের নরম বিছানা হারিয়ে আমানির সাথে পান্তাভাত খেয়ে অথবা না খেয়ে ছেলেটি বড়ো হতে থাকলো। দোকানে দোকানে নাইলনের ব্যাগ, ফেরি করতে করতে স্কুল পার হয়ে সে কলেজ পাশ করে ফেললো। হয়ে উঠল শিক্ষিত পরিপূর্ণ নাগরিক। কড়া ইস্ত্রি করা সাদা প্যান্ট, ইন করা ডিপ রঙের জামা, সাদা জুতো পরে টানটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। স্পোর্টসম্যান হতে ছেয়েছিল। খেলার দাপটে মাঠে জয় ছিনিয়ে আনতো। মাথা উঁচু করে চাকরি চেয়ে দাঁড়িয়ে গেল রাষ্ট্রের সামনে। কোথায় চাকরি? সরকার চাকরি দিলো না। অত্যাচারের পর শুরু হলো রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা। দোকানে দোকানে মশারি, নাইলনের ঝোলা… সাইকেলে ঝুলিয়ে সেলসম্যানগিরি করতে করতে স্বপ্ন দেখছিল একটা নিশ্চিত কাজের। কোথায় কাজ? সে এমন রাষ্ট্রের নাগরিক, যে চাকরি দিতে পারে না, কাজ দিতে পারে না। রাষ্ট্রের কাছ থেকে একের পর এক পাওনা হচ্ছিলো তামাশা, হতাশা। সঙ্গে তৈরি হচ্ছিলো- চাকরির পরীক্ষায় একের পর এক ডাক পাওয়া আর খালি হাতে ফিরে আসা বেকার বন্ধুর হতাশ দল। সন্ধ্যে হলেই বসতো তাদের হতাশার সম্মিলন। অস্থির দিশেহারা যুবকেরা কতোদিন তামাশা সহ্য করে! একে একে সততা, আদর্শ হারিয়ে স্বপ্নচ্যুত হয়ে ঢুকে পড়ছিল দুঃস্বপ্নের জগতে। এ যেনো সাজানো ছকের ঘুঁটি। বেকারত্বের হতাশার পাশাপাশি সরকারি মদতে ছড়ানো অজস্র ফাঁদ। পুজো, নামাজ, মানত, লটা্রি, মদ, জুয়ো অজস্র নেশার ফাঁদ। দুঃস্বপ্নের হতাশায় বন্ধুদের ফাঁদে পড়তে দেরি হলো না। সংসারের, দেশের সম্পদ হয়ে ওঠতে পারে যে যুবকেরা- একে একে মাথা হেঁট করে ঢুকে পড়ছিল মদ, জুয়ার ঠেকে। পেটের তাগিদে, নেশার ঘোরে হয়ে উঠছিল অসামাজিক ঠগ, জোচ্চোর, গুণ্ডা, বদমাস, খুনে, সমাজের শত্রু।
রণ হতে পারছিল না। সততা, ন্যায় নীতির আদর্শ বড্ড শক্ত ভিতের উপর গড়া ছিল তার। আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রায় একা লড়ে যাচ্ছিলো। কখনও দিল্লি থেকে মোটরবাইক এনে বিক্রি করে, কখনো কচ্ছপ আমদানির ব্যবসা, কখনও সাইকেল রাখার পাহারাদার, কখনও ইস্ত্রিওয়ালা… বেঁচে থাকার একটা কিছু সৎ অবলম্বন খুঁজতে খুঁজতে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিল। বড়ো পুঁজি ছোট পুঁজিকে খেয়ে ফেলে। অসৎ পুঁজির সাথে সৎ পুঁজির লড়াই। দাঁড়ানো অতো সহজ নয়। তখন সুদে টাকা খাটাবার ব্যবসায় নেমেছে। খরিদ্দারগুলো গরিবগুর্বো সব্জিওলা, ফেরিওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, না খেতে পাওয়া মদোমাতালের দল। এমনও হয়েছে, সক্কালবেলা বেরিয়েছে টাকা আদায় করতে- খাতকদেরই খাওয়া জোটে না। তো পাওনাদার কী করে? টাকা আদায় না করে, হাভেতের ঘরে চাল কিনে দিয়ে সেখানেই এক মুঠো খেয়ে খালি হাতে ফিরে আসে। টাকা ফেরৎ পাওয়ার চেয়ে খাতকের ঘরে হাঁড়ি না চড়লে ওর কষ্ট বেশি হতো। আদর্শের সাথে বেঁচে থাকার, বেঁচে থাকার সাথে আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার সে এক প্রাণপণ লড়াই। বাবু মায়ের স্বপ্ন দেখানো রণজিৎ শিক্ষার জোরে গড়ে উঠেছিল স্বপ্নময় হয়ে। লড়াই চালিয়েছিল দীর্ঘদিন। হতাশার দলে ভিড়েও স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন হতে দেয়নি। আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে পারেনি। কিন্তু স্বপ্ন ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। বন্ধুরা তখন সরকারি মনস্কামনা পূর্ণ করে নেশার ফাঁদে পড়েছে। হয়ে উঠেছে পাকা নেশারু। শিকারির হাতি দিয়ে হাতি ধরার মতো। তারাই সরকারি ছকের জীবন্ত ঘুঁটি হয়ে রণকে প্রভাবিত করে চলেছে। চারদিক থেকে হতাশ নিরুপায় রণ নেশাকে আশ্রয় করতে বাধ্য হলো। পূর্ণ হলো রাষ্ট্রের মনস্কামনা। নেশাগ্রস্ত রণ আর চাকরি চাইবে না। কাজ চাইবে না। প্রতিকার চেয়ে আন্দোলনের পথে হাঁটবে না। মদ খেয়ে রাস্তায় মাতলামি করবে। সংসারে অশান্তি করবে। সরকার আর একজন যুবকের হাত থেকে রেহাই পেলো।
রণ তবু মদের নেশার ভিতরেও আদর্শকে আঁকড়ে রাখতে চাইল। বাবু মায়ের দেওয়া নাম ‘রণজিৎ’। হেরে যাওয়া তাকে মানায় না। মানুষটির অস্তিত্ব দুটো সত্ত্বায় ভাগ হয়ে গেল। একজন হেরে যাওয়া নেশাগ্রস্থ রণজিৎ। আর একজন আদর্শ আঁকড়ে ধরা অপরাজিত রণজিৎ। সন্ধ্যে হলে নেশায় নেশা মিলে গেলে নেশাগ্রস্ত রণজিতের চারপাশে ঘিরে থাকতো দুঃস্বপ্নের গহ্বরে পড়া বন্ধু বান্ধব, সব্জিওলা, রিক্সাওলারা। আপাত দৃষ্টিতে সবাই অসামাজিক, মদোমাতাল। কিন্তু মাতলামির নিচে জেগে থাকে এক অন্যায়বোধ, সুস্থ স্বাভাবিক, মানবিক হয়ে ওঠার আকুল প্রবণতা। সহজাত সামাজিকতায় সবাই মানবিক হয়ে উঠতে চায়। নেশাগ্রস্ত রণর ভিতরে জেগে থাকা অপরাজেয় রণর আদর্শের সিক্ত ভালোবাসার বাঁধনে জেগে উঠতো তাদের মানবিক হৃদয়। সেই টানে সবাই হয়ে উঠতো তার বন্ধু, ভাই। রণজিৎ হয়ে উঠল, সাহাপাড়া, স্টেশনপাড়ার দাদা। ওখানকার ক্লাবের সেক্রেটারি। আপদে বিপদে দল বেঁধে রণজিৎ সবার পাশে। গরিব রণ ছিল অপূর্ব দরদী হৃদয়ের মালিক। কেউ বিপদে পড়েছে। হাতের আংটি খুলে দিয়েছে নির্দ্বিধায়, খাটের অভাবে কোনো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, ঘরের খাট তুলে নিয়ে দিয়ে এসেছে বিয়ের আসরে।
এই সেদিনের কথা, রণজিৎ মারা গেছে। তখনও শ্রাদ্ধ হয়নি। সাহাপাড়ার রাস্তায় এক মেয়ে আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। মনে পড়ে গেছে তার রণর কথা। চোখ ছলছল। দাঁড়িয়ে গেলাম। বললো- দাদা, কেন যে ছাইপাঁশ খেতো? সোনার মতো দামি জীবনটা হারিয়ে ফেললো। আর আমাদের মতো অনাথদেরই ক্ষতি হলো। জানেন, রণদা আমার বিয়ে দিয়েছিল। কপালে হাত দিয়ে বললো এই সিঁদুর রণদার জন্যেই আজ সিঁথিতে পরে আছি।
মেয়েটার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। ফুঁপিয়ে উঠল। বললাম- কেঁদো না। ধনী মদ খায় শখে, ফুর্তিতে। গরিব মদ খায় জ্বালায়। সরকারের অত্যাচারে, বঞ্চনায়, ফাঁদে পড়ে।
চাকরি পেয়ে চলে যাওয়ার আগে আমার এগিয়ে দেওয়া রঙ তুলিতে হয়তো স্বপ্নের বীজ রঙীন হয়ে উঠেছিল- শিবু, ঋষে, রণ, রূপাদের মধ্যে। ট্রান্সফার নিয়ে ফিরে এসেছিলাম স্বপ্নের পরিপূরক এক আদর্শের বাস্তবতা নিয়ে। সেই আদর্শের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠল রণর বাড়ি। সেইখানে যোগ দিলো সেই আদর্শের জীবন্ত বাস্তব প্রতিনিধি তমোনাশ। গড়ে উঠল ‘মুক্তধারা শিল্পীগোষ্ঠী’। রণর আদর্শ মাটি পেল।
রণজিৎ নিজের নামকে বড় ভালবাসত। ভুল করেও নিজের নাম ভুল লিখতো না। কেউ ভুল লিখলে সহ্য করত না। সেই নামের অর্ধেক পড়ে আছে সরকারি নেশার ফাঁদে। গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠল রণজিৎ মানে রণজিৎ। কেঁপে উঠল রাষ্ট্রের ধূর্ত ফাঁদ। শিল্পগোষ্টীর ক্রমচর্চায় ফাঁদ ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো সে। নেশাগ্রস্ত পরাজিত রণজিৎকে উদ্ধার করে নিল অপরাজেয় রণজিৎ। মদ খাওয়া ছেড়ে দিলো। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ফাঁদে পড়া মদের দেওয়া মারণ রোগ তখন ওর শরীরে শিকড় গেঁড়ে বসেছে। বেঁচে থাকার খুব ইচ্ছা ছিল মানুষটার। ছ’টা কেমো নেওয়া হয়ে গেছে। কিছুই খেতে পারছে না। ওজন কমে বিয়াল্লিশ কেজি। শরীর শুকিয়ে বাচ্চাছেলের মতো। আর জি কর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এসইউসিআই-সি দলের একক ডাকে বৃহত্তম জনমিছিলের ভিডিও দেখে ওর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পারলে উঠে বসে। বললো- জামাইবাবু, আমার ডাক্তার দেখানোর পরের ডেট কবে?
সারা জীবন মানুষটা বাঁচতে চেয়েছে। বাঁচতে চাইছে। কিন্তু কিছু বলার ছিল না। জানতাম, কী হতে চলেছে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মিথ্যে বলেছিলাম- ডাক্তারবাবু এখনও ডেট দেয়নি। বলতে পারিনি, ডাক্তারবাবু আর ডেট দেবে না। যন্ত্রণা উপশমের কোনো ওষুধই আর কাজ করছিল না। ঘুমের শক্তিশালী ওষুধও অকার্যকর হয়ে উঠেছে। সারারাত আধোঘুম আধোস্বপ্নের মধ্যে যন্ত্রণায় ছটফট করত। স্বাধীনতার পরে একক দলের ডাকা সর্ববৃহৎ মিছিল বাস্তবে এগিয়ে চলেছে আদর্শময় ভারতবর্ষের দিকে- স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে যন্ত্রণা ভুলে থাকার চেষ্টা করত।
২০২৫, ৩ ফেব্রুয়ারির ভোরে কর্কট রোগের শেষ আক্রমণে ফাঁদ-জয়ী রণজিৎ বৈরাগী সরকারি কৌশলে খুন হয়ে গেল। এবারের মতো রাষ্ট্র জিতে গেল। হ্যাঁ, এ দেশে সরকারি কৌশলে একটা কেন, দুটো তিনটে, চারটে, হয়তো হাজার রণজিৎ মরবে, কিন্তু আদর্শ মরবে না। মরে না। প্রতি মুহূর্তে বাস্তবায়িত হতে হতে বেঁচে থাকে। রয়ে গেল রণজিতের সাধের মুক্তধারা শিল্পীগোষ্টী। তাঁর আদর্শ বেঁচে থাকবে তারই জারি করা যুদ্ধের মধ্যে। মুক্তধারা শিল্পীগোষ্ঠীর কার্যক্রমের মধ্যে…